- 14 June, 2021
- 0 Comment(s)
- 605 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
বিজ্ঞান বলতে আমরা মূলত গবেষণা বুঝি। এমনকি অধ্যাপনার সঙ্গে গবেষণার যে সূক্ষ রেষারেষি চলে, তাও আজকাল বেশ রকমেতে টের পাই। ভালো পড়ানোর চেয়েও ভালো গবেষণার জন্য বাহবার বরাদ্দটা ইদানীং যেন অল্প করে হলেও, একটু মাত্রাতে বেশী করে চোখে পড়ে। কিন্তু অধ্যাপক বা শিক্ষক ভিন্ন আমরা যেতুম কোথায় ? সুযোগ্য শিক্ষক পেলে তবেই না যোগ্যতর একজন বিজ্ঞানীর জন্ম হয়। আসলে আমাদের প্রবৃত্তিই যে তেমন। যে কোন কিছুতেই একটা বাইনারি আনা চাইই চাই। সে পুরুষ-নারী থেকে শুরু করে গবেষণা বনাম অধ্যাপনার কূটকচালি। আচ্ছা, একেই কি আরও উচ্চমেধার মানুষেরা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলেন ? অথবা ‘নিয়ত বাইনারির ইতিবৃত্ত’ ইত্যাদি বলে এগুলিকে নিয়েই কি বেশ একটা চটজলদি ডিসকোর্স লিখে ফেলা যায় ? সে কথা বরং থাক, আলগা মন্তব্য করবো না। কেবল পরিবেশটাকে একটু হালকা করে নিতে চাইলাম। অন্ধকারের ভিতরে দাঁড়িয়ে বারে বারে সেই অন্ধকারের কথাই কেবল বলতে নেই। এখানে হাওয়া আসুক, আলো আসুক।
আজ যার কথা বলবো, তাঁর পরিচিতি মূলত শিক্ষক হিসেবে। গবেষণায় তাঁর বিশাল কৃতিত্ব না থাকলেও, তিনি বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানশিক্ষার বিষয়ে অন্যতম একজন পথিকৃৎ। বিশেষত রসায়ন শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান এবং শিক্ষাপদ্ধতি বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনিই ইংল্যান্ডের কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, রসায়নবিদ্যাতে প্রথম স্বীকৃত লেকচারার, এখন যে পদটিকে আমরা এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বলে চিহ্নিত করে থাকি।
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে, মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর দাদু-ঠাকুমার কাছেই বড় হয়ে উঠছিলেন ইদা ফ্রয়েন্দ। জন্ম ১৫ই এপ্রিল, ১৮৬৩। কিন্তু পরে তাঁর দাদু-ঠাকুমা দুজনেরই মৃত্যু হলে তিনি চলে আসেন তাঁর কাকার বাড়িতে। জায়গাটার নাম অস্ট্রিয়া, কাকার নাম ল্যুডউইগ স্ট্রস। পেশায় বেহালাবাদক। হ্যাল অর্কেস্ট্রার অন্যতম সদস্য ছিলেন এই ল্যুডউইগ। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্ক মধুর, দুইই বোধহয় আমাদেরকে ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছিয়ে দেয়। সেই কারণেই বোধহয় দিকপাল বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে অনেকেই নানারকমের বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। যদিও ইদা ফ্রয়েন্দ বেহালা বাজাতেন কি না জানা নেই, তিনি তাঁর কাকার তত্ত্বাবধানে বড় হয়ে গির্টন কলেজ থেকে ন্যাচারাল সায়ান্স ট্রাইপসে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কেমব্রিজ ট্রেনিং কলেজ ফর উইমেনে কেমিস্ট্রির লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হন। এক বছর পর তিনি কেমব্রিজের নিউহ্যাম কলেজের রসায়ন গবেষণাগারের অধ্যাপিকা হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৯০ সালে তিনি সরকারি ভাবে ওই কলেজের স্টাফ লেকচারার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। রসায়নে তিনিই প্রথম ইংল্যান্ডে নিযুক্ত স্টাফ লেকচারার। পরবর্তীতে তিনি নিউহ্যাম কলেজ কাউন্সিলেরও সদস্য হয়েছিলেন।
ইদা ফ্রয়েন্দ ছিলেন জন্ম-শিক্ষিকা। ক্লাস নেবার বিষয়ে তাঁর উৎসাহ তাঁকে সেই যুগে গবেষণার দিকে বিশেষ অগ্রসর হতে দেয়নি। তিনি স্নাতকোত্তর অথবা পিএইচডি গবেষণার দিকেও যাননি। কিন্তু তাঁর ক্লাস যাঁরাই করেছেন, একবাক্যে তাঁরা সকলেই স্বীকার করেছেন যে – তাঁর ক্লাস নেবার ধরনটি ছিল সকলের চেয়ে আলাদা। শিক্ষাদানের বিষয়ে তিনি সে যুগের চেয়েও অনেকটাই বেশী এগিয়ে ছিলেন। বিজ্ঞানী সত্তার চেয়েও তিনি বিজ্ঞানশিক্ষার বিষয়ে আলাদা করে নিজের অবদান রেখেছিলেন। উইলহেলম অসওয়াল্ডের তত্ত্ব অনুসারে, ইদা ফ্রয়েন্দ বিশ্বাস করতেন যে রসায়ন বা যে কোনও বিজ্ঞান শিক্ষার বিষয়ে ছাত্র এবং অধ্যাপকের মধ্যে সংলাপ হওয়াটা জরুরি। শিক্ষকতা কখনই একমুখী কোনও পদ্ধতি নয়, হতে পারে না। বিজ্ঞানশিক্ষা তো আরোই নয়। তিনি নিজে তাঁর ছাত্রীদেরকে উৎসাহ দিতেন মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধগুলিকে পড়ার জন্য, এবং পড়া হয়ে গেলে সেই প্রবন্ধগুলির বক্তব্যকে হাতে কলমে যাচাই করে দেখতে বলতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শুধু মাত্র তত্ত্ব মুখস্থ করে নয়, হাতে কলমে সেই তত্ত্বকে যাচাই করে দেখতে পারলে তবেই সেই শিক্ষার্জন সম্পূর্ণ হয়। শিক্ষার আত্তীকরণ ঘটে।
এই বিষয়ে একটি মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। অধিকাংশ ইউরোপীয় রমণীর মতোই ইদা ফ্রয়েন্দ বেকিংয়ের বিষয়ে বিশেষ ভাবে উৎসাহী ছিলেন। রসায়ন পড়াতে পড়াতে, এই বেকিংয়ের বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে তিনি তাঁর ছাত্রীদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। পিরিয়ডিক টেবল বা পর্যায় সারণী পড়াতে গিয়ে তিনি প্রত্যেক মৌলকে একেকটি করে ছোট কাপকেক হিসেবে সাজাতেন, এবং সেই সমস্ত ছোট ছোট কেকগুলিকে পর্যায় সারণীর অনুক্রমে টেবলের উপরে সাজিয়ে দিতেন। মৌলরূপী কেকগুলির উপরে চকোলেট আইসিং দিয়ে সেগুলির পরমাণু সংখ্যা লেখা থাকতো। নিষ্ক্রিয় মৌলগুলি আকারে গোলাকৃতি, একযোজী মৌলগুলি একটি কোণবিশিষ্ট, দ্বিযোজী মৌলগুলি দুটি কোণের – এমন ভাবে প্রতিটি মৌলকে যাতে আলাদা আলাদা ভাবে চেনা যায়, সেভাবেই ইদা ফ্রয়েন্দ এই আশ্চর্য টেবলটিকে সাজিয়ে তুলতেন। ক্লাস হয়ে গেলে অবশ্যই এই কেকগুলি ছাত্রীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হতো।
নিজের অধ্যাপনা জীবনে তিনি একটিই মাত্র গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। বিভিন্ন লবণের মধ্যে তাপজনিত কারণে আয়তনের পরিবর্তন – এই বিশেষ বিষয়টিকে নিয়েই সেই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিল। কিন্তু এর চেয়েও তাঁর মূল্যবান অবদান হল, রসায়ন শিক্ষার বিষয়ে তিনি দুটি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছিলেন। দুটি বইই বিশিষ্ট মহলে সমাদর লাভ করে। প্রথম বইটির নাম, ‘দ্য স্টাডি অব কেমিক্যাল কম্পোজিশনঃ এ্যান এ্যাকাউন্ট অব ইটস মেথড এ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল ডেভেলপমেন্ট উইথ ইলাস্ট্রেটিভ কোটেশনস’, (১৯০৪) – বইটি ২০১৪তে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত দ্বিতীয় বইটি, ‘দ্যা এক্সপেরিমেন্টাল বেসিস অব কেমিস্ট্রিঃ সাজেশনস ফর এ সিরিজ অব এক্সপেরিমেন্টস ইলাস্ট্রেটিভ অব দ্য ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপলস অব কেমিস্ট্রি’, ১৯২০ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। বইদুটির মূল শিরোনামগুলিকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে, তত্ত্বের চাইতেও হাতে কলমে রসায়নের প্রয়োগ বিষয়ে লেখিকা অনেক বেশী সচেতন এবং পারদর্শী ছিলেন। এমনকি তখনকার গবেষণাগারে ব্যবহারের জন্য বিশেষ এক ধরনের একটি টিউব নির্মাণের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান ছিল। বিজ্ঞান যে আসলে তত্ত্বের প্রয়োগ, হাতে কলমে দেখবার – পরখ করবার জিনিস, এই উপলব্ধি তাঁর মধ্যে প্রখর ভাবে কাজ করেছিল। সেজন্যেই তিনি স্মরণীয়।
হাতেকলমে কাজ করতে, তত্ত্বকে যাচাই করতে যাঁরা আগ্রহী ও পারদর্শী – তাঁরা যে ব্যক্তিজীবনেও প্রগতিশীল এবং বহির্মুখী হবেন তাতে আর আশ্চর্য কি। নারীর ভোটাধিকারের স্বীকৃতির দাবিতে ইংল্যান্ডে যে আন্দোলন, ইদা ফ্রয়েন্দ তাতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইংল্যান্ডের কেমিক্যাল সোসাইটিতে নারীদের সদস্যপদ প্রাপ্তির দাবিতেও তিনি সরব হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ছ’বছর পর ইংল্যান্ডের কেমিক্যাল সোসাইটিতে নারীর সদস্য পদ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকৃতি লাভ করে। আরও একটি কথা এই প্রসঙ্গে না বললেই নয়, শারীরিক ভাবে তাঁর একটি মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিশোরী বয়সে ভয়াবহ এক সাইকেল-দুর্ঘটনার কারণে তাঁর একটি পা বাদ চলে যায়। আজীবন তিনি প্রস্থেটিক পা ব্যবহার করে, ওয়াকিং স্টিকে ভর দিয়ে, অথবা সময়ে সময়ে হুইলচেয়ারে করে ঘুরে তাঁর কাজ করেছেন।
১৫ই মে, ১৯১৪ সালে ৫১ বছর বয়সে প্রয়াত হন ইদা ফ্রয়েন্দ। এমন একজন শিক্ষিকাকে আমরা সেভাবে ডকুমেন্ট করিনি। আজ এত বছর পর আমাদের তাঁর কথা মনে পড়েছে। অনেকে তাঁকে নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রত্যেক অধ্যাপক, অধ্যাপিকার কাছে ইদা ফ্রয়েন্দ একজন আদর্শ হওয়া উচিত। তিনি শুধু বিজ্ঞানকে অর্জন করেননি, বিজ্ঞানবোধকে বিতরণ করেছেন – আর কে না জানে যে, দুনিয়াতে জ্ঞানই হল সেই একমাত্র বস্তু যা বিতরণ করলে বৃদ্ধি পায়। ইদা ফ্রয়েন্দ মানুষকে বিজ্ঞান শেখাতে চেয়েছিলেন, নতুন ভাবে নতুন রকমে বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এই আরও নতুনের যাত্রাপথেই আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত।
সূত্রঃ
[১] মেরিলিন বেইলি ওগিলভি, ‘ইদা ফ্রয়েন্দ, অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি’, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
[২] ‘ইদা ফ্রয়েন্দ বায়োগ্রাফি’, নিউহ্যাম কলেজ
[৩] মার্গারেট হিল, এ্যালান ড্রোনসফিল্ড, ‘ইদা ফ্রয়েন্দঃ দ্য ফার্স্ট উওম্যান কেমিস্ট্রি লেকচারার’, আরএসসি হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি নিউজলেটার, সেপ্টেম্বর, ২০১৫
[৪] ইদা ফ্রয়েন্দ, ‘দ্য ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপলস অব কেমিস্ট্রি’, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯২০
[৫] জোনাথান স্মিথ, ‘টিচিং এ্যান্ড লার্নিং ইন নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি কেমব্রিজ’, বয়ডেল এ্যান্ড ব্রিউয়ার, ২০০১
ছবি : ইদা ফ্রয়েন্দ। সংগৃহীত
লেখক : প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষক, প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment