- 20 November, 2023
- 0 Comment(s)
- 451 view(s)
- লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
বিশ্বের প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম দাবি করে নারীর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদানের। যবে থেকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোগভোগে মৃত্যুবরণে ভীত মানুষ, সূর্য-চাঁদ-মাটি-আকাশ-জল-বায়ু-গাছ-জীবজন্তু ইত্যাদি প্রকৃতির উপাদানের পুজো ত্যাগ করে সাকার অথবা নিরাকার ভগবানের সাধন-ভজন করতে শুরু করেছে, তার থেকেই ধর্মগুরু,অবতার,পয়গম্বর-রা অর্থাৎ প্রায় সব ধর্মের এজেন্টরাই নিজ নিজ ধর্মমত কতটা সেরা এবং অকাল-মৃত্যু থেকে মানুষকে কতটা সেফ্টি দিতে পারে - সেটা প্রমাণের জন্য নানা চেষ্টা করেছে। প্রথম দিকে কঠোর সাধনার মাধ্যমে জীবতকালেই ইশ্বর দর্শন, অনন্তজীবন লাভের আশীর্বাদ/ বরদান পাওয়ার কথা বললেও যখন দেখা গেল বেশিদিন লোককে বোকা বানানো যাচ্ছে না, অধৈর্য মানুষ ইন্সট্যান্ট নুডল্সের মতো চটজলদি ফললাভ করতে চাইছে, তখন তারা নতুন বুদ্ধি বের করল। যা চোখে দেখা যায় না, অথচ যা নিয়ে মানুষের আগ্রহ চরম, সেই মৃত্যুকে হাতিয়ার বানিয়ে পরকালের নবজীবন লাভ ও সুখের স্বর্গবাসের মূলো ঝুলিয়ে বিরাট ব্যবসা ফাঁদল। এইবার মানুষের যুক্তিবুদ্ধিকে কব্জা করা গেল। মৃত্যু এবং ভগবান দুই অদেখা অদৃশ্য বস্তু – আর যা কিছু অচেনা তা নিয়ে যাবতীয় আশঙ্কা। সুতরাং ভক্তিবাদের উদ্ভব হল। দিব্যি চলছিল। কিন্তু ব্যবসা বাড়াবার জন্য অন্তর্দন্দ্ব জরুরি। সুতরাং এল জাতিভেদ, বর্ণভেদ এবং লিঙ্গভেদে অধিকারের বিভেদ। নিজে আরেকটু বেশি ভালো থাকতে চাও তাহলে এজেন্টের কাছে যাও, ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে চেষ্টা কর। বিশ্বাস বাড়াবার জন্য এল নানা ধর্মগ্রন্থ যেখানে এজেন্টরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে গণ্ডা গণ্ডা পুঁথি লিখে দিল অদেখা ঈশ্বরের নামে।
লিঙ্গভেদে যেখানে থাকল পুরুষ মানুষের জন্য পরলোকে ঈশ্বরের কোলে বসে অনন্ত সুখ,অমরত্ব, চিরযৌবন ইত্যাদি পাওয়ার লোভ, এবং মেয়েদের বলল, ‘এই এই বিধান ইহকালে মানলে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদেরও পরকালে স্বর্গবাসের চান্স দিতে পারেন যেখানে তারাও পুরুষের মতোই ভালো থাকবেন।’ যেই কিছু বুদ্ধিমতী মহিলা প্রশ্ন তুলেছেন, একই স্বর্গের টিকিটের জন্য মেয়েদের ঘাড়ে এমন বিধান বা শর্ত চাপানো কেন? তখনই চতুরতার সাথে তাঁদের কেউ শুনিয়েছে আদম-ইভের গল্প, যেখানে নিষ্পাপ আদমকে কামুক-পাপী বানিয়েছে ইভ! আবার কেউ শোনাল, পুরুষের হাড় থেকে মেয়েদের সৃষ্টি, সুতরাং জন্মসূত্রেই তারা পুরুষের অধীনস্ত গোলাম।
এই দ্বিচারিতা নিয়ে প্রাচীন যুগ থেকেই মেধাবী মহিলারা যখন ক্রমাগত প্রশ্ন তুলতে থাকলেন তখনই, তাঁদের মুখ বন্ধ করতেই ধর্মগ্রন্থগুলিত ঈশ্বরের কম্যান্ডমেন্টগুলির নয়া-অবতারে ‘অ্যামেন্ডমেন্ট’ এল। যেমন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের সংবিধান এখনও অবধি ১০৫ বার অ্যামেণ্ডেড হয়েছে, কিছুটা তেমনই। ধর্মের এজেন্টরা কিছু শ্লোক বা আয়াত আউড়ে মেয়েদের বোঝাতে লাগল, তাঁদের কোম্পানি থুরি, ধর্মমত নারীদের কতটা সম্মান দিয়েছে। সভ্যতার আদি লগ্ন থেকেই গোষ্ঠীর নেতা, দেশের রাজারা বুঝেছিলেন প্রজাদের বশ করার সবচেয়ে সোজা পথ হল ধর্মীয় এজেন্টদের সঙ্গে নেওয়া। কারণ ভিড়ের নিজস্ব কোনও মগজ হয় না, তাঁদের বিশ্বাসকে প্রভাবিত করলেই রাজশক্তির বশ্যতা স্বীকার করানো সহজ হয়। রাজা ও ধর্ম – দুই প্রতিষ্ঠান একে অপরের ইয়ার-দোস্ত। ফলে ধর্মীয় এজেন্টদের ঠিক করে দেওয়া বিধানে নারীর সম্মান হচ্ছে, নাকি অসম্মান- তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য রইল না কোনও আদালত। বেশিরভাগ মেয়েদের এটা বোঝানো সহজ যে, সভ্য দুনিয়ার সমস্ত ‘জাগ্রত ঠাকুর’ স্ত্রীলিঙ্গের। অর্থাত ধর্ম নারীকে এত সম্মান দিয়েছে যে পুরুষ পুরোহিত থেকে মেয়েরা দেবী রূপে পুজো পায়।’ উল্টোদিকে কেবল মেয়েদেরই কেন অশুভ শক্তি-পেত্নী-রাক্ষসী ইত্যাদির পাটও দেওয়া রয়েছে একই ধর্মগ্রন্থে –সেই প্রশ্নটা গল্পকাহিনি হয়েই চাপা পড়ে গেল! প্রতিটি ধর্মেই নানাভাবে এই এক ফর্মূলা দিয়ে বিশ্বাসের দুর্দান্ত ব্যাবসা চলছে। নারীদের স্বাভাবিক মেধা যাতে ধারালো না হতে পারে, তাই নানাবিধ ধর্মীয় বিধানে সংকুচিত করা হল তাঁদের লেখাপড়ার সুযোগ। পুরুষের তৈরি ধর্ম, পুরুষের লেখা ধর্মগ্রন্থের ছত্রে ছত্রে থাকা পুরুষ-নারীর অধিকার নিয়ে ভেদাভেদ সংক্রান্ত প্রশ্ন যাতে কম ওঠে সেজন্য নারীদের বোকা বানিয়ে রাখা দরকার। সেই কাজটা করতে পারে ধর্মবিশ্বাসের বিধান, যাতে ভয় দেখানো হল পরিবারের ক্ষতির জুজু দেখিয়ে। সামাজিক বিধানে বলা হল ‘স্ত্রী লেখাপড়া করলে স্বামীর অকালমৃত্যু অথবা পরিবারের ক্ষতি হবে।“
এবার যেসব ধর্মে আলোকিত শিক্ষিত পুরুষ নারীদের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে মুখর হয়েছে, জগদ্দল সমাজের নানা বাধার মুখেও হতদোম্য হন নি, সেইসব মনীষীদের হাতেই নারীবিদ্বেষী বিধানগুলি রদ করে নতুন করে ধর্মীয় অ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছে। আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বৈষয়িক ভাবে নারী-পুরুষের সমান উত্তরাধিকার। কিন্তু ইসলাম ধর্মে সেই সুযোগ আসে নি। যেহেতু ধর্মগ্রন্থের বিধানগুলি বিভিন্ন যুদ্ধের আধারে নারী পুরুষের সামাজিক অবস্থান নিয়ে, সুতরাং ধর্মের পথে আসা, ধর্মরক্ষায় নামা পুরুষের শৌর্য, বীর্য, অধিকার ইত্যাদি সুরক্ষা ও জান্নাতবাসী হওয়ার বিধানগুলিই মুখ্য ভূমিকায় আছে। এখানে মেয়েদের ভূমিকা কেবল সেই ধর্মের ঠেকেদার পুরুষের অধীনস্ত আজ্ঞাবাহী সঙ্গী হিসেবে।
শরিয়া যেসব দেশে কঠোরভাবে অনুসৃত হয় সেখানে মেয়েদের মাদ্রাসা শিক্ষা, ধর্ম শিক্ষার অনুমতি ছাড়া অঙ্ক,বিজ্ঞান,ইংরেজির মতো ‘দুনিয়াদারির শিক্ষা’ হারাম বলে মনে করা হয়। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারগণ যুক্তি দেন যে, হজরত মহাম্মদের সময় থেকেই অনেক মহিলাই ‘সাহাবী’ হয়েছিলেন, নবীজিও বলে গেছেন কৃতদাসীসহ সব নারীদেরই হাদিস শিক্ষা করা উচিত যাতে তারা আদর্শ স্ত্রী-মা-গৃহিণী হয়ে ওঠে, কারণ স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী গৃহকোণই মেয়েদের একমাত্র থাকার জায়গা।
এই ফর্মূলাই আফগান নারীদের প্রতি প্রয়োগ করছে তালিবান। তাদের একটাই হাতিয়ার- শরিয়া। যা দিয়ে তারা কার্যত গৃহবন্দি করেছে সেদেশের মেয়েদের। তালিবান অধ্যূষিত আফগানিস্তান নিয়ে সভ্য দুনিয়ার ইসলামিস্টদের নাক সিঁটকানো থাকলেও পর্দা প্রথার সমর্থনে তাদের ঝুলিতে প্রচুর কুযুক্তি আছে, যা আজকের ব্রেন-ওয়াশড্ নারীদেরও বাধ্য করে ‘পর্দা ইজ চয়েস’ বলতে।
নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে প্রতিপন্ন করার উদ্দেশে পর্দানসীন হতে বিধান দেওয়ার পেছনেও ইসলামিস্টদের (কু)যুক্তির ঢাল হয়ে দাঁড়ায় সূরা নুর -
"বিশ্বাসী নারীদের বলুন, তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং যৌন আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সাধারণভাবে যা প্রকাশ পায় তা ব্যতিরেকে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।“
সেটিকেই হাতিয়ার করে বাংলাদেশের তেঁতুল হুজুর ভার্চুয়াল ফতোয়া দিতে গিয়ে সোচ্চারে বলেন “বেপর্দা মেয়েরা অনেকটা তেঁতুলের মতো। তাদের দেখলে পুরুষের জিভে জল আসবেই। সুতরাং নিজেদের ঢেকে রাখা প্রতিটি মুসলিম নারীর কর্তব্য!” ‘হিজাব ইস মাই চয়েস’ বলা মেয়েরা এসব ওয়াজ শুনে হেসে উড়িয়ে দেয়, মগজ খাটিয়ে প্রতিবাদ করে না। কারণ প্রতিবাদী মেয়েরা জান্নাতের টিকিট পাবে না!
সূরা নূর ২-৩ আয়াতে বলা হয়েছে যে ‘ইসলামি আইনে বিয়ে এবং উপপত্নীত্ব ব্যতীত অন্যান্য যৌন সম্পর্ক সমূহ জিনা (ব্যভিচার) হিসেবে নিষিদ্ধ। অবিবাহিত ব্যভিচারী পুরুষ বা নারীকে একশতটি বেত্রাঘাত প্রদান করতে হবে , পাশাপাশি বিবাহিত ব্যভিচারী পুরুষ বা নারীকে (পরকীয়া) পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।' ইসলামে নারী পুরুষ উভয়েরই বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা, পরকীয়া ও সমকামিতা একেবারেই নিষিদ্ধ।
কিন্তু ব্যাভিচার বা জিনা নিষিদ্ধ হলেও পুরুষের বহুবিবাহ ইসলামসিদ্ধ। মানে বিয়ের আড়ালে পুরুষের ব্যাভিচারের রাস্তা খোলা। শরীরের কামনা মেটাতে একাধিক উপপত্নী রাখা পুরুষের জন্য জায়েজ হলেও, নারীদের জন্য নয়। সেক্ষেত্রে তাদের ‘পতিতা’ বলা হয়।
সামাজিক বিজ্ঞান বলে, কামনার অন্যতম দিক হল সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা এবং তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে ইচ্ছে /অনিচ্ছা। অর্থাৎ যৌন স্বাধীনতা। ইসলামসহ অনেক ধর্ম বিধানে সেই স্বাধীনতা পুরুষের জন্যই সীমাবদ্ধ। মেয়েরা কেবলই পুরুষের ধর্ষকাম মেটাবার যন্ত্র – যৌনদাসী। ‘মেয়েদের কামনা তৃপ্তি’ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা ইসলামেও ‘হারাম’। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলে দেখা যায় অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে ইসলামের বিধানের খুব বেশি ফারাক নেই।
প্রচলিত হিন্দুধর্ম, খ্রীষ্টধর্ম ও ইসলামধর্ম সবই কঠোর ভাবে পিতৃতান্ত্রিক। হিন্দুধর্মে যত রকমই দেবী থাক, খ্রীষ্টধর্মে যতই মাদার মেরি থাক – সাধারণ রক্ত-মাংসের মেয়েদের ‘ভালো মেয়ে’ প্রমাণ করতে তাকে নিজেদের মান-সম্মান যৌনাঙ্গ ‘সুরক্ষিত’ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং আমৃত্যু যৌনাঙ্গটিকে ‘রক্ষা করে’ ইজ্জত ( সম্মান) বাঁচিয়ে চলার বিধান দেওয়া হয়। এর অন্যথায় তারা ধর্ম-দেশ-কালভেদে সব মেয়েদেরই এককথায় ‘বেশ্যা’ বলে খোঁটা দেয়। মেয়েদের কামনা নিয়ে,মেয়েদের শরীর নিয়ে ব্যবহারিক জীবনে কোনও ধর্মেই উন্নত শারীরবিদ্যার বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গী রাখার কোনও বিধান দেওয়া নেই। যেহেতু পুরুষানুক্রমে আসা নিয়মে নারীকে ‘হয় দেবী, নয় দুরাত্মা’ রূপেই চিহ্নিত করা হয়েছে, স্বাভাবিক রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে কখনোই দেখা হয় নি - সুতরাং প্রতিমুহূর্তে নারীর দেবীত্বকে রক্ষা করতে, তাকে সমাজের ‘গুড বুকে’ থাকতে ‘অক্ষত যোনী’ রাখতে বলা, পর্দা ( ইসলামে ‘পর্দা’ কথাটি চলে, অন্যক্ষেত্রে ‘শালীন জামাকাপড়’ বলে )করতে বলা হয়। এর অন্যথা মানেই সে দুরাত্মা, বেশ্যা ইত্যাদি।
হিন্দু ধর্মে প্রাচীনকালে বহুবিবাহ প্রথা ছিল, পুরাণেও পুরুষের বহুবিবাহের হাজারো উদাহরণ আছে। বাস্তবেও বর্ণাশ্রম সমাজে ব্রাহ্মণরা একাধিক বিয়ে করত, ব্যাভিচার অত্যচার দ্বারা বহু মহিলার সর্বনাশ করত, কিন্তু বর্ণাশ্রম প্রথার মানদণ্ডে সমাজে সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ায় তাদের শাস্তি হত না। সামাজিক নিয়মে পুরুষের একাধিক উপপত্নী রেখে কাম চরিতার্থের জায়গাও ছিল। ওল্ড টেস্টামেন্টেও পলিগ্যামিকে আইনসিদ্ধ দেখানো হয়েছে। ইউরোপিয়ান সমাজে কিছু অঞ্চলে স্বামী যুদ্ধে বহুদিনের জন্য বাড়ির বাইরে গেলে স্ত্রীর জন্য ‘চ্যাস্টিটি-বেল্ট’ পরে থাকার বিধান ছিল, যা নারীটিকে সুরক্ষা দেওয়া কিম্বা ধর্ষণ থেকে বাঁচানোর অছিলায় আসলে তার নিজের যৌনাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে নির্দেশ দিত। সেগুলি নিঃসন্দেহে নারীবিদ্বেষী নিয়ম ও বর্জনীয়। কিন্তু কালক্রমে এই অনাচার বাতিল হয়েছে, ভারতে হিন্দুধর্ম সংস্কার হয়েছে বহু মনীষীদের মাধ্যমে। এদেশে আইন পাশ করেই বহুবিবাহ রদ হয়েছে ইংরেজ আমলেই, আজও আইনের চোখে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ । উপপত্নী থাকলে এমনকি চাকরি চলে যেতে পারে, এমন কঠোর আইন আছে।
কিন্তু যেহেতু ইসলামে এই ধরনের সংস্কার এদেশে আজও হয় নি, তাই এখনও মুসলিম ল’বোর্ড পুরুষের চারটি বিয়ে অনুমতি দেয় এবং আজও মুসলিম পুরুষ তার বিবাহিত স্ত্রীকে যে কোনও অজুহাতে তালাক দিতে পারে। সেখানে মেয়েদের পর্দাহীনতা একটা কারণ, যেখানে বলা হচ্ছে অন্যের সামনে নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শনের অর্থ ‘বেহায়াপনা’, নির্লজ্জতা যা মেয়েটির জন্য নিষিদ্ধ। সুরা নূর বলছে ‘স্ত্রী-রা যাতে দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাযত করে, তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে কেবল যেটুকু প্রকাশ পায় সেটুকু ব্যতীত, এবং তারা যেন তাদের মাথার কাপড় বক্ষদেশের উপরে রাখে।‘
এইভাবে নারীকে একটি বস্তাবন্দি জীবন কাটাবার আদেশ দেওয়া হয়েছে যেখানে তাঁর পছন্দ অপছন্দের কোনও স্থানই নেই। প্রচলিত ধর্মগুলিতে মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা, মেয়েদের কামনা বাসনা, ইচ্ছে অনিচ্ছে নিয়ে মান্যতা তো নেইই, বরং স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে। সুতরাং বলা যায়, তৃণমূল স্তরে সব প্রতিষ্ঠিত ধর্মেই আদিকাল থেকেই মেয়েদের প্রতিপদে বাধা দিয়েছে। সেইজন্যই আজও খবরের শিরোনামে ওঠে আধুনিক মফস্বলে ধর্মের ঠেকাদার ফতোয়া দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে মহিলাদের ফুটবল খেলা, উঠতি প্রতিভাবান মুসলিম অভিনেত্রী পারিবারিক নিষেধে অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ট্রেণ্ডে চলা ‘মাই চয়েস’ মন্ত্র জপেই, কিন্তু তাতে তাঁর মুখমণ্ডলের হতাশা চাপা থাকে না। এ নিয়ে সামান্য হৈচৈ হলেও সুদূরপ্রসারী কোনও প্রতিবাদ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয় না।
ধর্মীয় ফতোয়াতেই শরিয়া মেনে চলাকে যেকোনও সহি মুসলিমের কর্তব্য বলে বিধান দেওয়া হয়। তাই বহু মুসলিম বাড়িতে নানা রকম কট্টরতা (মেয়েদের পর্দা করা, ভীষণভাবে স্বামী ও পরিবারের সমস্ত পুরুষের প্রতি অনুগত থাকা, শরিয়তি নিয়মে মেয়েদের জন্য যা কিছু অবশ্য পালনীয় তা কঠোরভাবে পালন করা, পশ্চিমি পোষাক না পরা, পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত না হওয়া, আঁকা-গান-নাচ-সিনেমা-খেলা ইত্যাদি ‘হারামের কাজ না করা’) অনেকক্ষেত্রেই চলে।
একইভাবে শরিয়া আইনে মুসলিম মেয়ে ও ছেলের উত্তরাধিকার আইনে বৈষম্য করে। সেখানে একটি পুত্র , কন্যার দ্বিগুণ অংশ পায় যেখানে তারা যৌথভাবে দাবিদার। সন্তান থাকলে স্ত্রী মৃত স্বামীর সম্পত্তির এক অষ্টমাংশ এবং সন্তান না থাকলে এক-চতুর্থাংশ পাবে। মৃতের একধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে ওই এক অষ্টমাংশের সমান ভাগ হবে। বাকি অংশ ভাগ হবে জ্ঞাতিদের মধ্যে। একমাত্র পুত্র সন্তান মৃত পিতার ১৬ আনা (১০০%) সম্পত্তির দাবিদার, কিন্তু একমাত্র কন্যাসন্তান হলে মাত্র ৮ আনা (৫০%) সে পাবে, বাকি চলে যাবে পরিবারের অন্যান্যদের হাতে। এরকম প্যাঁচালো নিয়মের পক্ষে ইসলামিস্টদের বক্তব্য থাকে যে, ইসলাম খুবই উদার দৃষ্টিতে গোটা পরিবারের সবার স্বার্থসিদ্ধি করেছে। কিন্তু আড়ালে চলে যায় স্ত্রী-কন্যার সমানাধিকারের প্রশ্নটি। আজও এদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার হয়নি তাই, মুসলিম পরিবারের মধ্যে পারিবারিক হিংসা বা সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে নারী নির্যাতনের কোনও কেস আদালতে উঠলে ফলে মেয়েদের উপর ঘটা ইনজাস্টিসের নিরপেক্ষ সুরাহা মেলে না। ইতিহাস সাক্ষী থাকে শাহ-বানো কেসের মতো এদেশের প্রতিবাদী মুসলিম মেয়েদের শেষ পরিণতির। ধর্মকে তোষণ করে চলা সরকারের সামনে কেউ প্রশ্ন তোলার সাহস পায় না, যে ইসলাম দাবি করে নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদানের, সেই সমাজের নারীদের এত খারাপ দশা কেন ?
তবে ব্যতিক্রম সব দেশে সব সমাজে থাকে। সেক্ষেত্রে কিছু মুসলিম পরিবার ধর্মীয় বিধানের বৈষম্যকে অগ্রাহ্য করে আজকের দিনে হয়ত সমানাধিকার চর্চা করে, মেয়েদের অধিকার, খেলাধূলায় মেয়েদের যোগদান, এমনকি মেয়েদের কামনা নিয়েও মুক্তচিন্তা রাখে। কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রমী হিসেবই থাকে, উদাহরণ হতে পারে না। তাদের দেখে বাকিরা কিছুই শেখে না, তাদের যাপনকে আদর্শ হিসেবে ধরা তো হয়ই না, বরং তাদের বিরুদ্ধে খাপ বসিয়ে সেই পরিবারকে কোণঠাসা, একঘরে করে, নানা উপদ্রবে প্রায় সমাজচ্যুত করে ফেলা হয়।
দেশ মহাদেশ ভেদে ধর্মাচরণ আলাদা হতে পারে, কিন্তু পিতৃতান্ত্রি সমাজে হাজারো ধর্মীয় শর্ত এবং ধর্মের বিধিনিষেধ সজ্জিত বিধানগুলি যা নাকি ‘মেয়েদের ভালোর জন্যই বানানো হয়েছে’, মেয়েদের উপর নেতিবাচক প্রভাবই ফেলে।
তারচেয়ে যদি একটা এক্সপিরিমেন্ট করা যেত, প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস, নিষেধ ও পাপপুণ্যের দাঁড়িপাল্লায় চাপানো শর্তগুলি জোর করে গিলিয়ে দেওয়ার আগে যদি খোলা মনে কিছু ধর্মপরিচয়হীন কন্যাশিশুকে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের পাঠসহ ভাষাশিক্ষা, ইতিহাস, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইংরেজি, ভূগোল ইত্যাদি ‘দুনিয়াদারির শিক্ষা’ দিয়ে তারপর আঠেরো বছর বয়সে সরাসরি প্রশ্ন করা হত,
“বলতো নারীদের একটি সুস্থ সাংসারিক জীবনযাপনে ধর্মাচরণের প্রয়োজনীয়তা কীরূপ?”
তাঁদের সুশিক্ষিত, মুক্তচিন্তাশীল যুক্তিবাদী মস্তিষ্ক, আমার বিশ্বাস ,জবাব দিত “একজন দক্ষ মাঝির জীবনে যেমন সাইকেলের প্রয়োজনীয়তা – সেইরূপ।”
0 Comments
Post Comment