- 25 December, 2024
- 0 Comment(s)
- 116 view(s)
- লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
৯ আগস্ট ২০২৪ সেই অভিশপ্ত মধ্যরাত যেদিন আরজিকর হাসপাতালে ঘটা মহিলা-ডাক্তারের নারকীয় হত্যা-ধর্ষণের ঘটনা আপামর দেশবাসীকে চরমভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৪ আগস্ট ‘রাত দখল’ কর্মসূচী হল বাংলার ক্যালেন্ডারে আরেকটি প্রতিবাদী মাইলফলক। অভিনব এই ‘রাতের দখল নাও মেয়েরা’ শিরোনামে প্রতিবাদের ডাক দেওয়া হয়েছিল মূলত রাতে স্বাধীন চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা সহ কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপর ঘটা অপরাধের বিরুদ্ধে মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত জেহাদ। ইন্ধন হিসেবে ছিল কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপ্যালসহ সরকারের তরফের বিবৃতি। যার মোদ্দা কথা ছিল “রাতে মেয়েদের বাইরে বেরোনো ঠিক নয়।’ ‘ওইদিন ওই স্থানে মেয়েটির একলা যাওয়া ঠিক হয় নি।”
অর্থাত রাত, অন্ধকার, ফাঁকা স্থান ইত্যাদি শব্দগুলির সঙ্গে মেয়েদের যেন সম্পর্কটা সর্বদাই ব্যস্তানুপাতিক থাকে। তারা মুখ গুঁজে, মুখ বুজে, দিনের আলোয় কাজ সামলে সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ঢুকলেই এই ধরনের নারকীয় ঘটনাগুলি ঘটবে না –এরকম একটা হাস্যকর যুক্তি দেখাবার চেষ্টা হয়েছিল। একই বক্তব্য আজ থেকে বারো বছর আগে দিল্লির নির্ভয়া খুন-ধর্ষন কেসেও দেখেছিলাম। তখনও সরকার থেকে শিক্ষিত জনগনের একটা প্রচ্ছন্ন মতবাদ ছিল “রাতে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া মেয়ের চরিত্র ভালো না।“ “একলা ফাঁকা বাসে ওঠা উচিৎ হয় নি”। আরও পেছনে গেলে আমরা পাবো পার্ক স্ট্রিটের সুজেট ধর্ষণ কেস। সেখানেও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীসহ অনেক আমলাই বলেছিলেন “সুজেট যেহেতু অত রাতে বার’এ কিছু পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়েছিলেন, সুতরাং তিনি দুশ্চরিত্র। ভালো মেয়েরা কি অত রাতে ডিস্কে বা নাইটক্লাবে ছেলেবন্ধু নিয়ে বেরোয় ?”
সুতরাং বহু বছর ধরেই রাতে রাস্তাঘাটে যাতায়াত কার্যত ‘ভালো মেয়েদের’ জন্য নিষিদ্ধ বলেই পরিচিত ও সর্বজনগ্রাহ্য একটি মিথ! রাতে যারা রাস্তায় ঘোরে তারা সবাই প্রায় রেড লাইট জোনের বাসিন্দা। তাদের সঙ্গে সমাজের দৃষ্টিতে ভালো মেয়েদের দূরত্ব রাখাই উচিৎ। এই ফতোয়াদাতারা নিশ্চিন্তে ভুলে যান রাতের ডিউটিরত মেডিক্যাল স্টাফদের কথা, আয়া, পেট্রোল পাম্পের মহিলা কর্মী, সাফাইওয়ালা,আশাকর্মী, শেষরাতের ট্রেন ধরতে আসা ফুলওয়ালি, নাইট শিফট সেরে ফেরা কর্পোরেট কর্মী, মহিলা ক্যাবচালক, টেলিকম ডিপার্মেন্টের কলসেন্টার কর্মী, আইটি কর্মী বা রাতের পিংক-পেট্রলিং বাহিনীর মহিলা পুলিশকর্মীদের কথা। এইসব ইমার্জেন্সি সার্ভিসে দেশের একটা বড় অংশের মেয়েদের প্রতিদিন রাতে বেরোতে হয়।
একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বাধীন চলাফেরায়, কর্মক্ষেত্রে অফিস কেবিনে, হাসপাতালে ডিউটি আওয়ার্সে নিরাপত্তা দিতে চুড়ান্ত ব্যর্থ সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে আরও একবার আয়না দেখিয়েছিল আরজিকরের নৃশংস ঘটনাটি। তাঁর বিচার চেয়ে এবং দীর্ঘদিন অপপ্রচার হয়ে আসা এই ‘ভালো-মেয়ের সংজ্ঞা’র মিথ-কে চরম চ্যালেঞ্জ জানাবার জন্যই গত ১৪ আগষ্ট ২০২৪ সোশাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে ডাক দেওয়া হয়েছিল “মেয়েরা রাত দখল করো”।
এবার আমাদের মিশ্র কালচারের শহুরে সমাজে নানা মুনির নানা মত, বহু লোকের বহু প্রত্যাশা। সেরকমই অনেকরকম প্রত্যাশা নিয়ে এই আন্দোলনে নেমেছিলেন প্রচুর মানুষ। মেয়েদের আন্দোলনকে উৎসাহ দিতে, সলিডারিটি জানাতে প্রচুর পুরুষও সামিল হয়েছিলেন নানা জমায়েতে। অবশ্য তাদের মধ্যেও মোলেস্টর বা অশ্লীল ইঙ্গিত ও নারীশরীরে কনুইমারা সুযোগসন্ধানীও ছিল, তাদের কিছু অসভ্যতার কোপেও পড়েছিল শহরতলি, মফস্বলে ‘রাত দখলে’র কিছু মেয়েরা। তবু সামগ্রিক ক্ষেত্রে বিচার করে সেগুলি বিচ্ছিন্ন কেস হিসেবেই থেকে গেছিল। যাইহোক, রাজ্যজুড়ে মানুষের মনে যে এত ক্ষোভ জমে আছে তা সরকারও ভাবেনি, যাঁরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাঁরাও ভাবেননি। ফলে ১৪ আগস্ট রাতদখল কর্মসূচিকে রাজ্য সরকার ও পুলিশ কেউই বাধা দেয়নি। অনেক জায়গায় পুলিশ নিজে গিয়ে দোকানদারদের বলে এসেছিল ‘আজ সারারাত দোকান খোলা রাখবি। আন্দোলন আছে।’
সরকার বিরোধী সক্কলে ভেবেছিল সোশাল মিডিয়ায় ডাকা আন্দোলন, কত বড় আর হবে? লোকে খেপেছে যখন, রাস্তায় বেরিয়ে একটু চেঁচামেচি করে নিক। তাহলেই ভিতরের ক্ষোভ সব বেরিয়ে যাবে, তারপর স্বাধীনতা দিবসে ছুটি কাটিয়ে ১৬ তারিখ সবাই অফিস চলে যাবে। আন্দোলন খতম। মিডিয়াতে মুখ্যমন্ত্রীর পেয়াদাদের বক্তব্য ছিল তাঁরা সবাই এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ ,তাই ‘সিস্টেমিক চেঞ্জ’ করতে নেমেছেন, তার মধ্যে আরজিকরের মৃতা মেয়েটির জন্যে ‘জাস্টিস’ চাওয়াও আছে। ফলে সরকারের উতলা হওয়ার কিছু ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী ১৬ আগস্ট নিজেও আন্দোলনে নেমে পড়েছিলেন।
কিন্তু হিসাবে ভুল ছিল। যাঁরা রাতদখল আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তাঁরাও বোঝেননি যে দীর্ঘদিনের স্তূপীকৃত বারুদে আরজিকরের ঘটনাটি কেবল অগ্নিস্ফুলিঙ্গের কাজটা করেছে। বহুবছর ধরে সংগঠিত গণআন্দোলনের অভাবে রাজ্যের মানুষের, বিশেষত মহিলাদের, যত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল সবটাই রাস্তায় উপচে পড়বে। সেটা যখন ঘটল, গোটা বিশ্ব চাক্ষুষ করল ও মিডিয়া আখ্যায়িত করল মেয়েদের এই স্বতঃস্ফুর্ত ‘রাত দখল’ জমায়েতটি ‘ঐতিহাসিক গণবিপ্লব।’
‘রাত দখল’ কর্মসূচীর সেরকম ঘোষিত কোনও নেতানেত্রী ছিল না। বস্তুতই এটি ছিল স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাতে গৃহকোণের বাসিন্দাদের স্বেচ্ছায় ঘরের চৌকাঠ ডিঙানোর আহ্বান। তাই জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেমন কিছুজনের এক্টিভ নেতৃত্ব ছিল, মেয়েদের রাত দখলে সেরকম কোনও নেত্রী ছিল না। যে যেখানে পেরেছে – নগর, শহর, মফস্বল, শহরতলি, গ্রাম ইত্যাদি সব জায়গায় আট থেকে আশি বয়সের সব নারীই নিজেদের মধ্যে গ্রুপ বানিয়ে যে-যার মতো কর্মসূচী নিয়েছে। গ্রামে-মফস্বলে যে মেয়েদের রাতে বেড়ানো অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল, সেই মেয়েরাই গত ১৪ আগস্ট রাত থেকে মধ্যরাতে ন্যায্য অধিকারের আদায়ে রাস্তার দখল নিয়েছে। সাদা কাপড়ে মোটা দাগের লাল কালিতে লিখেছে, ‘নজরদারি নয় মুক্তি চাই, রক্ষা নয় অধিকার চাই’, ‘গুঁড়িয়ে দেব পিতৃতন্ত্র, ভেঙে যাবে রাষ্ট্রযন্ত্র’। এমনই সব বিচিত্রময় শব্দ বাক্যভরা স্লোগান। রাতের আলোয় রাস্তা দেখা, বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে পারা, নিজের মনের কথা চিৎকার করে বলতে পারা— এসব গ্রামবাংলার মেয়ের কাছে উৎসবের থেকে কম নয়। তাই ক্রমাগত বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে মেয়েরা রাত্রিবেলা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদী স্বর প্রসারিত করেছে। আট থেকে আশি প্রত্যেকেই চিৎকার করে বলছেন, ‘ইয়ে হক হামারি আজাদি’। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন ও মেয়েদের লড়াইয়ের এই বিপুল জেদের বশেই শাসক ১৪ আগস্ট মধ্যরাত অবধি মেট্রো চালু রাখতে বাধ্য হয়েছে। সারা রাত মেয়েদের বাড়ি পৌঁছাতে ক্যাব সার্ভিস দিয়েছেন বহু প্রাইভেট এজেন্সি। পথসভায় মিশেছেন পাশের আবাসনে পাহারা দেওয়া বৃদ্ধ পাহারাদার। চটশিল্পে ‘গেট বাহির’ হওয়া আন্দোলনরত শ্রমিকেরা জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের থেকে অনেক বেশি অসহায় সেই মা, যার কোল নিষ্ঠুরতার ফলে খালি হয়েছে।’ রিকশাচালকেরা নতুন কায়দায় প্রতিবাদী মিছিল সাজিয়েছেন। মুটে-মজুরেরা জীবনে প্রথমবার মাইক হাতে নিজেদের গলার স্বর উঠিয়েছেন। নাগরিক ব্যস্ত রাতের রাস্তা সন্ধ্যা থেকে মেয়েদের দখলের ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা বাসচালকেরা জানাচ্ছেন,‘আমাদের ঘরেও বউ, মেয়ে রয়েছে, আমাদের সবার জন্যেই এই আন্দোলন প্রয়োজনীয়।’ আটকে থাকা বাসের অফিসফেরত প্যাসেঞ্জারেরা বাস থেকে নেমে, অচেনা মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন - ‘তোমার-আমার এক স্বর, জাস্টিস ফর আরজিকর’ স্লোগানে। বেলঘরিয়ার অত্যাচারিত তরুণীর বাবা এয়ারপোর্ট এক নম্বরে ‘মেয়েদের রাতদখল’-এ অংশ নিয়ে জানাচ্ছেন, ‘আজ যদি এই আন্দোলন না চলত তাহলে হয়তো আমার মেয়ের চিকিৎসাই হত না। চিকিৎসার এত টাকা কোথায় ছিল আমার কাছে?’ মেয়ের চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ সেই অসহায় বাবা এই আন্দোলনের মধ্যে গিয়ে জোগাড় করতে পেরেছিলেন। ‘রাত দখলের’ মহোৎসবে এক শ্রমজীবী ‘মা’ নিজের লেখা প্রতিবাদী কবিতা প্রথমবার ধরা গলায় পাঠ করে শোনাচ্ছেন – কে কবে এমন দৃশ্য দেখেছে আগে? এ অধিকার তাঁদের আর কেই দিতে পেরেছে, এই আন্দোলনৎসব ছাড়া? ট্রেনের কামরার ভেতরে স্লোগান উঠেছে, নানা ধরনের প্রতিবাদী পোস্টারও পড়ছে। রাস্তা সেজেছে নতুন রঙে, ল্যাম্পপোস্ট আর দেওয়ালের গ্রাফিতি জুড়ে। তাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ধর্ষণ-সংস্কৃতি বিরোধী স্লোগান, ক্ষমতার দিকে তাক করে। হিজাব পরা মেয়ে হিন্দু ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান উঠিয়ে নারী-পুরুষের সমতা চাইছে। এই ডাক নিরাপত্তা বা সুরক্ষাকেন্দ্রিক যত না ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল নারী ও প্রান্তীয় লিঙ্গের মানুষের স্বাধীনতার। আরও গভীরে বলতে গেলে ভয় ভাঙার। কোনওদিন ভুলতে পারব না আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠা বাবার পিঠে বসে বাচ্চাটির প্ল্যাকার্ড ধরা ছবিটি যাতে লেখা ছিল— “আমি ভয় ছাড়া বাঁচব।”
রাতের রাস্তায় দুইপাশ জুড়ে মেয়েদের বিশাল-বিশাল মানববন্ধন যা দেখে দুর্গাপুজোর অষ্টমীর মাঝরাতে প্যান্ডেলের লাইনের কথা মনে পড়ে, এমনটা উৎসব ছাড়া আর কবে দেখা গেছে? এমনকি যাঁরা ভোটের সময় মেয়েদের ‘হাজার টাকার খোদ্দের’ বলে মশকরা করেছিল, তারাও সামিল হতে বাধ্য হয়েছে মেয়েদের এই আন্দোলনে, সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক স্কুল ছাত্রীর চিৎকার- ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে হবে, সঙ্গে এসো লড়তে হবে’।
‘ঐতিহাসিক ১৪ আগষ্ট’-এর পরে গোটা দেশ বুঝেছিল জনতা কতখানি ক্ষুব্ধ ও আক্রমণাত্মক। জল মাপতে ব্যস্ত সরকারপক্ষও বুঝেছিলেন লক্ষণ মোটেও তাদের পক্ষে ভাল না। তখন তারা ক্রমাগত আন্দোলনকে কোনও একটা ছকে বাঁধতে চাইল। এরফলেই দেখা গেল, যে মুখ্যমন্ত্রী নিজে দলীয় মিছিলে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে পা মিলিয়েছিলেন, তিনিও প্রকাশ্যে ঠান্ডা গলায় চোটপাট চালালেন “এখনও এফআইআর ঠুকিনি, ঠুকলে কিন্তু কেরিয়ারের সাড়ে বারোটা বেজে যাবে।” তার সুরে সুর মিলিয়ে বাকি কিছুজন বলে উঠলেন “আন্দোলনকারীরা সব নেশাখোর” “রাতদখলের নামে মহিলারা সব পিকনিক মুডে সেলফি তুলেছেন ফলোয়ার বাড়ানোর উদ্দেশে”, ‘বিরোধীরা সাধারণ মানুষের আন্দোলন হাইজ্যাক করেছে” ইত্যাদি নানা কটূকাটব্য! অর্থাৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত’ আন্দোলনের মধুচন্দ্রিমা অচিরেই শেষ হলো।
আরজিকরের মহিলা ডাক্তারের খুন ধর্ষণের মামলাটি সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার পরে দেখা গেল আন্দোলনের অভিমুখ বহুধাবিভক্ত। ‘জাস্টিস ফর অভয়া’ সহ সম্পূর্ণ নারীসুরক্ষার স্বার্থটি কেন্দ্রিভূত হলো মেডিক্যাল কলেজগুলোর দীর্ঘদিনের ঘুঘুর-বাসা ভাঙার লক্ষ্যে। ডাক্তারদের অনশন আন্দোলনের দ্বিতীয় ও সর্বাত্মক স্লোগান ছিল ‘থ্রেট কালচার’-এর বিরুদ্ধে লড়ার ডাক। কর্মজগতের হুমকির মূলত তিনটে ভাগ- এক) অতিরিক্ত কাজ করানোর চাপ; দুই) অনৈতিক কাজ করানোর চাপ; এবং তিন) আসল কাজটি একেবারেই না করানোর চাপ। এর মধ্যে নিজেদের ক্ষমতা থাকলেও উপরতলার রেকমেন্ডেশন ছাড়া আসা সাধারণ রোগীকে যেখানে সেখানে রেফার করার বিষয়টিও পড়ে। এইসব চাপের সঙ্গে আপোষ না করলে কেষ্টুবিষ্টুদের রক্তচক্ষুর কবলে পড়তে হবে। এই নিয়ে যখন আন্দোলনকারীরা মোট দশ দফা দাবি রাখল, তখন বহু নাটকের পরে অবশেষে জনরোষ বাড়তে থাকার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখলাম স্বাস্থ্যদপ্তরের কিছু কেষ্টবিষ্টু ধরা পড়ে হাজতবাসের সাজা পেলেন।
এর মধ্যে পুজো এল,গেল। অনুদানের মোচ্ছবে অনেক ক্লাবই সামিল না হয়ে এবছরের শারদীয়াকে ব্যতিক্রমী করে তুললেন। বর্ষা শরত গিয়ে শীত এল। কেটে গেল চার- চারটে মাস। ১২০ দিন। মাঝে হয়ত জমায়েতের ভিড় কমল, তা’বলে কিন্তু আন্দোলন থামল না। ১৪ আগস্ট ‘রাত দখলে’র আহ্বানে যে শ্রমজীবী মহিলা সামিল হয়েছিলেন, তাঁরা বুঝিয়ে দিলেন যত বাধাই আসুক না কেন তাঁরা প্রতিনিয়ত ধাক্কা খেতে খেতে এ-সমাজে এগিয়েছেন, এগোচ্ছেন, এগোবেন। আর তাদের ফলেই সমাজ তথা দেশের অর্থনীতিও ধাক্কা খেতে-খেতেই এগোবে। নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করার মধ্যে একটা আলাদা স্বাধীনতাও আছে। এই স্বাধীনতাটুকুর একশভাগ স্বাদগ্রহন করতেই তাঁরা বারংবার পথে নামছেন ও নামবেন।
সরকার গত চারমাস ধরে লাগাতার চলা ডাক্তারদের আন্দোলন, ধর্ষণের বিচার চেয়ে নাগরিক মিছিল, যত্রতত্র মেয়েদের রাতদখল ইত্যাদির ঠেলায় শেষমেশ সরকার নিজেদের পদ্ধতিতে তড়িঘড়ি এনেছে ‘অপরাজিতা বিল’ ও ‘রাত্তিরের সাথী’-র মতো ইমার্জেন্সি নারী সুরক্ষা বলয়। কিন্তু আন্দোলনের আরও এক বিরাট উদ্দেশ্য আছে। এটা ভয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন আর স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন। উৎসব তো এমনই হয়। সমাজকে নতুনের সন্ধান দেয়, সীমাবদ্ধতার গণ্ডি ভাঙে, রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি বাড়ায়, ভবিষ্যতে শুভ পথের দিশা দেখায়। এ উৎসব আসলে আন্দোলনৎসব।
সেই উৎসবের ধারা বজায় রেখেই ঐতিহাসিক রাত দখলের ৪ মাস পূর্তিতে আবারও কলকাতা দেখল ১৪ ডিসেম্বরে নারী-ট্রান্স- ক্যুয়ার সহ প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষের মহা সম্মেলন। একাডেমির সামনে রানুছায়া মঞ্চে অনুষ্ঠিত এই প্রতিবাদ জমায়েতের নাম ছিল– ‘স্পর্ধার চিৎকার’। উদ্যোগীদের পরিচয় ‘অভয়ার দল’ নামে। এই অভয়ারা আমাদের খুব চেনা জগতেরই বাসিন্দা – এলিট ক্লাসের মহিলা অফিসার, নামী স্কুলের শিক্ষিকা থেকে প্রান্তিক যৌনকর্মী সবাই। তাই ‘স্পর্ধার চিৎকার’-এ তাঁরাই বক্তা যাঁদের কথা এতদিন কেউ শোনেনি। এদিন খোলা মঞ্চে বক্তা হিসেবে বছর বারোর মুসকান মাইক হাতে তুলে বলে “কালীঘাটে থাকি বলে লোকে বাঁকা চোখে তাকায়, প্রশ্ন করে- ‘তোমার মা যৌনকর্মী নাকি? রেট কত!’ কেন কালীঘাটে তো মন্দিরও আছে, ভিআইপি-দের বাড়িও আছে। তাহলে সেখানে থাকলেই কেউ যৌনকর্মী হবে- এ ধারণা কেন?” - একটি নাবালিকার এই প্রশ্নটির নামই – স্পর্ধা।
এলজিবিটিকিউ যেসব মানুষেরা সেই জমায়েতে নানা স্লোগানে মুখরিত হচ্ছিলেন, তাঁদের নাম ধাম লিঙ্গ যাই থাক জিহ্বা নিঃসৃত কথাগুলি তো আসলে প্রান্তিক শ্রেণীর সাহসী চিৎকারই। যে ধ্বনি ‘সভ্য’ ‘শিক্ষিত’ শহুরে জনগণ বারবার অগ্রাহ্য করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তাদের একত্রে এক ছাতায় আসার সাহস জুগিয়েছিল ১৪ আগষ্ট মধ্যরাতের বিক্ষুব্ধ মেয়েদের ‘রাত দখলের’ স্পর্ধা। আরজিকরের নারকীয় কাণ্ডের পরে এত উৎসব এল-গেল, কিন্তু মানুষ যে আজও সেই ইস্যুটি ভুলে যায় নি, তা বোঝা গেল ১৮ ডিসেম্বরের জমায়েতে।
মূলত ‘জাস্টিস ফর অভয়ার’ নামে গত চারমাস ধরে চলা যাবতীয় রাজনৈতিক কাদা-ছোঁড়াছুঁড়ির নাটক দেখে ক্লান্ত আমাদের বোঝা দরকার নারীসুরক্ষা, পুরুষতন্ত্র এবং অভয়ার মৃত্যু এগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের সামাজিক দায়িত্ব এটা অন্যদের বোঝানো যে, আরজিকর, জয়নগর, যাত্রাগাছি, কুলতলিসহ অগুনতি অভয়ার (৬ মাসের মেয়েশিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা প্রতিটি নারী এখন লালসার শিকার) ধর্ষণ এক- একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ফলে তাদের আলদা আলাদা বিচার হয়ে গেলেই আমরা ভারমুক্ত হতে পারি না। তাই আরজিকরের মৃতা-ধর্ষিতা অভয়ার বিচার চাওয়া নাগরিকের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো ভবিষ্যতে যেনো একটা অভয়া-কাণ্ড না ঘটে তার জন্যও চেষ্টা করা। সেজন্যই তো আমাদের স্পর্ধার চিৎকার ছড়িয়ে যায় শহর থেকে গ্রামে- “অভয়ার ভয় নাই/ রাজপথ ছাড়ি নাই।”পুরুষতন্ত্র যতদিন নারীশরীরের দিকে লালসার থাবা বাড়িয়ে থাকবে, ততদিন এই আন্দোলন চলবে। আসলে এই দ্রোহের উৎসবটি একটি লম্বা কর্মসূচী যার শুরু আছে, শেষ নেই।
0 Comments
Post Comment