‘মায়ের জাত’—সম্মান নাকি সহানুভূতি?

  • 10 June, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1324 view(s)
  • লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
‘মায়ের জাত’ শব্দবন্ধটি নারীর ‘সম্মান’ কতটা বাড়িয়েছে কিম্বা ‘বাঁচিয়েছে’ তার প্রমাণ না মিললেও প্রাণীজগতের সবচেয়ে দুর্বল, অন্যের উপর নির্ভরশীল জাতি হিসেবে প্রতিপন্ন করে তাদেরকে সমাজের চোখে সহানুভূতি ও করুণার পাত্রী করে কখনো দেবতার আসনে, কখনো নিগ্রহের যূপকাষ্ঠে পিষে ফেলেছে— তার নজির রয়েছে ভূরিভূরি।

নারী শব্দের আভিধানিক অর্থে বলা হচ্ছ—নৃ-জাতির স্ত্রীসত্তা। যিনি বৈবাহিক সূত্রে দাম্পত্য জীবনে পুরুষের অংশভাগী এবং পুরুষের দ্বারা গর্ভবতী হয়ে সন্তান উৎপাদেনে সক্ষম।‘ এছাড়া যে যে প্রতিশব্দগুলি পাওয়া যায়— মহিলা, রমনী, অওরত, অঙ্গনা, অন্তঃপুরবাসিনী, অন্তঃপুরিকা, কামিনী, বামা, মানবীমানুষীমেয়ে, মেয়েছেলে, মেয়েমানুষমেয়েলোক, ললনা,  স্ত্রী,  স্ত্রীলো, জায়াজেনানাপত্নীবউবধূ,  ভার্যা, সহধর্মচারিণীসহধর্মিণী, সীমন্তিনী, জননী। আর এগুলির বিপরীত শব্দ মোটে ছয়টি— নর, পুরুষ, ছেলে, মরদ, বেটাছেলে, আদমি।

সুতরাং বোঝাই যায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর জন্য যেসব ‘ইতিবাচক’ সম্বোধন করা হয়েছে তাতে সিংহভাগই ওই ‘মেয়েরা মায়ের জাত’ ‘মাতৃত্বেই নারীর পূর্ণতা’ ইত্যাদি একপেশে তত্ত্বের জন্ম দেয়। নিঃসন্দেহে বাংলা অভিধান স্থবির নয়, নানা শব্দ প্রতিশব্দে প্রতিনিয়ত সেজে ওঠে বাংলা শব্দভাণ্ডার। কিন্তু নারীর জন্য প্রদত্ত প্রতিশব্দগুলিতে প্রাচীন মনুবাদী তত্ত্ব ব্যাতীত আধুনিকতার ছোঁয়া আজও নেই।

অভিধান ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যায়, যেখানে নারী শব্দের সর্বজনীন অর্থে ‘স্ত্রী, জায়াজেনানাপত্নীবউবধূ,  ভার্যা, সহধর্মচারিণীসহধর্মিণী, সীমন্তিনী— এতগুলি প্রতিশব্দ আছে যা বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রেই বসা উচিত, সেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে ‘স্বামী’ শব্দের সর্বজনীন রূপ নেই যাতে বিয়ের বাজারে তার অত্যাবশ্যক উপস্থিতি বোঝায়। কিন্তু নারী মানেই সে জন্ম ইস্তক সমাজের কাছে বিয়ের উপাদান এবং বাচ্চা বিয়ানোর মেশিন মাত্র।

আর এজন্যই তাদের মেয়েবেলা থেকেই রণে-বণে-জলে-জঙ্গলে কামুক পুরুষের লোলুপ থাবার যে কোনও আপদবিপদে ‘ঘরে কি মা-বোন নেই?’ ‘আমি তোমার মায়ের মত, বোনের মত’ বলে পরিত্রাণ পাওয়ার শিক্ষা দেওয়ার ট্রাডিশন আজও ঘটমান বর্তমান। এমন কি সাম্প্রতিক অতীতে নির্ভয়া ধর্ষণ কাণ্ডে আমরা দেখেছি রাজনৈতিক ধর্মগুরুরা রীতিমত মিডিয়া ডেকে ‘মেয়েটার উচিত ছিল সেই মুহূর্তে ‘ভাইয়া’ বলে ডাক দেওয়া। মনে রাখতে হবে মেয়েরা মায়ের জাত। তাদের মুখের ভাই সম্বোধনে যে কোনো ছেলের মন পরিবর্তন সম্ভব’— এমন আজগুবি কিম্ভুত বিধান দেন।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যেখানে বংশের ধারা এগিয়ে নিয়ে চলার জন্যই বিবাহ প্রতিষ্ঠানটির সৃষ্টি, এবং নারী জাতির জন্য কামিনী, রমনী, জননী ইত্যাদি যৌনগন্ধা শব্দ রাখা হয়েছে; যেখানে আজও ‘বংশে বাতি’ দিতে ‘নিজ ঔরস জাত’ পুত্র সন্তান চায় সিংহভাগ পরিবার, অন্যথায় খুন পর্যন্ত হতে হয় স্ত্রীকে—সেখানে বংশের ধারক-বাহক হিসেবে কেউ বাড়ির ছেলেটিকে বলেন না— ‘ছেলেরা বাবার জাত’ কিম্বা ‘পিতৃত্বেই ছেলেদের পূর্ণতা’ অন্যথায় ব্যাটাছেলের জীবন বৃথা। কেউ বলে না, কারণ পুরুষেরা গর্ভধারণে অপারগ।

যদি গর্ভধারণ সত্যিই খুব মহিমান্বিত ব্যাপার হয় তাহলে তো স্ত্রীজাতিকেই সবচেয়ে শক্তিমান ও মহান বলে মেনে নিতে হয় লিঙ্গ-ধর্ম-জাতি ভেদে। কিন্তু সেখানেও উল্টোছবি। প্রতিটা হাস্যকৌতুকে, সোশাল মিডিয়ার মিমে মেয়েদের নিয়ে বিশেষত বাড়ির বৌ’দের নিয়ে অত্যন্ত কুরুচিকর বার্তা দেওয়া হয়! যে জাতির বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে এত দেবত্ব আরোপ করা হয়, তাকেই সবচেয়ে দুর্বল সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী ভেবে অসম্মান করা হয় প্রতিনিয়ত। তাহলে এই ‘মায়ের জাতে’র প্রতি আরোপিত বিশেষণগুলি আদৌ কতটা সম্মানজনক— ভাবতে হবে বৈ কি!

কিছু বছর আগেই পাশ হয়েছে সিঙ্গল মাদারের অধিকার। নিজের হোক বা দত্তক স্বনির্ভর একা মায়ের কাছে সন্তান থাকবে একথা সুপ্রিম কোর্ট বলে দিলেও আজও সিঙ্গল মায়েরা পাড়ার সোসাইটি গসিপে অথবা বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত অপ্রীতিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হন সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে। এখনও সবস্তরের স্কুলে ‘সিঙ্গল-পেরেণ্ট’ অপশান রাখাটা বাধ্যতামূলক করাই হয়নি। যেখানে হয়েছে সেখানে বাচ্চারা ভর্তি হতে পারলেও বন্ধুদের ‘বুলি’র শিকার হতে হচ্ছে যার নেপথ্যে রয়েছে সেইসব বাচ্চাদের অভিভাবকদের একজন সিঙ্গল মাকে নিয়ে বিষাক্ত নোংরা আলোচনা।

মজার কথা হল, এঁরাই আবার সন্তান না চাওয়া, অ্যান্টি-নেটাল মহিলাদের দিকে বক্রোক্তি করেন ওই একই হাতিয়ারে ‘মাতৃত্বেই নারীর মুক্তি’। অর্থাৎ যে গর্ভাশয়ের দোহাই দিয়ে নারীর উপর এত গালভরা বিশেষণ আরোপিত হয়, সেই জরায়ুর স্বাধীনতা নারীর আজও নেই। সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে নারীর ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনও মূল্য নেই। স্ত্রীর গর্ভধারণ ব্যাপারটাই স্বামী অথবা পরিবার নামক মালিকের মর্জির দাস।

বাপের বাড়ি মেয়েদেরকে কম কথা, কম খাওয়া, কম হাসি, কম ওজন, কম লেখাপড়া ইত্যাদি শতাধিক শেকল পরিয়ে বিয়ের পিঁড়ির জন্য তৈরি থাকতে বলে কারণ একটাই—‘মেয়ে পরের সম্পত্তি’, ‘শ্বশুরবাড়িই নারীর একমাত্র গন্তব্য’ যেখানে ‘মাতৃত্বেই নারীর জন্ম সার্থক’। উল্টো দিকে ‘পিতৃত্বেই পুরুষজন্ম সার্থক’-মার্কা কোনও নীতিকথার ট্যাগ নেই। নেই বলেই স্ত্রী গর্ভবতী না হলে আজও তাকেই দোষী করে ‘বন্ধ্যা’ বা ‘বাঁজা মেয়েমানুষ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষিত অশিক্ষিত উভয় পরিবারেই।

অভিধানেও ‘বন্ধ্যা’ শব্দের কোনও পুংলিঙ্গ নেই, ‘বাঁজা’র বিপরীত শব্দের প্রয়োজন পড়েনি অভিধান-লেখকদের, কারণ ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে, সন্তান জন্মের দায় নারীর জরায়ুর। পুরুষ তো জন্ম ইস্তক বীর্যবানই— আমাদের লোককথা থেকে বীরগাথা অবধি তার সাক্ষী ! তবে সে বীর্যের ‘দম’ মাপার ইচ্ছে বা স্পর্ধা সে যুগেও ছিল না, এখনও নেই।

একবার লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে এই রকমই এক জরিবুটি-আয়ুর্বেদিক বলবর্ধক তেলওয়ালার সাথে বাওয়াল হয়েছিল। ‘সন্তানহীনতার অবসান, স্ত্রীর বাঁজা-দোষ কাটাতে ব্যবহার করুন …’ ইত্যাদির মাইকিং থামিয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘বন্ধ স্বামীর জন্য কিছু আছে? নাকি এই তেলেই চলবে?’ সে বেচারা থতমত খেয়ে শুধিয়েছিল ‘বন্ধ! কী বন্ধ?”

“কী আবার! স্বাস্থ্যবান স্পার্ম বন্ধ। খালি তো জল বেরোচ্ছে। ওষুধ আছে?” দ্রুত গতিতে টোটোর স্পিড বাড়িয়ে চোঁ-চা দৌড় মেরেছিল তেলওয়ালা।

শুধুমাত্র ‘মায়ের জাত’ ‘সংসারের লক্ষ্মী’ ‘সন্তানের দেখাশোনা মাকে ছাড়া হবে?’ ইত্যাদি মাখনগলা অজুহাতে অধিকাংশ শিক্ষিত কর্মক্ষম চাকুরিরতা মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে চাকরি ছাড়িয়ে কার্যত বিনা-বেতনের-গৃহশ্রমিক বানিয়ে রাখা হয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে দিল্লির মত রাজধানী শহরে একহাজার চাকরিরতার উপর করা সার্ভেতে জানা গেছে মাত্র ১৮%-৩০%  মহিলা মা হওয়ার পরেও চাকরি করছেন।

‘মায়ের জাত’ কথাটি মেয়েদের কে ব্যাঙ্গার্থে এবং পুরুষের তুলনায় নিকৃষ্ট জীব হিসেবে গন্য করার উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয় তা বোঝা যায় কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের মেটারনিটি লিভ, চাইল্ড কেয়ার লিভ ইত্যাদি নিয়ে কুরুচিকর কূটকচালি, টীপ্পনিতে। বস্তুত ‘দেবী’ অথবা ‘মা’ ডাক যে মেয়েদের মানুষ হিসেবে কোনোভাবেই সম্মান দেয় না তার প্রমাণ পাই যখন চলতি মাসেই উত্তরপ্রদেশের পঁয়ত্রিশ বছরের মদ্যপ আশী বছরের বৃদ্ধা দিদিমাকে ধর্ষণ করে, যখন প্রসূতি মাতা উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট আনতে যেতে চাওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে তীব্র বাধা ও অত্যাচারের সম্মুখীন হন, আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাটের ৯৫ বছরের বৃদ্ধা ধর্ষিত হন নাতির বয়সী প্রতিবেশির দ্বারা এবং খাস কলকাতার ফুলবাগানের এক পঞ্চাশোর্ধ মা নিগৃহীত হন তাঁরই ছেলের বন্ধুদের দ্বারা।  

‘মায়ের জাত’ শব্দবন্ধটি নারীর ‘সম্মান’ কতটা বাড়িয়েছে কিম্বা ‘বাঁচিয়েছে’ তার প্রমাণ না মিললেও প্রাণীজগতের সবচেয়ে দূর্বল, অন্যের উপর নির্ভরশীল জাতি হিসেবে প্রতিপন্ন করে তাদেরকে সমাজের চোখে সহানুভূতি ও করুণার পাত্রী করে কখনো দেবতার আসনে, কখনো নিগ্রহের যূপকাষ্ঠে পিষে ফেলেছে— তার নজির রয়েছে ভূরিভূরি।

সুতরাং পুরুষতান্ত্রিক ‘অলংকারে’র ভারে ন্যুব্জ হওয়ার আগে সেই বিশেষণটি হাতপায়ের শেকল পরানোর ফাঁদ কিনা— মগজ খাটিয়ে সেটি ভাবতে হবে মেয়েদেরই। তার জন্য শিক্ষা, সাহস, স্বনির্ভরতা এবং চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়াটা আগে দরকার। লিঙ্গবৈষম্যের লড়াইয়ের ময়দানে নেমে একটা শক্তপোক্ত ‘না’ বলতে যেটুকু বুদ্ধি বা শক্তি লাগে তার জন্য স্রেফ চোখ-কান খোলা রাখাই যথেষ্ট নয়।

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২০ অক্টোবর ২০২১ 

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার

ছবি: সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment