- 31 July, 2023
- 0 Comment(s)
- 682 view(s)
- লিখেছেন : রুমেলিকা কুমার
কর্ণাটকের স্কুলে হিজাব ব্যানের, এক আঠেরো বছরের বোর্খাধারীর জয় শ্রীরামের উল্লাসের মাঝে আল্লাহু আকবর বলে পালটা গলার আওয়াজ, প্রতিবাদ অশান্ত করেছে চেনা শহরকে। চেনা মহল আবার নানা বিতর্কে মশগুল। রায়াদির ক্লিনিকই তো আমাকে প্রথমবার চিনিয়েছে বোর্খার সাতকাহন। প্রথমবার এত কাছে থেকে মুসলিম মহিলাদের জীবনে চোখ রাখা শিখিয়েছে রায়াদি। সে নিয়ে লিখব কী? ভাবি।
ক্লিনিক মানে কী? ঘরে স্টেথো বিপি মেশিন নিয়ে বসে থাকা একজন ডাক্তার? কিছু ভলেন্টিয়ার? কিছু ওষুধ? এই সমস্ত কিছুর কোঅর্ডিনেশন?
হতে পারে। ক্লিনিক হয়তো অনেক জায়গাতেই এভাবেই চলে। ‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হবে’ বাজারে পিয়ারলেস অ্যাপোলোর ক্লিনিক চলে আরো পরিপাটি ভাবে। এসি ঘরে। সেখানে এই প্রত্যেকটা উপাদানকে খুঁজে ফেলতে খুব বিশেষ মগজাস্ত্র প্রয়োগ করতে হয় না। অথচ তার থেকেও বেশি চোখ টানে, মন টানে রায়াদির ক্লিনিকে। যে জন্যই হয়তো দীর্ঘস্থায়ী ভাবে কলমে উঠে এসেছে তার কথাই …
রায়াদির ক্লিনিকে আমি মেয়েদের ডাক্তার। কারণ আমার কাছে আসে মহিলারাই। এখন থেকে সরকারি হাসপাতালে ডেলিভারি করাবেন শুধু মহিলা ডাক্তাররাই – কিছুদিন আগে একটা খবর বেরিয়েছিল। নিজেও ইণ্টার্নশিপ করার সময় দেখেছি বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে মহিলা পুরুষের সংখ্যার তারতম্য। সেই সংক্রান্ত নানা চলতি কথাও কানে আসে। যেমন মেয়েদের জন্য গাইনি। ছেলেদের জন্য সার্জারি বা অর্থো। আবার নিজেরই বন্ধু, জুনিয়র সিনিয়রদের একাংশকে দেখছি এই চলতি কথাগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখাতে। দেখানো উচিতও বটে। দেখনোরই কথা।
তবু এখানে এসে মেয়েদের ডাক্তারই আমি। যাঁরা আসেন তাঁরা কেউই আমাকে ডাক্তার বলে ডাকেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দিদি সম্বোধনই কানে আসে। সে নিয়ে কোনো আপশোশ থাকে না। কেন ছেলেরা আসছে না সেই নিয়ে রাগারাগি থাকে না। আসলে দিনের শেষে যাঁরা কাউকেই কিছু বলতে পারেন না, বলার জায়গাটুকু পাননা - তারা কবে লিঙ্গবৈষম্যের জাল ভেঙে ডাক্তারের লিঙ্গপরিচিতি ব্যতিরেকেই চিকিৎসা করাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন – সেই অন্তিম বহুদূরে । তার তুলনায় দিল্লি কাছে। তার আগে অন্তত যদি একজনকেও তাঁরা পান হাতের কাছে – মেয়ে বলেই যদি গিয়ে বলার স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পান – তাহলে তাঁর মধ্যে লিঙ্গবৈষম্য থাকতে পারে – কিন্তু সেই মহিলা ডাক্তার হিসেবে নিজে হাজির থাকতে পারাটা মর্যাদার, সম্মানের। একটা প্রিভিলেজ। ঐ দিদি ডাকটা ভালোবাসার। সমস্যার সাথে সাথেই চুরি করি জীবনের গল্প। প্রতিফলন ঘটে কিছু লেখায়। কিছু ভাবনায়। কিছু আগামীতে।
হিসেব মেলালে দিনে চল্লিশটা পেশেন্ট হলে তার চল্লিশটাই হয় মেয়ে। উল্টোদিকে কোন একটি ছেলে বসে থাকলে এখন নিজের কাছেই সেটা উল্লেখযোগ্য হয়ে যায়। চল্লিশ জনের প্রায় ৩৫ জন মহিলা মুসলিম। বোর্খাপরিহিত ২০-২৫। হয়তো ভালো করে ডাটা সংগ্রহ করলে বয়সানুযায়ী কোন অংশের বোর্খা পরার প্রবণতা বেশি সেই নিয়ে চার্ট বানানো যায়। কিন্তু সেই গ্রাফে বড়ো বড়ো ফাঁক থেকে যাবে। হারিয়ে যাবে জীবনের গল্পগুলো …
দুই বোন একসাথে এল ক্লিনিকে। কোভিড বেড়েছে আবার। একজনের বেশি কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। অনেকসময় পরিবারের সবাই একসাথে দেখাতে আসে। মা’র সাথে দুই মেয়ে। অতএব ঢুকতে দিতেই হল। এক বছরের ছোট বড়ো। বড়ো মেয়ে নামী বেসরকারি স্কুলে পড়ত। লকডাউনে আর্থিক সমস্যা হওয়ায় পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া যায়নি। সরকারি উর্দু স্কুলে পড়তে নারাজ। খানিক নাক সিঁটকানো। বোর্খাধারী। ছোট মেয়েকে অবশ্য সেই স্কুলে দেওয়া যায়নি। সরকারি উর্দু স্কুলেই পড়ছে। আপাতত বন্ধ। খুললে যাবে। তার পরনে চুড়িদার। মা’ও বোর্খা পরে নেই। বড়ো মেয়ে কে জিগ্যেস করলাম বোর্খা কেন পরিস?
- বন্ধুরাও পরত। স্টাইলিশ লাগত। আগে পরতাম না। স্কুলে যাবার পর থেকে ওদের দেখে পরা শুরু করি। এখন ভালো লাগে তাই …
বোর্খা ধর্মীয় পোশাক হতে পারে। কিন্তু বোর্খা কী শুধুই ধর্মীয় পোশাক?
১৫ বছরের মেয়ে। তিন বোন মিলে দেখাতে এসেছে। ছোটটিকে আগেই চেনা আছে। মাসিকের ব্যথা সংক্রান্ত সমস্যার জন্য আগে একবার দেখাতে এসেছিল। এবারে তার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু পিরিয়ডে যে একটুও ব্যথা হয়নি এই শুভসংবাদটা না দিলে চলছিল না। দিদিদেরকেও টেনে এনেছে। সঙ্গে মা। তিনবোনের কেউই বোর্খা পরে নেই। মার পরনে বোর্খা। শরীরের একাধিক জায়গায় ফাংগাল ইনফেকশান। ওষুধ দিলাম। ভাল করে বোঝালাম দেখুন এত ঢাকাঢুকি দিয়ে রাখলে তো শরীরে সমস্যা। এত গরম জিনিস চাপিয়ে আছেন বলেই বেশি হচ্ছে। এত কিছু পরবেন না। সহজ উত্তর
- মেয়েদেরকে পরতে দিই না দিদি। ওরা পরবে না। আমাদের তো বয়স হয়ে গেছে। কী করব আর বলুন। কিন্তু ওদেরকে একদম পরতে দিই না …
বোর্খার ভেতর থেকেই কি জন্মায় না শেকল ভাঙার গান ??
৩৭ বছরের মহিলা। এর আগে বার দুয়েক দেখেছি। একবার ডিসেম্বরে। একবার জানুয়ারিতে। দুবারই এসেছেন ইনফেকশনের জন্য। ওখানে প্রত্যেকদিনের ৪০ জন মহিলার মধ্যে অন্তত ২০-২৫ জনের ক্ষেত্রে ফাংগাল ইনফেকশনের ওষুধ লিখতে হয়। হয়তো বা পরের কোন পর্বে সেই নিয়ে আরো লেখা যাবে। আপাতত ডাক্তারি থাক। ভদ্রমহিলাকে দেখে আলাদা কিছু মনে হল না। বললাম কী, আবার ইনফেকশন হয়েছে?
- নাহ দিদি। একদম হয়নি। পুরো ঠিক হয়ে গেছে। আপনি বলেছিলেন বোর্খা পরার জন্য বেশি হচ্ছে। হালকা হালকা জামাকাপড় পরতে। আমি তাই পরেছি। এবারে আর হইনি। ও বোর্খা পরা আমি ছেড়ে দিয়েছি। কী হবে পরে। নিজের কষ্ট …
নাহ বোর্খার সপক্ষে বা বিপক্ষে কোনটাই বলছি না। সাতকাহনের এক দুকাহন শোনালাম শুধু। অভিজ্ঞতার দুকলম লিখলাম শুধু। যে মানুষগুলো, যে ঘটনাগুলো, যে গল্পগুলো আমাকে দ্বন্দ্বে ফেলেছে, প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে নিজের ধারণাকে, গত সাত মাস ধরে একটু কাছ থেকে দেখে যাদের জীবনের শিকিকণা জানার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, কিছু শিক্ষা লাভের সুযোগ মিলেছে, সেই সমস্ত জানার শুরু ছিল একটাই – রায়াদির ক্লিনিক ।
যেখানে টেবিল, চেয়ার, ডাক্তার, ভলেন্টিয়ার, পেশেন্ট, আল্পনাদি, শিপ্রাদি, কুশলদা, নিমাইদা, অচিন্ত্যদা, গৌরীদাসহ আরো অনেক অনেক মানুষের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে একটা নতুন সমীকরণ। চিকিৎসার থেকে বেশি কিছু হয়ে উঠতে পেরেছে রায়াদির ক্লিনিক। জীবনের পথ চলার একটা সম্বল হিসেবে।
আজকে রায়া দেবনাথ মেমোরিয়াল সোসাইটির পথচলার একজন হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করা ছাড়া আর কীই বা হতে পারে …
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৬ ফব্রুয়ারি ২০২২
লেখক : চিকিৎসক, সমাজকর্মী
0 Comments
Post Comment