বৈধব্যে বিজয়ী মহারাষ্ট্র

  • 21 June, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 425 view(s)
  • লিখেছেন : সর্বাণী গুহ ঘোষাল
মহারাষ্ট্রের স্থানীয় শাসনস্তরে গৃহীত নতুন আইন বিধবাদের সামাজিক মর্যাদা পুনঃস্থাপনের একটি সক্রিয় উদ্যোগ। শুধুমাত্র পাঁচশো- হাজার টাকা হাতে গুঁজে বিধবাভাতার নামে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলির বিজ্ঞাপনবিলাসী জনকল্যাণ প্রকল্পের সঙ্গে হেরওয়াড পঞ্চায়েতে গৃহীত নীতির মূলগত তফাৎ রয়েছে। এ যেন উপর থেকে ছুঁড়ে দেওয়া দয়ারদান নয়, একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে হাতটি ধরে পরিবর্তনের আশ্বাস। আর তাই এটা সমস্ত মহিলা সমাজের কাছে স্বাগত এক উদ্যোগ।

গত পয়লা মে, ২০২২ মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলার হেরওয়াড গ্রামে ঘটে গেল এক গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক যৌথ উদ্যোগে সমকালীন ভারতে যে অতি অল্প জনকল্যাণমুখী কাজ হয় এটি সেরকমই একটি। ১৮৫৬ সালে বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ আইন আর তারও আগে ১৮২৯ রাজা রামমোহন রায় বহু লড়াই করে যে সতীদাহ নিবারণ আইন পাশ করান, বলা যায় হেরওয়াড পঞ্চায়েতের গৃহীত আইন সেই প্রকল্প সমূহের  যোগ্য উত্তরসূরি। 

 

হেরওয়াডের মানুষরা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে আইন গড়ে বিধবা জীবনে হিন্দু শাস্ত্র মোতাবেক পালনীয় রীতিনীতি গুলিকে অবিলম্বে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। মহারাষ্ট্রের মহা বিকাশ অগাধি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে হেরওয়াড ও পরবর্তীতে মনগাঁও গ্রাম পঞ্চায়েতে গৃহীত এই সদর্থক নীতিটিকে রাজ্যের সমস্ত গ্রামে বাধ্যতামূলক করার নীতি ঘোষণা করেছে। 

 

মেয়েদের অবমাননার তীর্থভূমি ভারতীয় সমাজে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবচেয়ে শোষণ- বঞ্চনার শিকার প্রশ্নাতীত ভাবে বিধবারা।  আর হিন্দু সমাজের মেয়েদের স্বামী মারা যাওয়া মানেই যেন মেয়েটির মেয়ে জীবনে এক কলঙ্ক, এক পাপের সংযোজন। সমাজ তুরন্ত ফণা তুলে তার খাদ্যাভ্যাস থেকে পরিধান, সামাজিক মর্যাদা থেকে অর্থনৈতিক অধিকার সমস্ত কিছুকে, এক বিরাট "না" এর নাগপাশে বেঁধে ফেলে। চারপাশে এক নিঃসীম  অন্ধকার "করতে নেই" এর জাল বিছিয়ে যায়। 

 

এই পর্যন্ত পড়েই অনেক স্বঘোষিত প্রগতিবাদী হয়তো হাসতে শুরু করেছেন। ভাবছেন আমরা সংস্কৃতিবান বাঙালি জাতি। এসব রক্ষণশীলতা আমরা প্রায় দুশো বছর আগে কাটিয়ে এসেছি। আমাদের এখানে বিধবাদের কোনো বিশেষ শোষণ অথবা পৃথকীকরণের শিকার করা চলেনা। আরে আমরা বাঙালিরাই তো সারা দেশকে চেনালেম বিধবাদের অধিকারের কথা! 

 

কিন্তু এই ভাবনাটা কি পুরোদস্তুর সত্যি? একটু নিজের অন্তরঅন্দরে তাকান তো। ভাবার চেষ্টা করুন তো বিজয়াদশমীর দিনে দুর্গা বরণ করতে গরদের শাড়ি পরে সিঁদুর সন্দেশের থালা হাতে মণ্ডপে যাবার সময় আপনি কি পাড়ার বিধবাদের কোনো একজনকেও সঙ্গী হতে ডেকেছেন? সংখ্যা গরিষ্ঠ ডাকেন নি, শুধু তাই নয়, প্রয়োজন বোধ বা সৌজন্যবোধ থেকেও ডাকেননি। কারণ আপনার বিবেক সেই ডাক দেওয়াকেই  পাপ ভাবিয়েছে। তার শরিক তাই আপনি হতে চাননি। খুব সচেতন ভাবে বিধবা মেয়েটিকে যন্ত্রণা দিতে যে আপনি চেয়েছিলেন, তা নয়। বরঞ্চ সদ্যবিধবা কনিষ্ঠ কারোর মুখোমুখি হয়ে হয়তো আপনি কষ্টই পেয়েছেন,তাই চোখাচুখিটুকুও এড়িয়ে গেছেন। আসলে পিতৃতান্ত্রিক বৈধব্য যাপনের নিয়মগুলো এত গভীর ভাবে প্রোথিত আপনার ভিতর, তাকে অতিক্রম করার ভরসা আর পাওয়া হলো না। লজ্জা পাবেন না। কারণ ডাক পেলেই বিধবা কন্যাটি যে আসতো, তার নিশ্চয়তাও নেই। কারণ সে নিজেও যে এই পাপ-পুণ্যের জগতে থমকে আছে। 

 

টেলিভিশনের পর্দায় পরম আগ্রহ নিয়ে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির স্পনসর করা পুজোয় পেশাদার অভিনেত্রীদের  সিঁদুরখেলার রঙিন সমাবেশ যখন মুগ্ধবিস্ময়ে দেখেন, সেখানে কোনো বিধবা অভিনেত্রীকে দেখলে পাশের জনকে বলেননি, "আরে ওর তো বর মরে গেছিলো না! দ্যাখ কিরকম সিঁদুর খেলছে নেচে নেচে"! বেরিয়ে আসে মুখ থেকে এধরনের কথাগুলো সচেতনে, অবচেতন ফুঁড়ে। তখন ভুলে যান সেলিব্রেটি অভিনেত্রীটি পেশার তাগিদে ঐ কাজটি করছেন অথবা তার ইচ্ছে/পছন্দের স্বাধীনতাকে (right to choice) মান্যতা দেওয়া আমাদের কর্তব্য। 

 

আমার নিজের বিয়ের কথা বলতে পারি। বড়পিসি আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বড়, চিরকাল পরিবারের যে কোনো অনুষ্ঠানে পুজোপাঠের দিক সামলানোর দায়িত্বে থাকা মানুষ। আমার বিয়েতে বড়পিসির হাতদিয়েই সমস্ত পুজো সারা হলো, আনন্দনাড়ু তৈরি থেকে বিয়ে দিলোও বড়পিসি। ঘটনাটা যে বিশেষ সামাজিক স্বাভাবিকতাকে ভেঙেছে সেটা টের পেলাম পরের দিন বরেদের বাড়ি ঢুকে। শুরুর হট্টমেলা কাটিয়ে ও বাড়ির প্রথম ঘণ্টাতেই বড় ননদ আর মাসি শাশুড়ি বেশ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এসে আমাকে বললেন, "তোমার বড়পিসিকে ভারি সৌম্য দেখতে জানো তো। তোমাকে খুব ভালোবাসেন না, বোঝা যাচ্ছিল। আচ্ছা তোমার পিসেমশাই কবে মারা গেছেন? কি হয়েছিল? কটি ছেলেমেয়ে ওঁদের?" এইসব হাবড়জাবড় প্রশ্নের পর এলো আসল বাণখানা। "আচ্ছা তোমাদের বাড়িতে আর লোকজন ছিল না, উনি কেন বিয়ে দিলেন? তোমার বাবা জ্যেঠা নয় কেন?  একে মেয়েমানুষ, তারপর বিধবা!" প্রশ্নের ধারা কোনদিকে যাচ্ছে বুঝে আমিও প্রস্তুত ততক্ষণে। সোজা বলে দিলাম আমাদের বাড়ির সব বিয়েশাদি, সত্যনারায়ণ ইত্যাদি সব বড়পিসির হাত দিয়েই হয়। যা একদম সত্যি। পিসেমশাই থাকা না-থাকা সব সময়েই। আসলে আমাদের বাড়িতে তো কেউ এতটা  আপনাদের মত গোঁড়া- কুসংস্কারছন্ন নেই, তাই এই প্রশ্নই ওঠেনি কোনোদিন। (যতটা উদার পরিবেশে বড় হয়েছি, তাকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলাম defense technique হিসেবে) নতুন বউয়ের মুখে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার মোটেই "সেকেলে" কি "কুসংস্কারছন্ন" তকমা পেতে ভালোবাসে না, তাই সে পর্যায়ে কথাটা থেমে গেল। কিন্তু বিষয়টা পরিবারের আনাচে কানাচে রয়েই গেল। 

 

আসলে রামমোহন-বিদ্যাসাগরকে নিজস্ব সম্পত্তি মনে করা, বেঙ্গল রেনেসাঁর গর্বে গর্বিত বাঙালি ভুলে গেছে ইতিহাস বইয়ের বাইরে নিজেদের  দৈনিক জীবনচর্যায় এসব প্রাতঃস্মরণীয়দের  অবদান। এঁদের শিক্ষাকে জীবনের পথে মোটেই আমল দিতে স্বচ্ছন্দ নয় একবিংশ শতকের বাঙালি। 

১৮৫৭ বিদ্রোহের পর আর একটাও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংস্কারের ধারায় সে সামিল হয়নি।

 

এই পর্যায়ে ব্রিটিশ শাসকও উপনিবেশে সামাজিক সংহতি বজায় রাখার তাগিদে আর সমাজ সংস্কার, বিশেষত মেয়েদের অবস্থান পাল্টানোর কোনো সক্রিয় উদ্যোগ নেয়নি। রক্ষণশীল নবশিক্ষিত বাঙালি পুরুষসমাজও মেয়েদের সীমিত পুঁথিগত শিক্ষার অধিকার দিয়ে পিতা-স্বামী- ভাইদের স্বদেশীয়ানা বা সাহেবিয়ানায় সহযোগী করেই প্রগতির রথে ব্রেক কষা সমীচীন মনে করেছে। মেয়েদের স্বতন্ত্রতার স্বীকৃতিতে বাঙালি পুরুষ কোনোকালেই আদৌ  সহজ নয়। 

১৮৯১- র সহবাস সম্মতি বিতর্কে বাঙালির তাণ্ডব সর্বজনবিদিত আজ। অথবা স্বাধীনতার পরে পঞ্চাশের দশকে হিন্দু কোড  বিতর্ক আর আশির দশকে শাহবানু বিতর্কও চোখে আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করে দেখিয়েছে দেশিয় সমাজের চোখে আর রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের চোখে মেয়েদের প্রশ্ন কতটা পুরুষতন্ত্রের মর্জি সাপেক্ষ। একই সঙ্গে বিবাহিত নারীর জয়গানে নিমজ্জিত বাঙলা, তথা ভারতীয় মুনাফা ভিত্তিক সংস্কৃতির দুনিয়া, শাঁখাসিঁদুরের অলীক মায়ার আবরণে মেয়েদের উপরে ঘটা যাবতীয় শোষণ বঞ্চনাকে এক মায়াকাজল মাখা চোখে দেখিয়ে সমাজমনকে অনন্ত অবদমনে রাখার কৌশলী প্রয়াসে প্রায় সম্পূর্ণ সফল আজ। আর তাই হেরওয়াডের ঘটনা বাংলায় যোগাযোগের ছাপানো, বৈদ্যুতিন কি সামাজিক মাধ্যমে ব্রাত্য বা পিছনের সারির খবর হয় মাত্র। 

 

এই সবকিছুর নিরিখে অবশ্যই মহারাষ্ট্রের স্থানীয় শাসনস্তরে গৃহীত এই নতুন বিধবাদের আইন অত্যন্ত জরুরি। নিয়মটির তাৎপর্য আরো বড় কারণ এটি বিধবাদের সামাজিক মর্যাদা পুনঃস্থাপনের একটি সক্রিয় উদ্যোগ। শুধুমাত্র পাঁচশো- হাজার টাকা হাতে গুঁজে বিধবাভাতার নামে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলির বিজ্ঞাপনবিলাসী জনকল্যাণ প্রকল্পের সঙ্গে হেরওয়াড পঞ্চায়েতে গৃহীত নীতির মূলগত তফাৎ এখানেই। আর তাই এটা সমস্ত মহিলা সমাজের কাছে স্বাগত এক উদ্যোগ। জনকল্যাণের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কল্যাণে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তার সামাজিক মর্যাদা অটুট রাখা আবশ্যিক সেটা আজকের রাজনীতিকদের "দিলাম" " করলাম " বুলির দাপটে গুলিয়ে দেয় কার টাকা কে দিল! প্রচলিত ধারায় জনগণকে  বোড়ে করে "গ্রহীতা" নির্মাণের বহু বিজ্ঞাপিত ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের পঞ্চায়েত স্তরে সাধারণের মধ্যে থেকে উঠে আসা এই নীতিকে তাই অনেকটা বেশি সমবেদনা তাড়িত ভাবতে ইচ্ছে হয়। এ যেন উপর থেকে ছুঁড়ে দেওয়া দয়ারদান নয়, একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে হাতটি ধরে পরিবর্তনের আশ্বাস। 

 

এবার আশা যাক কিছু শঙ্কার আলোচনায়। বিধবা উন্নয়নের এই মারাঠি উদ্যোগটি যথেষ্ট সাধুবাদ যোগ্য হলেও এর প্রয়োগ বিধি নিয়ে কতগুলো অস্বস্তি থেকেই যায়। প্রথম প্রশ্ন ওঠে অনুপ্রেরণা তৈরির জন্যে মনগাঁওর সরপঞ্চের ঘোষণাটি নিয়ে। সরপঞ্চ বলেছেন যে সমস্ত পরিবারে বিধবাদের জঘন্য সামাজিক অনুশাসন থেকে মুক্তি দেওয়া হবে তারা এককালীন পাঁচ হাজার টাকা অনুদান পাবে। ভয় হয় গার্হস্থ্য হিংসায় অন্যতম শীর্ষ স্থানাধিকারী ভারতে না আবার নতুন একটা হিংসার ফর্ম নির্মাণ করে ফেলে এই ঘোষণার সুবাদে। এছাড়াও  বিধবারা পুনঃ বিবাহ করলে তাদের বিশেষ সরকারি আর্থিক সহায়তার কর্মসূচিও ঘোষিত হয়েছে। এই সব কিছুই নারীর নিজস্ব ইচ্ছার বিরোধী হয়ে উঠবে নাতো!  তাদের এজেন্সি গড়ে ওঠায় নতুন বাধা জমবে নাতো! 

 

সবশেষে উল্লেখ করবো হেরওয়াড গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যা সন্ধ্যারানী যাদবের কথায়। এই মহিলা বিধবাদের মর্যাদা পুনঃস্থাপন আন্দোলনের অন্যতম সেনানী। সন্ধ্যার ভাষায় বৈধব্যের যাপন মেয়েদের বড় মনোবলহীন করে তোলে। প্রিয় বিচ্ছেদের চেয়েও বৈধব্যযাপনের রীতিনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি দুর্বল করে তোলে মেয়েটিকে। আর সাম্প্রতিক অতিমারি কালে মহারাষ্ট্রের প্রতি গ্রামেই দারুণ ভাবে বেড়ে গেছে আকস্মিক বিধবা সংখ্যাটি। তাই অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হতেই তাঁরা অতীতের সমস্ত জড়তা, সংশয় জোর করে সরিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যা আরো বলেন, তাঁর নিজের দেওরের হঠাৎ মৃত্যুর পরবর্তী মুহুর্তেই পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় কিছুতেই তার জাকে বৈধব্যযাপন করতে দেওয়া হবে না। একটি মানুষের চলে যাওয়ায় অন্য একজনের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে ব্যাহত করা অনুচিত শুধু নয় অমানবিক। পরিবারের সবার তখন দেখা উচিত কিছুতেই মেয়েটি যেন মনোবল না হারিয়ে ফেলে। পরিবার আর সমাজের সক্রিয় সহায়তাতেই একমাত্র বিধবা জীবনের অর্থহীন অযৌক্তিক বঞ্চনা- শোষণ গুলি আটকানো সম্ভব। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। আজকের বিন্দুবাসিনীদের চিন্তায় শুধু কোনো গঙ্গানারায়ণ ব্যথিত হলে চলবে না, সমাজকে অর্থাৎ আমাদের সকলকে হতে হবে সহমর্মী আর যুক্তিবাদী। 

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সৌজন্য ইন্টারনেট

 

 

   
0 Comments

Post Comment