ঘরে বাইরে : স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি মেয়েরা

  • 01 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1117 view(s)
  • লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্দা ভেঙে  বহির্জগতে মেয়েদের পা রাখা সীমিতভাবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই শুরু হয়ে গেছে। উদারপন্থী সংস্কারকরাও মনে করতেন স্ত্রীশিক্ষার উদ্দেশ্য হল সুমাতা, সুপত্নী, সুগৃহিণী হিসেবে মেয়েদের ভূমিকাকে আরো জোরদার করা। দেশ-জাতি-রাষ্ট্র এই সব নিয়ে মাথাব্যথা শুধুমাত্রা পুরুষের। মেয়েদের কাজ এবং বিচরণের পরিসর  নির্দিষ্ট করে দিয়ে পিতৃতন্ত্র মেয়েদের চেতনার ওপর আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। কিন্তু এই নির্মাণ ভেঙেই মেয়েরা স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন।

বিশ শতকের গোড়া থেকে বাঙালি মেয়েরা জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের বিভিন্ন ধারায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সমান্তরাল দুটি ধারা, গান্ধীজীর নেতৃত্বে অহিংস আন্দোলন, এবং সহিংস বিপ্লবী  আন্দোলন – দুটোই মেয়েদের আকর্ষণ করেছিল। পর্দা ভেঙে  বহির্জগতে মেয়েদের পা রাখা সীমিতভাবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই শুরু হয়ে গেছে। স্কুলে যেতে শুরু করেছে তারা বন্ধ গাড়ি চড়ে। পরবর্তী দশকগুলিতে কলেজ, মেডিকাল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজাও তাদের জন্য খুলে গেছে। মেয়েরা প্রবেশ করতে শুরু করেছে কর্মক্ষেত্রে, মূলত শিক্ষয়িত্রী বা ডাক্তার হিসেবে। তবে ঘর-সংসারই যে মেয়েদের প্রকৃত সার্থকতার ক্ষেত্র  - এই বক্তব্য বিভিন্ন প্রবন্ধ, উপদেশধর্মী পত্রপত্রিকায় পুনঃপুন উচ্চারিত হচ্ছিল। উদারপন্থী সংস্কারকরাও মনে করতেন স্ত্রীশিক্ষার উদ্দেশ্য হল সুমাতা, সুপত্নী, সুগৃহিণী হিসেবে মেয়েদের ভূমিকাকে আরো জোরদার করা।  নারীর আর্থিক স্বনির্ভরতা কখনই ছিল না কাঙ্ক্ষিত। আর রাজনৈতিক কর্মকান্ড মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল অভাবনীয়। সন্তানপালন, পতিসেবা আর ঘর-গেরস্থালীর থোড়বড়ি খাড়া  - এই নিয়েই তো মেয়েদের জীবন আবর্তিত হবার কথা! ঘরের বাইরেকার জগতটায় পুরুষের একচ্ছত্র অধিকার। আর দেশ-জাতি-রাষ্ট্র এই সব নিয়ে মাথাব্যাথা শুধুমাত্রা পুরুষের। মেয়েদের ওসব মাথায় ঢোকে না, আর মাথা না ঘামালেও চলবে। এই ভাবেই ঘর ও নারী আর পুরুষ ও বাহিরকে সমার্থক করে তুলে, মেয়েদের কাজ এবং বিচরণের পরিসর  নির্দিষ্ট করে দিয়ে পিতৃতন্ত্র মেয়েদের চেতনার ওপর আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। নারীত্বের ছাঁচ গড়ে মেয়েদের মগজে, মজ্জায় গেঁথে দিতে চেয়েছে। মেয়েরা অনেকাংশে সেই ছাঁচকে অন্তরস্থ করলেও তাদের মনোভূমিকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি পিতৃতন্ত্র। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হবার পর কতিপয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা তাদের স্বামী, পিতা বা পরিবারের অন্য পুরুষদের সঙ্গে কংগ্রেসের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তারা ছিলেন নীরব শ্রোতা। জাতীয়তাবোধক গান গাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনও ভূমিকা ছিল না। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা স্বদেশী আন্দোলনে বাঙালি মেয়েরা প্রথম স্বতঃস্ফূর্তভাবে, সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।  বিপ্লবীদের হাতে গয়না তুলে দিয়ে, তাদের গোপনে আশ্রয় দিয়ে, তাদের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখে, বিদেশি কাপড়, প্রসাধন বর্জন করে, চরকায় সুতো কেটে খদ্দর পরে স্বদেশী আন্দোলনে মেয়েরা নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিল। ঘরের লক্ষণরেখা অতিক্রম না করেই এই দৃপ্ত অংশগ্রহণ সম্ভব হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বাড়ির পুরুষেরা সবাই খুশি মনে মেয়েদের এই ভূমিকা মেনে নিয়েছিল মনে হয় না। মনে পড়ে আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতার কথা? সুবর্ণলতা তার বাড়ির ছাদে বিলিতি কাপড়ে আগুন লাগিয়েছিল বলে তার সাহেব-অনুগত স্বামী তাকে কম হেনস্থা করেছিল? আসলে লেখাপড়া শিখে মেয়েরা স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা অর্জন করুক, তাদের চেতনা জেগে উঠুক, সমাজ-দেশ-জাতির ভাবনায় তারাও ভাবিত হোক সেটা উদারমনস্ক সংস্কারকদের ও ঠিক কাঙ্ক্ষিত ছিল না। বাড়ির পুরুষেরা যে তা পছন্দ করবে না বলাই বাহুল্য।

১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে আসার পর মহাত্মা গান্ধী যখন অহিংস পন্থায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা করলেন, তখন বাঙালি মেয়েরা দলে দলে রাজনীতিতে যোগদান করতে শুরু করল।  গান্ধীর প্রত্যয় হয়েছিল, দেশকে পরাধীনতা শৃংখল থেকে উদ্ধার করতে হলে, সীতা, দময়ন্তী, দ্রৌপদীর মতো শুদ্ধাচারিণী, দৃঢ় ও সংযমী নারীদের নেতৃত্ব প্রয়োজন।  কিন্তু গান্ধীজী প্রথমে চেয়েছিলেন অন্দরমহলের বাইরে পা না রেখেই মেয়েরা তাদের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করুক।  মেয়েরা ঘরে বসে চরকায় সুতো কাটবে এবং সেই সুতোয় খদ্দরের শাড়ি বুনে নিজে পরবে ও অন্যদের পরাবে, এটুকু সক্রিয়তার মধ্যেই মেয়েদের বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। মেয়েরা অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই ভূমিকাকে গ্রহণ করেছিল। চরকার মাধ্যমে অন্দরমহলের গণ্ডী অতিক্রম করে বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল নিজেদের।  কিন্তু  অনেকেই আর অন্দরের ঘেরাটোপের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখতে চাইছিল না।  ভাঙতে চাইছিল অন্দর-বাহিরের পাঁচিলটা। অদম্য অতিক্রমণের তাড়নায় খড়কুটোর মতো ভেসে গেল গান্ধীর নিয়ন্ত্রণকামনা। মেয়েদের ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরের জগতে পা রেখে মিটিং, মিছিল, পিকেটিং - প্রতিবাদের এই সব হাতিয়ারগুলি ব্যবহার করার অনুমতি তাঁকে দিতেই হল। তবে তিনি বারবার সতর্ক করে দিলেন,  আন্দোলনে শামিল হবার অজুহাতে মেয়েরা যেন গার্হস্থ্যধর্মকে কখনোই অবহেলা না করে। স্বামী-সংসারের প্রতি কর্তব্যে অবিচল থেকেই মেয়েদের দেশের কাজে এগিয়ে আসতে হবে। চলতে হবে গান্ধীজীর দেখানো পথে।

গান্ধীবাদী আন্দোলনে যে সব মেয়েরা অংশগ্রহণ করেছিল তারা মূলত পিতা বা স্বামী বা পরিবারের অন্য কোনও পুরুষ সদস্যের হাত ধরে প্রবেশ করেছিল বাইরের আঙিনায়। কিন্তু অবিবাহিত বা বিধবা মেয়েদের কথাটা আলাদা। কিন্তু এদের ওপর পরিবার সমাজের নজরদারী কম ছিল না। শান্তিসুধা ঘোষ আজীবন বিয়ে করেননি। কিন্তু তাঁর দাদা ও অন্যান্য পুরুষ আত্মীয়রা ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল। শান্তিসুধা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যেতেন তখন তাঁর দাদা তাঁকে পৌঁছে দিতেন আবার নিয়ে আসতেন। মন চাইলেও শান্তিসুধা ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। স্বাবলম্বী হবার জন্য অপেক্ষা করেছেন। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করতে শুরু করার পর শান্তিসুধা তার কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। কোনো পুরুষ অভিভাবকের সমর্থন বা সহযোগিতা ছাড়াই।

 কমলা দাসগুপ্ত  তাঁর  স্মৃতিকথা রক্তের অক্ষর-এ  জানিয়েছেন, তিনি গান্ধীজীর কাছে চিঠি লিখে সবরমতী আশ্রমে গিয়ে থাকা ও দেশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও গান্ধীজী এর প্রত্যুত্তরে জানান,

‘বাপ-মায়ের অনুমতি নিয়ে এসো। তাছাড়া, তুমি এখানে এত সরল জীবনযাপন  করতে পারবে তো?’

আশ্রমে গিয়ে থাকার ব্যাপারে বাবা-মা যে অনুমতি দেবেন না কমলা সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। এই কারণে পথ বদলে তিনি সশস্ত্র কর্মকান্ডে যোগদান করেছিলেন।

 আবার যারা পরিবারের পুরুষ অভিভাবকের হাত ধরে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আঙ্গিনায় প্রবেশ করেছিল তারা খুঁজে পেয়েছিল আরও প্রতিপত্তিশালী এক পুরুষ অভিভাবককে। তবে সেই অভিভাবকের ছকে দেওয়া পথ থেকে  মেয়েরা কি এক চুলও বিচ্যুত হয়নি? নাকি প্রতিবাদের নিজস্ব পন্থা তারা খুঁজে পেয়েছিল? জেরালডিন ফর্বস  দেখিয়েছেন কিভাবে গান্ধীজী সরলাদেবীর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন আগামী দিনের আন্দোলনের নেতৃত্বদানের সম্ভাবনা, কিভাবে সরলাদেবীকে লেখা একের পর এক চিঠিতে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন কোথায় তাঁর খামতি, নেত্রী হতে গেলে কোন কোন গুণ তাঁকে আয়ত্ত করতে হবে।  কিন্তু সরলাদেবী গান্ধীর সমস্ত কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেননি, নিজের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী অগ্রসর হয়েছেন এবং অচিরেই গান্ধীজীর মোহভঙ্গ হয়েছে।

মহিলা সাহিত্যিকদের সৃজিত গল্প-উপন্যাসে পুরুষ নেতৃত্বের নির্দেশিত পথে মেয়েদের প্রশ্নহীন অনুগমনের পাশাপাশি প্রতিবাদ-প্রতিরোধেরও চিহ্ন খুঁজে পাই। রচিত হতে থাকে অনেক hidden transcripts। যেমন আশালতা সিংহের  ‘দেশের কাজ’ গল্পে নগ্ন হয়ে উঠেছে পুরুষ নেতৃত্বের দ্বিচারিতা আর মহিলা কর্মীদের একনিষ্ঠ আনুগত্যের সুযোগ নেওয়ার প্রবণতা। শান্তিসুধা ঘোষ তাঁর পথের ইঙ্গিত উপন্যাসে প্রশ্ন তুলেছেন, উদারপন্থী হিন্দু ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়েরা ঘরের মধ্যে বজ্রের শেকলে বাধা পড়ে থাকলে রাষ্ট্রিক মুক্তি নিয়ে কি করবে?

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শামিল হয়ে  মেয়েদের যৌন হেনস্থাও সহ্য করতে হয়েছে।  যদিও যে ইতিহাস এযাবৎ লেখা হয়েছে তা এই বিষয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেনি।  শহুরে এলিট মেয়েরা পার পেয়ে গেলেও  স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী গ্রাম-গঞ্জের মেয়েরা নিদারূণ যৌন অত্যাচারের শিকার হয়েছিল।  ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মেদিনীপুর জেলার  তমলুক মহকুমায় এক দিনে ৭৪ জন মেয়ে ধর্ষিত হয়েছিল। তবে দেহের শুচিতা বিনষ্ট হয়েছে বলে তারা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে বসে থাকেনি, তারা তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের দরবারে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে।

এবার আসি সহিংস বিপ্লবী আন্দোলনের কথায়। বিপ্লবী রাজনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণকে পরিবার সমাজ কখনোই অনুমোদন করেনি। বিপ্লবী দলগুলিতে মহিলাদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বাধাদানের পন্থা হিসেবে তাদের পরিবারের প্রতি গোয়েন্দা বিভাগের পরামর্শ ছিল,

… the parents or guardians of these women should be warned that they will be arrested if further revolutionary activity on their part (s) comes to light,, so please to be asked to keep a watch over them. IB Report File No 223/1919

গোয়ান্দা বিভাগের নির্দেশে বিপ্লবী মেয়েদের পরিবার তাদের ওপর নজরদারী করেছিল কি না জানা যায় না তবে পরিবারের সম্মতির তোয়াক্কা না করেই বা পরিবারকে লুকিয়ে দলে দলে মেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপ্লবী আন্দোলনে।  বিপ্লবী মেয়েদের ছিল ঘরে লড়াই, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা শিক্ষালাভ করেছে সেখানেও লড়াই। বেশির ভাগ মহিলা বিপ্লবী ছিল বেথুন কলেজের ছাত্রী। অধ্যক্ষা তটিনী দাস মেয়েদের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হওয়া একদম পছন্দ করতেন না। বিপ্লবী মেয়েদের কলেজ থেকে বহিস্কৃত করের উদ্যোগ নিলে সরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছাত্রীদের রীতিমতো সংগ্রাম শুরু হয়ে  গেছিল।

  বিপ্লবী মেয়েরা ঘরের উষ্ণতা ও নিরাপত্তাকে পরিহার করে ঘর ছেড়েছে, পুরুষ বিপ্লবীদের সঙ্গে একসঙ্গে গোপন ডেরায় বাস করেছে, হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছে। ধরা পড়লে নির্মম পুলিশী অত্যাচারও সহ্য করেছে।  এইভাবে  নারীত্বের সমাজ নির্মিত ছাঁচগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। তবে পুরুষ নেতৃত্বও যে তাদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে তা নয়। ভয় পেয়েছে, নারীর সংস্পর্শে এলে ছেলেদের মন চঞ্চল হয়ে উঠবে, তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে। ‘নারী নরকের দ্বার’ এই ধারণাটা বিপ্লবীদেরও মজ্জায় গেঁথে ছিল হয়তো। অনাবশ্যক কৌতূহল দেখানো হয়েছে বিপ্লবী মেয়েদের প্রেম-সম্পর্কের বিষয়ে। আন্দোলনে শামিল হওয়া মেয়েদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ছিল না। পুরুষ নেতৃত্বের নির্দেশ বিনা প্রশ্নে পালন করাই ছিল তাদের কাজ। শুধুমাত্র প্রশ্নহীন আনুগত্যের দাবি পূরণ করতে হয়েছিল তাই নয়, মেয়েদের নিজস্ব সমস্যাকে সামান্য সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিচার করা হবে এই প্রত্যাশাকেও বিসর্জন দিতে হয়েছিল। প্রত্যক্ষ করেছিল জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পিতৃতন্ত্রের বীজ।  আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় পীড়িত হয়েছিল তারা তবে জাতির স্বার্থে চুপ করে থেকেছিল।

ঘরে থেকেও যে মেয়েরা পরোক্ষভাবে বিপ্লবী আন্দোলনকে সাহায্য করেছিল তাদেরও কি পরিবারের কাছে একেবারেই হেনস্থা হতে হয়নি? বিপ্লবী দাদাকে এক রাতের জন্য বাড়িতে আশ্রয় দেবার জন্য আশাপূর্ণা দেবীর তাসের ঘর ছোট গল্পের নায়িকাকে সাংঘাতিকভাবে হেনস্থা করেছিল তার স্বামী ও পরিবার। চরিত্রহনন করেছিল তার। তাসের ঘরের মত তার আঠারো বছরের সংসার ভেঙে পড়ে গেছিল।

তবে সবাই কি নীরবে আপোষ করে নিয়েছিল এই সর্বব্যাপী লিঙ্গরাজনীতির সঙ্গে?  প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তাঁর মৃতুর আগে লেখা Long Live Revolution-এ রাজনীতি এবং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে অসাম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। ১৯৩১ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে সরলাদেবী চৌধুরানী দাবি করেছিলেন মেয়েদের জন্য আলাদা কংগ্রেস গঠন করা হোক। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে মেয়েদের সমস্যাগুলো যে গুরুত্ব হারাচ্ছে তিনি আশংকা  করেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কংগ্রেসের সদস্যাদের মধ্যে অনেকেই চায়নি মেয়েদের আলাদা কোনো মঞ্চ থাকা জরুরি। হয়তো তারা ভেবেছিল, জাতি স্বাধীন হলে মেয়েদের সমস্যার সমাধানে আর কোন বাধা থাকবে না। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হল ঠিকই কিন্তু মেয়েদের অবস্থা যে সাংবিধানিক অঙ্গীকার সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র পাল্টায়নি বরং অবনমন ঘটেছে তার প্রমাণ ১৯৭৪ সালের Towards Equality রিপোর্ট। আর এই যন্ত্রণাদায়ক উপলব্ধি থেকেই শুরু হল স্বতন্ত্র নারী আন্দোলন।

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৫ মে ২০২২ 

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সৌজন্য  ইন্টারনেট

 

 

 

 

.

 

 

0 Comments

Post Comment