রাধিকা যাদব ও সুপারম্যানঃ ভারত হওয়া সহজ নয়!

  • 16 July, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 129 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
 পরিহাসের বিষয় হল, যেহেতু সেই চুম্বন-দৃশ্যগুলির কিয়দংশ ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে মুক্তিপ্রাপ্ত ট্রেলরের মাধ্যমে জনগণ দেখে ফেলেছে, তাই সিনেমা চলাকালীন দর্শকের সেই সেন্সরি-কাঁচি টের পেতেও সামান্যতম অসুবিধে হচ্ছে না। যৌনতা নয়, নগ্নতা নয়, তায় সে অর্থে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা অবধি নয় – স্রেফ নায়ক-নায়িকার ওষ্ঠাধরের সামান্য মিলনকেও, এদেশের সনাতনী সেন্সরী-খুড়াদিগের ‘উত্তেজক’ বলে মনে হয়েছে। কাঁচি চলতে তাই আর এতটুকুও দেরী হয়নি। ‘খুড়ালোগ’ বোধহয় বলিউডের ‘আইটেম’ নাচগুলির সময় আফিং-সেবিত অবস্থায় থাকেন।

নারীরা বুঝি এদেশের নাগরিক নন? নাকি এদেশে নারীরা আদতে তার চেয়েও বেশি কিছু বোধহয়? সদরে-অন্দরে কড়া পাহারায় না রাখলে পরেই তাঁদের সম্ভ্রম খোয়ানোর সম্ভাবনা। আর সম্ভ্রম খোয়ালেই বা? চাপা দিতে বেশি সময় লাগবে না।

 

পাশাপাশি তিনটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব। তিনটি ঘটনাই সাম্প্রতিক, আপাতদৃষ্টিতে যদিও পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কবিযুক্ত – তবু নারী ও নারীর সম্ভ্রম-বিষয়ে কালের নিরিখে তিনটি ঘটনারই এমন সমাপতন, একইসঙ্গে যেন ট্রাজেডি ও কমেডির উদযাপন। সেলুকাসের বিচিত্র দেশ!

 

রাধিকা যাদব। নামটি প্রায় সকলের কাছেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। টেনিস খেলোয়াড় রাধিকার স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা, গো-বলয়ের ভক্তকুল-রাজধানী গুরুগ্রামের প্রতিবেশী ‘পুরুষ’দের সহ্য হয়নি। তাই রাধিকার বাবাকে ক্রমাগত টিটকিরি শুনতে হয়। ৪৯ বছর বয়সী দীপক যাদব, তিনিও মেয়ের গর্বে গর্বিত হওয়ার বদলে উলটে হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করেন। কোনও কোনও সূত্র থেকে এও জানা যাচ্ছে, রাধিকা বাড়ির অমতে ভিন্ন জাতের কোনও এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। সেই নিয়েও দীপকের সঙ্গে তার ব্যবধান বাড়ে। অবশেষে দীপক, নিজের হীনমন্যতা ঢাকতে নিজের মেয়েকেই খুন করার সিদ্ধান্ত নেন। ভক্তকুল-রাজধানী গুরুগ্রাম – প্রান্তিক ভারত, দেহাতি ভারত নয়, খাস অমৃত-ভারতেরই এক ‘অমৃতকুঞ্জের’ গত সপ্তাহের ঘটনা।

 

[এই প্রসঙ্গে গোটা গুরুগ্রাম শহরটিকেই ভক্তকুল-রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত করায় আগে থেকেই মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। তবু, ব্যক্তিগত পরিসরের একাধিক ঘটনা, পরিচিত একাধিক মানুষের একাধিক অভিজ্ঞতা, দুর্ভাগ্যবশত গোটা হরিয়ানা রাজ্য বা গুরুগ্রাম শহরটি সম্পর্কেই এধরনের মানসিকতা তৈরিতে সাহায্য করেছে।]

 

এবারে আসা যাক কাট টু – শহর কলকাতা।

 

সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজ প্রসঙ্গে আলাদা করে কোনও মন্তব্য করব না। গত বছর অভয়া-কাণ্ডের সময় থেকেই রেপ কালচার, থ্রেট কালচার প্রসঙ্গে নানা বক্তব্য, নানা প্রতিবাদ সমাজে ও সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসতে পেরেছে। তাই আশা রেখেছি, রেপ ও থ্রেট কালচারের পাশাপাশি, জাস্টিস চাওয়ার কালচারেও ক্রমশ সাধারণ মানুষ, প্রতিবাদী মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে শুরু করবেন। আশা করব এই উত্থান ও অগ্রগতি জারি থাকবে। ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ আরও জোরালো হবে। তবু আজকের নিবন্ধে সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 

ল কলেজের ঘটনার কিছুদিন পরেপরেই কলকাতার আরও একটি নামজাদা কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অবশ্য, আইনের ভাষা বলতে গেলে আজ বলা উচিত, “অভিযোগ ওঠে,” কারণ ঘটনা পরবর্তীতে আরও অনেক কিছু একইসঙ্গে ঘটে গিয়েছে। ঘটনার পরের সেই সমস্ত ঘটনাই, এই দেশে বা সমাজে নারীর অবস্থান প্রসঙ্গে, আমাদের আরও আশঙ্কিত হতে, আরও তাড়িত হতে বাধ্য করে।

 

আইআইএম কলকাতা, কেবল কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয় – দেশ ও বিদেশের শিক্ষা-মানচিত্রে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। এহেন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানেও কাউন্সেলিংয়ের অজুহাতকে ব্যবহার করে হোস্টেলের ঘরে নিয়ে গিয়ে মহিলা মনোবিদকে ধর্ষণের ঘটনা, একইসঙ্গে বেশ কয়েকটি বিষয়কে সামনে তুলে আনে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, ধর্ষণের জন্য কোনও রাজনীতি, কোনও রাজদীপ-মনোজিৎ অথবা রেপ কালচারেরও আলাদা করে প্রয়োজন পড়ে না। নারীমাংস দেখলেই ভোগ করতে চাওয়া, আসলে পুরুষ-সমাজের এক বিরাট বিকৃতকাম অংশের অসুখ। ‘বিরাট’ শব্দটিকে নিয়ে সংখ্যাতত্ত্বের টানাপোড়েন চলতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত পরিসরে, ঘনিষ্ঠ আলোচনায় ‘যৌনগন্ধী’ বিষয় বা ইঙ্গিত – যাতে কেবলই, বারংবার নারীকে পণ্যের স্তরে নামিয়ে আনা হয়, এই অভ্যাস থেকে আমরা বোধহয় কেউই পুরোপুরি বাইরে নই। হ্যাঁ, কেউ কেউ বলতেই পারেন নারীরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এধরনের আলোচনায় সমপরিমাণ উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিয়ে থাকেন। অবশ্যই থাকেন – এবং তাঁরা প্রত্যেকেই তখন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই ধর্ষকাম সমাজের জন্ম দিচ্ছেন। এর পাশাপাশি, আইআইএম কলকাতার ঘটনা এও প্রমাণ করে, সিসিটিভি অথবা প্রযুক্তিগত অন্য কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থাই, সমাজে ধর্ষণ আটকাতে ১০০% সফল হতে পারে না। সমাজের সার্বিক মনস্তাত্ত্বিক উত্তরণ ভিন্ন এই অন্ধকার থেকে মুক্তি অসম্ভব।

 

কিন্তু বর্তমান নিবন্ধের লেখক হিসেবে, রাধিকা যাদবের ঘটনার পাশাপাশি আইআইএম কলকাতার এই ঘটনার উল্লেখ, আদতে অন্য একটি কারণে আজ আমার বিশেষ প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে। সেটি হল, আইআইএমের ঘটনার পরবর্তীতে ধর্ষিতা মনোবিদের পিতা কলকাতায় আসেন, এবং তিনি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে মেয়ের ধর্ষণের ঘটনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। এমনকি শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, তিনি মেয়ের কোনওরকম ডাক্তারি পরীক্ষা করতে দিতেও আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অটো থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর মেয়ের আঘাত লেগেছে। ধর্ষণের কোনও ঘটনা ঘটেনি।

 

অর্থাৎ, সম্মানের প্রশ্নে, সমাজের প্রশ্নে, এমন জঘন্য একটি ঘটনাকেও সমাজের দোহাই দিয়ে আক্রান্তের বাবা আজ আড়াল করতে চাইছেন। কারণ এই ঘটনা নিয়ে বেশি জানাজানি-বাড়াবাড়ি হলে পরে, তাঁর মেয়েটি ‘দাগী’ হয়ে যাবে। সমাজের বাজারে ‘দর’ কমবে তার। বিয়ে শব্দটি সচেতন ভাবেই উল্লেখ করলাম না। সমাজ, বাজার – এই শব্দগুলিই এদেশে তথা সারা পৃথিবীর বৃহদংশেই বোধহয় নারীর অবস্থান বোঝাতে সবচেয়ে স্পষ্ট অর্থে ব্যবহার করা চলে।

 

… এদিকে এদেশের মহামহিম সেন্সর বোর্ড, বেটি বাঁচাতে পারুক না পারুক – বিদেশি সিনেমায় ‘বেটি’র ছবিতে কাঁচি চালাতে অন্তত অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। রাধিকা অথবা আইআইএমের ঘটনা তো নেহাতই নস্যি, একই সময়ে ভারত-সহ সারা পৃথিবীতে মুক্তি পেয়েছে জেমস গান পরিচালিত ছবি ‘সুপারম্যান’। আর সেই ছবিতেই সুপারম্যান ও তাঁর প্রেমিকা লইস লেনের একাধিক চুম্বন-দৃশ্যে হাতকাঁপা দর্জির দক্ষতায় কাঁচি চালিয়েছে ভারতীয় সেন্সর বোর্ড। পরিহাসের বিষয় হল, যেহেতু সেই চুম্বন-দৃশ্যগুলির কিয়দংশ ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে মুক্তিপ্রাপ্ত ট্রেলরের মাধ্যমে জনগণ দেখে ফেলেছে, তাই সিনেমা চলাকালীন দর্শকের সেই সেন্সরি-কাঁচি টের পেতেও সামান্যতম অসুবিধে হচ্ছে না। যৌনতা নয়, নগ্নতা নয়, তায় সে অর্থে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা অবধি নয় – স্রেফ নায়ক-নায়িকার ওষ্ঠাধরের সামান্য মিলনকেও, এদেশের সনাতনী সেন্সরী-খুড়াদিগের ‘উত্তেজক’ বলে মনে হয়েছে। কাঁচি চলতে তাই আর এতটুকুও দেরী হয়নি। ‘খুড়ালোগ’ বোধহয় বলিউডের ‘আইটেম’ নাচগুলির সময় আফিং-সেবিত অবস্থায় থাকেন।

 

তাই রাধিকা যাদব ও সুপারম্যান – ট্রাজেডি ও কমেডির এক যুগপৎ উদযাপন। সামাজিক মাধ্যমে কারা যেন মিম ছড়িয়েছিল এক সময় – ভারত হওয়া এ্যাক্কেরেই সহজ নয়!

লেখক : বিজ্ঞানী, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment