শাপিতপুরুষ (দ্বাদশ কিস্তি)

  • 13 February, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 422 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পূর্বকথা- গভীর রাত অবধি রিমা অস্থির সময় কাটায়। গলা শুকিয়ে কাঠ। গ্লাসের পর গ্লাস পানি চলছে, তৃষ্ণা বাড়ছে বৈ ছিটেফোঁটাও কমছে না। দু’বার করে ড্রইংরুমে গিয়েও কোন কথা না বলেই ফিরে আসে। সুমন রিমোট টেপায় মত্ত। ইদানিং কোন অনুষ্ঠান দেখে না। রিমোট টেপে হরদম। রিমা এখন ভেতর-বাইরে সম্পূর্ণ নিঃসহায়। মরণ যেন দুই হাত দূরে। নিশ্বাস আটকে বুকের ভেতরে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই বাইরে আসছে না। গভীর সমুদ্রে জাহাজ ডুবি মানুষের মতো গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে রিমা।

[২০]

আমি জীবিত আছি বাবা : সুমন

টিভি অন করেই সুমন বেড রুমে গেল। সমগ্র বিছানা জড়োসড়ো করে সুমনের বালিশ বুকে নিয়ে বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছে রিমা। ছয় মাস চলছে। এখন আর কাপড় উদোম করে দেখতে হয় না।  রিমার পোয়াতি শরীরে রূপ-লবণ্য উছলে পড়ছে। কাপড় হাঁটুতে উঠে আছে। সুমনের পায়ের তলা হতে মগজ পর্যন্ত ঝাঁ শব্দে শিউরে ওঠে। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইল। রক্ত ক্রমশ গরম হয়। শরীরটা জানোয়ার হয়ে ওঠে। শিকারখেকো জন্তুর মতো প্রচণ্ড রুখে লফিয়ে বিছানায় উঠে রিমার কাপড়ে হাত দেবে, ঠিক সেই মুহূর্তে তাড়া খাওয়া মানুষের মতো কেউ একজন হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করল। সুমন চমকে ওঠে। মানুষটা সুরসুর করে ডাইনিংরুম দিয়ে ড্রইংরুমে চলে গেল।

সুমন ভয়ে ভয়ে বিছানা থেকে নেমে এলো। ডাইনিংরুমে জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। আলোর মধ্যে দাঁড়াল। কেউ একজন সোফায় বসে হরদম রিমোট টিপছে। মুখটা পাশ ফেরানো। সোফায় দুই পা তুলে দিয়ে মাথা হেলিয়ে আরামে বসেছে মানুষটি। ভয় পায় সুমন। এক পা এগোয় তো দুই পা পিছায়। রিমাকে ডাকবে কি না ভাবে। বলা তো যায় না, ওর পেট কেটে বাচ্চা চুরি করে নিতেও আসতে পারে মানুষটা। এ ধরনের একটা নিউজ পত্রিকায় পড়েছে গতকাল-ই। পোয়াতী মায়ের পেট কেটে বাচ্চা বের করে বিক্রি করে দিচ্ছে অয়নের মতো কিছু লোভী ডাক্তার। এছাড়া পেশাদার কিলারও হতে পারে লোকটা। রিমা টাকা দিয়ে চুক্তি করতে পারে। এ কারণেই ওর এত অস্থিরতা, ছটফটানি। এত রাত পর্যন্ত ঘুমায়নি। এত কালের বন্ধন! নিজের হাতে খুন করাচ্ছে স্বামীকে, এটুকু অস্থিরতা তো হবেই। সুমন ফিক করে হেসে ওঠে অন্ধকার নাড়িয়ে। হঠাৎ ঘুর্ণিপাক ওঠে বুকের ভেতরে। দুই পা সরে এসে দাঁড়ায়। রিমাকে দেখা যায়। মাগি তুই ঘুমের ভান করে শুয়ে আছিস, অ্যাঁ! এতক্ষণ কার অপেক্ষায় ছিলি? আর এমন গলাকাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছিলি কেন? আমার দেহ থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে গেলে, বুকের ভেতরে ছুরি না হয় গুলি ঢুকিয়ে লাশ করে ফেললে, তুই ঠিকই ঘুমের ভান ছেড়ে লাফিয়ে উঠবি, আর আনন্দে রাধানৃত্য করবি! হঠাৎ সুমনের মনে হয়, এ খুনের ষড়যন্ত্রের সাথে অয়নও জড়িত। ও নিশ্চয় ঘুঘু শিকারীর মতো ওৎ পেতে আছে আশেপাশেই। কিলারটা ঢাকা থেকে আসতে পারে। আমি দিব্যজ্ঞান দিয়ে ঠিকই ধরেছিলাম। হিস্ করে মাথার চুল টেনে ধরে সুমন, কেন যে পুলিশকে বলে রাখলাম না! হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সুমন, কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না! রিমা আমাকে খুন করবে, এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না। মাগিটা সবাইকে হাত করে নিয়েছে। এখন আমি খুন হচ্ছি, নিজের ঘরে, নিজের স্ত্রীর ভাড়া করা কিলার দিয়ে। আমি দুর্ভাগা মানুষ। আমার ছেলেটার কী হবে এখন? রিমার দিকে তাকিয়ে এবার খুন চড়ে গেল সুমেনর মাথায়। দাঁড়া, মাগি তুই কিলার ভাড়া করে এনেছিস আমাকে খুন করার জন্যে? আমি খুন হলে অয়নের সাথে এখন-ই এখানেই ফষ্টিনষ্টি করবি! আমি তো খুন হচ্ছিই। তোকেও বাঁচতে দেব না। রিমার গলা টিপে ধরার জন্যে পা উঠিয়েছে কেবল সুমন, ড্রইংরুমের সোফায় বসা মানুষটি কথা বলে ওঠে, ওদিকে যেও না, এখানে আসো, এ ঘরে।  

সুমনের শরীর কেঁপে ওঠে। কিন্তু পা দুটি আর নড়ে না। খসখসে ভারি স্বর মানুষটার। এ স্বরটা সুমনের ভীষণ পরিচিত। 

এখানে এসো। দাঁড়িয়ে আছো কেন? এবার ধমকের স্বরে ডাকে মানুষটা।

অন্ধকার কাঁপিয়ে মরণচিৎকার দিয়ে ওঠে সুমন, রিমা কত টাকায় চুক্তি করেছে আপনাকে? আমি আরও বেশি দেব—দুইগুণ, তিনগুণ, আরও, আরও বেশি...

চিৎকার করো না। এখানে এসো বলছি। মানুষটা নড়ে চড়ে বসেছে। একই ভঙ্গিমায় মুখ ফিরিয়ে বসে আছে।

শারীরিক দুর্বলতা এবং ক্রোধ-উত্তেজনা হতাশায় সুমন কোমর থেকে ভেঙে পড়ে ঝড়ে ভাঙা গাছের মতন। হাঁটুর উপরে দুই হাতে ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে শব্দ করে হাঁপর টানে। কিলারটার কণ্ঠস্বর এত চেনা কেন? কিন্তু কে সে? মরচেপড়া স্মৃতির ঝাঁপ খুলেই আঁতকে ওঠে, এ যে অবিকল বাবার কণ্ঠ! কিলারটা বাবার কণ্ঠ পেল কিভাবে? বিমূঢ়ের মতো সুমন পা বাড়ায়, কিন্তু মৃত্যু-আতঙ্কে পিছু হঠে। কিলারটা নিশ্চয় স্টাডি করে এসেছে। বাবাকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। বাবার কণ্ঠস্বরে ডাকলে সহজে ওর ফাঁদে ধরা দেব আমি। আর তখনি বুকে-পেটে-পিঠে এলোপাতাড়ি ছুরি চালাবে।...হাঁপরের টান আরও বেড়ে গেল।

সুমন, আমি তোমাকে ডাকছি। তুমি আসছো না কেন? এত অবাধ্য তো তুমি ছিলে না?

সোফায় বসা মানুষটি কণ্ঠস্বর এবার আরও স্পষ্ট। এক লাফে ড্রইংরুমে পৌঁছে গেল সুমন। বসা মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে, বাবা!

কিন্তু মানুষটির বিশেষ কোন আবেগ নেই।

৩৫/৩৬ বছরের পূর্ণ যৌবনকালের শংকর গাঙ্গুলি সোফায় বসে রিমোট টিপছে। শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো চালু ছবির মতো ভেসে ওঠে সুমনের দুর্বল মনে। ছায়া নয়, বাস্তব মানুষটি বসা। সুমনের মনে শুধু একজন মানুষের ছবি আছে। একজন মানুষের সাথে বেড়ে ওঠার গল্প আছে। সেই মানুষ জীবন্ত এখন। সোফায় বসে রিমোট টিপছে। চুলের ভাঁজ, দেহের গড়ন, পোশাকের গাম্ভীর্যে বাবা একটুও বদলায়নি। সুমনের মনে পড়ে বাবাকে যখন শ্মশানের চিতায় ওঠায় তখন দেহের ওজন ছিল ২০/২৫ কেজি। নির্ভেজাল কঙ্কালের সংগ্রহ। সোফার দিকে আরও দু-পা এগিয়ে গেল সুমন। শংকর গাঙ্গুলি মুখ ফিরিয়ে সোজা সুমনের চোখে তাকায়। হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানিতে সুমনের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। চোখ খুলেই ‘বাবা’ বলে লুটিয়ে পড়ে।

বাবা, তুমি না মারা গেছো? গদগদ কণ্ঠে বলে সুমন।

হুঁ। শঙ্কর গাঙ্গুলি মাথা নাড়ায়।

তাহলে এলে কোথায় থেকে?

কেন, বাড়ি থেকে।

কোথায় বাড়ি?

সুমনের দিকে ক্ষিপ্র চোখে তাকায় শংকর গাঙ্গুলি। রহস্যময় হাসি ঠোঁটে।

লজ্জা পায় সুমন। স্বাভাবিক হয়। বাবার মুখোমুখি হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা, আমি খুন হবো।

জানি। শংকর গাঙ্গুলি নির্বিকার নির্লিপ্ত। 

জানো! কিন্তু কিভাবে সম্ভব? তুমি তো মৃত।

মানুষ কখনই মরে না। পৃথিবীর কোন প্রাণি বা কোন বস্তুই মরে না। অস্তিত্ব কখনো বিনাশ হয় না। তোমাকে কতদিন এ কথা বলেছি, বলো দেখি? তুমি সব ভুলে যাও। আমিই যদি মরে গেলাম, তুমি কে?

সরি বাবা। হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে সুমন।

এ বদভ্যাস এখনো ছাড়োনি দেখছি।

ভীষণ চুপ মেরে গেল সুমন।

শংকর গাঙ্গুলি একদৃষ্টিতে টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। পিনপতন নীরবতা। গাঢ় টানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভারি গলায় কথা বলেন, তুমি হেরে গেছো সুমন। এক অর্থে মরেও গেছো। তুমি আর তোমার মধ্যে নেই, অনেকটা আমার মতন। তবে তুমি লোকালয়ে আছো এই যা।

সুমনের রক্ত ঝিলিক দিয়ে উঠল। নিজের চেতন অবচেতন জগতে আলোড়িত হতে হতে দাঁড়িয়ে গেল ফটাস করে। রুমের চতুর্দিকে উদভ্রান্তের মতো দৌড়াচ্ছে বেদম। সে যে জীবিত এবং এখনো হেরে যায়নি, এ কথার ব্যবহারিক প্রমাণ হিসেবে টি-টেবিল তুলে চলন্ত টেলিভিশনের উপর সপাট সপাট আছড়াতে থাকল। টেলিভিশন ভেঙে টুকরো টুকরো করে হতচেতন হয়ে আঘাতখাওয়া হিংস্র পশুর মতো হাঁপাতে লাগল ।

ভাঙচুরের দুমদাম বিকট আওয়াজে ঘুমে থেকেই চিল্লিয়ে উঠল রিমা। ভারি শরীর টেনে তুলে কোঁকাতে কোঁকাতে ড্রইংরুমে পদক্ষেপ ফেলেই দুহাতে চোখ ঢাকে। এবং বসে পড়ে।

বেহুঁশ সুমন রমণোদ্ধত ষাঁড়ের মতো নাক উঁচিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টানছে। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় রিমা কিছুক্ষণ বসেই রইল। কোন কথা না বলে নিঃশব্দে উঠে রান্নাঘরে গেল। কেক কাটার চাকু হাতে নিয়ে ফের বিছানায় গেল। চাকুটি লুকিয়ে রাখে বালিশের তলায়। অন্তত আত্মরক্ষার চেষ্টা তো করা যাবে। বিছানায় সাপকুণ্ডলি হয়ে শুয়েছে। দম আটকে আসছে। নিশ্বাস ফেলছে ছোট্ট করে। মনে হয়, এখনি ছুটে এসে গলা টেপে ধরবে সুমন। গলায় সুমনের অদৃশ্য আঙুলের ফাঁস লেগে-ই আছে। 

হামাগুড়ি দিয়ে শোবার রুমে আসে সুমন। বিছানার উপরে উঠতে গিয়ে দুইবার পা হড়কে যায়। রোদে দৌঁড়ানো কুকুরের মতো পুরো জিভ বের করে বেদম হাঁপাচ্ছে। খেজুরের রস পড়ার মতো জিভ থেকে টপ টপ করে লালা পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোঙানির শব্দ মৃদু হয়। নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।

[চলবে...]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) 

0 Comments

Post Comment