মুসলিম সম্পত্তি আইনে মেয়ে কোলে ভিটেছাড়া

  • 15 May, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1906 view(s)
  • লিখেছেন : মনোয়ারা বিবি
স্বামী মারা যাওয়ার পর এক সপ্তাহও আমি শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে পারিনি। কোলের তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসতে হয়েছিল কারণ স্বামী মারা গেলেও তার বাপ তখনও জীবিত। মুসলিম উত্তরাধিকার সম্পত্তি-আইনে মা-মেয়ের অংশ বলে কিছু থাকল না। এই শরিয়তি আইন একদিকে যেমন বৈষম্যমূলক, অন্যদিকে তেমন পিতৃতান্ত্রিক। এই কাঠামো ধ্বংস না হলে অল্পবয়সী মুসলিম নারীর জীবনে যে দুর্বিপাক নেমে আসে তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি।

আমি মনোয়ারা বিবি। আমার বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাসনাবাদ ব্লকে। ‌বিয়ের বছর পাঁচেকের মধ্যে যখন আমার স্বামী ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তখন আমার বয়স সাকুল্যে কুড়ি আর একটা কন্যা সন্তানের মা। আমি একজন নিতান্ত সাধারণ গ্রাম্য গৃহবধূ। স্বামী মারা যাওয়ার পর এক সপ্তাহও শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে পারিনি। কোলের তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসতে হয়েছিল কারণ স্বামী মারা গেলেও তার বাপ তখনও জীবিত। জীবনে কোনদিন স্কুলে না যাওয়া নিতান্ত অক্ষরজ্ঞানহীন আমি শ্বশুর, শাশুড়ি আর তাদের ছোট ছেলের কাছে কোন কিছুই দাবি করতে পারিনি কারণ শরিয়তে নাকি বাপের আগে ছেলে মারা গেলে তার বউ,বাচ্চার বাড়ি-সম্পত্তিতে শরিকানা শেষ হয়ে যায়। বাপের বাড়ির এক কামরার ঘরে আমার ঠাঁই হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কি করে জীবন চলবে, মেয়েকে কীভাবে মানুষ করব সে প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে অজানা ছিল। আমি তখন বিড়ি বাঁধতে পারতাম। সেই কাজের ভরসায় আমাদের মা-মেয়ের জীবন বেঁচেছে। যে শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই মেলেনি, সেই বাড়ির লোকেরাও আমার সন্তান মানুষ করার চিন্তায় বিড়ি বাঁধাটাকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েনি। ‘‌কালো মেয়ে কি করে বিয়ে দেবে? আবার কখনও ‘‌মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে আমরা ছাড়া হবে না’‌ এই রকম কথাবার্তায় আমি ততদিনে অভ্যস্ত। রাগ হয়নি তা কিন্তু নয়; তবে রাগের সাথে কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। রাতদিন বিড়ি বেঁধে আমি অন্নসংস্থান করেছি, মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছি কিন্তু কোনদিন শ্বশুর বাড়ির সাহায্য প্রার্থনা করিনি। শুধু বার বার মনে হয়েছে আমি নিরক্ষর, শরিয়ত কি জানি না, বুঝিও না তাই ওরা আমার সাথে এমন করতে পেরেছে। এই চিন্তা যতবার এসেছে, আমার মেয়েকে পড়াশোনা করানোর জন্য আমি তত বেশি দৃঢপ্রতিজ্ঞ হয়েছি। দারিদ্রের কাছে আমি হার মানিনি।

২০০৯ সালে, সল্টলেকের জামিনী মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট থেকে আমি পেয়েছি 'মাতৃশক্তি পুরস্কার'। আমার মেয়েকে মানুষ করেছি, সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। আমি তার বিয়েও দিয়েছি, শ্বশুরবাড়ির লোকের উপস্থিতি ছাড়াই। আজও দেখতে পাচ্ছি কম বয়সে মুসলিম মেয়েরা বিধবা হলে স্বামীর সম্পত্তির অধিকার পায় না,এমনকি বাপের বাড়িতেও তাদের ঠাঁই হয় না। তিরিশ বছর পরেও সেই একইরকম অবস্থা আমাদের বলে দেয় সমাজে আমাদের অবস্থান ঠিক কোথায়। আজ আমার অবস্থার উন্নতি হয়েছে, আমি আমার লক্ষ্যপূরণে সমর্থ হয়েছি ঠিকই কিন্তু স্বামীর প্রাপ্য  সম্পত্তি পেলে আমাদের লড়াইটা এত কঠিন হত না।  আমরা আরও ভালভাবে বাঁচতে পারতাম। স্বামীহারা হওয়ার ক্ষত শুকাবার আগেই যারা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে তাদের কাছে আমি আর সম্পত্তির দাবি করি না, কিন্তু এমন অসহায় মেয়েদের প্রয়োজনে এই রীতি পাল্টানোর দাবি করি। এই শরিয়তি আইন একদিকে যেমন বৈষম্যমূলক, অন্যদিকে তেমন পিতৃতান্ত্রিক। এই কাঠামো ধ্বংস না হলে অল্পবয়সী মুসলিম নারীর জীবনে যে দুর্বিপাক নেমে আসে তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। ভবিষ্যতে আর কাউকে আমার মত ভুগতে না হয় সেই দোয়া করি।

পোর্টালের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বেশি পঠিত লেখাগুলো প্রকাশ করা হবে পরপর পাঁচদিন। প্রথম দিন প্রকাশ করা হলো এই লেখাটি।  

মূলছবি : প্রতীকী। ইনসেটে মনোয়ারা বিবি

অনুলিখন : বেবি নাজমিন

0 Comments

Post Comment