- 19 May, 2020
- 0 Comment(s)
- 938 view(s)
- লিখেছেন : শাম্মা বিশ্বাস
শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষ তৈরি করতে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। প্রাচীনকালে বলা হত ‘গুরু সাক্ষাৎ পরম ব্রহ্ম’ অর্থাৎ যে গুরু সামনে বিরাজমান তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মার আসন লাভ করেছেন। যদিও এসব এখন কথার কথা। শিক্ষক হেনস্তা থেকে শিক্ষক পেটানো সবই এখন আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। কিন্ত শুধু কি স্কুল কলেজের শিক্ষকদের হেনস্তা করা হয়? যাঁরা গৃহশিক্ষক তাঁদের হেনস্তা করার কথা আমরা জানতেও পারি না। দিনের পর দিন অপমান সহ্য করে মুখ বুজে তাঁদের হেনস্তার শিকার হতে হয়। শিক্ষার্থী-গৃহশিক্ষক, অর্থাৎ যাঁরা নিজেরা এখনও শিক্ষার্থী (ছাত্র-ছাত্রী) কিন্তু পড়াশোনা চালানোর জন্য বা হাত খরচ চালানোর জন্য যাঁরা গৃহশিক্ষকতা করেন তাঁদের অবস্থা বড়ই করুণ। এই সমস্ত গৃহশিক্ষকদের বড় অংশই কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, তার ওপর তাঁদের বয়স তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায়, টিউশন বাড়িতে তাঁদের কদরও কম। মাইনে নিয়ে সমস্যা, ছুটি নিয়ে সমস্যা—এই সব লেগেই থাকে।
করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় লকডাউনের জন্য এইসব গৃহশিক্ষকদের চরম অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়েছে। আমার এক বন্ধু বাড়ির বাইরে, শহরে থেকে পড়াশোনা করে। নিজের দৈনন্দিন খরচের পাশাপাশি নিজের পড়াশোনার খরচ টিউশনির মাস মাইনে থেকেই চালায়। লকডাউনের জন্য এখন সে ঘরবন্দি, এমনকি দেশের বাড়িতেও যেতে পারেনি। গাড়িঘোড়া বন্ধ। পায়ে হেঁটেও সম্ভব নয়। তার টিউশন বাড়ি এখন বলছে যেহেতু সে পড়াতে যেতে পারছে না তাই তার মাইনেও বন্ধ থাকবে। যে মাস থেকে পড়ানো শুরু হবে সেই মাস থেকে আবার মাইনে পাবে। ঠিক যেন দৈনিক ক্ষেত মজুর বা শ্রমিক। যে কদিন তুমি কাজ করবে সে কদিনের টাকা পাবে। কিছু শতাংশ টাকা স্কুল, কলেজের শিক্ষকদেরও হয়ত কাটা হতে পারে। কিন্তু বহু গৃহ শিক্ষকদের পুরো মাইনেটাই কেটে নিচ্ছেন ।
রুমা (নাম পরিবর্তিত), আমার এক বন্ধু এরমধ্যে একদিন ফোন করেছিল। কথায় কথায় রুমা জানালো— টিউশন তো বন্ধই, এমনকি অনলাইনে ক্লাস নিতেও নাকি রাজি নয় তার এক শিক্ষার্থীর মা। কারণ তাতে নাকি ছেলে কিছুই বুঝবে না। এদিকে কিন্তু স্কুল থেকে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। ছেলে ক্লাসও করছে। আসল কথা হল আমার এই বন্ধুকে তার ছাত্রের মা বলেছিলেন, তাকে তো অটো ভাড়া করে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে হচ্ছে না। বাড়িতে বসেই ক্লাস নিতে পারবে, তাই মাইনে যদি সে কিছু কম নেয়। বন্ধু রাজি না হওয়ায় তার টিউশনটাও চলে যায়। এইরকম অযৌক্তিক, অমানবিক কত কিছুই হচ্ছে। আমরা সবটা জানতেও পারছি না।
অন্যদিকে শিক্ষার্থী-গৃহশিক্ষক ছাড়াও প্রচুর মানুষ রয়েছেন যাঁরা গৃহশিক্ষকতা করেই সংসার চালান। মায়ের ওষুধের টাকা, পরিবারের খাবার, বাড়ি ভাড়া এমন নানান খরচ হয়তো ওই মাইনে থেকেই দিতে হয়। এখন তাঁরা ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতেও লজ্জা পাচ্ছেন, রোজগারের ন্যায্য টাকা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। পূর্ব মেদিনীপুরে এক উচ্চশিক্ষিত ছেলে চাকরি না পেয়ে কোচিং সেন্টার খুলেছিলেন। লকডাউনে সেটিও বন্ধ এখন। পেটের দায়ে তিনি এখন সব্জি বিক্রি করছেন। লকডাউন কবে খুলবে, আবার কবে তাঁর কোচিং সেন্টার শুরু হবে, ভাইরাসের ভয়ে বাবা-মায়েরা তাঁদের ছেলে-মেয়েদের আবার পাঠাবেন কিনা কোচিং সেন্টারে তাঁর জানা নেই।
এরমধ্যে কিছুটা ভাল খবরও আছে। পান্ডবেশ্বরে গৃহশিক্ষকদের করুণ অবস্থার জন্য তাঁদের পাশে দাঁড়ালেন সেখানকার বিধায়ক। তিনি দুশো জনেরও বেশি গৃহশিক্ষকদের হাতে আর্থিক সাহায্য তুলে দিয়েছেন। কিন্তু সেটা কদিনের জন্য? এই টাকা শেষ হলে তখন কী হবে? লকডাউন পর্যায়ক্রমে বেড়েই চলেছে। এই অসহায় গৃহশিক্ষকদের কী অবস্থা হবে তা কারও জানা নেই। করোনা-কালের লকডাউনে প্রকট হচ্ছে, বিত্তে বাস করা আপাত শিক্ষিত অনেক মনের অন্ধকার দিক। গৃহশিক্ষকদের জন্য তৈরি পাক্কা হিসেবে তাঁদের সন্তানরা কী শিখবে? ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত শিক্ষকরাই বা সেই সব পরিবারের সন্তানদের কীভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াবেন? তবে মানু্ষই তো পারে শত কষ্ট, বাধাকে জয় করে আবার স্বমহিমায় দাঁড়াতে। আদর্শ মানুষ তৈরির কারিগররা লকডাউনের অন্ধকারে হারিয়ে যাবেন না, আমার বিশ্বাস।
প্রতীকী ছবি।
লেখক শিক্ষার্থী-গৃহশিক্ষক, সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment