- 09 February, 2021
- 0 Comment(s)
- 1286 view(s)
- লিখেছেন : সোহিনী রায়
ভারতে পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়, যেমন বিয়ে, দত্তক নেওয়া, সম্পত্তির ভাগাভাগি ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রতিটি ধর্মের আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত আইন রয়েছে। যেমন হিন্দু ব্যক্তিগত আইন, মুসলিম ব্যক্তিগত আইন, খৃষ্টান ব্যক্তিগত আইন ইত্যাদি। এগুলো একেকটি একেক সময় তৈরি হলেও সবকটাই বৃটিশ আমলে হয়েছিল। পরে এই আইনগুলোই চালু থাকে, সামান্য কিছু বদলসহ। এর মধ্যে এখন যে হিন্দু ব্যক্তিগত আইন প্রাসঙ্গিক তা মূলত ১৯৫৫-৫৬ সালের মধ্যে তৈরি হয়েছে।
হিন্দু বিয়ে সংক্রান্ত আইন, সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন, নাবালক ও অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত আইন আর দত্তক ও খোরপোষ সংক্রান্ত আইন— মূলত এই চারটি আইন জুড়ে হিন্দু ব্যক্তিগত আইন তৈরি হয়েছে। এই আইন হিন্দু ছাড়াও বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই আইন সম্পর্কে একটা চালু ধারণা হল যে, এই আইনটিতে লিঙ্গ বৈষম্য নেই। ধারণাটি পুরোপুরো ভুলও নয়। আবার পুরোপুরো ঠিকও নয়। আইনটি প্রাথমিকভাবে লিঙ্গ-বৈষম্যে ভরা ছিলো। তারপর একের পর এক পরিবর্তন বা আমেন্ডমেন্ড হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্য দিয়ে আইনটি ক্রমশ তার গায়ে লেগে থাকা লিঙ্গ-বৈষম্যকে ছেঁটে ফেলছে। তারপরেও এই আইনটিতে একাধিক বড় বড় লিঙ্গ বৈষম্যের জায়গা রয়ে গিয়েছে।
নাবালক ও অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত আইনে শিশুর স্বাভাবিক অভিভাবক (natural guardian)-এর একটি ধারণা রয়েছে। স্বাভাবিক অভিভাবক মানে প্রাথমিক অভিভাবক ভাবা যেতে পারে। এই আইন অনুযায়ী, বিয়ের মধ্যে যে শিশু জন্ম নিচ্ছে, তার স্বাভাবিক অভিভাবক শিশুটির বাবা। বাবার পর তার অভিভাবক মা। বিয়ের বাইরের সন্তানের ক্ষেত্রে ঠিক উলটো। দত্তক সন্তানের ক্ষেত্রেও তাই। দত্তক নেওয়া বাবাই শিশুর প্রাথমিক অভিভাবক। আইনে বলা হচ্ছে যে, শিশুটি পাঁচ বছর পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবেই মা-র হেফাজতে থাকবে। মানে সেক্ষেত্রে মা-র একটা আলাদা ভূমিকা মেনে নেওয়া হলেও এখানে কোথাও মাকে অভিভাবকের (guardian)-এর জায়গা দেওয়া হয়নি। হেফাজত (custody) কথাটি আলাদা করে বলা হয়েছে। বিবাহিত নাবালিকার অভিভাবক তার স্বামী— এই আইন অনুসারে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, এই আইনটি সম্পূর্ণভাবেই লিঙ্গ-বৈষম্যে ভরা।
হিন্দু সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী কোনো ইচ্ছাপত্র বা উইল না করা থাকলে, বাবা বা মা মানে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে ২০০৫-এর পরিবর্তনের (আমেন্ডমেন্ট) পর থেকে ছেলে আর মেয়ের সমান অধিকার। হিন্দু সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনের দুটো ভাগ। একটা মিতাক্ষরা আর একটা দায়ভাগা। দায়ভাগা মূলত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা ইত্যাদি জায়গায় কার্যকরী আর মিতাক্ষরা ভারতের বাকী অংশের রেওয়াজ। দায়ভাগাতে ১৯৫৬ সাল থেকেই ছেলে ও মেয়ের সমান অধিকার দেওয়া রয়েছে। কিন্তু মিতাক্ষরা আইনটি একটু জটিল। এখানে সম্পত্তিকে মূলত দু-ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হল বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত সম্পত্তি (ancestral property) আর অন্যটি হল অর্জিত সম্পত্তি (aquired/separated property)। বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত সম্পতি মানে হল বাবার দিকের চার ‘পুরুষ’ ধরে তা প্রবাহিত হচ্ছে। মানে বাবা, তার বাবা, তার বাবা ইত্যাদি। একজন জন্মের পর থেকেই এই বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত সম্পতির অধিকারী। ২০০৫-এর আগে এই সম্পত্তিতে মেয়েদের কোনো অধিকার ছিলো না। কিন্তু এখন তা আছে। তবে সেটা বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত সম্পত্তি আর থাকছে না। অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক ধারণা অনুসারে বংশ বিষয়টাই বাবার দিক থেকে আসে। হিন্দু আইনেও এই ধারণাই রয়ে গিয়েছে।
হিন্দু আইন যখন ধীরে ধীরে লিঙ্গ-সাম্যর দিকে এগোচ্ছিল তখন ক্রমাগতই তা কিছু সাবেকীপন্থীদের বাধার সম্মুখীন হচ্ছিল। তাদের তুষ্ট করার জন্যই এই আইনে মেয়েদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার একটি বিশেষ বন্দোবস্ত করা আছে। পুরো সম্পত্তিতে উইল করার অধিকার বা ইচ্ছাপত্র তৈরির অধিকার দেওয়া রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই উইল করে এই অধিকার থেকে মেয়েদেরকে বঞ্চিত করা হয়। এখনও। মুসলিম ব্যাক্তিগত আইন অনুযায়ী আবার সম্পত্তির একটা নির্দিষ্ট অংশই কেবলমাত্র উইল করা যায়। বাকী অংশ আইনী উত্তরাধিকারীদের দিতেই হয়। যদিও মুসলিম আইন অনুযায়ী ছেলে আর মেয়ে সম্পত্তির সমান ভাগ পায় না। মেয়ে ছেলের অর্ধেক পায়। কিন্তু সেটা তাকে দিতেই হয়। উইল করে বঞ্চিত করা যায় না কোনোভাবেই।
ব্রিটিশ আমলের হিন্দু সম্পত্তি আইনে প্রথম নারী-অধিকার এলো ১৯৫৬ সালে আর পরবর্তীকালে এলো ২০০৫ সালে। সংজ্ঞাগত জায়গা বাদ দিলে ও ঠিক আগে বলা ইচ্ছাপত্রের অধিকারের জায়গা বাদ দিলে এই আইন এখন মোটের ওপর লিঙ্গ-সাম্য নির্ভর। মেয়েরা কি তার মানে ২০০৫ পরবর্তীতে অনেক সম্পত্তি-জমিজমা ইত্যাদির মালিক হয়ে উঠলেন? দেখা গেল তা হল না। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের ২০১৮-এর একটি সার্ভে দেখালো যে, ভারতের মোট কৃষিজমি যেগুলো ব্যক্তি মালিকানায় আছে তার মাত্র ২%-এর মালিক মেয়েরা। আসলে আইনে অধিকার দেওয়া থাকলেও সংষ্কৃতিতে এই অধিকার ঢুকলো না।
আইন কিছু লেখা মাত্র। আইনকে যারা কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন, পরিবার বা বিচারক, তাদের সংষ্কৃতিতে লিঙ্গ-সাম্যর প্রায় কোনো চর্চা না থাকা মেয়েদের এই বঞ্চনার জন্য মূলত দায়ী। আশির দশকে মধুবালা মিত্তাল নামে এক ডাক্তারি ছাত্রীর পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ পাওয়া না যাওয়ায় তার বাবা-মা মামলা করলে নিম্ন-আদালত রায় দেয়— ‘বেকার মেয়ে পরিবারের বোঝা। ফলে তার মৃত্যুতে বাবা-মা-র কোনো ক্ষতি হয়নি।’ তাদেরকে ক্ষতিপূরণ থেকেও বঞ্চিত করা হয়। হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার স্বীকার করে নিলেও, প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের ষাট শতাংশ কেটে নেয় আর নিম্ন-আদালতের নারী-বিদ্বেষী রায় নিয়ে চুপ থাকে। পরে অবশ্য ওনারা সুপ্রিম কোর্টে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। উদাহরণটি দিলাম এটা বোঝানোর জন্য যে, যারা আইনের রক্ষক সেই বিচারকদেরই যদি মেয়েদের সম্পর্কে এই ধরনের বৈষম্য-মূলক ধারণা থাকে তাহলে শুধু আইনে বদল এনে সমাজে লিঙ্গ-সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে !
সাংষ্কৃতিকভাবে মেয়েদের দুভাবে বিশেষিত করা হয়। একটা হল ‘বোঝা’ ভাবা হয়। যার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ ওপরে দেওয়া হল। আর একটি হল মহিমান্বিত করা। মহিমান্বিত করার মূল পদ্ধতি হল মেয়েদেরকে ত্যাগ ও তিতিক্ষার দেবী হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের পুজো বা ওই জাতীয় কিছু একটা করা । এই দুটোই আসলে মেয়েদের সম্পত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে মূল বাধা। উত্তর ভারতের একটি বিস্তৃর্ণ অঞ্চল জুড়ে মেয়েদের মধ্যে একটি সাবেকী আচার আছে যার নাম ‘হক ত্যাগ’। এই আচারে মেয়েরা তাদের যা হক, তাদের যা প্রাপ্য, তা ত্যাগ করেন। ধরে নেওয়াই যেতে পারে যে, এই ত্যাগের মূল প্রেরণা নিশ্চয়ই পরজীবনে স্বর্গবাস থেকেই আসে! ভারতীয় মেয়েদের আসলে এইভাবেই তৈরি করা হয়েছে। যারা ‘ভালো’ ভারতীয় নারী তারা ত্যাগ করেন— এই হচ্ছে ভালো ভারতীয় নারীর ধারণা। একজন ‘ভালো’ মেয়ে ইহজীবনে ত্যাগ করে, তার পরজীবন সুন্দর করার জন্য। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ‘ভালো মেয়ে’-র এই ধারণা এখন ক্রমশ বদলাচ্ছে। কিন্তু সেই বদলের গতি খুব ধীর। ‘ভালো মেয়ে’-র এই ধারণা শুধু ছেলেদের মধ্যে থাকে না, মেয়েরা নিজেরাও সেই ধারণা হজম করেন ও নিজেরা ‘ভালো’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। তাই যখন কেউ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন তখন সেই বঞ্চনার বিরোধিতা করে কোর্টে যাওয়ার ক্ষমতা যেমন অধিকাংশ মেয়ের থাকে না তেমনই তারা নিজেরাও মনে করেন যে, সম্পত্তি দাবী করলে তারা ‘ভালো বোন’, ‘ভালো ননদ’ ইত্যাদি হতে পারবেন না। ফলে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন বুঝতে পেরেও সম্পত্তির কোনো দাবী জানান না। ‘ত্যাগ’-এর লোভে।
ফলে দেখা যাচ্ছে যে, ইচ্ছাপত্র বা উইল তৈরির মধ্য দিয়ে মেয়েদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা, গোটা প্রশাসনিক কাঠামো জুড়ে মেয়েদের সম্পর্কে একটা বৈষম্য-মূলক ধারণা, রাজত্বকারী ধারণা হিসেবে সামাজিকভাবে আর মেয়েদের নিজেদের মধ্যেও ত্যাগের আদর্শ থাকা— মূলত এই ত্রিবিধ জালে জড়িয়ে গিয়ে মেয়েরা খুব কম সম্পত্তি পাচ্ছে শেষ পর্যন্ত। যদিও আইনে সে অধিকার দেওয়া আছে। বস্তুত সংষ্কৃতিতে সেই অধিকার নেই। এই মেয়েদের বঞ্চিত করে রাখার সংষ্কৃতি, পিতৃতান্ত্রিক সংষ্কৃতি জগদ্দল পাথরের মতো। একটু একটু করে ভাঙে। নানারঙের নারী অধিকার-আন্দোলন এই পাথর ভেঙে চলেছে একটু একটু করে। পাথরের ভার ক্রমশ হালকা হচ্ছে মেয়েদের ওপর, গোটা সমাজের ওপর। আশা করা যায় একদিন এই পাথর পুরোপুরি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে আর আইনী-অধিকারের বাধা অতিক্রম করে সংষ্কৃতিতে সত্যি সত্যি লিঙ্গ-সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
Cover image by Cartoonist Shankar during the Hindu code bill debate, from Shankar’s weekly, Jan 1950.
পুনঃ প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৫ মে, ২০২০
0 Comments
Post Comment