এক  টুকরো আকাশ (পর্ব-৩)

  • 06 November, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 65 view(s)
  • লিখেছেন : মীরা কাজী
মেহেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর  একটা ব্যাপার জয়িতাকে  নাড়া দিতে থাকে-  সেও তো পারে! “অবশ্যই পারবে”। জয়িতার ইচ্ছার কথা শুনে মেহেক জোর দিয়ে বলেছিল। এরপর ফর্ম তোলা থেকে শুরু করে ভর্তি হওয়ার  ব্যাপারে  সমস্ত কিছুতে জয়িতাকে সঙ্গ দিয়েছিল মেহেক। ততদিনে অবশ্য মেহেক জয়িতার  বন্ধু হয়ে গেছে। আসা যাওয়ার পথে জয়িতার সাথে দেখা না করে সে যায়না। ট্রেনের দেরী থাকলে বাড়তি সময়টা জয়িতার সঙ্গে আড্ডা দেয়।

                                                            পর্ব-  (গ)

জয়িতা   

        ফর্সা, দোহারা গড়ন , হাসি-খুশি মেজাজের তরুনী জয়িতা। তার মনের বীনার সব কটা তার যেন চড়া সুরে বাঁধা। হাসে হা-হা করে। কথা বলে উচ্চস্বরে।  হৈ হৈ করে বাঁচাটাই তার ধাত। মেন রোডের উপর ছোট্ট  এক তলা ছিমছাম বাড়িটার দরজা সবার জন্য খোলা। সামনে গ্রিল দিয়ে ঘেরা এক চিলতে বারান্দা। তারপর ভিতরে ঢুকেই বসার ঘর। শুধু মাত্র বসার ঘর বললে ভুল হবে, সেটি তার কর্মক্ষেত্রও। এখানে বসে  কিছু মেয়েকে সে সেলাই শেখায়। নিজেও এখনো  একটা সেলাই স্কুলে সেলাই শেখে।  ছেলে সাম্ব ব্যাঙ্গালুরুতে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে।  স্বামী নির্মল কাজের সুত্রে বোম্বেতে ।

     শ্রাবন মাসের এক বিকেল।  প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি পড়ছে।  জয়িতার কাছে যারা সেলাই শিখতে আসে রবিবার তাদের ছুটি। জয়িতার হাতে কোনো কাজ নেই।  নিজের জন্য যাহোক কিছু রান্না করে নিয়ে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছিল সে। মনের কোনে একটা গান গুনগুনিয়ে উঠছিল।  রাস্তা জন মানবহীন  দেখে জয়িতা স্বরগুলিকে  মুক্ত করে দিল , “ নীল অঞ্জনঘন কুঞ্জ ছায়ায় সম্বৃত অম্বর---হে গম্ভীর--“   বৃষ্টির ঝাফরির ভিতর  দিয়ে জয়িতা দেখল, একজন মহিলা  ভিজতে ভিজতে হাঁটছে। বৃষ্টির দাপট এত বেশি  ছাতায় জল আঁটছে না , উল্টে ছাতা সামলাতে মহিলাটি নাস্তানাবুদ হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই জয়িতার গান বন্ধ হয়ে গেল।  মহিলাটির পরনের শাড়ি গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে । বিশেষ করে পায়ের দিকে  ভেজা শাড়ি জড়িয়ে যাবার কারণে হাঁটতে বেগ পেতে হচ্ছে। কাঁধের ব্যাগটাও ভিজে চুপ চুপে।  মহিলাটি সম্ভবত স্টেশনের দিকে যাচ্ছে। জয়িতার বাড়ি থেকে স্টেশনের দূরত্ব  পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের রাস্তা। তবে আজকের  ব্যাপার  আলাদা।  রাস্তায় কোনো রিক্সা বা টোটোর দেখা নেই।

“শুনছে-এ-ন?” মহিলাটির  উদ্দেশ্যে  হাঁক দিল জয়িতা।

জয়িতার গলা  কানে  যেতে  ঘাড় ঘো্রাতেই  জয়িতাকে দেখতে পেল মহিলাটি।

“এখানে একটু দাঁড়িয়ে যান”। জয়িতা আবার চেঁচিয়ে বলল।

মহিলাটি  আর  দেরী না করে জয়িতার বাড়ির দিকে এগিয়ে এল।  বারান্দার ছোট্ট গেট খুলে মহিলাটিকে ভিতরে ডেকে নিল জয়িতা। সঙ্গে সঙ্গে এক পশলা বৃষ্টি  বারান্দায়  ঝাঁপিয়ে নামল।

“ এহ! আপনার বারান্দাটা  ভিজে গেল!” সংকোচের সাথে বলল মহিলাটি।

       “ বাদ দিন । এখন বসুন”। ভিতর থেকে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে মহিলাটির দিকে এগিয়ে দিয়ে  বলল জয়িতা।

“আপনি স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলেন নিশ্চয়?”

“ জঙ্গীপুর লোকাল ধরার কথা ছিল। ধরা হলনা।  পরের ট্রেন আবার পাঁচটায়”।

“এদিকে কোনো কাজে?”

“ না। কলেজে এসেছিলাম।“

“আজ তো রবিবার?”

“ওপেন ইউনিভার্সিটি শনি রবিবার খোলা থাকে”।

সেদিন জয়িতার দেওয়া শুকনো শাড়ি পরে, চা- টা খেয়ে পাঁচটার লোকাল ধরে বাড়ি ফিরেছিল  মহিলাটি। তার মধ্যে  মহিলাটির সমন্ধে অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে জয়িতার। মহিলাটির নাম মেহেক। নিসন্তান মেহেক  সময় কাটানোর জন্য ফের পড়াশোনা  শুরু করেছে।     

       মেহেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর  একটা ব্যাপার জয়িতাকে  নাড়া দিতে থাকে-  সেও তো পারে! “অবশ্যই পারবে”। জয়িতার ইচ্ছার কথা শুনে মেহেক জোর দিয়ে বলেছিল। এরপর ফর্ম তোলা থেকে শুরু করে ভর্তি হওয়ার  ব্যাপারে  সমস্ত কিছুতে জয়িতাকে সঙ্গ দিয়েছিল মেহেক। ততদিনে অবশ্য মেহেক জয়িতার  বন্ধু হয়ে গেছে। আসা যাওয়ার পথে জয়িতার সাথে দেখা না করে সে যায়না। ট্রেনের দেরী থাকলে বাড়তি সময়টা জয়িতার সঙ্গে আড্ডা দেয়।

      শুধু কি মেহেক! কলেজে ভর্তি হবার কিছু দিনের মধ্যেই  সহপাঠিরা জয়িতার ভাই - বোন-বন্ধু হয়ে উঠল।  জয়িতার একলা সংসার এখন কলেজের ভাই- বোনেদের হাসি কলতানে মুখর।

“ জয়িদি! শিগগির দরজা খোল? বাথরুম  যাব”।

“ জয়িদি! এক কাপ চা খাওয়াও না গো। বড্ড মাথা ধরেছে”।

“ জয়িদি,  দুশো টাকা ধার দাও না। খুব অসুবিধেয় পড়ে গেছি”।

“ জয়িদি!  বাড়ি ফেরার লাস্ট ট্রেনটা মিস করলাম।  রাতটা তোমার কাছে থাকব। বাড়িতে ফোন করে জনিয়ে দিয়াছি”।

এমন কত শত আবদার হাসি মুখে সামলায় জয়িতা।  আমিও এখন সময় সুযোগ পেলে জয়িতার কাছে  কিছুক্ষণ কাটিয়ে যাই।

“জয়িতা তোমার বাড়ি আজ  ফাঁকা কেন ? তোমার সাঙ্গ-পাঙ্গরা গেল কোথায়?” সেদিন জয়িতাকে শুধোলাম।

“ দল বেঁধে কোন একটা দোকানে গেছে।   আবার বায়না কত?   ওদের জন্য মুড়ি মেখে রাখতে হবে। এসে চায়ের সাথে খাবে”।

  “তোমার চা-চিনির খরচ তো অনেক বেড়ে গেছে?”

“ শুধু কি চা-চিনি?  জানেন দিদি?  বিস্কুট, চানাচুর, চিপস  এসব তো আছেই,  স্যানিটারি ন্যাপকিন শুদ্ধ আমাকে এক্সট্রা কিনে রাখতে হয়!  কেউ একজন দুম করে এসে বলল, জয়িদি!  চেঞ্জ না করে আর  পারছিনা।  কাল ফেরত দিয়ে যাব।  দেবে তো কত আমার জানা। কেবল মুখেই”। বলে হো হো করে হাসতে শুরু করল জয়িতা।

  “তোমাকে ওরা খুব জ্বালাতন করে  দেখছি!”

“ আমি  ওভাবে ভাবিনা।  কলেজে ভর্তি হবার পর  আমি খুব ভাল আছি দিদি। আমি একটা নতুন জীবন পেয়েছি।  না হলে আমি তো একটা সময় হাসতে ভুলে গিয়েছিলাম”।  কিছুটা উদাস  হয়ে বলল জয়িতা।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। সেদিনের মত উঠে পড়লাম। কারো ব্যাক্তিগত ব্যাপারে কৌতূহল করা উচিত নয়।

   ডেঙ্গু হবার পর থেকে  জয়িতাও আমার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।  এখন অনেক কিছুই আমার সাথে শেয়ার করে।  একদিন সে নিজে থেকেই তার গোপন ব্যথার জায়গাটি আমার কাছে প্রকাশ করে।

     আঠারো পুরো হবার আগেই জয়িতার বিয়ে হয়ে যায়। ছেলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার। দাবি দাওয়া নেই । মধ্যবিত্ত পরিবারে এমন পাত্র লাখে একটা মেলে। নির্মল ও তাদের বাড়ির সবার  জয়িতাকে পছন্দ হয়। বিয়ের পর  বরের সাথে জয়িতার স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি  হয়না।  তার বন্ধুদের মধ্যে যাদের  জয়িতার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের মুখ থেকে বিবাহিত জীবন সম্পর্কে কিছুটা  জানা হয়েছে। নিজের  জীবনের সাথে সেগুলো মেলে না। শ্বশুর,শাসুড়ি, দেওর, ভাসুর, জা নিয়ে যৌথ পরিবারে দিনের বেলায়  নির্মলের সাথে জয়িতার খুব একটা কথা হয়না। অফিস থেকে ফিরে নির্মল ফের বেরিয়ে যায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেশ রাত করে বাড়ি ফেরে। সারাদিন জয়িতা এই সময়ের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। প্রায় মাঝরাতে বিছানায়  দুটি শরীর কাছাকাছি হয়।  কিছু মামুলী কথা, সঙ্গে কিছুটা  আদর । এর বেশি কিছু নয়। তবে সেই আদরের তীব্রতা এত বেশি জয়িতার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।  কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর  নির্মল পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। কষ্ট হলেও  ততক্ষনে জয়িতার  শরীর জেগে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে সেটাকে দমন  করার চেষ্টা করে জয়িতা। প্রতি রাতে  জ্বলে ওঠা শরীরটা নেভাতে নেভাতে  অভিমানে খান খান  হয় জয়িতা। ক্রমশ  নির্মলের প্রতি একটা ক্ষোভ তৈরি হয়। কিন্তু নির্মল নির্বিকার। দিনের বেলাটা সংসারের বিভিন্ন কাজে সময় কেটে যায়। ননদ, জা নতুন বৌ জয়িতাকে নিয়ে নানান রসিকতা করে।  তাদের রসিকতায়  লজ্জা পাবার  বদলে  জয়িতা বিরক্ত বোধ করে। সেখান থেকে উঠে চলে যায়।

“ তোমার বৌএর খুব দেমাক!”  একদিন খেতে বসে নির্মলের বৌদি নির্মলকে বলে। জয়িতা যে কাছাকাছি আছে তারা জানত না।

“আমাদিকে তো পাত্তাই দেয়না। তোমার সাথে কথা টথা বলেতো? নাকি পায়ে ধরে সাধতে হয়?” নির্মলকে নিরুত্তর দেখে তার বৌদি ফের বলে।

“ আমার বয়েই গেছে সাধতে? ওই আমাকে  সাধে “। নির্মল বলে।

“ওমা! তাই! এদিকে আমরা একটু মজা করলে উঠে পালায়!”

সেদিন রাতে নির্মল জয়িতাকে  কাছে টানতে এলে জয়িতা  রাগে ফেটে পড়তে গিয়েও পারে না।  পাশাপাশি ঘর । পাশের ঘরে তার শ্বশুর- শাশুড়ি থাকেন।  যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে বলে, “ আমি এভাবে নিজেকে প্রতি রাতে অপমানিত হতে দেব না।  আমি তো তোমার কাছে আমার দাবি পেশ করি না। আমার  বিধি লিপি বলে মেনে নিয়েছি। তুমিও নিজের অক্ষমতাকে স্বীকার করে নিয়ে সরে থাক।  আর নয়”।

“ বিধিলিপি তোমার না আমার? নইলে তোমার মত স্ত্রী জোটে? যার কোনো ক্ষমতা নেই পুরুষ শরীরকে  জাগিয়ে তোলার!”

“ কি বললে?”

“ যা সত্যি তাই বলেছি। অপদার্থ  মেয়ে মানুষ!” জয়িতাকে ধাক্কা দিয়ে বিছনার কিনারায়  সরিয়ে দিয়ে বলে নির্মল।

জয়িতা আর পারেনা। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে ঠিক করে নেয় – কালই এখান থেকে চলে যাবে।

     হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই জয়িতাকে দেখে তার বাবা-মা  ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। এভাবে মেয়ের চলে আসাকে তারা ভালো চোখে দেখেনা।  নির্মলের সাথে কথা কাটাকাটি  করে চলে এসেছে শুনে জয়িতাকে তারা বকাবকি করে। সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা নির্মলের বাবাকে ফোন করে জয়িতার এমন আচরণের জন্য ক্ষমা চায়। বলে, দিন কতক পরে জয়িতাকে  ওবাড়িতে  পৌঁছে দেবে।

  বাবাকে অবশ্য যেতে হয়না। দিন কতক পরে নির্মল এসে হাজির হয়, জয়িতার বাবা-মা আশ্বস্ত হয় নির্মলকে দেখে। রাতে যথারীতি নির্মল জয়িতাকে আক্রমণ করে। এদিনের আক্রমণের মাত্রা যেন অন্যদিনের চেয়ে বেশি। যেন কোন ক্ষুধার্ত জন্তু মুখের কাছে  শিকার পেয়েও সেটাকে গলাধঃকরণ করতে না পারার ব্যর্থতায়  দাপাদাপি করছে।  জয়িতা  বাধা দিলে বিশ্রী ভাষায় গালি দিতে থাকে । সহ্য করতে না পেরে জয়িতা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, প্রায় সারা রাত সে বাইরে কাটায়। সকালে উঠে নির্মল  ফিরে যায় । যাবার আগে বলে যায় সামনে সপ্তাহে এসে জয়িতাকে নিয়ে যাবে।

   জয়িতা ভিতরে ভিতরে ছটফট করছে, নির্মলের বেয়াড়া আচরণের কথা ভেবে ক্রমশ মুষড়ে পড়ছে, এমন সময় একদিন সুকুমারের সাথে তার দেখা হয়। সুকুমার  জয়িতার ছোটবেলার বন্ধু। একটা সময় সে জয়িতাক পছন্দ করত। একই পাড়ার ছেলে। তার উপর দেখতে সুপুরুষ  নয়। বাড়ির অবস্থাও নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কত সুন্দর দেখতে ছেলেরা জয়িতার দিকে তাকিয়ে থাকে। জয়িতার কাছে সুকুমার পাত্তা পায়নি।

“কবে এলি রে?” জয়িতাকে দেখে  সুকুমার বলে।

“এই তো কদিন হল?”

“ সুকুমার, তোর সাথে একটু দরকার ছিল”।

“ আমার সাথে? তা বলনা? কি বলবি?”

“ এখানে নয়। একদিন বাড়িতে আয় বলব”।

“ কবে যাব বল?  কাল?”

“ আমি তোকে ফোন করে ডেকে নেব”।

“ ঠিক আছে। ডাকিস”।

জয়িতাদের পাড়ায় একটা বিয়ের নেমন্তন্ন ছিল। জয়িতার ও ছিল। কিন্তু শরীর খারাপের  অজুহাত দেখিয়ে  সে যায়না।  মা –বাবা বেরিয়ে গেলে সে সুকুমারকে ফোনে ডাকে।

“ কি বলবি বল? আমার একটু তাড়া আছে”।  কিছু পরে সুকুমার এসে বলে।

“সেতো দেখতেই পাচ্ছি। একেবারে রেডি হয়ে এসেছিস”।

  “তোকে এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?  বরের জন্য মন খারাপ?”

“খু-উ-ব”।

“ তাহলে ফোন করে ডেকে নে?”

“তাই নেব। তুই দাঁড়িয়ে থাকবি? বসবিনা”?

“  বসলাম। এবার বল কি বলবি?”

“অনেক কিছু বলতে চাই। কিন্তু তুই তো এসেই পালাই পালাই করছিস?”

“তাহলে  বরং আর একদিন আসব। আজ  বিয়ে বাড়ি যেতে হবে”।

  “আর  হয়তো সময় হবেনা রে?”

  “আচ্ছা   বল । বিয়ে বাড়ি না হয় দেরিতেই যাব”।

জয়িতা তার দাম্পত্য সম্পর্কের কথা সুকুমারের কাছে খুলে বলে ।

“এরপরও তুই ওবাড়িতে যাবার কথা ভাবছিস?”

“ কি করব তুই বল? বাবার ঘাড়ে বসে খাব?”

“তুই আর যাসনা। তোর ভালোর জন্য বলছি। অন্য কথা পরে ভাববি”।

“ সত্যি তুই আমার ভাল চাস?”

“ চিরকাল চেয়ে এসেছি।  আজও চাই”।

“তাহলে আমাকে তুই একটিবারের জন্য গ্রহণ কর। পুরোপুরি ভাবে”। সুকুমারের কাছে নতজানু হয় জয়িতা।

“জয়ী!” জয়িতার আচরণে হতচকিত হয়ে ওঠে সুকুমার

“পারবি না?  শুধু একবার? তুই রাজি নাহলে মরা ছাড়া আমার গতি নাই ! “

“ছাড়? ছাড় আমাকে? কি করছিস ? তুই কি পাগল হয়ে গেলি?”

সুকুমার যত ছটফট করে জয়ী ততই তাকে আষ্টে পিষ্টে বেঁধে ফেলে, অক্টোপাসের মত। শেষ পর্যন্ত সুকুমার আর পারে না। জয়িতার আহ্বান উপেক্ষা কররার ক্ষমতা ততক্ষণে তার আর নেই।

          পরের সপ্তাহে নির্মল এসে জয়িতাকে নিয়ে যায়। পরের মাসেই জয়িতা নিজের শরীরের পরিবর্তন  লক্ষ করে- মাথা ঘোরা, গা বমি ভাব। জয়িতা মা হতে চলেছে। বাড়ির সবাই খুশি। জয়িতার মা –বাবার কাছে খবর যায়। তারাও যার পর নাই খুশি হয়। কেবল নির্মলের মুখ হাঁড়ি।

“এটা কি করে হল?” জয়িতার কাছে  কৈফিয়তের সুরে বলে নির্মল।

“কোনটা?”

“পেটে কার বাচ্চা বয়ে বেড়াচ্ছ?”

“আমার পেটে আমার ছাড়া কার বাচ্চা বয়ে বেড়াব?

“ওটার বাপ কে?”

“ কেন  তুমি ?”

“ ন্যাকামি  হচ্ছে?”

“ কিসের  ন্যাকামি সেটাই তো বুঝতে পারছিনা?”

“ ফের উলটো পালটা কথা?”

“আচ্ছা জ্বালা! তাহলে তুমি কি শুনতে চাইছ বল? “

“ বাচ্চার বাবা কে সেটাই শুনতে চাইছি!”

“তাহলে তুমি স্বীকার করে নিচ্ছ তুমি অক্ষম?”

“একদম কথা ঘোরাবে না? সত্য বল, বাপের বাড়ি গিয়ে কার সাথে কি ঘটিয়ে এলে?”

“ তোমার মত অমন স্বামী থাকতে কার সাথে কি করব?”ব্যাঙ্গের হাসি হাসে জয়িতা।

নির্মল এবার সরাসরি জয়িতাকে আক্রমণ করে বসে। দুহাতে জয়িতার গলা টিপে ধরে। জয়িতা প্রাণপনে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ভাবে, আজই বুঝি তার জীবনের শেষ দিন। সন্তানের মুখ দেখা বুঝি তার আর হল না। ঠিক সেই মুহূর্তে কি মনে করে নির্মল তার হাতের চাপ আলগা করে দেয়। বুক ভরে শ্বাস নেয় জয়িতা। তার পর বিছানায় লুটিয়ে পড়ে।

“তোমার মুখ দেখতে আমার ঘেন্না করছে!” হিস হিস করে ওঠে নির্মল।

“ তোমার আজ করছে?  আমার  সেই প্রথমদিন থেকে তোমাকে ঘেন্না করে”। কাশতে কাশতে  কোনোমতে বলে জয়িতা।

“লজ্জা করে না? অন্যায় করে আবার বড় বড়  কথা বলছ?”

“আমার লজ্জা বা অন্যায়ের  কথাটা তুমি সবার কাছে চাউর করে দিতে পার। এখনো সময় নিচ্ছ কেন বুঝতে পারছি না? ভয় পাচ্ছ তো, তাতে তোমার  কেলেঙ্কারীটাও ধরা  পড়ে যাবে?”

“ আবার?” নির্মল ফের দুহাত উঁচিয়ে  এগিয়ে আসে বিছানায় ধুঁকতে থাকা জয়িতার দিকে। কিন্তু কিছু না করে শুধু আগুন ঝরা দৃষ্টিতে জয়িতা ভস্ম করে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।  অবধারিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে জয়িতার  ভিতরটা তখন কাঁপতে লেগেছে। এত সবের মধ্যেও  শরীরের কষ্ট ছাপিয়ে একটা নাম না জানা সুখ, কিছু একটা জিতে যাওয়ার আনন্দ তাকে জড়িয়ে ধরে। জয়িতা কাঁদতে ভুলে যায়।

       নির্মলের আঙ্গুলের দাগ জয়িতার গলায় নীল বর্ণ হয়ে ফুটে উঠেছে। আয়নায় নিজেকে দেখতে গিয়ে চমকে ওঠে জয়িতা। কেউ দেখে ফেললে নানান কথা উঠবে। ফের একগুচ্ছের প্রশ্ন! এর থেকে রেহাই পেতে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে জয়িতা। এমনিতেই এখন তেমন কিছু কাজ তাকে করতে হয়না।  বড় জা দুপুরে খাবার জন্য তাকে ডাকতে এলে মাথা ঘুরছে বলে এড়িয়ে যায়। রাতেও সে খেতে যায়না। শাশুড়ি ডাকতে এসে  ফিরে গেলে নিশ্চিন্ত হয় জয়িতা।

  দিন পনেরো  পর নির্মল বদলী নিয়ে বোম্বে চলে যায়। এই পনেরো দিনের মধ্যে জয়িতার সাথে তার কোনো কথা হয়না। একই বিছানায় দুজনে দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকে।

    সঠিক সময়ে জয়িতার ছেলের জন্ম হয়। ছেলে হুবহু মায়ের মত দেখতে। জয়িতা এতদিন ভয়ে কাঁটা হয়েছিল তার ছেলে যদি সুকুমারের মত দেখতে হয় তবে বাপের বাড়িতে মুখ দেখাবার উপায় থাকবেনা। কিন্তু সেটা না হওয়ায় জয়িতা এদিক দিয়েও বেঁচে যায়।

      ছেলে হওয়ার খবর পেয়েও নির্মল আসেনা। কাজ আছে বলে এড়িয়ে যায়। কয়েক মাস পরে অবশ্য একবার  আসে, তার মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে, সাম্ব তখন হামা দিচ্ছে। জয়িতার ছেলের নাম সাম্ব। নির্মল তার দিকে ফিরেও দেখেনা। রাত জেগে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করতে হবে  এই অজুহাত দেখিয়ে রাতে পাশের ঘরে শোয়। অন্যরা কে কি বোঝে কে জানে তবে জয়িতা বুঝতে বাকি থাকে না।

      সাম্বর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার শাশুড়ি মারা  যান। কিছুদিন পরে শ্বশুরও। নির্মলের অন্য দুই ভাই নিজেদের মধ্যে সংসার ভাগাভাগি করে নেয়।  জয়িতা একা ছেলে নিয়ে তখনো  ওই বাড়িতে । সংসার খরচের টাকা নির্মল পাঠায়। নিতে ইচ্ছা না করলেও নিতে হয় জয়িতাকে। একদিন জয়িতার মা-বাবা জয়িতকে ওই বাড়ি ছেড়ে তাদের কাছে থাকতে বলেন। নির্মলের আচরণে  তারা বুঝে গেছে মেয়ে-জামাইয়ের সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরেছে। যেটা সারবার নয়।

  বরাবরের জন্য বাবা-মায়ের কাছে চলে আসে জয়িতা। এখানে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। প্রথমেই সে ঠিক করে, বাবা-মায়ের বোঝা হয়ে থাকবে না। আর নির্মলের দয়ার দানও সে নেবে না। কিছু একটা তাকে করতে হবে। সে কিছুটা সেলাই জানত। ভালোভাবে শেখার জন্য একটা সেলাই স্কুলে ভর্তি হয়।

     দেখতে দেখতে সাম্ব এখন বাইশ বছরেরে যুবক।  ম্যানেজমেন্টের একটা কোর্স করতে ব্যাঙ্গালোর চলে গেছে। সাম্ব কিছুটা বড় হবার পরই জয়িতা ওবাড়ি ছেড়েও চলে এসেছে। নিজের গয়নাগাটি বেচে জায়গাটা আগেই কিনেছিল। পরে কিছুটা ব্যাঙ্ক লোন, বাদ বাকি  বাবার সাহায্যে রাস্তার উপর এই একতলা বাড়ি।

নির্মলের সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই। সাম্ব নির্মলকে সেভাবে চেনার সুযোগ পায়নি। তাই বাবার সম্পর্কে তার কোনো রকম আগ্রহ নেই। বরং তার প্রতি একটা বিদ্বেষ মনে মনে পোষণ করে সে। জয়িতাদের  কাছে নির্মল এখন অতীত। তার  সমন্ধে কোনো কথা আজকাল আর কেউ তোলে না। তবুও  কোনো কারণে উঠলে সাম্ব উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

  একটানা এতগুলো কথা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে  জয়িতা। তার পর বলে,

“জান দিদি, অনেক বার ভেবেছি নিজেকে শেষ করে দিই । পরক্ষণেই ভেবেছি, জীবন তো একটাই দেখিনা কি হয়? ঠিক করেছি না ভুল করেছি জানি না, তবে এটুকু বিশ্বাস করি আমি  কোনো পাপ করিনি”।

“যদি কিছু মনে না কর, একটা কথা শুধোই?” এতক্ষণ ধরে নীরব শ্রোতা হয়ে জয়িতার কথা  শোনার পর এই প্রথম কথা বলি।

  “ তোমাকে তো সবটা খুলে বললাম। অনেকদিন থেকে কাউকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু তেমন কাউকে পাইনি।  তোমার কাছে লুকোবার আমার কিছুই নেই।  কি জানতে চান বলুন?”

“সুকুমারের খবর কি? তার সাথে যোগাযোগ আছে?”

“ এখানে আসার পর সে আমার সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছিল। আমার দিক থেকে সাড়া না পেয়ে চুপ করে গেছে।  সুকুমার ভীষণ রকমের ভীতু আর তেমনি ভাল মানুষ। আমি এখনো তাকে শ্রদ্ধা করি।  সেদিন  আমার জোরাজুরিতে হলেও নির্মল  আমার নারী জীবনকে ধন্য করেছিল। সে আমাকে পূর্ণতা দিয়েছে।

  জয়িতা আর কোনো কথা বলেনা। তার চোখের কোনে কিছুটা অশ্রু  চিক চিক করছে । সেটা কিছু পাওয়ার আনন্দের নাকি, না পাওয়ার  বেদনার বোঝার উপায় নেই।  আমি চুপচাপ সেখান থেকে উঠে পড়ি।  নিজেকে গুছিয়ে তোলার জন্য কিছু সময় একা থাকার প্রয়োজন জয়িতার। 

   চলবে-- 

                                               

লেখক : কথাসাহিত্যিক 

ছবি : সৌজন্য ইন্টারনেট 

 

0 Comments

Post Comment