বিবাহিত নারী (ষষ্ঠ পর্ব)

  • 16 March, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 714 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
প্রকৃতপক্ষে একজন পুরুষই যেহেতু একজন মহিলাকে গ্রহণ করেন এবং বিশেষত এমন এক পরিস্থিতিতে তিনি সেই মহিলাকে গ্রহণ করেন যেখানে বিবাহযোগ্য মহিলার সংখ্যা বেশ প্রচুর, পুরুষের কাছে পাত্রী নির্বাচন করার সম্ভাবনাও তাই একটু বেশিই। তবে যৌনক্রিয়াকে যেহেতু এক ধরনের সেবা হিসাবে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এর ওপরই নারীদের সুবিধা নির্ভর করে আছে বলে মনে করা হয়, তাই নারীদের অন্যান্য নিজস্ব অগ্রাধিকারকে অগ্রাহ্য করা যুক্তিযুক্ত হিসাবেই পরিগণিত হয়।

প্রকৃতপক্ষে একজন পুরুষই যেহেতু একজন মহিলাকে গ্রহণ করেন এবং বিশেষত এমন এক পরিস্থিতিতে তিনি সেই মহিলাকে গ্রহণ করেন যেখানে বিবাহযোগ্য মহিলার সংখ্যা বেশ প্রচুর, পুরুষের কাছে পাত্রী নির্বাচন করার সম্ভাবনাও তাই একটু বেশিই। তবে যৌনক্রিয়াকে যেহেতু এক ধরনের সেবা হিসাবে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এর ওপরই নারীদের সুবিধা নির্ভর করে আছে বলে মনে করা হয়, তাই নারীদের অন্যান্য নিজস্ব অগ্রাধিকারকে অগ্রাহ্য করা যুক্তিযুক্ত হিসাবেই পরিগণিত হয়। বিবাহকেই তাই এমন এক নিয়তি হিসাবে ধার্য করা হয় যা একজন নারীকে পুরুষের স্বাধীনতা থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু স্বাধীনতার বাইরে প্রেম বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যেহেতু কোনো মূল্য নেই, তাই নিজের জীবনে কোনো একজন পুরুষের দ্বারা সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য, একজন মহিলাকে অবশ্যই কোনো এক নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি প্রেমকে ত্যাগ করতে হয়। আমি শুনেছি একজন ধর্মপ্রাণা মা তাঁর মেয়েদের শেখাচ্ছেন “ভালোবাসা হল একটি বোকা অনুভূতি যা কেবল পুরুষদের জন্যই সংরক্ষিত এবং এই বিষয়টি মেয়েরা ভালো বোঝে না”। সাদাসিধে ভাবে বললে, এটিই হল হেগেলের তত্ত্ব যা তিনি তাঁর ‘Phénoménologie de l’Esprit’ বইতে প্রকাশ করেছেন।

এর অর্থ এই যে, মহিলাদের কাছে এটা কোনো প্রশ্নই নয়, নির্বাচিত স্বামীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করা। বরং এটি হল সাধারণ অর্থে তাঁর নারী-সংক্রান্ত কার্যাবলিকে ন্যায়সংগত করা। একটি নৈর্ব্যক্তিক ও নির্দিষ্ট  কাঠামোর অধীন সুখানুভবকেই কেবল অতি অবশ্যই তাঁকে জানতে হবে। এই সুখানুভব নারীর যৌন নিয়তিকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি দান করে। প্রথমত, বিয়ের বাইরে নারীর অন্য কোনো যৌন ক্রিয়াকলাপের অনুমতি নেই। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্যই শারীরিক আদান-প্রদান একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করায় যৌন বাসনা আর আনন্দ তাদের মূল অর্থ অতিক্রম করে সামাজিক স্বার্থের অভিমুখী হয়েছে।

একজন কর্মী ও নাগরিক হিসাবে পুরুষেরা সর্বজনীনতার অভিমুখী হয় এবং বিয়ের আগেই বৈবাহিক জীবনের বাইরেও আকস্মিক সুখানুভব উপভোগ করতে পারেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন পুরুষ অন্যভাবেও তাঁর সন্তুষ্টি খুঁজে পান। কিন্তু যে-পৃথিবীতে একজন নারীকে মূলত মহিলা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, সেখানে নারীকে অবশ্যই পুরোপুরি মহিলা হিসাবে ন্যায়সংগত হতে হবে। দ্বিতীয়ত, এটি দেখা গেছে যে, পুরুষ ও মহিলার ক্ষেত্রে সাধারণ ও বিশেষের সংযোগটি জৈবিকভাবে পৃথক। স্বামী এবং প্রজননকারী হিসাবে একজন পুরুষ তাঁর নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই তাঁর যৌন সুখ খুঁজে নেন। বিপরীতে, প্রায়শই, মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রজনন কার্য ও যৌন পরিতোষের মধ্যে একটি বিযুক্তি হয়ে যায়। এই বিযুক্তি এতটাই হয় যে, মহিলাদের যৌনজীবনকে নৈতিক মর্যাদা প্রদানের দাবি করে বিবাহ আসলে প্রকৃত অর্থে সেই মর্যাদাই বাতিল করে দেয়।

মহিলাদের এই যৌন হতাশাকে পুরুষরা ভেবেচিন্তেই গ্রহণ করেছেন। দেখা গেছে, পুরুষেরা আশাবাদী প্রাকৃতিকতার ওপর নির্ভর করে সহজেই মহিলাদের দুর্ভোগে নিজেদের সমর্পণ করে দেন। মহিলাদের ভাগ্যই এটা : বাইবেলের এই অভিশাপ পুরুষপক্ষের সুবিধাজনক মতামতকে মান্যতা দিয়েছে। গর্ভাবস্থার যন্ত্রণা--ক্ষণিক এবং অনিশ্চিত আনন্দের বিনিময়ে মহিলাদের ওপর আরোপিত এই ভারী খেসারতও অনেক রসিকতা বা কৌতুকের বিষয়। “পাঁচ মিনিটের আনন্দ: ন-মাসের যন্ত্রণা ... এটি বাইরে বেরোনোর চেয়ে অনেক বেশি সহজে ভিতরে প্রবেশ করে”। এই বৈপরীত্য প্রায়শই তাঁদের আনন্দিত, খুশি করে। এটি ধর্ষকামী দর্শনের অন্তর্গত। মহিলাদের এই দুর্দশায় অনেক পুরুষ আনন্দিত হন এবং এই দুর্দশা উপশমের ধারণার প্রতি তাঁরা প্রবল বিতৃষ্ণ থাকেন। ফলত বোঝা যাচ্ছে যে, নিজেদের সহচরীদের যৌন সুখ প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে পুরুষের কোনো দ্বিধা-সংশয় নেই। এমনকি যৌন সুখ-ভোগের একচেটিয়া অধিকার কায়েমের জন্য মহিলাদের যৌন সুখ লাভের আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করাও তাঁদের কাছে অনেক সুবিধাজনক বলে মনে হয়।

প্রকৃতপক্ষে, স্বামী যদি মেয়েলি যৌনতা জাগ্রত করেন, তবে তিনি এটিকে সাধারণ রূপে জাগ্রত করেন, যেহেতু তিনি এককভাবে স্ত্রীর দ্বারা নির্বাচিত হননি। তিনি তাঁর স্ত্রীকে প্রস্তুত করছেন অন্যের বাহুতে আনন্দ খুঁজে নিতে। স্ত্রীকে অত্যন্ত বেশি পরিমাণে যত্ন করা নিয়ে মোঁতেইন আবার বলেছেন : “ টুপিতে পটি করে সেই টুপি আবার মাথায় দেওয়া”। যদিও দৃঢ় বিশ্বাসে তিনি স্বীকার করেছেন যে, পুরুষালি দূরদর্শিতা মহিলাদের প্রশংসাহীন অবস্থানে রেখে দিয়েছে।

মহিলারা যখন পৃথিবীতে প্রচলিত জীবনের নিয়মকে প্রত্যাখ্যান করেন তখন তাঁরা মোটেই ভুল করেন না, যেহেতু এই নিয়মগুলি পুরুষেরা তাঁদের ছাড়াই তৈরি করেছিলেন। তাঁদের আর আমাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই কলহ এবং বিবাদ চলছে। অনিচ্ছাকৃভাবে আমরা তাঁদের সঙ্গে নিম্নলিখিত আচরণগুলি করি : যখন আমরা জানতে পারলাম যে মহিলারা আমাদের চেয়ে প্রেমক্রীড়ায় বেশি সক্ষম, বেশি উৎসাহী আর এই ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কোনো তুলনাই চলে না ... তখন ... আমরা চেয়েছি মহিলারা সুস্থ, সবল, ভালো অবস্থায়, ভালোভাবে পুষ্ট এবং একইসঙ্গে সতী থাকুন : অর্থাৎ একইসঙ্গে গরম এবং ঠান্ডা। কারণ, আমাদের রীতিনীতি অনুসারে, বিবাহের কাজ হল কামাতুর দহন থেকে তাঁদের রক্ষা করে তাঁদের কিছুটা স্বস্তি-সতেজতা এনে দেওয়া।

প্রুধোঁ-র মধ্যে দ্বিধা কম ছিল। ‘ন্যায়বিচার’ অনুসারে বিবাহ থেকে তিনি ভালোবাসাকে সরিয়ে রেখেছিলেন।

প্রেমকে অবশ্যই ন্যায়বিচারে সমাহিত করা উচিত ... বাগদত্ত-বাগদত্তা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে-কোনো প্রণয়মূলক কথোপকথনই ঘরোয়া শ্রদ্ধার ধ্বংসসাধক। কাজের প্রতি ভালবাসা এবং সামাজিক কর্তব্যের অনুশীলন ... (একবার প্রেমের অফিস পরিপূর্ণ হয়ে যায়)। ... আমাদের অবশ্যই প্রেমকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিতে হবে রাখালের মতো যে-রাখাল দুধ জমাট বাধার পর চাপ বন্ধ করে দেয়...

ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক।

0 Comments

Post Comment