- 08 May, 2025
- 0 Comment(s)
- 66 view(s)
- লিখেছেন : পারমিতা মুখোপাধ্যায়
সোহিনী-অরিঞ্জয়ের বিয়ের পর অরিঞ্জয়ের বসের বাড়ীতে এটাই প্রথম পার্টি। বস্ বারবার ক’রে বলেছেন সোহিনীকে নিয়ে যেতে। অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের স্ত্রী বা স্বামীরাও আসছেন। শ্যাম্পেনের ফোয়ারায় উল্লসিত উদযাপন চলছে। সোহিনীর সঙ্গে বেশ সুন্দর আলাপ জমিয়ে নিলেন সকলেই। সোহিনীও মিশুকে মানুষ। ভালোই জমল। পার্টি প্রায় শেষের পথে। “স্যর্! এবার তাহ’লে আমরা আসি...” কথাটা শুনে বস্ তাকালেন অরিঞ্জয়ের দিকে। একবার সোহিনীকে দেখে নিয়ে অরিঞ্জয়কে বললেন “তোমার তো এখন মজাই মজা, অরিঞ্জয়! সব মজা নিজে ক’রো না। কিছু মজা আমাদের দিকেও পাঠিও!” ঠোঁটের কোণে হাসি। সে হাসির হিমশীতল স্রোত ব’য়ে গেল সোহিনীর শিরদাঁড়া বেয়ে। উপস্থিত বাকীদের চোখে মুখে তারিয়ে তারিয়ে মজা-দেখার উচ্ছলতা। অরিঞ্জয় থমথমে। নতুন চাকরি। সদ্য বিয়ে। বসের চটুলতায় না হাসা মানে তাঁকে অপমান করা। মুহূর্তে সামলে নিলেন বস্। অট্টহাস্যে ব’লে উঠলেন “আরে! ইয়ার্কিও বোঝো না?” হাসির ফোয়ারা ছলকে পড়ল ঘর-জুড়ে।
বুঝি! আমরা সব বুঝি! ইয়ার কী আর ইয়ার্কি --- সব বুঝি। জন্মের মুহূর্ত থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভেদে সক্কলকে সমাজ সমানভাবে শিখিয়েছে যে, মেয়ে আর মানুষ --- শব্দদ্বয়ের যতখানি দূরত্ব, মেয়ে আর মজা --- শব্দদ্বয়ের ততখানিই নৈকট্য। এ ব্যাপারে সমাজ বড়ই সাম্যবাদী। নারীকে নিয়ে কৌতুকের ধারণা আজকের নয়। সভ্যতার প্রগতি-বিমান যতদূরেই উড়ে যাক না কেন, নারীকেন্দ্রিক চটুল অসভ্যতার ‘প্রগতি’-র চেয়ে পিছিয়েই পড়েছে চিরকাল। আর এক্ষেত্রে শিক্ষার-ও সেভাবে কোনো অবদান নেই। প্রসঙ্গ যখন একটা মেয়েকে নিয়ে হাসি-মজার, তখন না-হাসাটাই পিছিয়ে-থাকার লক্ষণ কি না! আর, উচ্চপদস্থ ব্যক্তির রসিকতায় না-হাসা তো ঘোরতর আপত্তিজনক! তা সে রসিক ইঙ্গিত যতখানি নিম্ন রুচিরই হোক না কেন। তাছাড়া, শিক্ষার কথাই যদি ওঠে, তাহ’লে বলতে হয়, বোধ-হওয়ার আগে থেকেই সমাজ আমাদের মাথার কুঠুরিতে পুঁতে দেয় কিছু বস্তাপচা ‘শিক্ষা’। সে ‘শিক্ষা’ বুঝিয়ে দেয়, কখন কার কোন কথাটায় হাসা উচিত আর কোন কথাটায় নয়। বড় হওয়ার সাথে সাথে সেই বস্তাপচা ‘শিক্ষা’র সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই লাগে বটে চিন্তনের, বিবেচনাবোধের। আমরা বুঝতে থাকি, বুঝে-ওঠার-আগেই সমাজ যা যা বুঝিয়ে-রেখেছে তার সবটা ঠিক নয়। কিন্তু শেষে গিয়ে আবার সেই সমাজ-ই জিতে যায়। কর্মজগতের বা দলবদ্ধতার চাপে বুঝেও না-বোঝার ভান করতে শিখে যাই আমরা। যে হাসির কথায় হাসলে দলবদ্ধ জীব হিসাবে দলের কাছে নিজের মুখরক্ষা হয়, যে কৌতুকে নিজেকে ভাসালে নিজেকে সময়োপযোগী এবং তীক্ষ্ণধী প্রমাণ করা সম্ভব হয় --- সে হাসি যতই অন্যায় হাসি হোক না কেন, হাসতে হয়। সে অন্যায়ের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে বোধ, লুটিয়ে পড়ে বুদ্ধি, মাথা তোলার সুযোগ পায় না বিবেচনা।
সেদিন শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। অফিস টাইমের গড়পড়তা ভীড়। আমার একপাশে দু’জন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন, গায়ে ‘ভদ্র’লোকের পোশাক। কিছু একটা রসালো কথোপকথন চলছিল তাঁদের মধ্যে, মাঝপথ থেকে কানে এল ---
“ক” ‘ভদ্র’লোক “খ” ‘ভদ্র’লোককে বলছেন, “আমি তো গিন্নীকে বলেছি, তোমার ভয়ঙ্করী ছবি নিয়ে গিয়ে কর্পোরেশনকে দেখাব আর ব’লে আসব বাড়ীর সামনে বোর্ড টাঙিয়ে দিতে।“
“খ” ‘ভদ্র’লোক বুঝতে না পেরে বা না-বোঝার ভান ক’রে জিজ্ঞেস করলেন --- “কীসের বোর্ড?”
--- “কেন! বিপজ্জনক বাড়ী!”
দমফাটা হাসিতে ফেটে পড়লেন দু’জনেই।
দু’-একদিন আগেই একটা মাথা ব্যথার মলমের বিজ্ঞাপন দেখছিলাম। স্ত্রী স্বামীকে জানাচ্ছেন সারাদিনের কাজের চাপে তাঁর মাথা যন্ত্রণা করছে। স্বামীর প্রতিক্রিয়া “(যন্ত্রণা) ওপর থেকেই হবে নিশ্চয়ই! ভেতর থেকে (মাথা) তো খালি!” স্ত্রী বিরক্ত হ’য়ে বলছেন বাড়ীর (কাজের) চিন্তায় তাঁর ঘুম আসে না রাত্রে, স্বামী তুড়ি মেরে বুদ্ধি বার ক’রে বললেন “দারোয়ানকে তাড়িয়ে দিই? পয়সা বেঁচে যাবে!” প্রেক্ষাপটে বেজে উঠল বিকট হাস্যরোল। গোটা ভারতবর্ষের তীক্ষ্ণ দাঁত – তীব্র হাততালি মিছিল ক’রে যোগ দিল সে হাস্যরোলে, সে হাস্যরোল জাতপাতের বিভেদ করল না।
মেয়েদের হাসির খোরাক তৈরি করার কাজে মেয়েদের নিজেদের কি কম অবদান তা’বলে? এই তো সেদিন দেখলাম জনৈক সমাজমাধ্যম-তারকা তাঁর স্বামীর সঙ্গে মালদ্বীপে তোলা একটা ছবি পোস্ট করেছেন। ছবির নামকরণ করেছেন এরূপ --- “আমি ও আমার এ.টি.এম.”। ছবিতে অজস্র হা-হা, অজস্র লাইক। আলাদাভাবে চোখে পড়ল ছবির তলায় জ্বলজ্বল করছে আমার সুপ্রতিষ্ঠিত ‘স্বাধীনমনস্ক’ বন্ধুর মন্তব্য “একদম ঠিক। নিজের যতই থাক, বরের ঘাড় ভেঙে খরচা করার মজাই আলাদা।“
বি.এড. পড়ার সময় নানারকম প্রোজেক্টের সূত্রে দু’-চারটি বিদ্যালয়ে যেতে হ’য়েছিল কয়েকদিন ধ’রে। একবার এক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কক্ষে ঢুকে দেখি হাসির রোল পড়েছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে। অচিন্ত্য স্যর্ নবারুণ স্যর্-কে বলছেন, “তোমার মেজশালার তো ঐ কুচকুচে ছিরি, ওর এমন ফুটফুটে বউটা জুটল কী ক’রে বলো তো?” নবারুণ স্যর্ খিলখিলিয়ে ব’লে উঠলেন “কী ক’রে আবার, আমার মেজশালার অ্যাকাউন্টের ফুটফুটে টাকাগুলো দেখে!” গোটা ঘরে “কুচকুচে স্বামীর ফুটফুটে স্ত্রী” নামক মশলাদার যাত্রাপালার উল্লাস ছড়িয়ে পড়ল। সে উল্লাস লিঙ্গ-বয়স-ধর্ম কিছুই মানল না। শিক্ষার পরোয়া করা তো দূর অস্ত।
ফুলমামার বাড়ীতে সেদিন হঠাৎ এসে উপস্থিত হ’য়েছিলেন ওঁর পিসতুতো দাদা-বৌদিরা। ফুলমামী বেশ যত্ন-আত্তি ক’রে রান্নাবান্না করলেন। খেতে ব’সে কথায় কথায় ফুলমামী ব’লে ফেলেছেন তাঁদের কাজের লোক দু’দিন ধ’রে আসছেন না তাই তাঁরা দু’জনেই বাড়ীর কাজকর্মে ব্যস্ত থাকছেন। পিসতুতো দাদা মুহূর্তব্যয় না-ক’রে ফুলমামাকে জিজ্ঞেস করলেন “সে কী রে! তুই শেষে এত পড়াশুনো ক’রে হোম-মেড চাকর হ’লি?” হাসির উগ্রতায় কটকট করল ফুলমামীর কান। “আরে! বৌমা! রাগ ক’রো না যেন! একটু মজা করছি গো!”
আমাদের ভূগোল টিউশনের সহপাঠী ছিল সুমন। কলেজের প্রথম বছর। পাত সংস্থান (Plate Tectonic) পড়াচ্ছেন স্যর্। রিমিতার কোনো একটা জিনিস বুঝতে অসুবিধা হয়েছে, ও প্রশ্ন করছে একাধিকবার। তৃতীয় বার জিজ্ঞেস করতেই সুমন ব’লে উঠল “ওকে কেউ বোঝা এটা পাত্র সংস্থান নয়, পাত সংস্থান। ওর এটা বুঝে কিস্যু লাভ হবে না।“ অবাক হ’য়ে সেদিন দেখেছিলাম স্যরের গোঁফের আড়ালেও মুচকি হাসি।
পারিবারিক পরিসর থেকে সামাজিক অনুষ্ঠান, পাড়ার সেক্রেটারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বন্ধুবান্ধব থেকে কর্মক্ষেত্র --- নারীকেন্দ্রিক ঠাট্টা-তামাশায় আকৃষ্ট সকলেই। এই তামাশা যে আসলে নারীর জন্য কতখানি অমর্যাদাকর সে ‘বোধ’ নেই কারোর --- অনেক নারীরও না। এই ব্যঙ্গ চর্চায় বাদ পড়েন না ছায়াছবি বা সিরিয়ালের লেখক থেকে শিশু সাহিত্যিকরাও। বাদ পড়েন না রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে খেলোয়াড় --- কেউই। নইলে অতি জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা সস্ত্রীক টি.ভি.-র পর্দায় সাক্ষাৎকার দিতে এসে স্ত্রীয়ের সম্বন্ধে বলতে পারেন, যে, যখন দেখল হকিটা ওর দ্বারা হবে না তখন নাচতে শুরু ক’রে দিল।...?
নারীর বুদ্ধি, বিবেচনা, আচার-আচরণ, শারীরিক সমস্যা, সংসারে অবস্থান (তা সে উপার্জন করুন বা না করুন), ক্ষমতা-অক্ষমতা --- সবকিছু নিয়েই টক-ঝাল-মিষ্টি বিদ্রুপ সমাজের একটা বড় ব্যবসার মাত্রা পেয়ে এসেছে। শুধু ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে হেয় করার উৎসব নয়, প্রযোজকের ভাষায় “এসব করলে লোকে খায় বেশী”। মেয়ে মানেই মুখরোচক বিনোদন, মেয়ে মানেই চটুল খোরাক, মেয়ে মানেই সস্তা শরীরী চুটকি --- এই খোঁয়াড় থেকে বেরোতে আরও কত সুনীতা উইলিয়ামসকে আরও কত যুগ ধ’রে প্রমাণ দিয়ে যেতে হবে জানি না! অবশ্য সে কথাই বা বলি কী ক’রে, খোদ সেই সুনীতাও তো সমাজের খোরাক হওয়া থেকে বাঁচেন নি!!!
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment