- 18 November, 2024
- 0 Comment(s)
- 161 view(s)
- লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
বছরে দুটো দিনের খুব ভাল বাজার। সারা বিশ্বজুড়েই।
১। ভ্যালেন্টাইন্স ডে
২। মাদার্স ডে ।
একটায় প্রেম, অন্যটায় প্রণামের ধুম পড়ে গত কুড়ি বছর যাবত।
আরেকটা দিবসও কিছু বছর যাবত এদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে উঠছে সেটা–
৩। বাবা দিবস ।
ইদানীং খুব ধীরে হলেও হালে পানি পাচ্ছে বাবার প্রতি ভালবাসাও ।
তবে প্রথম দুই দিনের ব্র্যান্ড ভ্যালু তুলনামূলক বেশি। ভুলতে চাইলেও ভোলা অসম্ভব। সোশাল মিডিয়া থেকে বিজ্ঞাপনী চমক - দিনটির গুরুত্বে বাড়তি মাখন লাগাবার কাজ করে। যার শুরুটাই হবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের নানা দ্রব্যের উপর আকর্ষণীয় ডিস্কাউন্ট অফার দিয়ে। বিশ্বায়নের রং এতটাই চড়া যে আপনি হাজার এড়াতে চাইলেও পারবেন না।
যাই হোক, বিশেষ দিনে বিশেষ জনকে ঘিরে থাকা তাবৎ আয়োজনের মধ্যে একটা করে ইতিহাস লুকিয়ে থাকে।
তা, প্রেম দিবসের ইতিহাস নিয়ে অনেক কথাই ফেব্রুয়ারির গোড়া থেকেই আনাগোনা করে স্ক্রিনজুড়ে। দিনটির ব্যাপক ব্যাবসায়িক প্রচার ও জনপ্রিয়তার জন্যই মোবাইলের পর্দায় এর আদ্যোপান্ত ইতিহাস ঘুরে ঘুরে বেড়ায় নানান ফন্টে।
মাদার্স ডে'– মা দিবস, মায়েদের দিন অথবা মায়েদের ভালবাসা জানানোর দিনের ইতিহাসটি কিছুটা এরকম : -
অ্যান রিভস জার্ভিস ছিলেন একজন আমেরিকান সমাজসেবী। যুদ্ধে আহত সৈন্যদের সুস্থ করে তোলায় ব্রতী ছিলেন সারাজীবন ধরেই । ক্যাম্পের সেই সৈন্যদের কাছে অ্যান ছিলেন মায়ের মতো। তাঁদের দেখভালের জন্য 'মাদার্স ক্লাব'ও খুলেছিলেন অ্যান। সেখানে যুদ্ধে বিপর্যস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত সৈন্যরা তাদের পরিবারসমেত চিকিৎসাসহ নানা অসুবিধার কথা নিয়ে দরবার করতে আসতেন। ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থেকে পরবর্তীর জীবনযাপন বিষয়ে আলোচনা সবই হত।
এহেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের মত সেবিকা অ্যান রিভসের মৃত্যুর পরে, তার মেয়ে আনা জার্ভিস মায়ের মৃত্যু দিবসটিকে অন্য এক মাত্রা দেওয়ার কথা ভাবেন ।
মায়ের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এবং আহত সেনাদের প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ দায়িত্বপালন ও সেবামূলক কাজের ফলে যোদ্ধাদের কাছে যে তার মাতৃপ্রতিম জনপ্রিয়তা রয়েছে – সেই সবকিছুকে সম্মান জানাতে অ্যান রিভস কন্যা -- আনা জার্ভিস তাঁর মায়ের মৃত্যু দিবস ১০ মে তারিখটিকে 'মাদার্স ডে'-হিসেবে পালন করে ছুটির দাবি তুলতে শুরু করেছিলেন।
তখন সেটি ‘মাদার্স ওয়ার্ক ডে’ হিসেবেই পালিত হয়েছিল। কিন্তু দাবি ছিল, দেশ গড়ার অন্যরকম ব্রতে ব্রতী মায়েদের এই নিঃস্বার্থ সেবামূলক কাজকে পাকাপাকি ভাবে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া। কিন্তু সেই ছুটি না মঞ্জুর হয়ে যায়। তাই নিয়ে ঠাট্টা করে আমেরিকার সরকার বলে মাতৃ দিবসে ছুটি দিলে আবার শাশুড়িরাও নিজেদের নামে দিবস চেয়ে বসতে পারে। তখন কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। অতএব ‘নো মাদার্স ডে’।
আনা তবুও থেমে থাকেন নি। ১৯০৮ সালের ১০ মে প্রথমবার তিনি তাঁর সমাজসেবী মা অ্যান রিভস জার্ভিস ও তাঁর সহযোদ্ধা অন্যান্য মায়েদের স্মরণে ‘মাদার্স ডে’ হিসেবে পালন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যান্ড্রু মেথোডিস্ট চার্চে। সেখানে তাঁর সাথে অনেকেই স্বতস্ফূর্তভাবে যোগ দেন। কালক্রমে তাঁর অনবরত প্রচেষ্টায় ‘মাদার্স ডে’তে ছুটি মঞ্জুর হয় ১৯১১ সালে।
পরবর্তীকালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের ১৯১৪ সালের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটি ‘মাদার্স ডে’ হিসেবে পালন করার বিধি চালু হয় ।
এই ঘটনার অনেক পরে ১৯২০ সালে 'মাদার্স ডে কার্ড' তৈরি শুরু হয়। শুরু করেছিল ‘হলমার্ক কোম্পানি’।
কিন্তু 'মাদার্স ডে কার্ড' নিয়ে প্রচণ্ড সমালোচনা করেন আনা জারভিস স্বয়ং। তাঁর বক্তব্য ছিল, কার্ড কোম্পানিগুলো 'মাদার্স ডে' নিয়ে ব্যাবসা করতে চাইছে। এতে দিনটির গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ মজার কথা এই যে কার্ডের হাত ধরেই ‘মাদার্স ডে’ বিখ্যাত হয়ে উঠল গোটা বিশ্বে।
আমাদের দেশে কার্ড কোম্পানিগুলো মায়ের উদ্দেশ্যে সুন্দর সুন্দর কোটেশন আর ছবি দিয়ে কার্ড তৈরি করতে শুরু করে ১৯৯৫ সাল নাগাদ। টিন-টুইনদের চোখে পড়তে আরও কিছুটা সময় লেগে গেল। তার মধ্যেই তারা কার্ডের পাশাপাশি ছোটখাট উপহারও নিয়ে এল মায়ের নাম করে। আর বিশ্বমানের কিছু সিনেমা ভ্যালেন্টাইন্স ডে'র মত এইদিনকেও প্রচারের আলোয় এনে দিল ধীরে ধীরে ।
বাজার ছেয়ে গেল মায়েদের জন্য ছোটখাট চমকে : ছাপানো কাপ বা শো-পিস অথবা মাদার্স স্পেশাল গয়না, কলম ইত্যাদি।
নববঙ্গের নবযুগের চালকদের ভাষায় এইসবই হয়ে উঠল ‘কিউট নিকন্যাকস’।
কিন্তু দিন পাল্টাতে লাগল ।
উপহারের স্থান দখল করল ডিজিটাল টেকনোলজি । আধুনিক সন্তান স্মার্ট ফোন হাতে নিয়ে কয়েকটা ওয়াটসঅ্যাপ মেসেজ আর ভিডিও পাঠিয়ে দিয়ে ল্যাঠা চুকিয়ে দেয়। ডিজিটাল শুভেচ্ছার আবার সবচেয়ে বড় সুবিধা : বিনা পয়সার মাদার্স ডে উদ্যাপনও হল, আবার শুধু নিজের মাকেই নয়, চেনা অচেনা অনেক মাকেই অভিনন্দন জানানো গেল।
আজও তাই চলছে ।
মায়েরা আজও একই রকম গৃহকাজে ব্যস্ত থাকছেন, সন্তান মেসেজে মেসেজে দুনিয়ার তাবৎ মা-দের শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে। কিন্তু কাজকর্মে সদাব্যস্ত মায়েদের সেসব দেখার বা আয়োজনে সামিল হওয়ার সময় মিলছে না!
একথা সর্বজনবিদিত যে, সুস্থ প্রতিযোগিতা না থাকলে কোনো সুষ্ঠু কাজই ফলপ্রসূ হয় না। তাই বলে মা- বাবার দিবস পালনে প্রতিযোগিতা! আজ্ঞে হ্যাঁ, বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যখন আমেরিকা নানা সামাজিক বিপ্লবের নীরব সাক্ষী হচ্ছে, সেই সময় সরকারিভাবে মা দিবস পালনের অনুমতি মেলার পিছু পিছু এল ‘বাবা দিবস’ পালনের দাবি।
বিষয়টা বেশ মজার নিঃসন্দেহে।
আনা জার্ভিসের হাত ধরে ১৯০৮ সালের ১০ মে আমেরিকায় যখন প্রথম ‘মা দিবস’ পালন হল, ঠিক সেই বছর ৫ জুলাই তারিখে ভার্জিনিয়া চার্চ ৩৬২ জন কয়লা খনির শ্রমিকের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে ‘শ্রদ্ধা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁদের অনাথ সন্তানদের কথা মাথায় রেখে ওই তারিখটিই প্রথম পুরুষ ( পিতা ) দিবস হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পায়। কিন্তু ফাদার্স ডে’র গল্প আসে তার পরের বছর।
আমেরিকার গৃহ যুদ্ধের এক সৈন্য উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট ছিলেন ছয় সন্তানের ‘সিঙ্গল পেরেন্ট’। তিনি দু’বার বিয়ে করেন এবং দু’বারই স্ত্রী মারা যান। ফলে এই সন্তানদের একদিকে মা এবং অন্যদিকে বাবা হিসেবে বড় করার দায়িত্ব তার উপরেই এসে পড়ে। তার মেয়ে সোনোরা সেই ‘সিঙ্গল ফাদার’-এর দায়িত্ব পালনকারী পিতার কাজকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে মা-দিবসের মতই ‘বাবা-দিবস’ পালনের দাবি জানান । আসলে মাতৃত্বের সাথে স্নেহমমতার কিছুটা একচেটিয়া বন্ধনের ছবিই সামাজিক অভিধানে লিপিবদ্ধ।
পিতৃত্বের সাথে এই সংবেদনশীল মননের ছবিটি অপরিচিত না হলেও সেটাকে আলাদা মাত্রা দিতে সামাজিক কোন দিবস উদ্যাপন –কে অনেকেই বাড়াবাড়ি বলে মনে করত। ফলে সোনোরার এই দাবিও বেশ ক’বার নস্যাৎ হয়ে যায়। অনেক প্রচেষ্টার পরে ১৯১০ সালের ১৯ জুন তারিখে আমেরিকা তার প্রথম ‘ফাদার্স ডে’ পালনের অধিকার পায়। প্রসিডেন্ট উড্রো উইলসনের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার পিতা দিবস পালন করে ওইসব একক অভিভাবকত্ব বা সিঙ্গল পেরেন্টহুড –এর দায়িত্ব পালনকারী বাবাদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
যে কোনও স্বাধীন ও মানবাধিকার সুরক্ষাকামী দেশ ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে মাথা নত না করে, এরকম বহু ছোট খাটো সামাজিক বার্তাকে জনহিতকর উদ্দেশ্যে বাহিত করেই একটা সুস্থ ও সুসংহত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে ব্রতী হতে পারে। প্রথম বিশ্বের কাছে এসব তো অবশ্যই শিক্ষনীয়। ফাদার্স ডে’তে এই সিঙ্গল পেরেন্টহুডের দাবিটি নিঃসন্দেহে বিপ্লব সৃষ্টিকারী।
পেরেন্ট হুড বা অভিভাবকত্ব জিনিসটা সত্যিই বেশ বিতর্কিত বিষয়। গর্ভ ধারণ করলে কিম্বা ঔরস সিঞ্চিত করলে একটি ভ্রূণের সাথে রক্তের সম্পর্ক হয়ত স্থাপিত হয় ঠিকই, তবে সত্যিকার মাতৃত্ব অথবা পিতৃত্বজনিত দায়িত্বপালন এসব জৈবনিক ক্রিয়ার উপরেই পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকে কি? প্রশ্ন ওঠে ।
বিশেষত একবিংশ শতাব্দীর এই জেটপ্লাস যুগে যখন উন্নয়নশীল দেশে খবর হয় শিশুকন্যাকে ব্রাত্য করে ডাস্টবিনে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে, পুত্র কামনায় অপর শিশুকে বলি দেওয়া হচ্ছে, মেয়ে জন্ম দেওয়ার ‘অপরাধে’ স্ত্রীকে ত্যাজ্য করছে কোনো পুরুষ, বাজে খরচা হিসেবে সদ্যজাতকে গঙ্গায় ছুঁড়ে দিচ্ছে কেউ, কিম্বা অভাবের তাড়নায় শিশুকে বিক্রি করছে কোনো মা -- তখন সত্যি ভাবনা আসে বিবাহোত্তর দাম্পত্যই কি আদৌ তৈরি করে বাবা-মায়ের মানবজমিন ?
তর্কের খাতিরে এমন খবর হওয়া এসব ‘ব্যতিক্রমী’ পিতাদের কথা যদি বাদও দেওয়া যায়, তবে হাতের কাছেই এক অন্যরকম পিতার উদাহরণ দিই -
আমার বাবা একজন স্বচ্ছল সরকারি কর্মচারি ছিলেন, অফিস কাছারিতে কাজের দক্ষতা, ছবির মত হাতের লেখা এবং আদর্শ নিয়ে নানা জ্ঞানগম্ভীর কথাবার্তায় ঈর্ষনীয় সুখ্যাতি তাঁর । গ্রামে তার প্রভাব প্রতিপত্তিই হোক বা শিক্ষা দিক্ষার গভীরতা হোক - ‘বাবা’ হয়ে ওঠার আগে তাঁর ভদ্রতা ও রুচিশীল বাঙ্গালিয়ানা আপাদমস্তক চুঁইয়ে পড়ত। শুধু সফল সরকারি কর্মচারী বলেই নয়, অশিক্ষিত ও মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামের এক আলমারি বইসহ দালানবাড়ি, ফি-রবিবার হারমোনিয়াম-তবলা সহযোগে আসর বসানো গায়ক ও আশেপাশের নানা ছোটবড় ছেলেমেয়েকে গান শেখানোর মাস্টার হিসেবেও যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। সেই অজ পাড়াগাঁয়ে রবিঠাকুর যেখানে সেভাবে পৌঁছাননি, সেখানে আমার বাবার রবীন্দ্র-নজরুল -দ্বিজেন সঙ্গীতচর্চা ছিল রীতিমত আলোচনার বিষয়। এইরকম সদালাপী জনপ্রিয় মানুষটির ঘরে বাইরের মুখ ও মুখোশটি ছিল একেবারে উত্তরমেরু ও দক্ষিণ মেরুর গল্প। বাইরে যিনি আসর জমিয়ে মাত করে দেন, বাড়িতে তিনিই নিজের স্ত্রী কন্যার প্রতি খড়গহস্ত হয়ে থাকেন।
কেবলমাত্র দূরে চাকুরিরতা স্ত্রীর কর্তৃত্বকে নস্যাৎ করার অভিপ্রায়ে তিনি আজীবন একটি প্রতিযোগিতা চালিয়ে গেছেন।
উইলিয়াম জ্যাকসান স্মার্টের মত সিঙ্গল পেরেন্ট হওয়ার সৌভাগ্য (!) বছর পাঁচেকের জন্য পেয়েছিলেন আমার বাবাও। পরিস্থিতির চাপে মায়ের আঁচল ছেড়ে আমার জীবনের তেরো থেকে সতেরো বছর বয়স অবধি ‘বাপের বাড়ি’তে কাটাতে হয়েছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতা যাকে আজীবন তাড়া করে শান্তি তার উপর বিরূপ হয়ে ছেড়ে চলে যায়। ক্লাস এইটে পড়া মেয়ের ‘দখল পেয়ে’ নিজের বাড়িতে পুং কর্তৃত্ব ফলানোর ‘জেদ’ ও বাইরের ‘ইমেজ’ ধরে রাখার এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা ভদ্রলোকটির ভেতর পিতৃরস যতটা সঞ্চিত করেছিল, তারচেয়েও বেশি চাপ নিয়ে ফেলেছিলেন ‘ফার্স্ট গার্লের বাবা’ পরিচয় পেতে।
কে যেন বলেছিল দূরবর্তী দাম্পত্য সুখের হয় কারণ সেখানে দিবারাত্রের সহাবস্থানের অভাবে মনমালিন্যেরও প্রকাশ ঘটে কম। কথাটা আপেক্ষিক সত্য। আসলে হয় কি, দম্পতিদের স্থানগত দূরত্ব তাদের মনের দূরত্বও অসম্ভব রকম বাড়িয়ে ফেলে। আর সেই টানাপোড়েনের সহজলভ্য শিকার হয় সন্তান। বিশেষত যদি সেটি একমাত্র এবং অভিভাবকের বাধ্য হয়। তা মা-বাবার ভাগাভাগির সন্তান হওয়ার ‘মজা’ আমার মতো হতভাগ্যরাই জানে। এখন ভাবি ভাগ্যিস তখন মা-দিবস, বাবা দিবসের চল ছিল না। নইলে সন্তানের উপর আধিপত্য কার বেশি থাকা উচিৎ - এই টানাপোড়েনে এক্সট্রা কিছু মশালা যুক্ত হয়ে আমাদের নিউক্লিয়ার পরিবারে প্রতিযোগিতার বাজার আরও গরম করে তুলত হয়ত।
বাইরে সর্বজনপূজ্য প্রগতিশীল কথাবার্তায় ‘কন্ঠ ছাড় জোরে’- মতাদর্শের মানুষটি ঘরের মেয়েদের ‘আওয়াজ নামিয়ে কথা বলা’র পক্ষপাতি ছিলেন । কন্যাসন্তান হওয়ার দুঃখ ঘোচাতে যিনি আমায় ‘ছেলের মত’ সব বিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে চেয়েছিলেন সেই তিনিই চাননি ছেলের মত করে নিজের কেরিয়ারের সিদ্ধান্তটা আমি নিজের ইচ্ছেমত নিই ।
“ছাত্রানাং অধ্যনয়ং তপ” বীজমন্ত্র যিনি আমার কানে ঢেলে দিয়েছিলেন ক্লাস এইট থেকে এবং অনবরত ফার্স্ট হওয়ার তালিম দেওয়ার আপ্রাণ যে চেষ্টা তিনি করতেন - সেটা যে কেবলমাত্র বাইরের গদগদ সমাজের কাছে স্ত্রী সাথে প্রতিযোগিতার মেডেল ছিল, তা জানলাম অনেকটা বড় হওয়ার পরে। যে মেয়েকে নিয়ে তিনি সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন, সেই মেয়েরই ভালবাসার আঁকার খাতা ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন ডাস্টবিনে – কারণ ছবি আঁকা ইসলাম বিরুদ্ধ!
মেয়ের উচ্চমাধ্যমিকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা যে বাবা, মার্ক্সবাদের টিকা লিখে দিচ্ছেন রাত জেগে, সেই তিনিই বাড়ির ভেতর পুষে রাখছেন চুড়ান্ত লিঙ্গবৈষম্য। ‘ছেলের মত’ মানুষ করা মেয়েকে ‘কম-হাসি’, ‘ঢিলা-পোষাক’,‘নিচু-কণ্ঠস্বর’, ইত্যাদি পাঠদানের সাথে ‘সবেতে ফার্স্ট হওয়া’র ফতোয়া দিচ্ছেন যিনি, সেই তিনিই রাতের ট্রেনে এক লম্পটের উদ্ধত আচরণের সামনে মেয়েকে পড়তে দেখে আতঙ্কে ‘ফ্রিজ’ হয়ে যাচ্ছেন, প্রতিবাদে এগোতে পারছেন না– এ আমার নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা। সেই দিন হাত-পা ছুঁড়ে সেলফ-ডিফেন্সের হাতেখড়ি হয়েছিল।
মেয়ের গতিবিধির উপর নজরদারি চালানো ‘বাবা’ বাড়িতে আসা উড়ো ফোনে মেয়ের সম্পর্কে অশ্লীল কথাবার্তা শুনে থতমত খেয়ে চুপ করে যেতেন - পিতৃত্বের সহজাত নিরাপত্তা প্রদানে যিনি চুড়ান্ত অপারগ ।
একদিকে চাকরিরতা স্ত্রী ও মেয়ের স্বাধীন চিন্তাধারা যাঁর চক্ষুশূল, অন্যদিকে কুসংস্কারে জর্জরিত লোকের প্রতি বিষোদ্গার করতেন যিনি, মেয়েকে ‘পিওর সায়েন্স’ পড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন যে পিতা - সেই তিনিই অবসর জীবনে হাদিস কোরানের পাশাপাশি আশ্রয় নিয়েছিলেন জ্বিন তত্ত্ব, দোজখের আগুন আর জান্নাতুল ফিরদৌসের বাহাত্তরটি হুর প্রাপ্তির গাঁজাখুরি দাস্তানে!
নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ বোধে আমি আজীবন বোঝার চেষ্টা করে চলেছি, এই যে এক পৃথিবী বৈপরীত্য নিয়েও একজন স্বামী এবং একজন বাবা সারাটা জীবন কেবল ছায়াযুদ্ধেই কাটিয়ে ফেলল, তার ভেতর পেরেন্টহুডের চারা আদৌ রোপণ হয়েছিল কি?
বাবার ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান আমার মায়ের। জীবনভর যে কেবল লড়াই করে গেল ব্যক্তিগত ও বহিরাগত জীবনের তাবৎ অসাম্যের বিরুদ্ধে – সেই যোদ্ধাটির নাম ‘মা’। এই ভদ্রমহিলা একটা কন্যাসন্তানের ‘মা’ হয়ে ওঠা ইস্তক লিঙ্গবৈষম্য আর গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হয়েছেন। নিজের শিক্ষা দীক্ষা, উপার্জন ক্ষমতা এবং স্বাধীন চিন্তাচেতনাকে বিসর্জন না দেওয়ার জন্য যে অবিচার তিনি সয়েছেন, তা কেবল আমার ‘মা’ হয়ে ওঠার জন্যই।
‘মায়েরা মিথ্যে কথা বলে’ – কবিতাটার মায়ের মত দাম্পত্যের কুড়িটা বছর কাটিয়েছেন আমার মা। শত অত্যাচার সয়েও যাতে সন্তানের কাছে পিতার ছবিটা নষ্ট না হয়ে যায় তারজন্য যিনি অনবরত ‘ভাল থাকা’র অভিনয় করে চলতেন – তিনি আমার মা। সন্তানের জন্মক্ষণ থেকে একটি হোস্টেলে সিঙ্গল-মাদারের ভূমিকায় প্রায় বারো বছর একটানা দায়িত্ব পালন করেও যিনি কখনো অনুযোগ করেননি বা স্বামীর সাথে তুলনামূলক প্রতিযোগিতায় নামতে চাননি –তিনি আমার মা। পিতৃহারা মেয়ের অধিকারের দাবিতে অসম লড়াইয়ে নামা মানুষটা -আমার মা। নারীঅধিকার হননকারী শরিয়তের রক্তচক্ষুর সামনে উদ্ধত প্রশ্ন রেখে মেয়ের অধিকারের লড়াইয়ে শান্ত অথচ বলিষ্ট পদক্ষেপে যিনি জয়ী হতে পারেন – তিনি আমার মা।
আর সেইজন্য পেরেন্টহুড নিয়ে লিখতে বসা আমি চাই না ‘মা’-এর চেহারায় - চব্বিশ ঘণ্টা ঘাম-নুন-তেলে জবজবে হয়ে থাকা মলিন বসনের মহিলার ছবি আঁকতে। আপামর বাঙালি যেভাবে সাদাসিধা, খুব কর্মঠ, খুব সহ্যশীল, মুশকিল আসানের খুব বড় মাধ্যম, বিনা পারিশ্রমিকে নিরলস নিঃস্বার্থ শ্রমদাতা ইত্যাদি হিসেবে মায়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করে, সেই চেষ্টার মধ্য দিয়েই এক একটা মাতৃদিবস ‘মহান দিবস’ হয়ে ওঠে। অথচ সত্যিটা হল - মা একজন এমন নারী, যে কিনা নিজের স্বার্থ,বংশের স্বার্থ,সমাজের স্বার্থ রক্ষার্থে একজন মা হয়ে উঠেছেন নিতান্ত জৈবিক কারণেই (ব্যতিক্রমীরা ধর্তব্য নয় )। ওটুকুই বৈজ্ঞানিক সত্যি। কিন্তু সামাজিক বাঁধনে এবং হালফিলের নানা দিবস উদ্যাপনে আমরা মা’ শব্দকে ঘিরে তৈরি করি অতিমানবিক কিছু স্বর্বংসহা মিথ। ভুলে যাই মায়েরাও সর্বাগ্রে রক্ত মাংসের মানুষ। ‘মা’ হওয়ার জন্য তাঁর উপর আলাদা করে মহত্ব আরোপ করাটায় কোনও ‘প্রাইজমানি’ নেই।
যদি সত্যিই মা দিবস পালনে মহানতা জড়িয়ে থাকে, তাহলে ওই একটি দিবস বাদ দিলে বাকি ৩৬৪ দিন মা-কেন্দ্রিক খিস্তিখেউড় কেন বেরোয় মধ্যবিত্ত জিহ্বায়? মা-বোন নিয়ে পৃথিবীর সিংহভাগ গালিগালাজ তৈরি ও ব্যবহৃত হয় কেন? আজও স্কুলে, অফিসে, সরকারি পরিচয় পত্রে অভিভাবক হিসেবে মায়ের পদবী কেন ব্রাত্য? মা যদি সত্যি এত প্রিয়জন হন তবে মাতৃপরিচয়ে সন্তান প্রতিপালনের জন্য কেন বারবার আদালতের শরণাপন্ন হতে হয় সিঙ্গল মাদারদের ?
এক অবিবাহিতা মহিলা গেজেটেড অফিসার নিজের সন্তানকে একলা মানুষ করার জন্য আদালতে গেলে, সন্তানের একক অভিভাবকত্ব চাইলে, নিম্ন আদালত তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে কেন বলে যে, "অভিভাবকত্বের দাবী সম্বলিত পিটিশন দাখিলের ক্ষেত্রে বাচ্চার বাবার পরামর্শ আবশ্যক।" সাথে এও ব্যাখাও দেয় ' The guardians and wards Act ' এবং ' Hindu minority and guardianship Act' অনুযায়ী, অভিভাবকত্ব স্থানান্তর করতে গেলে বাবা-মা দুইয়ের অনুমতি লাগবে। কেন তখন কেউ মাদার্স ডে’তে সোশাল মিডিয়াতে নেওয়া শপথের কথা তোলে না? অথচ Section 13 of the Hindu Maintenance and Guardianship Act, 1956 states that the welfare of the minor shall be the paramount consideration. A mother knows the best for her child, so if the welfare of the child is affected by disclosing the name of the father, then it is her own choice not to disclose it. The violation of the right to privacy and the child’s welfare shall not be affected. তবু মায়ের ‘মহান’ হওয়ার কাগুজে প্রমাণ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের ২০১৫ সালের ‘সিঙ্গল পেরেন্টশিপে’র রায়কে কেন আজও বুড়ো আঙুল দেখানো হয়? যে সমাজে ডাস্টবিনে কুকুর-মা পাহারা দেয় মানবশিশুকে, আস্তাকুড়ে ঠাঁই হয় কন্যাভ্রূণের ; সেখানে একজন দায়িত্বশীল সক্ষম মা’কে তার সন্তানের দায়িত্ব নিতে আদালতে চক্কর কাটতে হয় কেন ফি বছর? পিতৃ পরিচয় নিয়ে বেড়ে ওঠা সন্তানের কাছে মাতৃদিবস পালনের অধিকার কেন শুধুই সোশ্যাল মিডিয়ায় লিপিবদ্ধ থাকে? এই ‘কেন’-গুলোর সদুত্তর যেদিন সঠিকভাবে পাওয়া যাবে, সেদিনই সার্থক হবে মাতৃদিবস পালন, হয়ত পিতৃদিবসও।
আসুন দেখে নিই অভিভাবকত্ব নিয়ে সাম্প্রতিক সুপ্রিম রায় কী?
On 13 August 2021 Supreme Court of India directed the State of Kerala to bring in new forms which do not contain the fields requiring details of father since asking for details of a father of a child conceived through ‘Assisted Reproductive Technologies’ (ART) would be violation of “rights of privacy, dignity and liberty”. The S. Court also directed that “in the column where the name of the father or husband is sought for, another entry could be made as that of the mother (like Father / Husband / Mother)”. The Supreme Court recognized the right to privacy of single mothers and held that disclosing the name and details of the father of a single mother would amount to a violation of her right to privacy.
একক মাতৃত্বের অধিকারের কেস অবশেষে একক অভিভাবকত্বেরও স্বীকৃতি দেয়। যেখানে সিঙ্গল মাদার্সদের প্রতি দেশের আইনেও মানুষ যাতে আরেকটু নমনীয় হয় তার সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। ‘অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজি’ (ART) বলতে সারোগেসি সহ যেকোনও কৃত্রিম প্রজনন মাধ্যমকেই বোঝানো হয়েছে।
As per the National Guidelines for Accreditation, Supervision and Regulation of ART Clinics in India published by the Ministry for Health and Family Welfare, Government of India in the year 2005 “There would be no bar to the use of ART by a single woman who wishes to have a child, and no ART clinic may refuse to offer its services to the above provided other criteria mentioned in this document are satisfied. The child thus born will have all the legal rights on the woman or the man.”
The Assisted Reproductive Technology (Regulation) Bill, 2020 introduced in the Lok Sabha এটাও স্পষ্ট করে জানায় যে প্রাপ্তবয়ষ্ক নারী স্বেচ্ছায় একক- মা হতে চাইলে ART –এর সাহায্য নিতে পারে। ভূমিষ্ট হওয়া কোনও শিশুই অবৈধ নয়, ফলে মাতৃত্ব যেভাবেই আসুক শিশুর জন্মের পরে তার অভিভাবকত্ব, কাস্টডি, আইনি উত্তরাধিকার সমস্ত কিছুই মা ও সন্তানের ন্যায্য অধিকার – এতে কোনও দ্বিমত থাকবে না।
পরিশেষে বলি, সন্তানের কাছে বাবা মা উভয়ের ভূমিকাই যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সন্তানজন্মের পরে এক দম্পতির বাবা-মা হয়ে ওঠার ভূমিকাও ততখানিই গুরুত্বপূর্ণ। সেইজন্যই প্রথাগত দাম্পত্যের বাইরে, এই মা-দিবস, বাবা-দিবস পালনের হুজুগ তখনই সর্বজনীন হয়ে উঠবে যখন সিঙ্গল পেরেন্টহুডকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে খোলা মনে। যেখানে ‘এককালে এক রাজা ছিল’ গল্পের পাশাপাশি “এক যে ছিল রানী ” দিয়েও গল্প শুরু হবে। সন্তান প্রথম থেকেই সরল বিশ্বাসে জানতে পারবে, কেবল বিবাহিত নর-নারীই জনক-জননী হয় না – ‘পেরেন্টহুড’ শব্দটি ধারে ও ভারে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।
0 Comments
Post Comment