অযৌক্তিক বৈপরীত্য নাকি সত্য আধুনিকতা – এ’বছরের ৮ মার্চ

  • 07 March, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 511 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
 এদেশের মানুষ, এদেশের নারী, শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াক। দুধ-ঘি-কিশমিশ-মাখন, পাথরের লিঙ্গে বিসর্জন না দিয়ে দেশের অভুক্ত নারীদের ক্ষুধানিবৃত্তির প্রয়োজনে ব্যবহার করুক। পাশ্চাত্য রেনেসাঁর পরিবর্তে আমরা যখন ধর্মীয় নবজাগরণকেই সামাজিক নবজাগরণ বলে মেনেছিলাম, সেই দিন থেকে আমাদের পশ্চাদপসরণের শুরু। সনাতন ধর্মবোধকে রক্ষা করতে চাইলে, আধুনিক হওয়া চলে না। অযৌক্তিক বৈপরীত্য আর বহুত্ববাদের সহাবস্থান এক জিনিস নয়।

৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

৮ মার্চ, ২০২৪ – মহাশিবরাত্রির উদযাপন।

 

গোড়াতেই ভ্রান্তি রয়ে গেল। ৮ মার্চ কেবল নারী দিবস নয়। সঠিক বাংলায় সেই দিনটির নামকরণ হওয়া উচিতঃ শ্রমজীবী নারী দিবস অথবা ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং উইমেন’স ডে। যেমন ভাবে রাষ্ট্রপুঞ্জের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ইন্টারন্যাশনাল ডে অব উইমেন এ্যাণ্ড গার্লস ইন সায়ান্স হিসেবে পালন করা হচ্ছে। বিশেষ ভাবে, বিজ্ঞান, এঞ্জিনিয়রিং, প্রযুক্তি ও গণিতবিদ্যায় কৃতী নারীদের কুর্নিশ জানাতেই এমন সিদ্ধান্ত। কাজেই মেয়েদের উপলক্ষ করে মেতে ওঠার জন্যও এখন এমন একাধিক স্মর্তব্য দিবস ঘোষিত হয়েছে। যথোপযুক্ত আড়ম্বরে সেগুলির উদযাপনও দেখা যাচ্ছে। তাহলে আর নতুন করে নারী দিবসের বিষয়েই বা কলম ধরতে যাওয়া কেন? অচ্ছে দিন তো প্রায় এসেই পড়েছে বলে মনে হয়। কাজেই,

 

৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

৮ মার্চ, ২০২৪ – মহাশিবরাত্রির উদযাপন।

 

বৈপরীত্যের এমন সহাবস্থান বড় একটা দেখা যায় না। বিগত বছরে নারী ও ধর্ম বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সরাসরি তাতে দেখিয়েছিলাম পুং-শাসিত সমস্ত ধর্মের বিচারেই নারীর স্থান কোথায়। ৮ মার্চ শিবরাত্রি ও নারী দিবসের এই যে সহাবস্থান, দেখতে চাইব কতজন মানুষ এই দুই বিষয়েই সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের আবেগ ব্যক্ত করেন। সেই সংখ্যাও যে নেহাত কম হবে না বলাই যায়। এই বৈপরীত্যের মূলেই আঘাত করা প্রয়োজন।

 

হিন্দু ধর্ম প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অম্লান দত্ত কোনও এক সময়ে মন্তব্য করেছিলেন, একদিকে যেমন এই ধর্ম সকল বিষয়কে গ্রহণ করেছে (আমি বলব, করতে চেষ্টা করেছে অথবা চেষ্টা করার অভিনয়টুকু অন্তত কিছুক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে) – অন্যদিকে সেই ধর্মই ‘সনাতন’কে ব্যর্থ সম্মান জানাতে গিয়ে যুগযুগান্তের গলিত-উচ্ছিষ্ট সমস্ত নিয়ম-আচার-অনুষ্ঠানকেও বোঝার মতো নিজের শরীরের উপর টানতে টানতে বয়ে নিয়ে চলেছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রেই এ ধর্মের পারদর্শিতা বেশি বলে মনে হয়। নয়তো আজ অবধি এদেশের মানুষ শিবরাত্রির মতো একটি সম্পূর্ণরূপে পুরুষতান্ত্রিক অনুষ্ঠান ঘিরে এতখানিও উদ্বেল হয়ে উঠত না। এতখানিও উচ্ছ্বাস দেখাত না বোধহয়। একথা কেনই বা আমরা স্পষ্ট করে বলতে পারি না – অমরনাথের তুষারলিঙ্গ আদতে একটি অদ্ভুৎ সুন্দর ভৌগোলিক বিস্ময় বই তো নয়। ভূগোলের ভাষায় তাকে বরফের স্ট্যালাগমাইট হিসেবে ব্যাখ্যা করা চলে। সেটিকে অহেতুক একটি ধর্মস্থানে পরিণত করে, সেই জায়গার পরিবেশ ও জলবায়ুকে নষ্ট করে, আমরা লিঙ্গের উপাসনা করেছি। নারীকে বুঝিয়েছি শিবতুল্য স্বামীর লক্ষ্যই তোমার জীবনের পরম-লক্ষ্য হওয়া উচিত। শৈব-সাধনার নামে আমরা একদিকে পুরুষকে দিয়েছি উচ্ছৃঙ্খলতার বেলাগাম অধিকার (উত্তরপ্রদেশের কানওয়ার যাত্রার বিষয়ে পড়লেই যে কেউ এই বিষয়ে অবহিত হবেন) অন্যদিকে নারীকে শিখিয়েছি যুগযুগান্ত ধরে পুরুষের দাস হয়ে থাকা, শিবতুল্য স্বামীর ঘরণী হয়ে থাকাতেই তাদের একমাত্র মুক্তির উপায়। সেই দিনটিতেই এই বছরের নারী দিবস। বছরের এই দিনটিতে তাই সরাসরি এই উৎসবের বিরুদ্ধেই আওয়াজ তোলা জরুরি।

 

আজকাল খুব নিয়মনিষ্ঠ ভাবে প্রবন্ধের বিষয় সাজাতে পারি না। সময়ের অভাবে ভাষা অথবা চিন্তা অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে। তারই মধ্যে পথচলতি কুড়িয়ে নেওয়া ভাবনাতেই মনের বক্তব্য সাজাতে চাই। নারী দিবসের জন্য লিখতে লিখতে অধ্যাপিকা ঋতু সিংহকে মনে পড়ল। ডঃ ঋতু সিংহ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী। কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ে তিনি দিল্লির দৌলতরাম কলেজে সাময়িক সময়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। যথাযথ ইন্টারভিউ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁকে নির্বাচন করা হয়, এবং যে পদটির জন্য তিনি নির্বাচিত হন সেই পদটিও দলিত প্রার্থীদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। এরপর ২০২০ সালের আগস্ট মাসে কোনও কারণ ছাড়াই ঋতুকে সেই পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ঋতুর অভিযোগ দলিত হওয়ার কারণে শুরু থেকেই দৌলতরাম কলেজের অধ্যক্ষা, তিনিও একজন মহিলা – তিনি ঋতুর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আসছিলেন, এবং শেষ অবধি দলিত হওয়ার কারণেই তিনি ঋতুকে বহিষ্কার করেন। এই সময় ঋতু কলেজের বাইরে অবস্থান আন্দোলন শুরু করেন, কিন্তু অতিমারির কারণে দশ দিন পর তিনি সেই আন্দোলন তুলে নিতে বাধ্য হন। তার পরবর্তীতে ঋতু আদালতের দ্বারস্থ হন। তিনি জানান কোভিড-সময়ের সরকারি নিয়ম অনুসারে কোনও চুক্তিভিত্তিক, আংশিক সময়ের কর্মীকেও কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাই করা যাবে না বলে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল। তৎসত্ত্বেও ঋতুকে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই এভাবে বহিষ্কার করা হয়। মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ ৩৫জন ছাত্রের স্বাক্ষর-সমেত একটি অভিযোগপত্র আদালতের কাছে পেশ করে, যাতে ঋতু সিংহের অধ্যাপনা-পদ্ধতি নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। সেই চিঠির বয়ান অনুযায়ী, স্বাক্ষরিত ছাত্রেরা “তাঁর কাছে পড়তে না চেয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত করেছে” – এবং এমনই আরও কিছু ব্যক্তিগত অভিযোগকে সামনে এনে কলেজ কর্তৃপক্ষ ঋতু সিংহের বহিষ্কারের বিষয়টি আদালতের সামনে নিরপেক্ষ ও যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঋতু সিংহের আবেদন অনুসারে আদালতের তরফে বিশেষ তদন্তকারী দল দৌলতরাম কলেজে যায় এবং তারা দেখে সেই ৩৫ জনের নামে আদতে কোনও ছাত্রই দৌলতরাম কলেজে নেই। অর্থাৎ, সবদিক থেকেই কলেজ কর্তৃপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থনের নামে একটি আদ্যন্ত জাল নথি আদালতে জমা দিয়েছে। অথচ এর পরেও কিন্তু, আজ অবধি এই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। এই ২০২৪ -এও প্রতীকী প্রতিবাদ জানিয়ে অধ্যাপিকা ঋতু সিংহ সেই কলেজেরই সামনে পকোড়া বিক্রির দোকান দিয়েছেন। তবুও প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সামাজিক মাধ্যমেও সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে, এমনটাও বলা চলে না। এই মুহূর্তে যে বিয়ে অথবা বসন্তের মরসুমেই ‘দেশবাসী গা ভাসায়েছেন!’

 

সূত্রঃ https://maktoobmedia.com/india/because-i-am-a-dalit-a-teachers-battle-against-caste-bias/

 

তবুও তো ঋতু অথবা তাঁর স্তরের মানুষেরা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। দাবি-দাওয়া, আন্দোলন জারি রাখতে পারেন। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হতে পারেন, অন্ততপক্ষে চেষ্টা করতে পারেন। পরী, অথবা পিপলস আর্কাইভ অব রুরাল ইণ্ডিয়ার একটি রিপোর্ট এই লেখা তৈরির সময়েই চোখে পড়ে গেল হঠাৎ। রাজস্থানের কুশলগড় তেহসিলের ১৯ বছর বয়সী ‘দিয়া’র গল্প। জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে সেই ‘দিয়া’কে বিয়ে করে নেয় স্বামী রভি। তারপর শুরু হয় অত্যাচার। সেই অত্যাচারের বর্ণনা নতুন করে আর লিখতেও ইচ্ছে করে না। গার্হস্থ্য হিংসা, নারীর উপরে অত্যাচার, বস্তু হিসেবে নারীকে একক ভোগদখলের যে পাশবিক পুরুষ-প্রবৃত্তি, কত না বার, কতখানি নৃশংসতা, ও তদজনিত অস্বস্তির সঙ্গেই আমাদের তা দেখতে হবে? অনুভব করতে হবে? লিখতে হবে? নিবন্ধন করতে হবে? আমি জানি না। কেবল ১৬ থেকে ১৯ হয়ে উঠতে গিয়ে ‘দিয়া’কে যা দেখতে হয়েছে, অথবা, তারও পরবর্তীতে যখন জানতে হয়, দেশব্যাপী এমন ‘দিয়া’র সংখ্যা লাখ পেরিয়ে হয়তো বা কোটিরই কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতে পারে, সেই সম্ভাবনাও এতটুকুও অস্বাভাবিক নয় – কোথাও গিয়ে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে তখন নারীবাদ, নারীবাদী আন্দোলন, নারী দিবস, ইত্যাদি সমস্ত বিষয়কেই তুচ্ছের চেয়েও তুচ্ছ বলে ভাবতে ইচ্ছে হয়। রাশিতথ্যেরাই যে আরও বেশি করে আমাদের সত্যের সামনে দাঁড় করায়।

 

রাজ্যঃ রাজস্থান

 

মহিলাদের উপরে অত্যাচারের ঘটনায় রাজ্যগুলির মধ্যে সারা ভারতে স্থানঃ তৃতীয়

 

এমন অত্যাচারগুলির ক্ষেত্রে চার্জশিট জমা পড়ার খতিয়ানঃ মোট নিবন্ধীকৃত অপরাধের মাত্র ৫৫%এর ক্ষেত্রে চার্জশিট জমা পড়েছে, (দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন)

 

এবং,

 

জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া, অথবা এমন ভাবে অপহরণ করে গায়ের জোরে বিবাহে বাধ্য করা – এমন অপরাধগুলির ক্ষেত্রে তার দুই-তৃতীয়াংশই সরকারি ভাবে নিবন্ধীকৃত হয় না, কেবল গ্রামীণ সালিশি সভার পুরুষতান্ত্রিক মোচ্ছব-মঞ্চতেই এগুলিকে ‘সহজে মিটিয়ে ফেলা হয়’, অসামান্য কুশলতায়

 

সূত্রঃ https://ruralindiaonline.org/en/articles/in-banswara-domestic-ties-that-bind-and-gag/

 

এখনও বলব, ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এদেশের মানুষ, এদেশের নারী, শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াক। দুধ-ঘি-কিশমিশ-মাখন, পাথরের লিঙ্গে বিসর্জন না দিয়ে দেশের অভুক্ত নারীদের ক্ষুধানিবৃত্তির প্রয়োজনে ব্যবহার করুক। পাশ্চাত্য রেনেসাঁর পরিবর্তে আমরা যখন ধর্মীয় নবজাগরণকেই সামাজিক নবজাগরণ বলে মেনেছিলাম, সেই দিন থেকে আমাদের পশ্চাদপসরণের শুরু। সনাতন ধর্মবোধকে রক্ষা করতে চাইলে, আধুনিক হওয়া চলে না। অযৌক্তিক বৈপরীত্য আর বহুত্ববাদের সহাবস্থান এক জিনিস নয়। হয় আমাদের ধর্মকে বেছে নিতে হবে, নয়তো বেছে নিতে হবে আধুনিকতার রুক্ষ রাজপথটিকেই। নারী দিবসের পথচলা থেকেই বরং, আমরা সেই নির্বাচনের লক্ষ্যে দেশকে শিক্ষিত করতে চেষ্টা করি চলুন।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment