তিনি ‘মাতেমেতিশিয়েন’!

  • 05 April, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 668 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবির দেশে, কবিতার দেশে – রাজধানী প্যারিসের প্যার লা-চ্যাজ কবরখানাতে শুয়ে আছেন, কবি পল এল্যুয়ার, হোমিওপ্যাথির জনক ও জননী যথাক্রমে স্যামুয়েল ও মেলানি হ্যানিম্যান, সুরকার ফ্রেডেরিক শোপ্যাঁ, এমনকি ‘সুখী রাজপুত্র’-এর রচয়িতা অস্কার ওয়াইল্ড। ঘন হয়ে পাতা ছড়িয়ে আছে ছোট্ট আরও একটি কবরের উপর। মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ (এপ্রিল, ১৭৭৬ – জুন, ১৮৩১), টেলিপ্যাথির এক আশ্চর্য সমাপতন। গত সপ্তাহের  ১লা এপ্রিলেই আমরা মেরি-সোফি’র ২৪৫তম জন্মদিবসকে পেরিয়ে এসেছি। নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক (পর্ব ১৩)

[সাধারণ অভ্যাসে কোনও ধারাবাহিকের ভ্রম সংশোধন করতে হলে, সেটিকে নতুন কিস্তির একেবারে শেষে দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি অল্প স্বাধীনতা নিতে চাইবো – কারণ আমার মনে হয়েছে যে, নতুন কিস্তির একেবারে শেষে পূর্ববর্তী কিস্তির ভ্রম সংশোধন বিষয়ে বলা হলে অনেক সময়ই তা সাধারণ পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও যেতে পারে। লেখকের দায়িত্ব নিজের ভুলত্রুটিকে সর্বাগ্রে স্বীকার করা। কারণ এখনও, এই যুগেও  ছাপার অক্ষরের মূল্য অসীম। গত ২২শে মার্চ তারিখে, এই পোর্টালে – নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক এই প্রবন্ধমালাটির অংশ হিসেবে ‘নিউটন, ভলতেয়ার এবং!’ শীর্ষক যে কিস্তিটি প্রকাশিত হয়েছিল তার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ‘ওয়ার এ্যান্ড পীস’ গ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে ভলতেয়ারের নাম উল্লিখিত হয়েছে, যদিও আদতে ‘ওয়ার এ্যান্ড পীস’ গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন লিও তলস্তয়। আবেগের আতিশয্যে এই ভুল তথ্যটিকে প্রকাশ্যে উপস্থাপিত করার সম্পূর্ণ দায় বর্তমান লেখকের। ‘ওয়ার এ্যান্ড পীস’-এর মতো একটি সুবিখ্যাত গ্রন্থের বিষয়ে এমন একটি ভুল তথ্য দেবার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি কৃতজ্ঞ যে আমার বিশেষ বন্ধু শ্রীমান অর্হিত ঘোষ এই বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং আমি এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।]

“She Proved to the world that even a woman can accomplish something worthwhile in the most rigorous and abstract of sciences and for that reason would well have deserved an honorary degree.”

- কার্ল ফ্রেডরিখ গস, ১৮৩৭

ছবির দেশে, কবিতার দেশে – রাজধানী প্যারিসের প্যার লা-চ্যাজ সেমেট্রিতে কিছুক্ষণ নিশ্চুপে বসে থাকবো, যদি কোনোদিনও সেখানে যাবার সুযোগ পাই। পাশাপাশি এই কবরখানাতে শুয়ে আছেন, কবি পল এল্যুয়ার, হোমিওপ্যাথির জনক ও জননী যথাক্রমে স্যামুয়েল ও মেলানি হ্যানিম্যান, সুরকার ফ্রেডেরিক শোপ্যাঁ, এমনকি ‘সুখী রাজপুত্র’-এর রচয়িতা অস্কার ওয়াইল্ড। এক নিস্তব্ধ দুপুরে সেখানকার সঙ্গীতটুকুকে উপলব্ধি করতে চাইবো। অনুভব করবো বহুযুগের একেকটা দীর্ঘশ্বাস, সময়ের মতোই। ... ঘন হয়ে পাতা ছড়িয়ে আছে ছোট্ট আরও একটি কবরের উপর। মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ (এপ্রিল, ১৭৭৬ – জুন, ১৮৩১), টেলিপ্যাথির এক আশ্চর্য সমাপতন। গত সপ্তাহের  ১লা এপ্রিলেই আমরা মেরি-সোফি’র ২৪৫তম জন্মদিবসকে পেরিয়ে এসেছি। এই মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ’র নামের বিপরীতে যে নামগুলোকে আমরা পাচ্ছি, প্রযুক্তি অথবা বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত থাকলে যে কারোরই সেই নামগুলিকে দেখলে ঈর্ষা-বোধ হবে বোধহয়। জীবদ্দশায়, এই মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ, তাঁর গবেষণার সূত্রে পরিচিত হয়েছিলেন, কাজ করেছিলেন এই সমস্ত দিকপালেদের সাহচর্য্যে – যাঁদের নাম হল, যথাক্রমে জোসেফ-লুই ল্যাগ্র্যাঞ্জ, আদ্রিয়েন লেজেন্দ্র, কার্ল ফ্রেডরিখ গস, ডেনিস পয়সোঁ, অগস্ত-লুই কচি এবং – জোসেফ ফুরিয়র। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এঁরা একেকজন একেকটি দিগন্তকে খুলে দিয়ে গেছেন। লেজেন্দ্র’র বহুপদী সংখ্যামালার তত্ত্ব, বাস্তব অবস্থায় চলরাশির বিস্তৃতির ক্ষেত্রে পয়সোঁ’র প্রাথমিক অবদান, গসের সংখ্যাতত্ত্ব, অথবা এঞ্জিনিয়রিংয়ের ছাত্রের কাছে ফুরিয়র’স সিরিজ – চাঁদের হাট বললেও বোধহয় এই নক্ষত্রপুঞ্জকে সঠিক ভাবে ব্যখ্যা করা যাবে না। কিন্তু এই প্রত্যেকজন নক্ষত্রের সান্নিধ্যে এসেও নিজের পরিচয়, নিজের দীপ্তিকে অক্ষয় রেখেছিলেন মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ। অধ্যাপক গস থেকে শুরু করে অনেক দিকপালেরাই পরবর্তীতে স্বীকার করেছিলেন যে স্রেফ নারীত্বের কারণেই বোধহয় তাঁর জীবিতাবস্থায় ততটাও স্বীকৃতির মুখ দেখেননি এই মহীয়সী। সে কেবল সমাজের লজ্জা, সমাজের মাথা নীচু হবার কারণ।

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস, সোফি’র তখন তেরো বছর বয়স। গণতন্ত্রের সেনানীরা বাস্তিল কারাগারে প্রবেশ করল। প্যারিসের রাস্তায় তখন বিদ্রোহের আগুন। রু-স্যাঁ-দেনি’র বাড়িতে তখন কার্যত গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে সোফিকে, বাইরে বেরুনোর অনুমতি নেই। এই সময় সোফি’র হাতে এসে পড়ল ‘লিস্তোয়্যার দে মাথেমেতিক’, বিশ্বখ্যাত সমস্ত গণিতবিদদের জীবনকাহিনী। আর্কিমিডিসের মৃত্যুর ঘটনাটি সোফি’র মনকে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করলো। ইতিহাসের গতিতে এর অনেক বছর পরেও সেই প্রাথমিক আলোড়নের এক দ্বিতীয় ঢেউ আসবে। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে, জ্ঞানতাপস আর্কিমিডিস এবং অন্যান্য গণিতবিদদের জীবনীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে অঙ্কের জাদুতে মজে গেল। রাত জেগে মোমবাতির আলোয় সোফি’র গণিতচর্চা শুরু হল। মায়ের শত আপত্তি সত্ত্বেও অঙ্কের প্রেম থেকে সোফি’কে বের করে আনা গেল না। প্রথম দিকে আলোর ব্যবস্থা না করে, শীতের রাতে কম্বল না দিয়ে – কিঞ্চিৎ অসহযোগিতার চেষ্টা করলেও, পরবর্তীতে সোফি’র মাও বুঝলেন যে মেয়েকে আর অঙ্কের থেকে দূরে রাখা যাবে না। রাজধানীর একপ্রান্তে যখন বাস্তিল দখলের লড়াই, তখন অন্যপ্রান্তে রু-স্যাঁ-দেনি’র বাড়িতে সোফি’র আশ্চর্য নৈশ-সাধনার পালা চলছে। অঙ্কের সাধনা – সেই সাধনার অঙ্গ হিসেবে সোফি পড়ছে আইজ্যাক নিউটন থেকে শুরু করে বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ লিওনহার্ড অয়লারের সমস্ত গবেষণা। জ্যামিতি ততদিনে তার ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে। বিপ্লবের আগুন খানিকটা স্তিমিত হয়ে এলে পরে, ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে প্রতিষ্ঠিত হল একোল পলিতেকনিক। কিন্তু সেখানে যে নারীদের প্রবেশাধিকার নেই! নাই বা থাকলো। এই সময় একোল পলিতেকনিকের বক্তৃতার প্রতিলিপিগুলি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কাজেই সেগুলিকে হাতে পেতে সোফি’রও কোনও সমস্যা হল না। এগুলির উপরে ভিত্তি করেই সোফি তার কাজগুলিকে মঁসিয় লো-ব্লঁ ছদ্মনামে একোল পলিতেকনিকের একজন অধ্যাপককে পাঠাতে শুরু করল। জনৈক এই ‘লো-ব্লঁ’র মেধায় অভিভূত হয়ে অধ্যাপক তাঁর সাক্ষাৎ পেতে চাইলেন। সোফি’র ছদ্মনামের আড়ালটুকুও ঘুচে গেল। কিন্তু অধ্যাপক এতে মোটেই বিরক্ত হলেন না। বরং তিনিই এরপর থেকে সোফি’র অন্যতম মেন্টর হয়ে রইলেন। বিশ্বখ্যাত এই অধ্যাপকের নাম জোসেফ ল্যাগ্র্যাঞ্জ। মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ’র জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হল।

১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে আদ্রিয়েন লেজেন্দ্র প্রকাশ করলেন ‘এসেই সুর লা থিওরি দে নম্ব্র’ অর্থে সংখ্যাতত্ত্বের বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধমালা। এই সূত্র ধরেই সোফি’র সঙ্গে লেজেন্দ্র’র আলাপচারিতা শুরু হল, এই আলাপচারিতাও জারি থাকবে আগামীতে আরও অনেক বছর পর্যন্ত। আলাপ হল বিশ্ববিখ্যাত সংখ্যাতাত্ত্বিক কার্ল ফ্রেডরিখ গসের সঙ্গেও। এখানেও সোফি প্রথম নিজের পরিচয় দিলেন মঁসিয় লো-ব্লঁ হিসেবে, কিন্তু এখানেও এক আশ্চর্য ঘটনার কারণে সোফি’র পরিচয় ফাঁস হয়ে গেল। যে সময়ে মঁসিয় লো-ব্লঁ’র সঙ্গে গসের আলাপচারিতা বেশ একটা উচ্চতায় পৌঁছিয়েছে সেই সময়েই গসের শহর ব্রনশউইগের দখল নেয় ফরাসী সেনাবাহিনী। সোফি’র মনে জেগে ওঠে সেই কিশোরী-বেলায় পড়া দার্শনিক আর্কিমিডিসের করুণ পরিণতির কথা। অবশেষে আর থাকতে না পেরে তিনি তাঁর পারিবারিক বন্ধু ও সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে কর্মরত এক জেনারেলকে তাঁর আশঙ্কার কথা জানান। সেই জেনারেল সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠে, তাঁর অধীনস্থ এক সেনাকর্তাকে সশরীরে গণিতবিদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবার জন্য সশস্ত্র অবস্থায় খোদ গসের বাড়িতেই পাঠিয়ে দেন। মঁসিয় লো-ব্লঁ’র সত্যটিও এই সময়ে ফাঁস হয়ে যায়। তার মেধার পাশাপাশি মঁসিয় লো-ব্লঁ’র এই দ্বিতীয় রূপটিকে উন্মোচিত হতে হকচকিয়ে যান গণিতবিদ নিজেও। রূপকথার মতোই দুই মেধাবী গুরু-শিষ্যের প্রথম পরিচয় ঘটে। সংখ্যাতত্ত্বের বিষয়ে সোফি’র পান্ডিত্যে গস অভিভূত হয়েছিলেন। তাঁর একাধিক ব্যক্তিগত চিঠিপত্রেও সে কথার উল্লেখ আছে।

এরপর পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা বা ইলাস্টিসিটি নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন সোফি। প্যারিস একাডেমির এক প্রতিযোগিতায় তিনি পদার্থের স্থিতিস্থাপকতার বিষয়ে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রটি পাঠান। এই প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন আরেক বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ ডেনিস পয়সোঁ স্বয়ং। সোফি’র এই গবেষণায় অধ্যাপক আদ্রিয়েন লেজেন্দ্র বিশেষ ভাবে তাঁকে সহযোগিতা করেন। পরবর্তীতে প্রতিযোগিতার সময়সীমা আরও দুবছর বাড়িয়ে দেওয়া হলে বিচারক পয়সোঁ’ও নানা ভাবে সোফিকে গণিত এবং গণিতপ্রক্রিয়ার বিষয়ে সাহায্য করতে চেষ্টা করেন। জোসেফ ল্যাগ্র্যাঞ্জও এই সময়ে সোফি’র গবেষণাকে স্বীকৃতি দেন। অবশেষে সোফি’র তৃতীয় পরিমার্জিত গবেষণাপত্রটিই একাডেমির প্রতিযোগিতায় বিজয়ী রূপে ঘোষিত হয়। মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ’ই প্যারিস একাডেমির ইতিহাসে প্রথম মহিলা গবেষক যিনি একাডেমির কোনও প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন এবং পুরষ্কারে সম্মানিত হন। এর আগে এমিলি দ্যু শাতেলি’র গবেষণাপত্র একাডেমির জার্নালে প্রকাশিত হলেও তিনি কোনও বিশেষ পুরষ্কারে ভূষিত হননি। কিন্তু এতদসত্ত্বেও, স্রেফ নারীত্বের কারণে পুরষ্কৃত হয়েও একাডেমির কোনও অনুষ্ঠানে সোফি’র প্রবেশাধিকার ছিল না। কারণ তখনও, কেবলমাত্র একাডেমির পুরুষ সদস্যেরা এবং তাঁদের সহধর্মিণীরাই একাডেমির অনুষ্ঠানে প্রবেশ করতে পারতেন। অনেক পরে একাডেমির এক সচিব, সোফি’র জন্য একাডেমির অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অনুমতিপত্র জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত তাঁর নাম উল্লেখ না করে পারছি না, সোফি’র জন্য অনুমতিপত্র জোগাড় করে দেওয়া সেই ব্যক্তিটি আর কেউই নন – স্বয়ং জোসেফ ফুরিয়র, যার নামে ফুরিয়র’স সিরিজ, এঞ্জিনিয়রিং এবং গণিতের ছাত্রদের কাছে এক অবশ্যপাঠ্য অধ্যায়।

একাডেমিতে কাজের সময়েই গণিতবিদ কচি’র সঙ্গেও সোফি পরিচিত হন। স্থিতিস্থাপকতার বিষয়ে সোফি’র অন্তিম গবেষণাপত্রটি এই কচি’ই একাডেমির জার্নালে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। সংখ্যাতত্ত্বের গবেষণায় এরপর সোফি জগদ্বিখ্যাত গণিতবিদ ফার্ম্যাটের শেষ উপপাদ্যটিকে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন। সামান্যে একটি অনুমানের জায়গা থাকলেও মোটের উপরে একটি সাব্যস্ত প্রমাণ খাড়া করে মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ সেটিকে গসের কাছে প্রতিলিপি করে পাঠান। যদিও এই চিঠির কোনও উত্তর তিনি পাননি। গণিত এবং ফলিত গণিতের এতগুলি ক্ষেত্রে যাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল, আজ ইতিহাসের গতিতে আমরা তাঁকে বিস্মৃত হতে বসেছি। অঙ্কের পাশাপাশি দর্শন এবং মনোবিদ্যাতেও সোফি’র গবেষণামূলক অবদান রয়েছে। সমসাময়িক ফরাসি দার্শনিক অগুস্ত কোমতে, মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ’র দর্শনপ্রসঙ্গে উচ্ছসিত বক্তব্য রেখেছেন। সবশেষে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে স্তন-ক্যানসারে আক্রান্ত হন সোফি। রোগ যন্ত্রণার মধ্যেই তিনি আবার স্থিতিস্থাপকতার বিষয়ে তাঁর নতুনতর গবেষণা প্রকাশ করতে শুরু করেন। কিন্তু সমাজের যে তবুও চোখ খুললো না। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে প্যারিস নগরীর রু-দ্য-স্যাভয়’তে মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটে পরিচয়ের জায়গাটিতে লেখা হয় ‘রঁতিএ্যার – আনুইতঁ’, যার অর্থ হল ‘সম্পত্তির অধিকারী’। ছবির দেশ, কবিতার দেশের আধিকারিকেরা অন্তত ‘মাতেমেতিশিয়েন’ শব্দটিও তো কষ্ট করে লিখতে পারতেন। ইতিহাসের অতলে সোফি তলিয়ে যাচ্ছিলেন। ছ’বছর পর গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ’র প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কার্ল ফ্রেডেরিখ গস মন্তব্য করেন, “... তাঁর নিঃসন্দেহে একটি আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি পাওয়ার অধিকার ছিল”। নিঃশব্দে সোফি চলে গেলেন।

... কোনোদিন যদি প্যার লা-চ্যাজের সমাধিক্ষেত্রে যেতে পারি, হলফ করে বলতে পারি – শোপ্যাঁ, অস্কার ওয়াইল্ড, অথবা পল এল্যুয়ারকে বাদ দিয়েও, মেরি-সোফি জার্ম্যাঁ’র শ্বেতশুভ্র সমাধিফলকটির সম্মুখে মাথা নীচু করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো। আমার মনে পড়বে তখন, বাস্তিল ধ্বংসের ইতিবৃত্ত। মনে পড়বে রু-স্যাঁ-দেনি’র চোরকুঠুরিতে তখন আর্কিমিডিসের জীবনীতে মগ্ন আরেকজন। সাধনার জন্য কেবল নৈঃশব্দ আর অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হয়। ... বাস্তিলের কারাগার ভাঙলেও, নারীমুক্তির পথ বেয়ে এখনও যে শতসহস্র সোফি’রা আকাশের দিকেই পথ চেয়ে বসে আছে। সেই পথের শেষ কোথায় ?

সূত্রঃ

[১] লুই বুকারেলি ও অন্যান্য, ‘সোফি জার্ম্যাঁ – এ্যান এসে ইন দ্য হিস্ট্রি অব দ্য থিওরি অব ইলাস্টিসিটি’, আইএসবিএন সংখ্যাঃ ১৩-৯৭৮-৯০-২৭৭-১১৩৫-৯, ১৯৮০

[২] ব্যারি সিপ্রা, ‘এ উওম্যান হু কাউন্টেড’, সায়ান্স, খন্ড ৩১৯, সংখ্যা ৫৮৬৫, পৃষ্ঠা ৮৯৯, ২০০৮

[৩] আন্দ্রিয়া দেল-সেন্টিনা, ‘লেটার্স অব সোফি জার্ম্যাঁ প্রিসার্ভড ইন ফ্লোরেন্স’, হিস্টোরিয়া ম্যাথেমেটিকা, খন্ড ৩২, সংখ্যা ১, পৃষ্ঠা ৬০-৭৫, ২০০৫

[৪] আন্দ্রিয়া দেল-সেন্টিনা, ‘আনপাবলিশড ম্যানুস্ক্রিপ্টস অব সোফি জার্ম্যাঁ এ্যান্ড এ রি-ইভ্যালুয়েশন অব হার ওয়ার্ক অন ফার্ম্যাটস লাস্ট থিওরেম’, খন্ড ৬২, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ৩৪৯-৩৯২, ২০০৮

[৫] আন্দ্রিয়া দেল-সেন্টিনা, ‘দ্য করেসপন্ডেন্স বিটুইন সোফি জার্ম্যাঁ এ্যান্ড কার্ল ফ্রেডেরিখ গস’, আর্কাইভ ফর হিস্ট্রি অব এক্স্যাক্ট সায়ান্সেস, খন্ড ৬৬, সংখ্যা ৬, পৃষ্ঠা ৫৮৫-৭০০, ২০১২

ছবি : সৌজন্য : উইকিপিডিয়া

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক

0 Comments

Post Comment