- 10 October, 2023
- 0 Comment(s)
- 1617 view(s)
- লিখেছেন : নন্দিনী জানা
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ‘লাভ জিহাদ’ বা ‘প্রেম জিহাদ’ নামে একটি শব্দ বন্ধের সঙ্গে আমরা সম্যক পরিচিত। পাঁচ বছর আগেও যার অস্তিত্ব সেভাবে ছিল না, তাই নিয়ে আস্ত আইন তৈরি হয়ে গেল ভারতের অন্যতম জনবহুল একটি রাজ্যে, যেখানে জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ মুসলমান। ‘লাভ জিহাদ’ কিন্তু ভালবাসার জন্য জেহাদ ঘোষণা নয়। ‘লাভ জিহাদ’-এর অর্থ হল মুসলমান পুরুষ ‘লাভ’ বা ভালবাসার অভিনয় করে হিন্দু নারীকে ফুসলিয়ে বিয়ে করে প্রধানত ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য। উদ্দ্যেশ্য, ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি যা নাকি এক বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ, ধর্মের জন্য জিহাদ। গত নভেম্বরে, উত্তরপ্রদেশে বেআইনি ধর্মান্তরকরণ বন্ধ করার জন্য আইন পাশ হয়েছে যাতে বলা হয়েছে ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীকে বিয়ে করার জন্য জেলাশাসকের কাছে দু মাস আগে একটি নোটিস দিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট আইনী কর্তৃপক্ষ আগে খতিয়ে দেখবেন ধর্মান্তরকরণ বা তাতে কোনও প্রকার জোর খাটানো হচ্ছে কিনা। যদি সংশ্লিষ্ট পুরুষটি দোষী সাবস্ত্য হন তাহলে তা জামিন অযোগ্য অপরাধ এবং তার সাজা হল ১০ বছরের কারাদণ্ড। যদিও এতে কোনও বিশেষ ধর্মের উল্লেখ নেই, মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনেই বিশেষ করে অ-মুসলমানকে বিয়ে করতে গেলে ধর্মান্তরিত করতে হয়। গত বছর এই আইনটি পাশ হওয়ার পর থেকে বেশ কিছু মুসলমান পুরুষকে উত্তর প্রদেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে বিজেপি শাসিত মধ্য প্রদেশ রাজ্যেও ধর্মীয় স্বাধীনতা বিল পাশ করা হয়েছে যার উদ্দেশ্যও মোটামুটি একই। মুসলমান জনসংখ্যা এমন বিয়ে হওয়ার ফলে ঠিক কত বেড়েছে তা সঠিক জানা যাচ্ছে না যদিও, কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ এবং ঘৃণা ছড়ানোর কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। তার প্রমাণ, বিখ্যাত গয়না প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘তনিষ্ক’-এর মুসলমান পরিবারের হিন্দু বৌমার সাধভক্ষণ বিজ্ঞাপনে দেখানো নিয়ে আপত্তি, নিন্দার ঝড় এমনকি শোরুম ভাঙচুরের ঘটনা। তাতে শেষ পর্যন্ত ‘তনিষ্ক’ বিজ্ঞাপনটি দেখানো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল। অর্থাৎ, ধর্মান্তরকরণ হল কি হল না, সেটা মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। একটি মুসলমান পরিবারে হিন্দু বৌ— তা কোন মতেই বরদাস্ত করা হবে না। এবং তা একবিংশ শতকের ভারতে। বস্তুত, ফুঁসলিয়ে বিয়ে করার এই তত্ত্বে ধরেই নেওয়া হয়েছে যে মেয়েরা অসহায়, নির্বুদ্ধি, নিজস্ব ভালমন্দ বিচারে অক্ষম জীব। তাদের নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তারা অপারগ। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ, নিজের ইচ্ছেমত জীবন কাটাবার স্বাধীনতা এখানে ধর্তব্যের বিষয়ই নয়।
শিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষ নিজের পছন্দে বিয়ে করতে গেলে অনেক সময়ই পারিবারিক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়, সেখানে এই ধরনের একটি আইন থাকলে তার সুবিধা নিয়ে বাড়ির অমতে বিয়ে সহজেই বন্ধ করা যায়। বাস্তব হল, ভারতে এখনও ৯০ শতাংশেরও বেশি বিয়ের পাত্র-পাত্রী ঠিক করে তাদের পরিবার। সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ম তো দূরস্থান, জাতি-কোষ্ঠী-গোত্র মিলিয়ে বিয়ে করারই রেওয়াজ। তা সত্ত্বেও, যবে থেকে মেয়েদের বিয়ের বয়স একটু করে বেড়েছে, মেয়েরা শিক্ষিত হতে শুরু করেছে, নিজেদের মতামত জানাতে পেরেছে তখন থেকেই কোনও কোনও মেয়েরা নিজেদের জীবনসাথী নিজেরা পছন্দ করা শুরু করেছে। এ ভাবেই বিধবা-বিয়ে, অসবর্ণ বিয়ে, এমনকি আন্তঃ-ধর্ম বিয়েও তার জায়গা করে নিয়েছে। নারী-পুরুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বৃদ্ধির সঙ্গেই এর যোগ। আধুনিক কালে বঙ্গদেশে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে এ ধরনের বিয়েতে অগ্রগণ্য ছিলেন ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের নারীপুরুষ। তবে যে পরিমাণে বিধবা-বিবাহ বা অসবর্ণ বিবাহ হয়েছিল, তার তুলনায় আন্তঃ-ধর্ম বিয়ের সংখ্যা নগণ্য। ইতিহাস ঘেঁটে দেখে নেওয়া যাক অতীতের এমন কিছু বিয়ের নজির যাতে প্রমাণ হয়ে যায় যে ভালবাসা বা প্রেম অনেক মহৎ ও উদার এক অনুভূতি, সত্য হল আদপে তা সঙ্কীর্ণতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে। খাঁটি প্রেমের ক্ষেত্রে যে ধর্ম কোনও বাধ সাধতে পারেনি তার প্রমাণ এই ধরনের বিয়েতে অনেক দম্পতিই তাঁদের নিজেদের ধর্মের আচার-আচরণ পালন করেন বিবাহিত জীবনেও। আসলে, ভালবাসা ও সহিষ্ণুতা এবং পারস্পরিক সম্মানের মধ্যে দিয়েও যে কাছে টেনে নিয়ে অনেক বড় যুদ্ধ জয় করা যায়, তা বর্তমান ঘৃণার বাতাবরণে আমরা ভুলতে বসেছি। তাই ঘুরে তাকানো যাক অতীতের দু’একটি ঘটনার দিকে। যে বাস্তব আমাদের দেশে উপস্থিত রয়েছে, তাকে অদৃশ্য করার চেষ্টার বিপরীতে গিয়ে ঘুরে তাকানো যাক সেই অতীতে যখনও এই ধরনের বিয়ে হতো এবং যা এখনো হয়ে থাকে।
১৯২৫ সালের ২৪শে এপ্রিল আন্তঃ-ধর্ম বিয়ে করেছিলেন বিখ্যাত কবি ও সংগীতকার, ‘বিদ্রোহীকবি’ কাজী নজরুল ইসলাম। বর্ধমানের চুরুলিয়ায় জাত নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্য ও সঙ্গীত প্রতিভা, বাগ্মীতা, অমায়িক স্বভাব এবং ব্যতিক্রমী জীবনচর্যায় জয় করে নিয়েছিলেন বহু মানুষের মন। পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। কুমিল্লার বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর পরিবারের সঙ্গে তাঁর যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল তার ফলেই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন বীরেন সেনগুপ্তর খুড়তুতো বোন আশালতা ওরফে প্রমীলার সঙ্গে। ১৯২১-এ তিনি এই পরিবারের অতিথি স্বরূপ থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আশালতা ও তাঁর মা গিরিবালা দেবী নজরুলকে সেবা শুশ্রূষা করে ভাল করে তোলেন। এই সময় থেকেই বালিকা প্রমীলার মনে রেখাপাত করেছিলেন নজরুল এবং এই পরিবারের সঙ্গে তাঁর প্রীতির সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছিল। ধীরে ধীরে নজরুলের প্রতি প্রমীলার প্রেম, প্রীতি ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়। ইতিমধ্যে তিনি কলকাতা থেকে ‘ধূমকেতু’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন এবং এই পত্রিকায় প্রকাশিত লেখালেখি থেকেই তিনি রাজরোষে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তারি বরণ করেন। একবছর পরে কারামুক্ত হলে প্রমীলার মা তাঁর কন্যার সঙ্গে নজরুলের বিয়ে দেবার জন্য তৎপর হন। কিন্তু বাধ সাধলো ধর্ম। বীরেন্দ্রনাথের মা বিরজাসুন্দরী ও বাবা ইন্দ্রকুমার এই বিয়ের বিরোধী ছিলেন সম্ভবত সামাজিক রোষের ভয়েই। অত ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও বীরেন্দ্রনাথ চাইলেন নজরুল ‘শুদ্ধি’ করে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করুন, অথবা ব্রাহ্মমতে রেজিস্ট্রি বিয়ে করুন। অন্যদিকে, নজরুল এর কোনওটি করতেই রাজি হলেন না, উপরন্তু সমন্বয়বাদী এই কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিক মানুষটি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে তিনি বা তাঁর হবু স্ত্রী কারুরই বিয়ে করার জন্য ধর্ম পরিবর্তন করার দরকার নেই। কিন্তু, এতে আপত্তি জানালেন মোল্লারা, এমন বিয়ে দিতে রাজী হলেন না কোন মৌলভী। শেষে নজরুলের বন্ধু মুসলমান ধর্ম শাস্ত্রে পণ্ডিত মৌলভী মৈনুদ্দিন হোসেন এক উপায় বাতলে দিলেন যে ‘আহলে কিতাব’ বা যে ধর্মে অপৌরুষেয় ধর্ম গ্রন্থ আছে তাঁদের মধ্যে বিবাহ ইসলামে স্বীকৃত। ফলে দুটি মানুষ যারা ইতিমধ্যে বাঁধা পড়েছেন ভালবাসার বন্ধনে, তাঁদের বিয়ে দিলেন মৌলভী মৈনুদ্দিন হোসেন। প্রমীলার মা গিরিবালা দেবী আগাগোড়া এই বিয়েতে মেয়ের পাশে ছিলেন, কিন্তু বীরেন সেনগুপ্ত বা অন্য হিন্দু আত্মীয়রা কেউ খুব উপস্থিত ছিলেন না ৫ নং হাজী লেনের বিবাহ মণ্ডপে। এই বিয়ে মুসলমান মতে দেনমোহর করে সম্পাদিত হয়েছিল। বীরেন সেন সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বিয়েতে তাঁর অমত এবং এজন্য তিনি খুড়িমার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের কথা জানিয়েছিলেন। গিরিবালা দেবী প্রত্যুত্তরে তাঁর বিবৃতিতে জানান যে— ‘দুইটি হৃদয়ের মধ্যে অকপট ও অকৃত্রিম প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছে জানিয়া আমি তাহাদের বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ করিয়া দিতে প্রস্তুত হইয়াছি। মিলনাকাঙ্ক্ষা যেখানে অন্তরের অন্তস্থল হইতে উদ্বুদ্ধ, ধর্মগত পার্থক্যের জন্য সেখানে পশ্চাদপদ হওয়া আমি বিবেচনা করি নাই’। বাস্তবিক, এই বিয়ে যেখানে বর কনের নিজস্ব ধর্মমত এবং স্বাতন্ত্র রক্ষিত হয়েছিল, তা খুবই সুখের হয়েছিল। স্ত্রীর ডাকনাম ‘দোলন’ বা ‘দুলি’র নামে কবি নজরুল ভালবেসে ‘দোলনচাঁপা’ নামে এক কাব্যগ্রন্থ রচনা করে উৎসর্গ করেছিলেন স্ত্রীকে। ধীরে ধীরে বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে।
১৯২৮ সালে আন্তঃ-ধর্ম বিয়ে করেছিলেন অরুণা গাঙ্গুলী ও আসফ আলি। অরুণার জন্ম ১৯০৯ সালের ১৬ই জানুয়ারিতে যুক্ত প্রদেশের কালকা-তে। আদতে পূর্ববঙ্গের বরিশালের মানুষ, উপেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী এবং তাঁর স্ত্রী অম্বালিকা দেবী ছিলেন প্রবাসী বাঙালী ব্রাহ্ম যারা যুক্ত প্রদেশে রেস্তোরাঁ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অরুণার কাকারাও ছিলেন স্বনামধন্য মানুষ— ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী যিনি প্রথম যুগের বিখ্যাত বাঙালী চলচ্চিত্র-নির্মাতা এবং নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট জামাতা (মীরা দেবীর স্বামী)। অরুণা গাঙ্গুলীই পরবর্তীতে হয়েছিলেন বিখ্যাত নেত্রী অরুণা আসফ আলি যিনি বিশেষত ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত। উদারচেতা বাবা মায়ের সান্নিধ্যে অরুণা উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছিলেন প্রথমে লাহোরের স্যাক্রেড হার্ট কনভেন্টে এবং পরে নৈনিতালের অল সেন্টস কলেজে। এরপর তিনি কলকাতায় গোখলে মেমোরিয়াল স্কুলে চাকরি নেন। এই পর্বেই এলাহাবাদে তাঁর পরিচয় হয় বিখ্যাত ব্যারিস্টার এবং তৎকালীন কংগ্রেস পার্টির নেতা আসফ আলির সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেম এবং পরিণয়। ১৯২৮ সালে এই বিয়েতে অমত ছিল অনেকেরই। ধর্ম ছাড়াও বয়সের ব্যবধানও ছিল বাধা স্বরূপ। অরুণার তখন মাত্র ১৯/২০ আর আসফ আলি তাঁর থেকে প্রায় তেইশ বছরের বড়। বিয়ের সময়ে অরুণার বাবা আর জীবিত ছিলেন না। কাকা নগেন্দ্রনাথ যিনি নিজেকে অরুণার অভিভাবক বলেই মনে করতেন, তিনি এই বিয়েতে এতই মর্মাহত হয়েছিলেন যে বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনদের তিনি বলেছিলেন, ‘ও আমার কাছে মৃত, আমি ওর শ্রাদ্ধ করলাম’। কিন্তু অরুণা আসফ আলির রাজনৈতিক তথা জনজীবন এই বিয়ের পর অন্য মাত্রা পেয়েছিল। তিনি স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস রাজনীতিতেই শুধু সক্রিয় হয়েছিলেন তাই নয়, তাঁর স্বাধীনচেতা, নির্ভীক মনোভাব তাঁকে ১৯৪২ সালের আন্দোলনের অবিসংবাদী নেত্রী করে তুলেছিল। এ সময়ে যখন সব নেতারাই প্রায় জেলে বন্দী তিনি একাই আত্মগোপন অবস্থা থেকে পত্রিকা, পুস্তিকা প্রকাশ প্রভৃতি কাজের মধ্যে দিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। বিবাহ বরং এই দম্পতির উত্তরণ ঘটিয়েছিল। স্বাধীন ভারতে অরুণা আসফ আলি হয়েছিলেন দিল্লীর প্রথম নির্বাচিত মেয়র।
শিক্ষা জগতে এবং বাংলার রাজনীতিতে স্বনামধন্য হুমায়ুন কবীর এবং শান্তিলতা দাসের বিয়ে একদা আলোড়ন ফেলেছিল। খান বাহাদুর কবিরুদ্দিন আহমেদের পুত্র হুমায়ুন কবীরের জন্ম ১৯০৬ সালে। তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্ম হৃদয়প্রকাশ দাস আর অশোকলতা দাসের কন্যা মেধাবী ছাত্রী শান্তিলতা দাসের পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এ পড়াকালীন ১৯২৪ সালে। কবীরও ছিলেন স্কুল কলেজ থেকে ডাকসাইটে ছাত্র। আদতে ফরিদপুরের মানুষ কবীর বি এ-তে ইংরাজী অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন ও শান্তি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। আশ্চর্যজনক ভাবে এম এ-তেও তাঁদের এই অসাধারণ ফল বজায় থাকলো। এরপর, কবীর উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ গেলেন আর তেজস্বিনী শান্তি সেই সময়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবল ঘূর্ণিতে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন। ১৯৩০ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় গড়ে ওঠা নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সম্পাদিকা হলেন শান্তি দাস আর সহ সভানেত্রী তাঁর মা অশোকলতা। শুধু, গান্ধীজী পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন নয়, অচিরেই কলকাতায় নারী-পরিচালিত আন্দোলনগুলির প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তিনবার তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৩২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের অভ্যর্থনা কমিটির তিনি সম্পাদিকা হয়েছিলেন। তারপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি খানিক শান্ত হয়ে এলে এবং কবীর ১৯৩২ সালের শেষের দিকে দেশে ফিরলে তাঁদের বিয়ে হয়। গান্ধীজীরও সমর্থন ছিল তাঁদের বিয়েতে। তবে এই বিয়ের প্রাক্কালেও কম জল ঘোলা হয়নি। শোনা যায়, হবু বর ও কনে দুজনেরই বাবাদের এই বিয়েতে ততো মত ছিল না। এমনকি, সে সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রে এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি বেরিয়েছিল। সরলা দেবীর নেতৃত্বে বেশ কিছু শিক্ষিত মহিলা এই বিয়ের বিরুদ্ধে তাঁদের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু, এই বিয়ের সপক্ষে কনের মা অশোকলতা যে সাহসিকতা ও মানবিকতা বোধের পরিচয় দিয়েছিলেন তা অতুলনীয়। ১লা অগ্রহায়ণ, ১৩৩৯ সালে তিনি বঙ্গবাণী পত্রিকায় যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে জানিয়েছিলেন, “...কেবল মুসলমান বলিয়া, আমি যদি এই নির্মল চরিত্র যুবাকে প্রত্যাখ্যান করি, তবে যে আমার অধর্ম হয়”---“ঈশ্বর এক, তাঁর ধর্মও এক, পার্থক্য কেবল বাহিরের আড়ম্বর। বাহ্য আচার ব্যবহারের পাঁচিলগুলি ভাঙ্গিয়া ফেল। দেখিবে সব একাকার...”।
স্বাধীন ভারতে ১৯৫৬ সালে বিশেষ বিবাহ বিধি বা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট পাশ হলে এ ধরনের বিয়ে করার পথ কিছুটা মসৃণ হয়েছিল। কিন্তু, তবুও আন্তঃ-ধর্ম বিয়ে জনপরিসরে আগের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছিল, এমনটা নয়। আরেক বিখ্যাত বাঙালী দম্পতি যারা আন্তঃ-ধর্ম বিয়ে করেছিলেন তারা হলেন গৌরী আয়ুব ও আবু সয়ীদ আইয়ুব। গৌরীর জন্ম ১৯৩১ সালে পাটনায়। জন্মসূত্রে গৌরী দত্তের পারিবারিক শিকড় ছিল পূর্ববঙ্গের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ময়মনসিংহে। গান্ধীবাদী পিতা ধীরেন্দ্রমোহন দত্ত এবং মা নিরুপমা দেবীর সাহচর্যে আদ্যন্ত পাটনায় বেড়ে ওঠা মেধাবী গৌরী দর্শনে বি এ পড়তে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যান ১৯৫০ সালে। ইতিপূর্বে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি ছাত্র-রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে কদিন কারাবরণ করলে, তাঁর বাবা বিশ্বভারতীতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এখানে তাঁর অধ্যাপক ছিলেন প্রবোধচন্দ্র সেন, ক্ষিতিমোহন সেন, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, আবু সয়ীদ আয়ুব প্রমুখ। দর্শনের অধ্যাপক আবু সয়ীদের পড়ানোর প্রতি মুগ্ধতা থেকে তাঁদের মধ্যে হৃদ্যতা তৈরি হয়। ক্রমশ তাঁরা পরস্পরের খুব কাছাকাছি চলে আসেন। আয়ুব গৌরীর চেয়ে বয়সে ২৫ বছরের বড় হলেও এক গভীর ভালবাসায় জড়িয়ে পড়েন দুজনে। ১৯৫২ সালে বি এ পাশ এবং ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেন গৌরী। এম এ ক্লাসেও তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল গৌরীর। তিনিও ছাত্রী এবং ভালবাসার পাত্রীর কাছে উজাড় করে দিয়েছিলেন জ্ঞানের ডালি। আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতে, ‘দু’জন মানুষের ভালবাসা যদি কিছু সার্থক ইন্টারেস্টকে ঘিরে পরিণতি লাভ করে, তাহলে সে ভালবাসা সার্থক হয়, এবং দিনে দিনে পূর্ণতর হয়ে ওঠে। নইলে শুধু ভালবাসার জন্য ভালবাসা যেন শিকড় কেটে দেওয়া গাছের মতো আস্তে আস্তে শুকিয়ে সংসারের ঊষর জমিতে ক্রমে হারিয়ে যায়।’ গৌরীও এর সমর্থনে বলেছেন, ‘তাঁর সাহচর্য আমার জীবনকে এমন ফলবান করে তুলেছিল যে তার ভিতর দিয়েই আমরা পরস্পরকে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারছিলাম।’ ১৯৫৬ সালে বাড়ির অমতে তিনি বিয়ে করেন বিখ্যাত এই দর্শনের অধ্যাপক ও সাহিত্য সমালোচককে। বাবার সমর্থন না থাকলেও মেয়ের বিয়ের জন্য সঞ্চিত টাকা তিনি গৌরীকে দিতে চাইলে, আত্মাভিমানী গৌরী তা নিতে অস্বীকৃত হন। বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কের এখানেই ইতি। তাঁদের রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়েছিল আয়ুবের ৫ নম্বর পার্ল রোডের বাড়িতে। এই বিয়ের সময়ে গৌরী ২৫ আর আবু সয়ীদ ৫০। কিন্তু তাঁদের যৌথ জীবনে ধর্ম বা অসম বয়স কোন প্রতিবন্ধকতা হয়নি, দুজনেই তাঁরা স্পর্শ করেছেন নানা শিখর। ভবিষ্যৎ জীবনে গৌরী আয়ুব শুধু ডাকসাইটে শিক্ষক বা সফল লেখক হয়েছিলেন তাই নয়, বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য আজীবন লড়াই করে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এক ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় দাঙ্গার সময়ে তিনি এবং আরো কয়েকজন বুদ্ধিজীবী মিলে গড়ে তুলেছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য পরিষদ। শুধু বক্তৃতা নয়, সমাজসেবার মধ্যে দিয়ে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মেলামেশার মাধ্যমে তাঁদের মধ্যেকার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বাধাগুলি অপসারণের চেষ্টা করেছিলেন জীবনভর। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শরণার্থীদের প্রতি সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
এমন অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দুয়েকজন বিখ্যাত মানুষের কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরলাম মাত্র, কিন্তু ভালবাসা ধর্ম-জাতির সীমাকে অতিক্রম করতে পারে। তাই হিন্দু পরিবারে বিয়ে হওয়া মুসলমান নারী সোমাইয়া আখতার নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়ে লিখতে পারেন, “একে অন্যের ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার খেলা এখানে চলে না”... “দুটি পরিবারে যখন বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি হয়, তখন সেখানে হিন্দু-মুসলমান থাকে না, আত্মীয় হয়ে যায়”। তাছাড়া, মেয়েদের নিজের পছন্দে করা বিয়ে, প্রেমজ বিয়ে অনেক সময়ই পরিবারতন্ত্র এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তাদের মানুষ হিসেবে স্বকীয় বোধের পরিচয়। পারিবারিক অনুশাসনকে উপেক্ষা করে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে মেয়েদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাকে তা মান্যতা দেয়। শতাব্দী প্রাচীন কাল থেকে পিতৃপরিবার ও গোষ্ঠী নারীর ওপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে চলে তারই নগ্ন রূপ মেয়েদের নিজেদের পছন্দে করা বিয়েতে বাধাদান। এর একটা উল্টোপিঠ হল, কোনও মেয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে না চাইলে পরিবার ও আত্মীয়বর্গের এ নিয়ে মাথাব্যথার শেষ থাকে না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মেয়েদের ইচ্ছেকে সম্মান জানাতে জানে না। তাই অন্য ধর্মের প্রেমিককে ভালবেসে বিয়ের অর্থ হল ফুঁসলিয়ে বিয়ে। আবার বিবাহিত নারী যে শুধু বিবাহ সূত্রে ধর্ম নয়, তার গোত্র, পদবী, অনেক ক্ষেত্রে পরিবার থেকে দেওয়া নাম, ঠিকানা সব কিছুই বদলাতে বাধ্য হন, তাতে এই পিতৃতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের কোনও আপত্তি নেই। সমাজ ব্যবস্থায় জাতপাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভেদকে সযত্নে পালন করার এক উপায় হল বিয়ে। সুতরাং, পাত্র-পাত্রীর নিজের পছন্দের বিয়েতে এই সামাজিক বর্গগুলি অতিক্রম করার চেষ্টা হলে তাতে পরিবারের সম্ভ্রম নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। তাই নাকি ‘পরিবারের সম্মান’ রক্ষার্থে নিজের হাতে তিল তিল করে অতি যত্নে বড় করা কন্যার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করতে এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে সাম্প্রতিক ভারতে তাকে হত্যা করতেও আটকায় না পরিবারের লোকেদের। একই কারণে, বিবাহিত হিন্দু নারীর ধর্ম বদলে গেলেই তা ‘লাভ জিহাদ’। বর্তমানে দিল্লীতে আন্তঃ-ধর্ম বিয়ে নিয়ে কাজ করে চলা বেসরকারি সংস্থা ‘ধনক’-এর এক কর্ণধার আকাঙ্ক্ষা শর্মার কথায়— “মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার আছে, সরকার পছন্দ করার অধিকার আছে, কিন্তু জীবনসাথী পছন্দ করার অধিকার নেই।”
তথ্যসূত্রঃ
শৈলসুতা দেবী, পরিণয়ে প্রগতি
গৌরী আইয়ুব, আমাদের দুজনের কথা ও অন্যান্য
আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ১৪ই অক্টোবর, ২০২০
মুজফফর আহমেদ, কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা
পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
লেখক : অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক
ছবি ঃ প্রতীকী
0 Comments
Post Comment