নতুন বছর উদযাপনে 'বুল্লি বাই'

  • 15 January, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 515 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
সমাজকর্মী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, পাইলটের মতো স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত নারী সুল্লি ডিলসের ডিল অব দ্য ডে- তে ডিল হিসাবে নিলামে উঠেছিল। সেইসময় পাইলট হানা মহসিন খান নয়ডায় এফআইআর করেন। হানা ছাড়াও কংগ্রেস সোশ্যাল মিডিয়া দলের আহ্বায়ক হাসিবা আমিন, কবি নাবিয়া খানও দিল্লি পুলিশের কাছে এফআইআর দায়ের করেছেন। প্রসঙ্গত, 'সুল্লি' শব্দটি একটি মানহানিকর হিন্দি স্ল্যাং। ভারতীয় হিন্দু সংগঠনগুলো মুসলিম নারীদের হেয় করার জন্য এই স্ল্যাং ব্যবহার করে। 'বুল্লি' শব্দের  অর্থ নিন্দনীয়।

দুড় দাড়্‌ চুরমার— ঘুম ভাঙে কই রে!

ঘর্‌ঘর্‌ ভন্‌ ভন্‌ ঘোরে কত চিন্তা!

কত মন নাচে শোন্‌— ধেই ধেই ধিন্‌তা!

ঠুং ঠাং ঢং ঢং, কত ব্যথা বাজে রে—

ফট্‌ ফট্‌ বুক ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে!

(শব্দকল্পদ্রুম, সুকুমার রায়)

নতুন বছরের প্রথম দিনটি আপনারা কী ভাবে উদযাপন করলেন? 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' বার্তায় নিশ্চয় আপনার হোয়াটস অ্যাপ উপচে পড়েছে, আপনিও গদগদ হয়ে প্রত্যুত্তর বার্তা পাঠিয়েছেন। সত্যিই তো এত আনন্দময় পরিবেশে আমরা আমোদে ভেসে না গিয়ে কী বা করতে পারি!  আমাদের চারিপাশে কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথাও বিচ্ছেদ নেই! তবে সবসময় আমার, আপনার এবং আমাদের দেশের সদা সুখী  বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতাদের মতো সবাই আনন্দে ভেসে বেড়াতে পারেন না! সাংবাদিক কুররাতুলিয়ান রেহবার, ইসমত আরা, রেডিও জকি সাইমা রহমান, অভিনেতা শাবানা আজমি, সমাজকর্মী খালেদা পারভিন, জহরলাল নেহুরু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিখোঁজ ছাত্র নাজিব আহমেদের মা ফাতিমা নাফিস ছাড়াও বহু সংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকারকর্মীদের বছরের প্রথম দিনটি সুখকর হয়নি! কারণ এদের সক্কলকেই ‘বুল্লি বাই’ নামের একটি অ্যাপে নিলাম করা হচ্ছিল। পাকিস্তানি নোবেলজয়ী শিক্ষা অধিকারকর্মী মালালা ইউসুফজাইকেও এই  নিলামের তালিকায় রাখা হয়েছিল। সাংবাদিক ইসমত আরা জানিয়েছেন, বছরের প্রথম দিন হোয়াটস আ্যপে নিউ ইয়ারের বার্তার মধ্যে হঠাৎ তাঁর এক বন্ধুর সম্পূর্ণ অন্য এক বার্তায় জানতে পারেন, তাঁকে একটি আ্যপে নিলাম করা হচ্ছে! বছরের প্রথম দিন এমনই আপত্তিকর অ্যাপ দেখে অনেক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সরব হন। মূলত যে সমস্ত স্বাধীনচেতা সফল মুসলিম নারীগণ, অনেক সময় আমাদের সরকার রাজের সমালোচনা করেছেন তাঁদের আপত্তিকর ভাবে ‘নিলামে’ তোলা হয়েছিল। প্রায় একশো নারীর  ছবি 'বুল্লি বাই'অ্যাপে আপলোড করা হয়েছে। অনেকেই টুইট করে জানিয়েছেন- তাঁরা প্রচন্ড 'মানসিক আঘাত' পেয়েছেন এবং খুব 'আতঙ্কিত' বোধ করেছেন। একজন বিধর্মী অবলা নারীর, বোরখায় মুখ ঢেকে চুপ করে সমস্ত অন্যায়কে মেনে নিয়ে মিনমিন করে  জীবন কাটানোর কথা, সেই সংখ্যালঘু নারী যখন শিক্ষিত হয়ে হম্বিতম্বি শুরু করেন; তখন তো তাকে শায়েস্তা করতেই হবে! তাই না? সমালোচকরা বলছেন, সাম্প্রতিক ভারতে রাজনৈতিক পরিবেশ জটিল মেরুকরণ হয়ে যাওয়ার ফলে মুসলমান নারীদের বিরুদ্ধে ট্রোলিং পরিস্থিতি ভয়ানক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তবে এই ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছিল গত বছর মে মাসে।'লিবারাল ডজ' নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রথম মুসলিম নারীদের নিলাম করা শুরু করেছিল।এরপর জুলাই মাসে 'সুল্লি ডিলস' নামের একটি অ্যাপে ৮৩ জন মুসলিম নারীর ছবি দিয়ে নিলাম শুরু হয়। টুইটার থেকে নাম, ছবি, ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে অ্যাপে দেওয়া হয়।

সমাজকর্মী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, পাইলটের মতো স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত নারী সুল্লি ডিলসের ডিল অব দ্য ডে- তে ডিল হিসাবে নিলামে উঠেছিল। সেইসময় পাইলট হানা মহসিন খান নয়ডায় এফআইআর করেন। হানা ছাড়াও কংগ্রেস সোশ্যাল মিডিয়া দলের আহ্বায়ক হাসিবা আমিন,  কবি নাবিয়া খানও দিল্লি পুলিশের কাছে এফআইআর দায়ের করেছেন। প্রসঙ্গত, 'সুল্লি' শব্দটি একটি মানহানিকর হিন্দি স্ল্যাং। ভারতীয় হিন্দু সংগঠনগুলো মুসলিম নারীদের হেয় করার জন্য এই স্ল্যাং ব্যবহার করে। 'বুল্লি' শব্দের  অর্থ নিন্দনীয়।

সাংবাদিক ফাতিমা খান ২০২০ সালে দিল্লি হিংসার রূঢ় বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছিলেন। কারা সুপরিকল্পিত ভাবে দাঙ্গা করেছিলেন তাঁদের কথা প্রকাশ্যে এনেছিলেন। এর ফলেই তাঁকে নিলামের তালিকায় রাখা হয়েছিল। দীর্ঘ ছয় মাসে সুল্লি ডিলসের ব্যাপারটা একপ্রকার ধামা চাপা পড়ে গিয়েছিল। 'বুল্লি বাই' অ্যাপ মাথা চাড়া দিতেই, কান টানতেই মাথা এসে হাজির হয়েছে।  দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল ‘সুল্লি ডিলস’-এর মূল পান্ডা ওমকারেশ্বর ঠাকুরকে ৯ই জানুয়ারি মধ্যপ্রদেশ থেকে গ্রেফতার করেছেন। হানা খান এ প্রসঙ্গে বলেছেন- "আমি প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু যে অজস্র মুসলিম মহিলার ছবি দিয়ে ওই কদর্য আক্রমণ হচ্ছিল, তাঁদের মধ্যে অনেকে সেই সাহস পাননি, অনেকে টুইটার প্রোফাইল বন্ধ করে দিয়েছেন। আক্রমণকারীরা সেটাই চায়।’’ (তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন,  ১২/১/২০২১)

সাংবাদিক ইসমত আরা বিগত দুই বছর ধরে 'লাভ জিহাদ', 'ধর্মান্তরকরণ' সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন। 'লাভ জিহাদ'-এর পাশাপাশি ধর্ম, ঘৃণা ও হিংসা, নাগরিকত্ব আইনের পর দিল্লির সহিংসতার মতো বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ পত্রে নিয়মিত লিখছেন।ফলে, অবধারিত ভাবে তাঁকে 'বুল্লি বাই' অ্যাপে নিলামে তোলা হয়েছে। বিবিসির একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে, ইসমত আরা তাঁর এফআইআরের অভিযোগে 'মুসলিম নারীর  বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে' শব্দটি সচেতন ভাবে ব্যবহার করেছেন।

তবে এই অ্যাপে ষোল বছরের কিশোরী, আঠারো, কুড়ি বছর কিশোরীর পাশাপাশি সাতষট্টি  বছরের নারীদের নিলামে তোলা হয়েছে। ষোল বছর কিংবা আঠারো বছরের একজন কিশোরী যখন এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন তাঁদের নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়! বয়ঃসন্ধিকালে শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। অনভিপ্রেত ঘটনার কবলে পড়ে অনেকসময় বয়ঃসন্ধিকালে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। নিলামে তোলা বাচ্চা মেয়েরা হয়তো সারাজীবনের জন্য ভীতু হয়ে গেল, তাঁদের লড়াকু মনকে দমিয়ে দিয়ে আড়ালে মুচকি হেসে স্বার্থসিদ্ধি যাঁরা করলেন, তাঁরা কে বলুন তো?

সচেতন ভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে 'বুল্লি বাই' অ্যাপ জুড়ে রয়েছে বয়ঃসন্ধিকালের খেলা। কে বা কাহারা অতি সুন্দর ভাবে আমাদের ছেলেমেয়েদের মগজ ধোলাই করে, মগজের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে রাশিরাশি ঘেন্না। বুল্লি বাই অ্যাপের নির্মাতা, একুশ বছর বয়সী নীরজ বিষ্ণোই, প্রধান অভিযুক্ত আঠারো বছর বয়সী শ্বেতা সিংহ, এছাড়া রয়েছেন, বছর একুশের ময়াঙ্ক রাওয়াল ও বিশাল কুমার।কেউ দাঁড়িয়ে আছেন বয়ঃসন্ধিকালে, কেউ সদ্য অতিক্রম করেছেন বয়ঃসন্ধিকাল! আমরা জানি, বয়ঃসন্ধিতে থাকা ছেলে মেয়েরা ভীষণ কৌতূহলপ্রবণ হয়।অনেক সময় তাঁরা নানান নেশায় জড়িয়ে পড়েন, এই বয়সীরা অতি সহজেই অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। গভীরভাবে ভেবে দেখুন, ২০১৪ সালে এই অ্যাপ কান্ডে যুক্ত দোষীদের বয়স কত ছিল।সেইসময় রমরমিয়ে চলছিল- লাভ জিহাদ, লিঞ্চিং, হেট স্পিচের মতো নিকৃষ্টতম কর্মযজ্ঞ। 'বুল্লি বাই' অ্যাপ কান্ডে জড়িত কেউ কখনো হিস্ট্রি সিটার(পূর্বের অপরাধমূলক রেকর্ড) ছিলেন না, পরিবারের কেউ কোনদিন কোন অপরাধমূলক কাজ করেননি। সকলে কলেজের প্রথম, দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। রাতারাতি কী ভাবে তাঁরা অপরাধী হয়ে গেল? আমাদের  ছেলেমেয়েরা কতটা সুরক্ষিত আছে!  ধর্মান্ধ নীরজ বিষ্ণোই গ্রেফতার হবার পর অনুশোচনা প্রকাশ করেননি।

'ঘৃণা ভাষণ' ভারতের দাঙ্গায় ১৯৯০ সাল থেকে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। আডভাণীর রাম রথযাত্রা দিয়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সূত্রপাত হয়। পরবর্তী দুই বছর হিন্দু দেশবাসীকে ধীর বিষক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়েছে। আডভাণী, উমা ভারতীরা স্থানে স্থানে বিষাক্ত বক্তৃতা দিয়েছেন। আবার, দিল্লি দাঙ্গার কিছুদিন আগে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রসহ অন্য মন্ত্রীরাও প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশ্যে নানা উসকানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন। প্রসঙ্গত, অভিযোগ উঠেছে উত্তরাখণ্ডে ধর্মীয় সমাবেশের নামে ভয়ানক বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়া হয়েছে। সেই বক্তৃতার ভিডিও এখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। যাইহোক, আমাদের সরকাররাজ যেহেতু বিতর্কিত ঘটনা দেখলেই মৌনব্রত ধারণ করেন তাই 'বুল্লি বাই' কান্ড, 'বিদ্বেষ ভাষণ' সবকিছু দেখে তিনি নীরব আছেন। জাতীয় অপরাধপঞ্জি থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৪ সালের পর থেকে ভারতে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতার পরিমাণ বেড়ে গেছে।(তথ্যসূত্র: দ্য ওয়াল ব্যুরো, ৮/১/২০২২)

'বুল্লি বাই' কান্ডে সাংসদ প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী সরব হয়েছিলেন। মহারাষ্ট্রের সরকারের কাছে দ্রুত এই নোংরামির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। খুব তাড়াতাড়ি অপরাধীরা গ্রেফতার হয়েছেন। তবে বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতারা মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন। যে ভাবে প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল, সেইভাবে কোন মহলকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি! অতি কৌশলে ঘেন্নার বীজ মগজে গেঁথে দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে কোন অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে?  সত্যিই বুঝতে পারছি না কেমনতর আচ্ছে দিন এলো, প্রাচীনকালের মতো বিকিকিনি চলছে, নারীদের নিলামে তোলা হচ্ছে!  আবার হয়তো দুইদিন বাদে নূতন আরেক অ্যাপলিকেশন গজিয়ে উঠবে। আচ্ছা, সত্যিই এটা ২০২২ সাল? মাঝেমাঝে মনে ভ্রম  জাগে! কখনো কখনো মনে হয় টাইম মেশিনে চড়ে সটান বর্বরোচিত কোন অতীতে পৌঁছে গেছি!

লেখক: সমাজকর্মী ও প্রাবন্ধিক

ছবি: সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment