পাস্তুর-‘কন্যা’ ক্যাথারিন ইভান্স

  • 28 June, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 562 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
আমেরিকার মতো দেশেও কাঁচা দুধ খাওয়া যে একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত নয় এবং পাস্তুরাইজেশনের মাধ্যমেই যে দুধের মধ্যে ভেসে থাকা জীবাণুকে অনেকটাই নাশ করা সম্ভব, সেই বিষয়ে প্রায় কোনও ধারণাই ছিল না। এই ধারণাকে সঠিক গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যিনি প্রথম জনসমক্ষে তুলে ধরেন, তিনি এ্যালিস ক্যাথারিন ইভান্স। তাঁর গবেষণার ফলশ্রুতি হিসেবেই, ১৯৩০ সালে মার্কিন স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে দুধের পাস্তুরাইজেশনকে বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করা হয়। নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক (পর্ব ১৯)

১৯৩০ বা ৪০এর দশকে, শিকাগো শহরের সবকটি নামজাদা সংবাদপত্রে মিল্ক পাস্তুরাইজেশন সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞাপন নিয়মিত প্রকাশিত হতো। তাতে লেখা থাকত যে খামারবাড়ি থেকে বেরোনো দুধে যদি সামান্য কয়েকটিও ব্যাক্টিরিয়া থেকে গিয়ে থাকে তবে সেই সামান্য সংখ্যক ব্যাক্টিরিয়াই কিন্তু উপভোক্তার বাড়িতে পৌঁছানোর সময় অবধি বেড়ে গিয়ে কয়েক লক্ষে পরিণত হতে পারে। বিজ্ঞাপনে আরও বলা হত যে শহরের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করা দুধের ক্ষেত্রেই প্রতি পনেরো ফোঁটাতে সংখ্যার হিসেবে দশ লক্ষ অবধি জীবাণু বা ব্যাক্টিরিয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এই দুধকে পরিশ্রুত না করে পান করাটা একেবারেই অনুচিত। এরপর বিজ্ঞাপনটিতে পাস্তুরাইজেশনের ব্যবহার ও উপকারিতা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া থাকত। খোদ আমেরিকার মতো দেশেও কাঁচা দুধ খাওয়া যে একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত নয় এবং কেবল পাস্তুরাইজেশনের মাধ্যমেই যে দুধের মধ্যে ভেসে থাকা জীবাণুকে অনেকটাই নাশ করা সম্ভব, সেই বিষয়ে প্রায় কোনও ধারণাই ছিল না। এই ধারণাকে সঠিক গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যিনি প্রথম জনসমক্ষে তুলে ধরেন, তিনি এ্যালিস ক্যাথারিন ইভান্স। যদিও একজন মহিলা হয়ে তিনি কিভাবে বিজ্ঞানের বিষয়ে মন্তব্য করছেন! – হ্যাঁ, বিংশ শতাব্দীর আমেরিকাতেও নিজের গবেষণা প্রকাশের সময় এ্যালিস ক্যাথারিনকে ঠিক এমন সমস্ত প্রশ্নেরই সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কি ভাগ্যিস তাতে এ্যালিস পথ হারিয়ে ফেলেননি। বরং কঠোরতর আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়েই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বৈজ্ঞানিক সত্যকে। সেই সংগ্রাম এক অনন্ত যাত্রাপথের ইতিহাস, যার শুরুটা হয়েছিল বোধহয়, সেই পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের ব্র্যাডফোর্ড কাউন্টির এক নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সাধারণ আটচালা ঘর থেকেই।

আমেরিকাতে আটচালা ঘর হত কি না জানা নেই। বোধহয় হত না। কিন্তু সত্যি সত্যিই এ্যালিস ক্যাথারিন ইভান্সের পিতা উইলিয়াম হোয়েল ছিলেন পেশাতে কৃষক এবং মা এ্যানি ইভান্স ছিলেন গ্রামীণ স্কুলের শিক্ষিকা। কাজেই খুব ছোটবেলা থেকেই মেয়েকে নিয়ম করে পড়তে বসাতেন বাবা উইলিয়াম এবং মা এ্যানি। ক্রমশ সাসক্যেহানা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এ্যালিস ক্যাথারিন ইভান্স স্কুলজীবনের অন্তিম পরীক্ষাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। এদিকে ছাত্রীজীবনে তিনি কিন্তু কেবলই বই মুখে নিয়ে সারাটাক্ষণ বসে থাকারও পাত্রী ছিলেন না। ডাকাবুকো এ্যালিস স্কুলের বাস্কেটবল দলেরও অন্যতম সদস্য ছিলেন। স্কুলের পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হবার পর এ্যালিসও মায়ের দেখাদেখি স্কুলশিক্ষিকার চাকরিতে যোগদান করেন। তাঁর স্মৃতিকথাতে এ্যালিস লিখেছেন, এই চাকরি যে তাঁর খুব একটা পছন্দের ছিল বা মনোমত ছিল তা নয়। কিন্তু সেই সময় আমেরিকাতে মেয়েদের পক্ষে আর অন্য কোনও চাকরিতে যোগ দেওয়াটা একেবারেই অসম্ভব ছিল। চার বছর পর, প্রামীণ শিক্ষিকাদের পড়াশোনার উন্নতির জন্য চালু হওয়া - কর্নেল ইউনিভার্সিটির বিশেষ একটি পাঠক্রমের আওতাতে এ্যালিস ক্যাথারিনও আরও অনেকজনের সঙ্গে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের আশায় নিজের নাম নথিভুক্ত করেন। এই পাঠক্রমের মাধ্যমেই তিনি ১৯০৯ সালে বৃত্তি-সহ ব্যাক্টিরিওলজিতে বি.এস. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর, প্রথম মহিলা হিসেবে তিনি উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ব্যাক্টিরিওলজিতে গবেষণার জন্য একটি স্কলারশিপ পান, এবং তার সুবাদেই ১৯১০-১১ সালে সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি ব্যাক্টিরিওলজিতে এম.এস. বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে সম্মানিত হন।

চাকরিজীবনের শুরুতে এ্যালিস আমেরিকান কৃষিমন্ত্রকের অধীনে ব্যুরো অব এ্যানিমাল ইন্ডাস্ট্রির আওতাতে ব্যাক্টিরিওলজিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনিই প্রথম মহিলা হিসেবে, ইউএসডিএ বা আমেরিকান ড্রাগ এজেন্সির তরফে পূর্ণসময়ের একজন ব্যাক্টিরিওলজিস্টের সরকারি স্বীকৃতি লাভ করেন। এই সময় গবেষণা করতে করতে তিনি ব্রিউসেলোসিস নামের অসুখটিকে নিয়ে বিশেষ ভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। এ্যালিস দেখেন যে ব্যাসিলাস এ্যাবরটাস বলে এক ধরনের বিশেষ প্রজাতির ব্যাক্টিরিয়ার উপস্থিতির কারণেই সেই সময়ে গবাদি পশুদের মধ্যে প্রজনন-সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে, এই ব্যাক্টিরিয়া কেবলমাত্র অসুস্থ প্রাণী-শরীরেই নয় - এমনকি সুস্থ প্রাণীদেহেও এর উপস্থিতি পাওয়া যেতে পারে। এর থেকেই তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, সুস্থ প্রাণীদেহের প্রাণীজ দ্রব্যকেও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে – তার মাধ্যমেও মানবশরীরে রোগবিস্তার সম্ভব; আর সেই কারণেই দুধ বা অন্যান্য প্রাণীজ দ্রব্যের পরিশ্রুতকরণ একান্ত ভাবেই জরুরী।

১৯১৮ সালে ‘সোসাইটি অব আমেরিকান ব্যাক্টিরিওলজিস্ট’এর তরফে প্রকাশিত জার্নাল অব ইনফেক্টিশিয়াস ডিজিজের একটি সংখ্যাতে এই বিষয়ে এ্যালিসের গবেষণা প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়। সাধুবাদ তো অনেক বড় কথা, এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে, পিএইচডি ডিগ্রি নেই যাঁর এমন একজন ‘মহিলা’ কিভাবে বৈজ্ঞানিক বিষয়ে মন্তব্য করেন – এই অভিযোগ তুলে বিজ্ঞানী মহলে আলোড়ন পড়ে যায়। তদানীন্তন একজন বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসক, ডক্টর থিওবল্ড স্মিথ সরাসরিই মন্তব্য করেন যে, একজন মহিলার কাছ থেকে বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তব্য শুনতে তাঁরা প্রস্তুত নন। এমনকি, কাঁচা দুধের মাধ্যমে রোগবিস্তার হতে পারে বলে এ্যালিস যে দুধের পাস্তুরাইজেশনের বিষয়টির উপরে জোর দিয়েছেন – এই বক্তব্যকে ভিত্তি করে, এ্যালিস পাস্তুরাইজেশনের যন্ত্রনির্মাতাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে এমনতরো প্রচার চালাচ্ছেন – এই অভিযোগও একাধিক মহল থেকে উঠে আসে। যদিও পরবর্তীতে পুরুষতান্ত্রিক বিজ্ঞানীমহল তাঁদের উন্নাসিকতাকে যে বেমালুম হজম করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাইই নয়, সংক্রামক রোগবিস্তারের ক্ষেত্রে অনেক পরবর্তীতে একটি সরকারি কমিটি তৈরি হলে পরে থিওবল্ড স্মিথ সেই কমিটির সদস্য হিসেবে ইভান্সের নেতৃত্বে কাজ করতেও কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন। সত্যকে যে কখনও দাবিয়ে রাখা চলে না। যা সত্য তা একদিন প্রকাশিত হবেই। আজ হোক, অথবা কাল।

যদিও, ব্যাক্টিরিয়া সংক্রান্ত গবেষণায় নিজের বক্তব্যকে সঠিক ভাবে তুলে ধরতে গিয়ে ডাকাবুকো এ্যালিস নিজের প্রাণসংশয় ডেকে আনেন। ব্রিউসেলোসিস নামক অসুখটিকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়ে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে এ্যালিস নিজেই এই ব্যাক্টিরিয়া সংক্রান্ত অসুখে আক্রান্ত হন, যা তাঁকে পরবর্তীতে প্রায় কুড়ি বছরের জন্য রোগাক্রান্ত ও অসুস্থ করে দেয়। এরই মধ্যে অবশ্য, কার্যত তাঁর এই জীবনকে বাজি রেখে করা গবেষণার ফলশ্রুতি হিসেবেই, ১৯৩০ সালে মার্কিন স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে দুধের পাস্তুরাইজেশনকে বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও মেনিনজাইটিস এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো একাধিক প্রাণঘাতী রোগের উপরেও ইভান্স গবেষণা করেছিলেন।

এর আগেও আমরা দেখেছি, মহীয়সী এমন একেকজন মানুষ যখন নিজেদের অস্তিত্বে বিরাজ করেন – তখন তাঁদের যুগান্তকারী উপস্থিতির কথা বিচার করেই, তাঁরা কেবল তাঁদের নিজস্ব ক্ষেত্রটিতেই নয় – বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা প্রভৃতি নির্দিষ্ট বিষয়কে ছাপিয়ে গিয়ে তাঁরা সামগ্রিক সমাজের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ান। সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনে, ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কারের প্রয়োজনে তাঁরা একেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। ডাকাবুকো এ্যালিস ক্যাথারিনও সমাজে নারীর অবস্থানকে ভুলে যাননি। এমনকি মানবতার অস্তিত্বকে, গণতন্ত্রের অস্তিত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকেও তিনি এক মুহূর্তের জন্যও বিস্মৃত হননি। তাই, ১৯৬৫-৬৬ সালে যখন মার্কিন স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে স্বাস্থ্যবিমার জন্য তাঁকে নাম নথিভুক্ত করতে অনুরোধ করা হয়, তিনি সেই সুবিধা নিতে অস্বীকার করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, সেই স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পের আওতায় আসতে গেলে সেই সময়ে প্রত্যেক সুবিধাভোগীকে তার পূর্ববর্তী জীবনে তিনি কখনও কোনও কম্যুনিস্ট সংসর্গে এসেছিলেন কি না, সেই বিষয়ে তথ্য দিতে হত। এ্যালিস এই তথ্য দিতে অস্বীকার করেন এবং এই সুবিধা লাভে অস্বীকৃত হন। এর প্রতিক্রিয়াতে, এক বছরের মধ্যেই মার্কিন স্বাস্থ্য দপ্তর তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই স্বাস্থ্যবিমাটির ক্ষেত্রে বিতর্কিত এই ধারাটিকে প্রত্যাহার করে নেন।

পাস্তুর কেবল পদ্ধতিটুকুকে বলেছিলেন। এর আগে মদ, বিয়ার প্রভৃতি বিলাসবহুল পানীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রেই মূলত পাস্তুরাইজেশনের পদ্ধতিটিকে প্রয়োগ করা হত। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে দুধের মতো একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সংরক্ষণ করতে গেলে যে পাস্তুরাইজেশনের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে, এ্যালিস ক্যাথারিন ইভান্সই বিশেষ ভাবে এই বক্তব্যকে জনসমক্ষে তুলে ধরেন। পাস্তুর-‘কন্যা’ এ্যালিস ক্যাথারিনই তাই সেই মহান বৈজ্ঞানিকের সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে চিরবন্দিত হয়ে থাকবেন।

সূত্রঃ

[১] আর. আর. কলওয়েল, ‘এ্যালিস ইভান্সঃ ব্রেকিং ব্যারিয়ার্স’, দ্য ইয়েল জার্নাল অব বায়োলজি এ্যান্ড মেডিসিন, ১৯৯৯

[২] এ্যালিস ক্যাথারিন ইভান্স পেপার্স, ১৯২৩-১৯৭৫, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন

[৩] টিফানি ওয়েন, ‘আমেরিকান উইমেন অব সায়ান্স সিন্স ১৯০০’, ২০১১

[৪] মারিয়ান স্টিভেন্স, ‘ইভান্স, এ্যালিস ক্যাথারিন’, আমেরিকান ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি, ১৯৯৯

[৫] জন পারাস্কান্দোলা, ‘এ্যালিস ক্যাথারিন ইভান্স (১৮৮১-১৯৭৫)’, জার্নাল অব পাবলিক হেলথ পলিসি, খন্ড ২২, সংখ্যা ১, ২০০১

ছবি : এ্যালিস ক্যাথারিন ইভান্স। সংগৃহীত

লেখক : প্রযুক্তিবিদ্যার গবেষক, প্রাবন্ধিক

0 Comments

Post Comment