- 09 September, 2020
- 0 Comment(s)
- 813 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ছোটোবেলায় পিটিশন সই করতে খুব উৎসাহ পেতাম। সেই লম্বা লম্বা চিঠিতে, কার কার কাছে সব চিঠি পাঠান হবে তার খতিয়ান, দাবিদাওয়া-চাহিদা’র একগুচ্ছ বর্ণনা – অনলাইন অথবা অফলাইনে দস্তখত একটা দেগে দিতে পারলেই মনে হত দেশ উদ্ধার করে ফেলেছি। ক্রমে ক্রমে যখন বয়স বাড়ল, অভিজ্ঞতায় একটু একটু করে পাক ধরতে শুরু করল, তখন বুঝতে পারলাম – কেবল পিটিশনের খোঁচাতে কাজ হয় বড়ো অল্প। কাগজ-কলমের পৃথিবীতে আইন যদি-বা বদলিয়ে ফেলাও যায়, তারপরেও আবার সেই আইনকে বলবৎ করতে গিয়েও শত বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। সমাজ বোধহয় অনেকটা সেই দূরপাল্লার মালগাড়ির মতোই। নড়তে চড়তে তার সময় লাগে অনেক। একেকটা সময়ে যদিও-বা সে চলতে শুরু করেও, তবুও কোন্ স্টেশনে তার দাঁড়াবার খবর হয়েছে – অনেক সময়ে স্টেশনমাস্টারের কাছেও তার হদিস থাকে না। সাড়ে সাতশো কোটি জনসংখ্যার পৃথিবীতে সমানাধিকার বড়ো ভয়ঙ্কর জিনিস। সে কী আর এমনি এমনি তৈরি হয়!
যে কাজ শক্ত, মানুষ তাকেই ফেলে রাখতে চায়। তাই সমানাধিকারের পাল্লাটা কোনোদিন কোনোখানেই একেবারে সমান হতে পারেনি। হ্যাভ আর হ্যাভ-নটদের চিরকালীন পার্থক্যবিন্যাসগুলিকে সঙ্গে নিয়েই আমরা সহস্রাব্দ পেরিয়েছি। খতিয়ান কেবল স্ট্যাটিস্টিক্সের ওজন বাড়িয়েছে। আমরা সে সমস্ত কিছুকে পড়ে দেখতে, শেয়ার করতে, পিটিশন লিখতে ব্যবহার করেছি। এখনও করছি। কেবল ওইটুকুই।
আমরা নারীমুক্তির কথা বলি। ইন্দিরা গান্ধি, মার্গারেট থ্যাচার, লাইবেরিয়ার নোবেলজয়ী প্রেসিডেন্ট (নামটুকু উইকিপিডিয়াতে দেখে নেবেন), অথবা হিলারি ক্লিন্টনদের উদাহরণে উদ্বাহু হতে পছন্দ করি। কমলা হ্যারিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হলে পরে, লাড্ডু বিতরণেও শামিল হই। অথচ, অক্সফ্যামের কিছু তথ্যকে বারংবার চোখে দেখেও যেন বা সেগুলিকে এড়িয়ে যেতেই বেশি পছন্দ করি। হাত ঘুরিয়ে এড়িয়ে যাবার ভান করি কেবল।
যেমন ধরা যাক, পৃথিবীর সমস্ত আইনপ্রণেতাদের মধ্যে এখনও মাত্র ২৪% মহিলা এবং ৭৬% পুরুষ। আর এই মহিলাদের ২৪%-এর মধ্যেও মাত্রই ৫% মেয়র বা সমতুল্য কোনো উচ্চ প্রশাসকের পদে আছেন। এখনও, পুরুষদের তুলনায় - সারা পৃথিবীতে গড়-বেতনের হিসেব অনুযায়ী মেয়েরা ২৪% কম মাইনে পেয়ে থাকেন। দেশ-বিশেষে এই বৈষম্যটি আরও প্রবল। পৃথিবীর ৭৮ কোটি অশিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই নারী। ১৫৩টি দেশে নারীদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন আইন বলবৎ রয়েছে। ১৮টি দেশে এমনও আইন রয়েছে যেগুলির নির্দেশ অনুযায়ী পুরুষেরা তাঁদের বিবাহিত স্ত্রীকে কর্মক্ষেত্রে চাকরি করতে যাবার অনুমতিটুকুও না দিতে পারেন। পৃথিবীর মোট নারী জনসংখ্যার ৩৩%-ই জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে লিঙ্গভিত্তিক অত্যাচার অথবা গার্হস্থ্যহিংসার শিকার হন। লকডাউনের ভারতবর্ষে, অত্যন্ত শিক্ষিত একেকটি পরিবার থেকেও এমন অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, বাড়িতে গার্হস্থ্যহিংসার শিকার হয়ে উপাচার্যের দ্বারস্থ হয়েছেন এমনটাও কানে এসেছে। লজ্জিত হতেও লজ্জা করেছে তখন।
যাই হোক, আজকের প্রবন্ধের বিষয় কেবল এই সমস্ত স্ট্যাটিস্টিক্সের কূটকচালি নয়। এমনকি, সে অর্থে ‘আরবান’ সমস্যাগুলিও নয় (নিন্দুকেরা গার্হস্থ্যহিংসাকে ‘আরবান’ সমস্যা বলে থাকেন)। গতমাসের মাঝামাঝি সময়ে ‘আশা’কর্মীদের বিক্ষোভে একাধিকবার দিল্লিসহ উত্তর-ভারত, বিশেষত হরিয়ানার বেশ কিছু অংশ দফায় দফায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। আমরা কোভিড-যোদ্ধা, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স ইত্যাদি পেশার মানুষজনকে নিয়ে বেশ একটা হইচই চালাচ্ছি কিছুদিন ধরেই। কিন্তু এই ‘আশা’কর্মীদের সমস্যাগুলিকে নিয়ে কারোর মধ্যেই ততটাও উৎসাহ দেখছি না। এই ‘আশা’কর্মীদের স্বাস্থ্যকর্মীর সমান মর্যাদা দেবার লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্দোলন চলছে বহুদিন ধরেই। সেই আন্দোলন কতটা যুক্তিযুক্ত সে অনেক পরের বিষয়। আপাতত, আমরা একেকজন ‘আশা’কর্মীর দায়িত্ব এবং ‘পে-স্কেল’ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে চেষ্টা করি। যে রাজ্যগুলিতে বিশেষ করে ‘আশা’কর্মীদের বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে, সেখানে একেকজন ‘আশা’কর্মীর দায়িত্বে থাকে কম-বেশি ১০০০জনসংখ্যার একেকটি ক্লাস্টার। এই জনসংখ্যার স্বাস্থ্যগত পরিসংখ্যান রাখা, তাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অবহিত করা, বাড়ির মেয়েদের পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে জানানো, এমনকি গর্ভাবস্থায় তাদেরকে সহযোগিতা করা – এই সমস্ত কিছুই ‘আশা’কর্মীদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এক্ষেত্রে জানা উচিত যে, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অবহিত করা বা গর্ভাবস্থায় সহযোগিতা করা এমনকি টীকাকরণ অভিযানে অংশ নেওয়া ইত্যাদি সিংহভাগ পরিষেবার জন্যই ‘আশা’কর্মীরা কিন্তু কোনোরকমের বেতন বা ভাতায় স্বীকৃত নন। কুড়িয়ে বাড়িয়ে নানা রকম খাতে, ইনসেন্টিভ মিলিয়ে একজন ‘আশা’কর্মীর বেতন মাসে ২০০০ থেকে খুব বেশি হলে ৪৫০০টাকা। ঠিকই শুনেছেন, ন্যূনতম ১৮০০০টাকার মাসিক বেতনের স্বপ্ন-আন্দোলন-প্রতিশ্রুতি কেবল নিউজ-রিল হয়েই থেকে গিয়েছে। অথচ এই ২০০০ থেকে ৪৫০০টাকার কাজের জন্য ‘আশা’কর্মীদের প্রায় কোনো ছুটিই নেই, সপ্তাহে সাতদিনই বলতে গেলে তাঁদের বেরোতে হয়। অনেক সময় দিনে ১৪ঘণ্টা অবধি কাজ করতেও তাঁরা বাধ্য হন। এরপরেও যদি তাঁরা রাস্তায় না নামেন, তাহলে বোধহয় কেবলমাত্র ঈশ্বর অথবা ভগবানগোত্রীয় কারোর সঙ্গেই তাঁদের ধৈর্যের তুলনা করা যেতে পারে।
এই কোভিড-সময়ে আরও ব্যাপক ভাবে তাঁদের দায়িত্ব বেড়েছে। নিয়মিত তাঁদের এলাকাগুলিতে মানুষজনের স্বাস্থ্যের খতিয়ান রাখা, ফ্লু-সম্পর্কিত উপসর্গ কোথাও দেখা যাচ্ছে কি না তার হিসেব রাখা, কোভিড-কোয়ারান্টাইন সেন্টারগুলি পরিদর্শন করা, যাঁরা কোভিড-আক্রান্ত হয়ে হোম-আইসোলেশনে আছেন তাঁদের নিয়মিত খবর নেওয়া ইত্যাদি গুচ্ছ কাজের ভার তাঁদেরকে সামলাতে হচ্ছে। অথচ, এত কিছুর পরেও একটি সাধারণ পিপিই-পোশাক পেতেও তাঁরা নাজেহাল হচ্ছেন। প্রায় কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই তাঁদেরকে কোভিড-নজরদারির কাজে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বেতনবৃদ্ধির প্রসঙ্গ তো অনেক দূর কি বাত! তাঁদের পথে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তাঁদের দাবি অতি সামান্য, ১৮০০০-ও নয়, ১০০০০ টাকার মাসিক নির্ধারিত বেতন এবং পিপিই-সহ কোভিড-প্রোটোকলের নিরাপত্তা। সাধারণ মাস্ক বা গ্লাভসকে সম্বল করে এঁদেরকে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে তস্যের তস্য ঘনজনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলিতে – কোভিড-যোদ্ধা হিসেবে নিধিরাম সর্দারের মতোই।
এঁদেরকেও দিনান্তে বাড়ি ফিরতে হয়। ‘রানিং হট ওয়াটার’ তো দূর-অস্ত, অনেকের বাড়িতে রানিং ওয়াটারটুকুরও ব্যবস্থা নেই। স্যানিটাইজার-সাবানের খরচা মিটিয়ে ঘরের শিশুটির ডিজিটাল পড়াশোনার খরচ, বড়ো কঠিন ঠাঁই। বড়ো কঠিন সময়। লিঙ্গভিত্তিক বেতনবৈষম্য দূরে থাকুক, এমন একেকটি পেশাতে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাগুলি থেকেও এঁরা বঞ্চিত। মনে রাখতে হবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর স্বাস্থ্য এবং সামাজিক পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মরত জনসংখ্যার ৭০%-ই মহিলা। সেই ফ্রন্টলাইনের নারীদের একাংশকেই যখন এভাবে নিরাপত্তা ছাড়াই যুদ্ধের ময়দানে পাঠানো হয়, তখন আর বাকি সমাজের নির্বাক বিস্ময়টুকুই সবচেয়ে বিস্ময়কর বলে মনে হতে থাকে। এই নৈঃশব্দকেই সবচেয়ে অপমানকর বলে মনে হয় তখন!
ছবি : প্রতীকী
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment