বিপর্যয় ও উত্তর ২৪ পরগনার দিনমজুর মেয়ে

  • 06 June, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1030 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
দৈনিক রোজগারের তাগিদে বহু মেয়ে পাশের জেলাগুলো থেকে কলকাতায় আসেন। প্রতিদিন যাতায়াত করেন তাঁরা। লকডাউন তাঁদের মুখের খাবার কেড়েছে। এতদিন ঘর আগলে লকডাউন ওঠার অপেক্ষায় ছিলেন। আমফান এসে ঘরটাও শেষ করে দিল। এখন শুধুই হাহাকার।

'নিউ নরমাল', সম্প্রতি আমরা পরিচিত হয়েছি এই শব্দটির সঙ্গে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় নতুন স্বাভাবিক। এই নতুন স্বাভাবিক জগতে সব কিছুই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে! চারিদিকে এত সমস্যা! কোভিড-১৯ এর মধ্যে বিষফোঁড়ার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ হানা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে বাংলা-ওড়িশা কে।

পশ্চিমবাংলা এমনিতেই পিছিয়ে পড়া রাজ্য, লকডাউনের ফলে যে অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল, কৃষির উপর নির্ভর করে হয়তো খানিকদূর সুরাহা হতো, কিন্তু আমফানের জেরে তছনছ হয়ে গেছে দক্ষিণবঙ্গের ফসল। চারিদিকে ধ্বংসের চিহ্ন। গৃহহীন-খাবারহীন মানুষের হাহাকার চারিদিকে।

কেবলমাত্র, উত্তর ২৪ পরগণার প্রায় ৪০৯৫ স্কোয়ার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আমফানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার ২২টি ব্লক, ২৫টি পুরসভা এবং একটি কর্পোরেশন এলাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে। প্রশাসনের হিসেবে শুধু এই জেলাতেই ৪০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। সাড়ে চার লক্ষ বাড়ি নষ্ট হয়েছে। ( তথ্যসূত্র:এইসময়, ২৪/০৪/ ২০)

বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলা। তবে অদ্ভুত ভাবে সুপার সাইক্লোন আমফানের খবর 'হিন্দুস্থান মিডিয়া' দায়সারা ভাবে দেখিয়েছে।বাংলার বাইরের মানুষ আজকেও জানেন না, কি হয়েছিল বাংলায়। গতকাল মহারাষ্ট্রে 'নিসর্গ' নামক সাইক্লোন যখন হয়, তখন একজন মহিলা টুইট করেন- 'Mumbai is the only City in the World having to face both #Corona & #Cyclone. I am confident we will tide over both. Ganapati BappaMorya!! এই টুইটকে কেন্দ্র করে বিস্তর বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যিনি টুইটার ব্যবহার করেন, তিনি এতটা অজ্ঞ কি করে! তিনি কেন বাংলার খবর জানেন না! এ ধরনের অনেক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়েছেন। তবে এই দায়ভার পুরোপুরি মিডিয়ার। কিছুদিন আগে বলিউড অভিনেত্রী করিনা কাপুর আমফান বিধ্বস্ত এলাকার একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছিলেন, 'আমাদের ভাবতে হবে।’‌ হ্যাশট্যাগ দিয়েছিলেন 'নো মিডিয়া কভারেজ’, ‘প্রে ফর বেঙ্গল’।  বেশিরভাগ 'হিন্দুস্থান মিডিয়া' বিধ্বস্ত বাংলার খবর দেখায় নি, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বিতর্ক এখন অব্যাহত।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমফান কে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণা করতে বলেছিলেন। ২২ মে দিল্লিতে একটি বৈঠকে, উনার বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে বাইশটি বিরোধী রাজনৈতিক দল সোচ্চার হন। আমফান তার তাণ্ডব চালিয়ে বিদায় নিয়েছে। তারপর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে বিপত্তি বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছিলেন ত্রাণ বিলি করার সময় যেন  কোথাও অসৎ উপায় অবলম্বন না করা হয়। তাঁর ভাষ্যমতে, 'এক পয়সাও যদি এদিক ওদিক হওয়ার অভিযোগ ওঠে আমি DM-কে ধরব৷ আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, আমি ছেড়ে কথা বলব না। কড়া অ্যাকশন নেব। (তথ্যসূত্র : এইসময়, ২৪/০৪/ ২০)

তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই সতর্কীকরণকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কে জানে! বিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে এখনও অভিযোগ করা হচ্ছে কেউ পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ পাচ্ছেন না। পাঁচ হাত ঘুরে জিনিস আসছে, ফলে অর্ধেক নিয়ে সন্তুষ্ট হতে হচ্ছে। প্রথমে করোনা, তারপর আমফানের কবলে পড়ে কি দুরবস্থা হয়েছে, সে কথা বর্ণনাতীত। এই দুঃসময়ে প্রচণ্ড কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন অসহায় মহিলারা। করোনাভাইরাস ও আমফানের ফলে নারী ও পুরুষ সবার জীবিকাকেই বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে, নারীর ওপর এর প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়। আমফান, করোনার প্রভাবে মূলত জর্জরিত হয়ে পড়েছেন দুস্থ নারীরা। তাঁরা জানেন না কোথায় গেলে সাহায্য পাবেন! মাথার উপরের ছাদ চলে গেছে, কাজ চলে গেছে, পেটের ভাত নেই, পরনের কাপড় নেই। ‘নেই’ -এর কবলে পড়ে তাঁরা দিশাহারা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, করোনার জন্য অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে নারীদের পরিণতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে। লকডাউন কালে নারী নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। এমনকি তাদেরকে মজুরি চাওয়ার অপরাধে মালিকদের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছে।

গ্রামে কাজ করে উপার্জনের মুখ দেখতে পেতেন না বলে শহরে কাজ নিয়েছিলেন রওশনআরা (নাম পরিবর্তিত )। চব্বিশ পরগণার সীমান্ত গ্রামে তাঁর বাসস্থান ছিল। লকডাউনের ফলে নিরুপায় হয়ে তাঁকে গ্রামে ফিরতে হয়েছিল। আমফান তাঁর শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিয়ে চলে গেছে। তাঁর ঝুপড়ি ঘর ভেসে গেছে। এখন তিনি স্থানীয় স্কুলে বরয়েছে। তিনকুলে কেউ নেই,  এখন তাঁর বেঁচে থাকার বাসনা চলে গেছে। আগে গ্রামে লোকের বাড়ি মুড়ি ভেজে দিন গুজরান হতো। এখন তিনি জনে জনে বলছেন-কে দেবে কাজ! কি হবে এ ভাবে বেঁচে থেকে। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন সুলতা (নাম পরিবর্তিত)। এক মেয়ে মারা গেছে বছর খানেক আগে। স্বামী কর্কট রোগে আক্রান্ত। ওঁর বাসস্থান ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সীমান্ত এলাকায়। লকডাউনের আগে কলকাতায় কাজ করতেন। কাকভোরে লোকাল ট্রেনে করে কলকাতা আসতেন, দিনশেষে বাড়ি ফিরে যেতেন। তিনিও উদাস গলায় জানালেন,- যদিওবা করোনা বিদায় নিলে কাজ জোটে, দিন শেষে ফেরার জায়গাটা আর রইলো না! আদৌও মাথাগোঁজার আর ঠাঁই হবে কিনা জানিনা !

বছর আঠাশের মায়মুনার (নাম পরিবর্তিত) অবস্থাও তথৈবচ। ঝড়ে তাঁর বাড়ি ভেঙে গেছে। বছর দশেকের ছেলেকে নিয়ে তাঁর বাস চব্বিশ পরগণার সীমান্ত এলাকায়। মা, ছেলে লকডাউনের আগে হোটেলে রান্নার কাজ করতেন। এখন কাজ নেই,পয়সা নেই, ছাদ নেই। এখন অন্যের সাহায্যে দিন কাটছে। জবার (নাম পরিবর্তিত ) স্বামী লকডাউনের আগে রিকশা  চালাতেন, এখন অসুস্থ হয়ে আছেন। জবা লোকের বাড়িতে কাজ করতেন, এখন সব পাট চুকেছে। ঝড়ের তাণ্ডবে সব গেছে। ইদানীং স্বামী, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে গ্রামের স্কুলে আছেন।  জানেন না, আগামী দিনে কি করবেন!

দুস্থ নারীরা বুঝতে পারছেন না আবার কবে তাঁরা স্বাবলম্বী হবেন। মূলত তাদের কাজ ছিল শহরকেন্দ্রিক। করোনার ফলে শহরাঞ্চলে কবে আবার তাঁরা যেতে পারবেন জানেন না। এই বিপর্যয়ের সময় সরকার থেকে নারী উন্নয়ন লক্ষ্যে কোন প্রকল্প গঠন করা হয় নি। সরকার দিল্লির মসনদে বসে একের পর এক অপরিমাণদর্শিতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে, আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করছি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আমফানের ফলে রাজ্যে প্রায় লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পরিস্থিতি দেখতে রাজ্যে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আকাশপথে বাংলার ধ্বংসস্তূপ তিনি দেখেছেন। এরপর,পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্যকে হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার ঘোষণা করেন। তিনি স্বচক্ষে পরিস্থিতি দেখে, গুরুত্বপূর্ণ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো তাই প্রধানমন্ত্রী কে অনুরোধ জানাতে হচ্ছে, তিনি যেন,পরবর্তী কোন বিপর্যয়ে বিমানের জানলায় বসে প্রকৃতি দেখতে না যান-

“... উঁচু থেকে তুমি দেখতে পাও মাইল মাইল শূন্যতা

প্রকৃতির নিয়ম ও নিয়মহীনতার সর্বনাশা মহিমা

নতুন জলের প্রবাহ, তেজে স্রোত-যেন মেঘলা আকাশ উল্টো

হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীতে

মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন বাড়ি ও কাণ্ডহীন গাছের পল্লবিত মাথা

ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে

বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ, কী সুন্দর!”

 

ছবি: প্রতীকী

লেখক অধ্যাপক ও সমাজকর্মী

0 Comments

Post Comment