- 08 June, 2020
- 0 Comment(s)
- 892 view(s)
- লিখেছেন : জিনাত রেহেনা ইসলাম
আমরা মেয়েরা হোষ্টেলে সাড়ে আটটায় গেট বন্ধ হয়ে যাওয়াকে নিয়মের মত মেনেছি। আমাদের পরের প্রজন্মও সেটাই করছে। নিয়মকে প্রশ্ন না করার বাধ্য মেয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েই জন্মেছিলাম কি না জানিনা। পাশেই মেন হোষ্টেলে রাত বলে কিছুই নেই। পুরুষের জোরকে আমরা সংসারের মডেল মানতাম। উচ্চকিত কণ্ঠ ও আরোপিত সামাজিক ন্যায়নীতিকে অমান্য করা ছাড়া কি ছেলেদের মানায়? তাছাড়া ছেলে-মেয়ের এক নিয়ম যখন পরিবারেই নেই তখন আবার হোস্টেলে কীসের? তাই প্রতিবাদের এটা কি সাবজেক্ট? মনেই আসেনি। পড়া শেষ। হোষ্টেলের পাটও চুকিয়ে দিয়েছি। যারা তা না করে সিস্টেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, তাদেরকে কি আমরা চিনি? চিনতে চাই আদৌ? বলবো কি আমরা আমাদের মেয়েদের "পিঞ্জরা তোড়" দের কথা। কজন জানি ও চিনি ওদের? অথচ মেয়েদের জন্য ২০১৫ সাল থেকে গলা ফাটাচ্ছে ওরা। হোষ্টেলের নানারকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে নাগাড়ে লড়াই চালাচ্ছে। এদের দুজন ফাউন্ডার মেম্বারকে এই লকডাউনে একাধিক কেসে জড়িয়ে গরাদের পেছনে করা হয়েছে। জেএনইউ এর গবেষণারত ছাত্রী জেলবন্দি দেবাঙ্গনা কলিতার বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনের ধারা লাগিয়ে দেওয়া হল চতুর্থ নম্বর কেসে। নাতাশা নারওয়ালও এখন ইউএ পিএ-তে বন্দি। ফেব্রুয়ারিতে করা এন আর সি, এনপিআর, সিএএ- এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ পিছু ছাড়ছেনা এদেরও।
পিঞ্জরা তোড়দের আন্দোলনের ইতিহাস না জানলে দেবাঙ্গনা কলিতাদের জানা যাবে না। ২০১৫ তে জামিয়া মিলিয়ায় মেয়েদের নাইট আউট বাতিলের নোটিশকে কেন্দ্র করে মেয়েরা বিক্ষোভ শুরু করে। দিল্লি কমিশন অফ ওম্যান থেকে যেহেতু নির্দেশ এসেছিল তাই এই সেক্সিস্ট হোষ্টেল রুল নিয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দিল্লি জুড়ে। প্রতিবাদের থিম হিসেবে বেছে নেওয়া হয় 'কিস অফ লাভ, ব্লাড অন মাই স্কার্ট'কে। প্রতিবাদীদের ফেসবুক র্যালিও খুব সাড়া ফেলে। পিঞ্জরা তোড় প্রাথমিকভাবে নিজেদের প্ল্যাটফর্ম গড়ে নেয় এভাবেই। আন্দোলনের প্রচারে নেমে প্রতিবাদীরা স্লোগান তোলে,
"The streets need more women, more light
Even Cinderella had till midnight
The world’s changing;
Don’t hold on so tight
Laxmi Bai didn’t have
a curfew to fight"
(রাস্তায় আরও বেশি মহিলাদের দরকার,
আরো আলো,
এমনকি সিন্ডারেলারও মধ্যরাত ছিল
বিশ্ব এখন পরিবর্তন চায়
এত শক্ত করে ধরো না
লক্ষ্মী বাঈ এর লড়াই এর সময়
কারফিউ ছিল না ।")
পিঞ্জরা তোড় বা ব্রেক দ্য হোষ্টেল লকস, ছাত্রীদের হোষ্টেল, পিজি ও মেসে নিরাপত্তা নিয়ে সবরকম কারফিউ করার বিরোধিতা করে। পিজিতে বেশি ভাড়া দাবি, মর্যাল পুলিশিং বন্ধ করা ও ইউজিসির গাইডলাইনে সুরক্ষার ধারা, অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি গঠন ও হোষ্টেলে এক নিয়মের দাবিতে তারা অনড় থাকে। লাইব্রেরিতে ছেলেরা রাত দুটো পর্যন্ত থাকার অনুমতি পেলেও মেয়েদের সাড়ে সাতটা/আটটায় ঢুকে যাওয়ার বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তোলে। এক ফিস ভরতে হবে ছাত্রীদের তবে সময় ব্যবহারের এত ফারাক কেন? সুরক্ষার নামে নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রণের নামে মুক্তি ও স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার বিপক্ষে সওয়াল করে পিঞ্জরা তোড়। নিরাপত্তা কখনো তালা বন্ধ থেকে অর্জন করা সম্ভব নয়। সুরক্ষার পরিভাষা লুকিয়ে থাকা নয়। এই ছিল পিঞ্জরা তোড় দের বক্তব্যের সারমর্ম।
কিন্তু সহজ ছিল কি আন্দোলনের পথে হাঁটা? তামাম দিল্লির কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পিঞ্জরা তোড়দের দাবির পোস্টার ছেয়ে যায়। এমনকি পোস্টারিং করতে গিয়ে দিল্লি ইউনিভার্সিটির পিঞ্জরা তোড় সদস্যদের মোবাইলে মার খাওয়ার হুমকি পেতে হয়। ঘটনা থানা পুলিশ অবধি গড়ায়। নতুন পোস্টার পড়ে এবারে অবরোধের বিরুদ্ধে "You can't lock the walls".
চেন্নাই, আলিগড়, রায়পুর, পাতিয়ালা, কটক, ত্রিবান্দ্রাপূরমে পিঞ্জরা তোড় খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এবং ক্যাম্পাসে পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের বিরুদ্ধে বক্তব্য জোরালো হতে থাকে। প্রতিষ্ঠার ঠিক একবছর পরের বছরেই সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হোস্টেলের মেয়েরা পিঞ্জরা তোড়-এর সামনে নিজের পোশাকের নজরদারি, খাবার ও থাকবার অপ্রতুলতা ও হোস্টেল সংক্রান্ত নানা অভিযোগের কথা জানায়। পিঞ্জরা তোড় মেয়েদের বডি সেমিং ও পোশাকের নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করে ইউজিসির নিয়ম দেখাতে বলে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রধানদের প্রবল রোষের মুখেও পড়ে তারা। কিন্তু আন্দোলনের ভাষা ও বার্তা একই ভাবে শক্তিশালী থাকে।
কেরালার এক কলেজে ছাত্রীরা চারটের পর লেকচার ও লাইব্রেরি যাওয়ার দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য আন্দোলনে বসে। আইআইটি রুরকি ও নিট কালিকট, পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি যোগ দেয়। আন্দোলন এইভাবে অকারণ আটকে রাখার নিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত জমি তৈরি করে। পিঞ্জরা তোড়দের লাগাতার আন্দোলন ও অভিযোগ জমা দেওয়ার ভিত্তিতে সমস্যার সুরাহা হয়। বৈষম্যমূলক হোষ্টেলের নিয়মের জন্য প্রথমে ২৩ টি ইউনিভার্সিটি ও পরে আরও ৭ টি কলেজকে তলব করে দিল্লি ওম্যান কমিশন। জানতে চাওয়া হয় হোস্টেলে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা নিয়মের ভিত্তি কি? এই বছরই ইউজিসি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মহিলা কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, নিষিদ্ধকরণ, এবং প্রতিকারের বিষয়ে একটি চিঠি প্রকাশ করে। পিঞ্জরা তোড় এরপর দিল্লি ইউনিভার্সিটির নির্বাচনের হিংসাত্মক প্রকৃতির ও মাসকিউলিন আগ্রেসনের বিরুদ্ধে 'নাইট মার্চ' করে। সাফল্য কখনোই নিষ্কলুষ হয়না হয়ত। তাদের বিরুদ্ধে নন ইনক্লুসিভ হওয়ার অভিযোগ তোলে তাদেরই দলের ট্রাইব্যাল, মুসলিম ও বহুজন সম্প্রদায়ের ১৮ জন সদস্য। ঠিক তার পরের বছর দেবাঙ্গনা ও নাতাশাদের নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন- জমায়েত - হিংসা সংক্রান্ত অভিযোগে জেলবন্দি হওয়ার ঘটনা।
আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অহংকার। পিঞ্জরা তোড় সেই ধারায় ব্যতিক্রম নয়। কেননা ব্যর্থতার দিকই আগামীর মশাল জ্বালায়। মেয়েদের অধিকার আদায়ের জন্য পিঞ্জরা তোড়দের আন্দোলন মেয়েদের সাহসের দরজায় কড়া নাড়বেই। সিস্টেম কে প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজতেই শিক্ষা। অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই আন্দোলন। প্রতিবাদই আনে উত্তরণ। প্রতিরোধ সাময়িক। তাই মেয়েদের এভাবেই ভয়কে জয় করতে এগিয়ে আসতে হবে। ঘর - বারান্দা ছাদ থেকে কারফিউ এর কাঁটা উপড়ে ফেলতে হবে। স্বাধীনতার ক্ষতিপূরণ অবরোধ নয়। আরও একটু বেশি স্বাধীনতার দাবি শেষতক রেখে যাওয়াই মুখ্য।
তুরস্কে মেয়েরা তৈরি করেছিল 'ফ্যান্সি ওম্যান অন বাইক'। করাচীতে 'গার্লস অ্যাট ধাবা'। ইরানে 'মাই ষ্টেলদি ফ্রিডম'। সব গ্রুপগুলির লক্ষ্য জেন্ডার জাস্টিস। পাথরের মত অনড় ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে দেখানো। ছক ভাঙলে কী হয়? স্বাধীনতার পরিভাষা ছেলে-মেয়ের জন্য এক হোক সেই আবেদন তোলা। বৈষম্যের বিরোধিতা কি রাজনৈতিক অবস্থান? অধিকার দাবি কি দাঙ্গাবাজিকে প্রশ্রয়? শান্তিপূর্ন জমায়েত কি নৈরাজ্যের বার্তাবহক হতে পারে? সময় এসেছে ভাববার। 'বেশ হয়েছে, যেমন গেছ আন্দোলনে। অন্যায় করেছ, জেল যাও! ছাড়া পাওয়ার অপেক্ষা করো!" - দেবাঙ্গনা ও নাতাশাদের নিয়ে এই চেনাজানা ন্যারেটিভের বাইরে কি আমরা অন্যকিছু ভাবতে পারবো ?
ছবি : দেবাঙ্গনা কলিতা ও নাতাশা নারওয়াল (সংগৃহীত)
লেখক : শিক্ষক ও সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment