- 27 October, 2023
- 0 Comment(s)
- 1450 view(s)
- লিখেছেন : শাম্মা বিশ্বাস
কবি নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই’। কোনো মানুষেরই কি এই ভেদাভেদ করা উচিত? আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে আমরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলি, নারী পুরুষের সমান অধিকার দরকার। আজকের মেয়েরা কোনো ভাবে পিছিয়ে নেই, জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে, কাজের শরিক হচ্ছে। তবু বেশ কিছু জায়গায় শুধু মেয়ে বলেই তার প্রতি বৈষম্য বহাল তবিয়তে টিকে আছে। যে বৈষম্যের শিকার হতে হবে হয়তো আমাকেও। সেই ভবিষ্যত ভাবনায় আমি অসম্মানিত, আতঙ্কিত। আমার মতো অনেক মুসলিম মেয়ের মধ্যেই রয়েছে এই অসম্মানের ব্যথা।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মেয়েদের অনেক সমস্যার মধ্যে একটা বড় সমস্যা হল সম্পত্তির সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া। শরিয়তে বলা আছে ছেলে আর মেয়ে কখনই সম্পত্তির সমান অধিকার পাবে না। ছেলেদের থেকে মেয়েরা কম পাবে। আর আজকের এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও এই নিয়ম মানা হচ্ছে। আমি আমার দাদা, ভাইয়ের মত পড়াশোনা শিখেছি, কষ্ট করে বাইরে গিয়ে পড়েছি, হয়তো চাকরির তাগিদে আর পাঁচটা ছেলের মতোই বাইরে গিয়ে কষ্ট করে টিকে থাকার জন্য লড়াই করবো। অন্য ছেলেদের মতো সংসারের হাল ধরবো, আমার মা বাবাও হয়তো গর্ব করে অথবা চোখের জল (খুশির) ফেলে বলবে আমার মেয়ে, ছেলের থেকে একটুও কম না। পাড়া প্রতিবেশী সবাই বলবে ছেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে ওই মেয়ে। ও কম কি! কিন্তু সম্পত্তি ভাগের সময় তখন যে প্রমাণ করে ছাড়ে, হ্যাঁ মেয়ে তুমি কম। কম বলেই আমার সমান অধিকার নেই আমার নিজের বাড়িতে, নিজের সম্পত্তিতে। আমার মা বাবা যতই বলুন আমরা ছেলে মেয়ের ভেদাভেদ করি না কিন্তু ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করতে গিয়ে সেই শরিয়তের প্রসঙ্গ তুলবে। অনেক পরিবারেই এটা ঘটছে। শরিয়তের খুঁটিনাটি অন্য ক্ষেত্রে মানে না। সম্পত্তি ভাগের সময় কেবল শরিয়তকে ভয় পায়? তা হয়তো নয়। প্রচলিত বণ্টন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত বলেই সম্পত্তি ভাগের সময় ভুলে যায়, ছেলে আর মেয়ে সমান। মেয়েকে বঞ্চনা করা হচ্ছে, দুঃখ দেওয়া হচ্ছে সেই বোধটাও হারিয়ে যায়। আর এই খানেই আমাদের লড়াই।
আধুনিক যুগে এসেও কেন আমরা কম নেব বা কম পাবো? যখন নারী পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই তখন কীসের জন্য এই অবিচার! শুধু কি তাই, আমার মা এবং মাসিরাও তাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন শুধু তাদের কোনো ভাই বা দাদা ছিল না বলে। ভাই বা দাদা না থাকার কারণে তাদের সম্পত্তির ভাগের অংশীদার হয়েছেন আত্মীয়রা। আমার একটি মামা থাকলে কোন আত্মীয় সম্পত্তির অংশীদার হতো না। উত্তরাধিকার সম্পত্তি ভাগে ছেলে-মেয়ের মধ্যে এই বৈষম্য কেন মানব? এমনকী যদি কোনো বাচ্চার বাবা তার দাদু বেঁচে থাকাকালীন মারা যান, এবং সম্পত্তির ভাগ যদি না হয়ে থাকে তবে সেই শিশুটির আর কোনো অধিকারই থাকবে না তার দাদুর সম্পত্তির ওপর। আমার চেনা মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলা ব্লকে একজন মহিলাকে সাত বছরের বাচ্চা নিয়ে শ্বশুর শাশুড়ী বাড়ি ছাড়া করতে পেরেছিল শুধুমাত্র এই নিয়মের জন্য। মানুষের মানবিকতা আজ কোথায়! হাদিসের অজুহাত দেখিয়ে যে নিয়ম চালু রেখেছে, সেখানে মনুষ্যত্ব চাপা পড়ে থাকছে। সময় পাল্টেছে, মানুষকেও সময় অনুযায়ী পাল্টাতে হচ্ছে। মেয়েরাও অর্থ উপার্জন করে সংসারের হাল ধরছে। বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিচ্ছে। তাই এককালের নিয়মকে আজ পাল্টানোর সময় এসেছে। আমাদেরও উচিত এই আইন সংস্কারের আন্দোলন জোরালো করা। জানি, কোনো ভালো জিনিসই খুব সহজে পাওয়া যায় না। যেমন রোকেয়া খুব সহজেই পারেননি মুসলিম মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে, অনেক লড়াই তাঁকে করতে হয়েছে। বিদ্যাসাগর, রামমোহন হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছিলেন হিদু মেয়েদের কিছু অধিকার আদায়ের জন্য। অনেক বাঁধা পেরিয়ে একটা সময়ের পর তাঁরা সবাই জয়ী হয়েছেন। আমার বিশ্বাস আমরাও একদিন পারবো মুসলিম মেয়েদের সম্পত্তির সমান অধিকার আদায় করতে। লড়াইটা তাই থামিয়ে দিলে চলবে না।
প্রতীকী ছবি
লেখক : গৃহশিক্ষক ও সমাজকর্মী
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৯ জুন,২০২০
0 Comments
Post Comment