- 12 April, 2025
- 0 Comment(s)
- 80 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
মহাশ্বেতা
এতগুলো দিন পর আবার মহাশ্বেতার সাথে দেখা হওয়ার ঘটনাটা বেশ আশ্চর্যজনক। বৈশাখের এক বিকেলে বাড়ির কাছেই একটা পার্কে বেড়াতে গিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে পার্কের মাঝখানে পুকুরটার পাড়ে গিয়ে বসেছি। সুর্যাস্তের লাল আভা পুকুরের জলে এসে পড়েছে, তন্ময় হয়ে সেই দৃশ্য দেখছি। মনে হল, কারা যেন আমার পাশটিতে এসে বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম - একজন মধ্য বয়স্কা মহিলা ও একজন তরুণী নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বসে আছে। তরুণীটির সাথে আমার চোখাচোখি হতে, তাকে চেনা বলে মনে হল। কিন্তু কোথায় দেখছি, মনে করতে পারছি না।
“মহাশ্বেতা!” হঠাৎ করে মেয়েটি আমার স্মরণে এসে গেল।
মহাশ্বেতা নিশ্চয় আমাকে আগেই চিনেছে। আমি যে এতদিন পরেও ওকে চিনে ফেলব ভাবতে পারেনি। পারলে হয়তো আমার থেকে আড়াল খুঁজত।
আমার মুখে নিজের নাম শুনে মহাশ্বেতা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। নিজের পাংশু মুখখানা কোথায় লুকোবে ঠিক করতে না পেরে দুই হাতের পাতায় সেটাকে ঢেকে নিল। কী হয়েছে জানিনা, তাই চুপ করে থাকলাম।
“ আপনি?”
“আমি ওর মা”। আমার প্রশ্নের উত্তরে মহাশ্বেতার সঙ্গের মহিলাটি বললেন।
“মহাশ্বেতার কী হয়েছে? এত শীর্ন দেখাচ্ছে?” নিজের পরিচয় দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“কিছুদিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না”।
“এখন কি ও আপনাদের কাছেই থাকছে?”
“ হ্যাঁ, কোথায় আর থাকবে, রাস্তায় তো আর বেশিদিন থাকা যায় না!”।
“ঠিক বুঝলাম না”।
“ কী বলব, সবই কপালের ফের। নাহলে ওমন হুট করে বিয়ে করতেই বা যাবে কেন! তারপর, পাঁচ বছর পর হঠাৎ করে একদিন একাই বাড়ি ফিরে এল। মাঝখানে কী ঘটেছে কিছুই জানিনা। ওর বাবা থাকলে চিন্তা ছিলনা। এখন আমি কী যে করি, মাথা কাজ করে না।” কথা শেষ করে ভদ্রমহিলা আঁচলে চোখ মুছলেন।
কী বলে প্রবোধ দেবো বুঝতে পারছি না। বললাম, “পিছনের কথা ভেবে তো লাভ নেই, এখন আপনাকেই শক্ত হতে হবে”।
“ সব ঠিক হয়ে যাবে”। আমি মহাশ্বেতার পিঠে হাত রেখে বললাম।
মহাশ্বেতা মুখ তুলল না।
“একসময় মহী আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করত। আসুন না একদিন। কলেজের কাছেই আমাদের বাড়ি। যাকে বলবেন চিনিয়ে দেবে”। আমাকে উঠতে দেখে ওর মা বললেন।
মহাশ্বেতা সোনামুখী কলেজে আমার ছাত্রী ছিল। চেহারাটি আকর্ষণীয়। খুব সেজে গুজে কলেজে আসতো। পড়াশোনা ছাড়াও নাচ,গান, আবৃত্তি, মঞ্চাভিনয় সবেতেই বেশ পারদর্শী। প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর মেয়েটি অল্প দিনেই সবার প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলো। কলেজের কোনও অনুষ্ঠান মহাশ্বেতাকে ছাড়া ভাবাই যায় না।
সেকেন্ড ইয়ারে উঠে দুম করে কলেজ আসা বন্ধ করে দিল মহাশ্বেতা। জানা গেল, বাড়ির অমতে একজনকে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়েছে। দিনকতক মহাশ্বেতাকে নিয়ে গুঞ্জন চলল। তারপর স্বাভাবিক নিয়মেই সবাই তাকে ভুলে গেল। তার বন্ধুদের কথা অবশ্য আলাদা।
তারপর প্রায় সাত বছর পর আজ আকস্মিক ভাবে তার সাথে আমার দেখা। শীর্ণ, কোটোরাগত চোখ, ফ্যাকাসে চেহারার মেয়েটির সাথে আগের মহাশ্বেতার মিল খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
বাড়ি ফিরে মহাশ্বেতার কথাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারলাম না। এক রবিবার মহাশ্বেতাদের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। মহাশ্বেতার মা আমাকে দেখে খুশি হলেন। মহাশ্বেতা বিছানায় নেতিয়ে পড়েছিল। আমাকে দেখে সে উঠে বসল। কথা- টথা বিশেষ বলল না। আমিও জোর করলাম না।
কয়েকদিন পর ফের গেলাম। মহশ্বেতাকে তেমনই শুয়ে থাকতে দেখে বললাম, “এভাবে শুয়ে না থেকে হারমোনিয়ামটা নিয়েও তো বসতে পার, অত ভালো গানের গলা তোমার।”
মহাশ্বেতা কোনও উত্তর না দিয়ে উদাসীনভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে থাকল।
মহাশ্বেতার মায়ের সনির্বন্ধ অনুরোধে, তাছাড়া এই কয়েকটা দিন খুব কাছ থেকে দেখার পর, এই প্রাক্তন ছাত্রীটির প্রতি ভিতরে ভিতরে একটা টান অনুভব করছি। কলেজ ছুটির পর মহাশ্বেতাদের বাড়ি যেতে শুরু করলাম।
মহাশ্বেতার মা একদিন বললেন, "সারাদিনের মধ্যে এই বিকেল বেলাটায় মহী একটু যা উঠে বসে। আপনি চলে গেলেই আবার যাকে তাই”।
আমার পরামর্শে ওকে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট ডাক্তার দেখানো হোল। ডাক্তার বাবু অল্প ওষুধ-পত্র দিলেন। সেই সাথে বললেন, "ওর সাথে কথা বলে, ওর কষ্টটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। যতক্ষণ না ও নিজের ভিতর পুষে রাখা যন্ত্রণা কারও সাথে ভাগ করে নেবে ততক্ষণ ও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে না”।
মহাশ্বেতার মায়ের সাথে কথা বলে জানলাম, বিয়ের পর সেই যে মহাশ্বেতা ঘর ছেড়েছিল, তারপর থেকে ও কোথায়, কেমন ভাবে ছিল সবটাই অজানা থেকে গেছে। প্রথমটায় রাগে, অভিমানে ওরা মেয়ের খোঁজ নেননি। তারপর মহাশ্বেতা শহর ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। চেষ্টা করলে খোঁজ পাওয়া যেত, তবে ওর মা-বাবা সে চেষ্টা করেননি। মহাশ্বেতার বাবা ওদের বিয়েটা মেনে নিতে পারেননি। মনে মনে কষ্ট পেতেন ঠিকই কিন্তু মুখে সে কথা স্ত্রীর কাছেও স্বীকার করতেন না। মহাশ্বেতা যদি বাবার কাছে এসে ক্ষমা টমা চাইত,তাহলে কী হোতো বলা যায়না। তবে মেয়েও বাবার মতই জেদী। সামনে এসে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, কোনও যোগাযোগই সে রাখেনি।
মহাশ্বেতার বাবা ‘করোনা’য় মারা গেলেন। ওর মা তখন চারদিকে অন্ধকার দেখছেন, সেই সময় একদিন মহাশ্বেতা ফিরে আসে। পাগলিনীর মত চেহারা, ময়লা কাপড় চোপোড়, মাথার চুলে জট। জিজ্ঞেস করলে কোনও উত্তর করে না। ওর মা ভেবেছিলেন, কিছুদিন গেলে নিশ্চয় সব বলবে। কিন্তু আজ দু বছর হতে চলল, একই রকম আছে। সারাক্ষণ চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকে, পৃথিবীর কোনও কিছু নিয়ে ওর আগ্রহ নেই। ফেলে আসা জীবনের ব্যাপারে একটি কথাও বলেনা। জোরাজুরি করলে রেগে যায়, খাওয়া–দাওয়া বন্ধ করে দেয়।
ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায়, খুব ধীরে হলেও মহশ্বেতা সুস্থতার দিকে এগোচ্ছে - গেলে কথা টথা বলে। এখন নিয়মিত মহাশ্বতার বাড়ি যাওয়া হয় না। তবে মাঝে মধ্যে যাই।
প্রত্যেকবারের মত এবারেও দোলের ছুটিতে পুরুলিয়া যাব ঠিক করলাম। পুরুলিয়া আমার ভারি প্রিয় জায়গা। ওখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে টানে, বিশেষ করে এই মার্চে। এবার যাব ঘাটশিলা। ভাবলাম, মহাশ্বেতাকে সাথে নিয়ে গেলে কেমন হয়, খোলামেলা পরিবেশে কয়েকটা দিন কাটালে ওর মন কিছুটা হাল্কা হবে।
মহাশ্বেতার মাকে বলতে তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। মহাশ্বেতা রাজি হল না। ঘাটশিলার কথা শোনা মাত্র তার মুখটা রক্তশুন্য হয়ে গেল।ঘাড় নেড়ে জানাল, সে যাবে না।
“ঘাটশিলা খুব ভালো যায়গা। গেলে তোমার ভালো লাগতো”।
“চল না, ঘরে বসে থেকে থেকে দিনকে দিন তুই কুঁড়ে হয়ে যাচ্ছিস। ঘর থেকে বেরোলে তবে না মন ভালো হবে।” ওর মা বলল।
“কে বলেছে তোমাকে, ওখানে গেলে আমার মন ভালো হবে?” মহাশ্বেতার গলার স্বরে একরাশ বিরক্তি।
“তুই কী কখনও গেছিস ওখানে? একবার যাবার কথা হয়েও যাওয়া হয়নি। তোর বাবা যাবার পর থেকে আমিও ঘরবন্দী হয়ে আছি।”
“কেন বার বার একই কথা বলছ? তোমার ইচ্ছে হলে যাও, কে বারণ করেছে?”
“হ্যাঁ তাই যাব, একেবারেই যাব। একজন গিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন! এবার আমিও যাব।“
“মা, চুপ কর। আমি আর পারছি না! ওখানে গেলে আমি পাগল হয়ে যাব। ওখানে আমি সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছি- আমার ভালোবাসা, আমার সংসার, স-অ-ব! আমিও চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না, থেকে গেলাম এই কষ্ট সহ্য করার জন্য”! মহাশ্বেতা রেগে উঠেই, পরক্ষণেই দপ করে যেন নিভে গেল। তার ব্যথাকাতর দু চোখ অশ্রুভারে টলমল করে উঠল।
আমি ও মহাশ্বেতার মা পরস্পরের মুখের দিকে চাইলাম- ওর মনের বন্ধ দরজায় ঘা পড়েছে!
আমি দোলের ছুটিটা ঘাটশিলায় কাটিয়ে এলাম। ওখানে গিয়ে বার বার মহাশ্বেতার কথা মনে হচ্ছিল। ঘাটশিলা তো ছোটো জায়গা নয়, যে কারও নাম বললেই তাকে চিনে নেবে। পুরোনো বাসিন্দা হলেও একটা কথা ছিল। তাই মহাশ্বেতার খোঁজ নেওয়ার কথা মাথাতেও আসেনি। কিন্তু অযাচিত ভাবে একজন এসে মহাশ্বেতার খবর আমাকে জানাল।
ঘাটশিলার বিখ্যাত ‘রঙ্কিনী মন্দির’এ পুজো দিতে যাব বলে টোটো ধরেছি। টোটো চালকটির নাম তপেশ। আমি কোলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি শুনে তপেশ তার পরিচিত এক দাদা-বৌদির সুখ্যাতি করতে শুরু করল। তারাও কোলকাতার মানুষ ছিল। ওর বৌ তাদের বাড়িতে বাসন মাজার কাজ করত। মন্দিরের কাছেই তাদের বন্ধ কাপড়ের দোকানটা দেখিয়ে আফশোসের সুরে বলল, “দাদাবাবু-বৌদি দুজনেই বড় ভালো মানুষ ছিল। করোনার সময় আমরা যখন না খেয়ে মরতে বসেছি, তখন আমাদের বাড়ি বয়ে খাবার পৌঁছে দিয়ে গেছে। কোলকাতা থেকে ক’দিনের জন্য এখানে এল, খেলাঘর সাজিয়ে রেখে চলে গেল!”
“ চলে গেল! কোথায়?”
“ সে বড় দুঃখের কথা দিদিমনি, প্রথমে দাদাবাবু করোনায় মারা গেল। বৌদি একা কী করে থাকবে, তাই সেও বাড়ি তালা বন্ধ ক’রে চলে গেল। বাপ-মায়ের কাছেই গেছে। তবে আমার মন বলে, বৌদি একদিন না একদিন ঠিক ফিরে আসবে। দোকানটার টানেই আসবে”।
“কী নাম ছিল তোমার দাদাবাবুর?”
“ সৌমেন। পদবী বলতে পারব না” ।
“আর বৌদির? তার কী নাম বলতো?” আমি নিশ্চিত তপেশ মহাশ্বেতাদের কথা বলছে।
“বৌদির নাম মহাশ্বেতা”। আপনার চেনা কেউ?
আমি উত্তেজনা সামলে নিয়ে বললাম, “না তেমন কিছু নয়। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”
কথায় কথায় তপেশের কাছ থেকে মহাশ্বেতাদের সমন্ধে আরও কিছু জেনে নিলাম। তবে আমি জানলেই তো হবেনা। মহাশ্বেতাকে তার নিজের কথা নিজের মুখ দিয়ে বলতে হবে।
একদিন বিকেলে মহাশ্বেতাদের বাড়ি গেছি। মহাশ্বেতার মা রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত। আমি ইচ্ছাকৃত ভাবেই ঘাটশিলার কথা তুলে এটা সেটা বলার পর বললাম,” রঙ্কিনী মন্দিরের পাশে ‘মনীন্দ্রনাথ বস্ত্রালয়’ থেকে শাড়ি-গামছা কিনেছি। দোকানটা ছোটো হলেও দেখলাম জিনিস-পত্র বেশ ভালো। দামও সস্তা”।
“মনীন্দ্রনাথ বস্ত্রালয়! সেটা তো বন্ধ! “
“ওটা বন্ধ আছে না? তাহলে ওর পাশের দোকানটা থেকে কিনেছি। একেবারে গায়ে গায়ে দোকান তো।”
“মনীন্দ্রনাথ বস্ত্রয়ালয়” তোমাদের তাই তো?” কিছু সময় পর খুব আস্তে করে বললাম।
“হ্যাঁ। বাবার নামে। ভেবেছিলাম, একদিন না একদিন বাবার অভিমান ভাঙবে। জেনে নিশ্চয় খুশি হবে। তখন কী জানতাম, আমি যা ভাবছি তার কোনোটাই সত্যি হবে না! তার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে!” থেমে থেমে বলল মহাশ্বেতা।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মহাশ্বেতা আবার বলতে শুরু করল-
“কলেজের পিওন সৌমেনকে বিয়ে করলে এ্যাডভোকেট মনীন্দ্রনাথ চৌধুরীর সন্মান নষ্ট হবে। বাবা আমাদের বিয়েটা কিছুতেই মেনে নিলেন না। তখন আমি আর সৌমেন ঠিক করলাম এই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাব। এখানে আমরাও সুস্থভাবে বাঁচতে পারবনা। অকারনে সৌমেনকে অপদস্ত হতে হবে।
আমরা পুরুলিয়ায় গিয়ে সংসার পাতলাম। আমার সামান্য কিছু গয়না আর সৌমেনের জমানো কিছু টাকা, ওটুকুই আমাদের সম্বল। খরচ করতে শুরু করলে ওটুকু টাকা শেষ হতে কতক্ষণ, যা করবার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। সৌমেন ঘাটশিলায় ‘রঙ্কিনী মন্দির’এর কাছে একটা গুমটি মতন শাড়ি-গামছার দোকান দিল। এখানে যারা পুজো দিতে আসে মূলত তারাই এখান থেকে কেনা কাটা করে। প্রথম দিকে হতাশ হলেও কিছুদিনের মধ্যেই বিক্রীবাটা কিছুটা বাড়ল।
অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের সাথে অনেকের পরিচয় হয়ে গেল। এবার আমরা কিছুটা নিশিন্ত হলাম।
বেশিদিন এমনটা থাকল না। হঠাৎ করে শুরু হল ‘অতিমারী করোনা’। সারা দেশে লক ডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। যানবাহন দোকান পাট বন্ধ। হাতে যা ছিল তাই দিয়ে কোনও রকমে চলছে। কিছুদিন পর লকডাউন কিছুটা শিথিল হোল, কিছুক্ষণের জন্য দোকান-পাট খোলা হতে লাগল। তবে চারদিকে অসুস্থতার খবর, মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত।
এমন সময় খবর পেলাম আমাকে সংসারের কাজে সাহায্য করত যে মহিলাটি তার স্বামীর জ্বর। তখন জ্বর মানেই করোনা।
ফোন করে খোঁজ নিতে গেলে দীপালী, মানে আমার সাহায্যকারিনীটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কী বলব বৌদি,ও তো জ্বরে বেহুঁস, এদিকে বাড়িতে এক দানা খাবার নেই। ছেলে-মেয়েদুটোকে কি করে বাঁচাই!”
আমি বেশ কিছুটা খিচুড়ি রান্না করে,টিফিন ক্যারিয়ারে ভ’রে সৌমেনকে বললাম, “এই টিফিন কেরিয়ারটা দীপালীদের দিয়ে এস। ভিতরে ঢোকার দরকার নেই। দরজার বাইরে রেখে চলে আসবে। আমি ফোনে জানিয়ে দিচ্ছি। ও নিয়ে নেবে।“
সৌমেন সেটা পারেনি। ও ভিতরে ঢুকে দীপালীর হাতে টিফিন ক্যারিয়ারটি ধরিয়ে দিয়েছে, ওদের খবরাখবর নিয়েছে। বলে এসেছে, কাল আবার খাবার দিয়ে যাবে।
আমি শুনে সৌমেনকে খুব বকাবকি করলাম এসব বাড়াবাড়ি করবার জন্য। ও বলল, “ওভাবে পালিয়ে আসা যায়। দিপালী আমাকে দেখতে পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। ওর স্বামীকে আজ-কালের মধ্যে কোয়ারান্টাইন সেন্টারে নিয়ে যাবে শুনলাম।“
“সেই ভালো। নাহলে সবার হয়ে যাবে। তুমি আর দেরী না করে কাপড় কেচে, স্নান করে এসো।“
ভয়ে ভয়ে দিন কাটছে। আজ এর বাড়ি কাল ওর বাড়ি থেকে দুঃসংবাদ এসেই চলেছে। পুলিশ,স্বেচ্ছা-সেবকরা অসুস্থ মানুষ জনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কোয়ারান্টাইন সেন্টারে। শহর ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে কোয়ারান্টিন সেন্টার করা হয়েছে। কিছু ডাক্তার, নার্স সেখানে ডিউটি দিচ্ছে।
এর ঠিক চারদিন পর দোকান থেকে সৌমেন বাড়ি এসে কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়ল। গায়ে হাত দিতেই বুকটা ধক করে উঠল। জ্বর! রোজ অবেলায় স্নান করার ফল ভেবে মনকে প্রবোধ দিলেও বুকের ভিতর খচখচানিটা থেকেই গেল।
তিন দিন পেরিয়ে গেলেও সৌমেনের জ্বর কমল না। একদিন খেতে বসে সৌমেন বলল, “খাব কী করে? খাবারের স্বাদ, গন্ধ কিছুই পাচ্ছি না, কেবল তেতো স্বাদটাই যা একটু পাচ্ছি। আচ্ছা, আমার ‘করোনা’ হয়নি তো?”
আমি ততক্ষণে যা বোঝার বুঝে নিয়াছি। তবু মুখে বললাম, “যত সব আজে বাজে কথা! জ্বর হলে জিভ তেতো হয়ে থাকে”।
দেখতে দেখতে পাঁচ দিন কেটে গেলেও যখন সৌমেনের জ্বর কমল না। হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করাতে, রিপোর্ট এল- “করোনা পজেটিভ”।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লেও কাউকে কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম।
সৌমেন বলল, “আমি কোয়ারান্টিন সেন্টারে ভর্তি হয়ে যাই। না হলে তোমারও হবে। সেই সাথে যে আসছে তারও”।
আমি তখন পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্তা।
কাউকে কিছুই করতে হোল না। সাত দিনের দিন হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবকেরা এসে সৌমেনকে কোয়ারান্টাইন সেন্টারে নিয়ে গেল।
সৌমেনের সাথে সেই আমার শেষ দেখা। আমি একা, গৃহবন্দী। সারাদিন দুশ্চিন্তায় কাটে। রাত কাটে বিনিদ্রভাবে। কারও কাছে গিয়ে কথা বলব সে উপায়ও নেই।
সৌমেনকে কোয়ারান্টাইন সেন্টারে নিয়ে যাবার ১০ দিনের মাথায় আমার জ্বর এল, সাথে পাতলা পায়খানা। নিজের জন্য ভাবিনা। পেটে যে আছে তার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লাম। নিজেই স্বেচ্ছা-সেবকদের সাথে যোগাযোগ করে নিজের অসুস্থতার কথা জানালাম। তখন একটা কথাই আমার মনে হতে লাগল- কোয়ারান্টাইন সেন্টারে গেলে সৌমেনের সাথে দেখা হবে। সেন্টারে তখন আর রোগী রাখার জায়গা নেই। যাদের অবস্থা স্থিতিশীল তাদের বাড়িতেই কোয়ারান্টিন করে রাখা হচ্ছে। আমাকেও তেমন ভাবে রাখা হোল। বাড়িতেই থাকি, ওরাই দুবেলা খাবার দিয়ে যায়।
কয়েকদিন পর আমার চরম সর্বনাশটি ঘটে গেল। রাত থেকে তলপেটে যন্ত্রণা,যে ডাক্তার বাবুকে ফোনে জানাতে উনি বললেন, “দেখতে যাওয়া সম্ভব নয়, বেড-রেস্টে থাকুন। অনেক সময় স্ট্রেস থেকে ওই রকম সিমটম হয়।“
ভোরের দিকে যন্ত্রণা তীব্র আকার নিল। বাথরুমের কোমোডে গিয়ে বসতেই প্রচণ্ড যন্ত্রণার সাথে আমার শরীর থেকে কিছু একটা বেরিয়ে গেল, সেই সাথে আমার শরীরের সমস্ত রক্ত যেন হড় হড় করে নেমে যেতে থাকল।
বাথরুম থেকে শরীরটাকে টেনে বিছানায় এনে ফেললাম। তিনদিন একই অবস্থায়, রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকলাম। নড়া-চড়া করার ক্ষমতা নেই। চতুর্থ দিনে উঠে রক্তমাখা কাপড় চোপোড় থেকে নিজেকে মুক্ত করে, বিছানা ও বাথরুমটাকে ব্যবহার যোগ্য করলাম।
এই কয়েকটা দিন নিজেকে নিয়েই ছিলাম। এবার সৌমেনের চিন্তাটা আমাকে অস্থির করে তুলল। স্বেচ্ছা-সেবকরা আমাকে খাবার দিতে এলে তাদের কাছে সৌমেনের খবর জানতে চাইলাম। তারা জানাল, এখানকার কোয়ারান্টিনে যারা ছিল তাদের সবাইকে ভালো চিকিৎসার জন্য কোলকাতায় পাঠানো হয়েছে। তারপর আর কোনও খবর তাদের কাছে নেই।
এর কয়েকদিন পর আমার পীড়াপীড়িতে স্বেচ্ছা-সেবকদের একজন বলল,”এখান থেকে যারা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে কেবল একজন সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে”।
আমি ভাবলাম সে নিশ্চয় সৌমেন। আমি অস্থির হয়ে বললাম, “যে ফিরে এসেছে সে এখন কোথায়?”
”তাকে একটা স্কুলে রাখা হয়েছে। চারদিন অব্জারভেশনে রাখার পর তাকে বাড়ি পাঠানো হবে। সম্ভবত লোকটার মাথার গোলমাল হয়ে গেছে- আবোল তাবোল বকছে। তার বাড়িতে খবর পাঠনো হয়েছে, তারা এখনও কোনও যোগাযোগ করেনি”।
“আমি একবার তাকে দেখতে যেতে পারি? আমি তো এখন সুস্থ হয়ে গেছি”।
“সে আপনার স্বামী নয়। সে ‘সুবাটি’র মানুষ, নাম নরেন মাঝি। আপনার স্বামীর খবর পেলে আপনাকে জানানো হবে।”
তবুও আমি আশা ছাড়লাম না। একদিন সেই স্কুল গিয়ে হাজির হলাম। মাঠের মাঝখানে স্কুল বাড়িটার সার সার কামরাগুলির সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ। একটা জানালা খোলা দেখে সেখানে উঁকি দিতেই দেখতে পেলাম, বছর পঞ্চাশের শীর্ণ চেহারার একটা লোক ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে সে এগিয়ে এল। ভাষাহীন দৃষ্টি মেলে আমার দিকে চেয়ে থাকল। আমি একবুক হতশা নিয়ে ফিরে এলাম।
অনেকে বলল, সৌমেন নিশ্চয় বেঁচে আছে, যারা কোয়ারান্টিনে মারা গেছে তাদের ডেডবডি বাড়ির লোককে দেখানো হয়েছে। এখন আমার উচিত উপর মহলে খোঁজ করা।
উপায়ান্তর না দেখে, সৌমেনের বাড়িতে ফোন করে ওর ভাই দীপেনকে পুরো ঘটনাটা জানালাম। দীপেন একবার ঘাটশিলায় আমাদের কাছে এসেছিল। তাকে বেশ ভদ্র বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু ফোনে তার কথা বার্তায় ভদ্রতার লেশ মাত্র পেলাম না। পরিবর্তে যে ভাষায় আমার সাথে কথা বলতে শুরু করল, অন্য সময় হলে আমার মাথা গরম হয়ে যেত। তাকে দুকথা না শুনিয়ে পারতাম না। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন, আমি সেসব গায়ে না মেখে মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, “আমাকে গালাগাল দেবার অনেক সময় পাবে। এখন তোমার দাদা কোথায়, কেমন ভাবে আছে সেই খবরটা যোগাড় করার চেষ্টা কর।”
প্রতিদিন সৌমেনের বাড়িতে ফোন করি - যদি কোনও খবর মেলে। কিন্তু প্রতিদিন হতাশ হই। ফোন করলে ওদিক থেকে বেশির ভাগ সময় ফোন তোলে না। যদিবা তোলে একটাও বাড়তি কথা না বলে, ‘খবর পেলে জানাব’ বলে ফোন রেখে দেয়। আমি কীভাবে আছি সে প্রশ্নের ধার দিয়েও যায় না। আমি অবশ্য সে আশা করি না।
আমিও চুপচাপ বসে নেই। যে যেমন বলছে তেমন ভাবে খোঁজ করছি। সব জায়গা থেকে একটা কথাই শুনতে হচ্ছে- এখানকার সেন্টার থেকে কয়েক দফায় কোলকাতায় রোগী পাঠানো হয়েছে বা এখনও হচ্ছে। যারা মারা যাচ্ছে তাদের ডেডবডি তাদের বাড়ির লোকেদের দেখানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত আমি ছাড়া এমন অভিযোগ কেউ করেনি।
“ডেডবডি বলছেন কেন? আমার স্বামী তো বেঁচেও থাকতে পারে?” একদিন থাকতে না পেরে এক অফিসারকে আমি বললাম।
“সেটা হবার নয় ম্যাডাম, বেঁচে ওঠা মানুষদের নিয়ে গণ্ডগোল হবার কোনও সম্ভাবনা নেই। ডেডবডি নিয়েই কিছু কিছু সমস্যা হচ্ছে। হয়তো বাড়িতে সবার করোনা হয়েছে, তাই খবর দিলেও ডেডবডি দেখতে কেউ আসতে পারছে না। আবার অনেকে করোনার ভয়ে আপনজনের ডেডবডি দেখতে আসছে না। আবার আপনি বলছেন আপনাকে নাকি কোনও খবরই দেওয়া হয়নি”।
“না, হয়নি। আমি মিথ্যা বলছি বলে মনে হচ্ছে আপনার?”
“না ,না, তা বলব কেন? আপনি আমাকে ভুল ভাবছেন।“
“তাহলে এখন আমার কী করনীয় আপনিই বলুন”।
“কী বলি বলুন তো! ওখানকার পাঠনো ডেডবডির হিসাবের সাথে এখানকার হিসাব মিলিয়ে দেখলে তবেই আসল সত্যিটা বোঝা যাবে। কিন্তু এখন তো সেটা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে, একটা কথা বলি আপনাকে কিছু মনে করবেন না, উনি বেঁচে আছেন এই ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন”।
রেগে উঠতে গিয়েও নিজেকে কোনও মতে সামলে নিলাম।
“শুনুন, আপনি আপনার স্বামীর ছবিসহ নাম ,পরিচয়, কবে কোন সেন্টারে ভর্তি হয়েছিল সমস্ত উল্লেখ করে, ‘এই মানুষটির খবর চাই- জীবিত অথবা মৃত’ এই বয়ানে একটা দরখাস্ত জমা দিতে পারেন”। আমাকে উঠতে দেখে অফিসারটি ফের বললেন।
বাড়ি এসে সৌমেনের বাড়িতে ফোন করলাম। সেদিন অন্যদিক থেকে সৌমেনের এক বোন ফোন ধরল। আমি সৌমেনের ভাই দীপেনকে চাইতে সে বলল, দীপেন মানে তার ছোড়দা আজ ব্যস্ত আছে। তাদের বাড়িতে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান আছে। আজ সে কারও ফোন ধরতে পারবে না।
“কার শ্রাদ্ধ? প্রায় দিনই তো আমার সাথে কথা হচ্ছে, তেমন কিছু শুনিনি তো?”
“বড়দার।” সৌমেনের বোন ধরা গলায় বলল।
“বড়দার! মানে সৌমেনের! “
আমাকে নীরব শ্রোতা পেয়ে সৌমেনের বোন একাই বলে যেতে লাগল, ধরা গলা তখন তীক্ষ্ণ, বিষময়—তার ছোড়দা উপর মহল থেকে খবর যোগাড় করেছে, তার বড়দা কোলকাতার কোয়ারান্টিন সেন্টারে মারা গেছে। সেন্টারের পক্ষ থেকে ডেডবডি দেখার জন্য গার্জেন হিসাবে মহাশ্বেতার কাছে খবর পাঠানো হয়েছিল। কিন্ত দুদিন অপেক্ষা করেও কোনও সাড়া না পেয়ে তাকে গণচিতায় দাহ করা হয়েছে। সেই সাথে সে আরও বলল, মহাশ্বেতা তখন নিজের করোনা হয়ে যাবে এই ভয়ে স্বামীর ডেডবডি দেখতে যায়নি। এখন মিথ্যা অজুহাত সাজিয়ে শ্বশুর বাড়ির লোকের সহানুভূতি আদায় করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেটা হবার নয়। তাদের দাদাই যখন নেই তখন কিসের বৌদি! মহাশ্বেতার জন্যই তাদের দাদার অকাল মৃত্যু হয়েছে। মহাশ্বেতা আর কখনও যেন তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে।
সৌমেনের বোন আরও অনেক কিছু বলে গেল। সবগুলো আমার কানে গেলেও মাথায় পৌঁছালো না। এত হতাশার ভিতরেও কোথাও একটা আশার ক্ষীণ রশ্মি আমার ভিতর জেগে ছিল, সেই মুহুর্তে সেটা চিরতরে নিভে গেল। কেন কে জানে কান্নাও এলনা। শুকনো চোখে সারা রাত একভাবে বসে থাকলাম।
ভোরের আলো ফোটার আগে, বাড়িতে তালা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। সম্বল বলতে একটা আংটি বিক্রীর কিছু টাকা। রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই চলে। কিছু যানবাহন এখন অনিয়মিত ভাবে যাতায়াত করছে। আগু-পিছু না ভেবে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রেনে উঠে পড়লাম। ফাঁকা কামরায় কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙতে দেখি, ব্যাগের টাকা ও মোবাইলটা উধাও। এরপর কীভাবে এখানে এসে পৌঁছেছি, আমি নিজেও জানি না। এক সময় দেখি, আমি এ বাড়ির বাইরের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আর আমার সামনে সাদা সিঁথি, সাদা শাড়ি পরে আমার মা।
“এখন আমি বেঁচে কী করব? কার জন্য বাঁচব?” মহাশ্বেতা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।
ওর মা ওকে সান্ত্বনা দিতে গেলে, আমি তাকে থামতে বললাম, “ওকে কাঁদতে দিন, মনের ভিতরকার জমাট বাঁধা পাথরটা গলে না যাওয়া পর্যন্ত ও হাল্কা হতে পারবেনা”।
মহশ্বেতা এখন একেবারে সুস্থ। সে আবার গান শিখতে শুরু করেছে। সেই সাথে কিছুজনকে গান শেখায়। পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাচ্ছে - ওপেন ইউনিভার্সিটিতে। ওর মা এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। মহাশ্বেতা আগের মহাশ্বেতা হয়ে উঠতে পারবে কি না জানিনা। তবে এতকিছুর পর যতটুকু পারে তাই বা কম কী!
(চলবে)
0 Comments
Post Comment