- 24 July, 2022
- 0 Comment(s)
- 1002 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
হাস্যরসের ভেতর দিয়ে শ্রেণি-বিদ্বেষ, বর্ণ-বিদ্বেষ, জাতি-বিদ্বেষ ও লিঙ্গ-বিদ্বেষের বিষ সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। হাস্যরসে বিশেষ শ্রেণি, বর্ণ, গোত্র বা লিঙ্গের মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রে এইজন্য বৈষম্য ও বিদ্বেষ স্বীকৃতি পেয়ে যায়। অনেকেই এখন বর্ণ-জাতি বিদ্বেষ নিয়ে তৎপর হয়েছেন, কিন্তু লিঙ্গ-বিদ্বেষী অসহ্য রসিকতা নিয়ে কেউ তেমন প্রতিবাদ জানান না।
ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাদের জানিয়েছিলেন—
'বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’ বোরোলিন; বোরোলিনে ক্ষত সেরে যায়, তেমনি বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হাস্যরস, রঙ্গ-তামাশা, কৌতুক-মস্করা, রস আমাদের মনকে ফুরফুরে করে তোলে, কিন্তু এই তামাশা একসময় বিদ্বেষ ছড়ায়!
বৈষম্য ও বিদ্বেষ সমাজের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। উচ্চশিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত— সবাই অপরপক্ষকে নাকাল করে, হাসির খোরাক করে বড্ড আনন্দ পান! একদম ছোটতে জোলার বোকামির গল্প শুনতাম। তারপর একটা সময় সান্টা সিং বান্টা সিং খুব বিখ্যাত হয়েছিল। তখন সর্দারজি বলতে আমজনতা বুঝতেন বোকাচন্দ্রর। এই জল সুপ্রিমকোর্ট অবধি গড়িয়েছিল। এই ধরনের শ্রেণি বিদ্বেষ নিয়ে অনেকেই সোচ্চার হয়েছিলেন, ফলে সর্দারজিরা সে যাত্রায় পার পেয়ে গেছেন।
গবেষকগণ জানাচ্ছেন— হাস্যরসের ভেতর দিয়ে শ্রেণি-বিদ্বেষ, বর্ণ-বিদ্বেষ, জাতি-বিদ্বেষ ও লিঙ্গ-বিদ্বেষের বিষ সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। হাস্যরসে বিশেষ শ্রেণি, বর্ণ, গোত্র বা লিঙ্গের মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রে এইজন্য বৈষম্য ও বিদ্বেষ স্বীকৃতি পেয়ে যায়। অনেকেই এখন বর্ণ-জাতি বিদ্বেষ নিয়ে তৎপর হয়েছেন, কিন্তু লিঙ্গ-বিদ্বেষী অসহ্য রসিকতা নিয়ে কেউ তেমন প্রতিবাদ জানান না। ফলে রমরমিয়ে চলছে নারীদের হেয় করা। লকডাউনে নারীদের হেয় করে অনেক নারী বিদ্বেষী জোকস বেরিয়েছে। আমরা কেবল দেখে গেছি। নির্বোধ নারীগণ সেইসমস্ত কৌতুক বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভাগ করে নিয়েছেন। মাঝেমাঝে অদ্ভুত লাগে, নির্লিপ্ত থাকতে ইচ্ছা করে। আবার মনে হয় একটু সচেতন করতেই হবে ‘নির্বোধদের’। যাইহোক, পিতারা যে নক্সা তৈরি করে দিয়েছেন সেই পথে হাঁটতে খুব ভালো লাগে! কারো মনে প্রশ্ন জাগে না? ক্ষোভ তৈরি হয় না! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৌতুক সম্পর্কে জানিয়েছেন— ‘কৌতুক জিনিসটা কিছু রহস্যময়। জন্তুরাও সুখ-দুঃখ অনুভব করে, কিন্তু কৌতুক অনুভব করে না।’ একইভাবে যদি মন্তব্যের বিষয়টিকে উল্টে দিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করি তাহলে দেখব কৌতুকের রাশিরাশি হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে একরাশ মনস্তাপ।
আন্তর্জাতিক সংস্থা কাউন্সিল অফ ইউরোপ নারীর বিরুদ্ধে থাকা লিঙ্গ-বিদ্বেষ বন্ধের উদ্যোগ হিসেবে ‘সেক্সিজম : সি ইট, নেম ইট, স্টপ ইট’ শীর্ষক একটি অনলাইন বিবৃতি প্রকাশ করেছিল। সেই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সমাজে ‘সেক্সিজম’ অর্থাৎ পুরুষকে ‘শ্রেষ্ঠ’ এবং নারীকে ‘হীন’ ভাবে উপস্থাপন করার বিভিন্ন পন্থা রয়েছে। ছবি, কথা, ইশারা এছাড়া অনেকরকম ভাবে নারীকে হেয় করা হয়। কাউন্সিল অফ ইউরোপ 'সেক্সিজম’-কে ভয়ংকর হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। সংস্থাটি জানিয়েছে কৌতুকের ভেতর দিয়েও সেক্সিজম প্রকাশ পায়। আবার, কনভার্সেশান ডটকমে প্রকাশিত ‘সাইকোলজি বিহাইন্ড দি আনফানি কনসিকোয়েন্সেস অফ জোক্স দ্যাট ডেনিগ্রেট’ প্রবন্ধটিতে কৌতুকের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে যখন নেতিবাচক হিসাবে উপস্থাপন করে কৌতুক চলে তখন সেটিকে ‘ডিসপ্যারেজমেন্ট হিউমার’ বলা হয়। এ ধরনের মজাকে বৈষম্যের ধারক-বাহক মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কৌতুক-১
বিপদকে হাসিমুখে মোকাবেলা করুন! অনেকদিন পর স্ত্রী বাবার বাড়ি থেকে ফিরেছে। সেন্টু দৌড়ে গিয়ে উৎফুল্ল হয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালো। বউকে দেখে হাসি মুখে সেন্টু বলল—: শুভ গৃহ প্রত্যাবর্তন! স্ত্রী: কী ব্যাপার! এত হাসি-খুশি কেন? আমাকে দেখে তো এত খুশি হও না! সেন্টু: সকালে রাশিফলে দেখলাম, বিপদকে হাসিমুখে মোকাবেলা করুন!
কৌতুক-২
ভদ্রলোক: স্যার আমার বউ হারিয়ে গেছে।
ডাক্তার: এটা হাসপাতাল, আপনি পুলিশ স্টেশনে কমপ্লেন করুন।
ভদ্রলোক: আসলে আনন্দের চোটে মাথাটা কাজ করছে না।
কৌতুক-৩
প্রেমিক: মাত্র পনের দিন হলো আমাদের পরিচয় হয়েছে। আমাকে কতটুকু জানো যে, বিয়ে করতে চাইছ?
প্রেমিকা: যা জানার ঠিকই জানি, আমি যে ব্যাংকে চাকরি করি, সেখানে তোমার ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে না!
কৌতুক-৪
ঈশ্বর মেয়েদের সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন যাতে পুরুষ তার প্রেমে পড়ে, আর মেয়েদের নির্বোধ করে সৃষ্টি করেছেন যাতে তারা পুরুষের প্রেমে পড়ে।
কৌতুক-৫
১ম বন্ধু: উফ্ বাজার করা, রান্না করা, কাপড়-চোপড় ধোয়া, ঘর পরিষ্কার— এত কাজ একা করতে পারছিলাম না। তাই বিয়েটা করেই নিলাম।
২য় বন্ধু: এত কাজ আমিও একা করতে পারছিলাম না, তাই ডিভোর্সটা দিয়েই দিলাম।
কৌতুক-৬
দেবদূত: আপনি কি বিবাহিত?
১ম ব্যাক্তি: হ্যাঁ
দেবদূত: আপনাকে স্বর্গে পাঠানো হল। কারণ, পৃথিবীতে আপনি যথেষ্ট নরক ভোগ করে এসেছেন।
২য় ব্যাক্তি: হ্যাঁ, দুবার বিয়ে করেছিলাম।
দেবদূত: আপনাকে নরকে পাঠানো হবে। কারণ, আপনি নরকবাসে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
কৌতুক-৭
চুম্বকের সাথে মেয়েদের পার্থক্য হল, চুম্বকের অন্তত একটা পজিটিভ দিক থাকে।
এই কৌতুকগুলো আমাদের কি বলছে? সাধারণত এই কৌতুকগুলো বোঝাচ্ছে—
ক) বিয়ে মানেই ভয়ংকর। নারীরা কলহ প্রিয়, তাই বাড়িতে সকল অশান্তি তারাই সৃষ্টি করে ।
খ) নারীদের গৃ্হস্থালী কাজ করতে হবে, পুরুষেরা করলে সেটা তাদের কাছে শাস্তি ।
গ) নারীরা নির্বোধ, অর্থ লোভী। শাড়ি,গয়না, সম্পত্তি তাদের প্রিয়।
ঘ) কৌতুকগুলোতে নারীদের এতটা অসহনীয় হিসাবে উপস্থাপন করা হয় । তাদের মৃত্যুকামনা করেও হাস্যরস সৃষ্টি করা হয়!
ঙ) মেয়েদের বুদ্ধি নিয়ে উপহাস করা হয়। নারীর শরীর নিয়ে মজা করা হয়।প্রায়শই কৌতুকগুলোতে মোটা ও রোগা মেয়েদের শ্রীমতী ভয়ংকরী হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। অর্থাৎ- এই ধরনের নারীরা ভ্যাম্প কিংবা অতি নির্বোধ।
প্রসংগত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাস্যরস নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তারমধ্যে একটি এইরকম—
রবীন্দ্রনাথ সদলবলে বেড়াতে গিয়েছেন। সঙ্গে নির্মলকুমারী মহলানবিশ, তাঁর স্বামী এবং আরো অনেকে। একদিন সবাই মিলে গেছেন কেনাকাটা করতে, খানিক পরে রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করলেন নির্মলকুমারী নানা দোকান থেকে নানা সাইজের আবলুশ কাঠের হাতি কিনছেন। গুরুদেব নির্মলকুমারীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার, এত হাতি কিনছ কেন?’
নির্মলকুমারী লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘তিনি (প্রশান্ত মহলানবিশ) এ ধরনের হাতি পছন্দ করেন।’
রবীন্দ্রনাথ তো রসিক মানুষ। স্থূলকায়া শ্যামা নির্মলকুমারীর দিকে চেয়ে তিনি মজা করে বললেন, ‘এতক্ষণে বুঝতে পারছি প্রশান্তর কেন তোমাকে এত পছন্দ!’
নারীদেরকে পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত করা হয়েছে।
এবার আসা যাক পুরুষদের প্রসঙ্গে। সমস্ত মাতাল পুরুষ নিয়ে হাস্যরস তৈরি হয়েছে। আজ অবধি কোন মাতাল নারীদের নিয়ে কৌতুক হয়নি। পুরুষরা মদ খান মানে সাত খুন মাপ। আবার পুরুষদের পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক কৌতুক পরিবেশন করা হয়। তারাপদ রায় জানিয়েছিলেন— দুনিয়াতে সব হাসির গল্প মদ ও মাতাল নিয়ে। আবার রম্যসাহিত্যে মাতালদের পেলবতার প্রলেপে জড়িয়ে, অত্যন্ত উদারতার মোড়কে মুড়িয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রায়ই রসিকতার শিকার হতে হয়। তাদের লক্ষ্য করে পুরুষ সহকর্মীরা ‘নোংরা কৌতুক’ বলে খুব মজা পায়। এতে নারী সহকর্মীটির মনে কী প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না।
কয়েকজন কর্মজীবীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। সেখানে কেট (ছদ্মনাম) নামে একজন এক্সেকিউটিভ পুরুষ সহকর্মীদের ইঙ্গিতপূর্ণ নোংরা কৌতুকে অতিষ্ঠ হয়ে চাকরিই ছেড়ে দিয়েছেন। একদিনের একটি ঘটনা বর্ণনায় কেট বলেন— তিনি লাল হিল জুতা পরে অফিসে গিয়েছিলেন। তার একজন বস কৌতুকের ছলে বুঝিয়েছিলেন কীভাবে কেট ‘বিশেষ অন্তর্বাস’ না পরেই অফিসে এসেছেন। এখানেই শেষ নয়। বারংবার তাকে এমন সব যৌন উসকানিমূলক রসিকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আরেকবার কম্পিউটারে প্লাগ ঢুকানোর সময়ও একজন সিনিয়রের ইঙ্গিতপূর্ণ কৌতুক শুনতে হয়েছে।
কেট জানতেন এটা নিছকই মজা করার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। পুরুষের মধ্যে বারবার যখন একটা মেয়ে হাস্যকৌতুকের উপলক্ষ্যে পরিণত হয় তখন আর কত সহ্য করা যায়! কেটও পারেননি। চাকরি ছেড়ে আসার সময় মানবসম্পদ বিভাগে তিনি এটাও জানিয়েছিলেন— কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের কৌতুক তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। (তথ্যসূত্র: বিবিসি)
আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্য এমনভাবে প্রবেশ করেছে আমরা বেশিরভাগ সময় বুঝতে পারি না, বৈষম্য আসলে কীভাবে হচ্ছে কখন হচ্ছে। আমাদেরকে মুক্তির পথ বেছে নিতে হবে। প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হবে। কখন নারীদের হেয় করা হচ্ছে এমন কৌতুকে প্রশয় দেওয়া যাবে না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, এই একই কষ্টের অংশীদার যাতে না হয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এবার নারীদের উদাসীনতার খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে—
Searching for freedom
Slowing down time
There's more that I feel
Deep in my bones
Hidden in me, there's reasons I know
I've been searching for freedom (Ziggy Alberts)
পুনঃপ্রকাশ
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী
ছবি: সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment