ধর্ম, নারী ও অনুশাসনের চৌকাঠ

  • 26 December, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 481 view(s)
  • লিখেছেন : মোনালিসা পাত্র
আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি, কোনও পারিবারিক আলোচনাই আমার চাকরি, লেখাপড়া গবেষণা নিয়ে হয়না বরং আমার বিবাহ বিষয়ক আলোচনাটি বেশ উপাদেয় এবং এক্ষেত্রে মহিলাদের ভূমিকা বেশ অগ্রণী ও কিছুক্ষেত্রে কেবলমাত্রই। বিবাহ হল অন্যদিকে এক শোষণ যন্ত্র যা ধর্মের নামে কেবল শোষণই করে। শাঁখা, সিঁদুরের ব্যবহার মহিলাদের চিহ্নিত করে একটি পুরুষের সম্পদ হিসেবে কিন্ত বিবাহিত পুরুষের কোন চিহ্ন লাগেনা।

অনন্তকাল ধরে ধর্ম ও পিতৃতন্ত্র একে অপরের ধারক ও বাহক। নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের লড়াই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ধর্ম ও পিতৃতন্ত্রকে দুটি আলাদা অস্তিত্ব হিসেবে দেখলে সম্পূর্ণ বিষয়টি বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। মেয়েদের পাপ ও পুণ্যের দোহাই দিয়ে, ভালো মন্দের দোহাই দিয়ে শোষণ করাই সামাজিক দস্তুর। হিন্দুধর্মের কথা আমি বিশেষ বলতে পারি কারণ আজন্ম এই ধর্মীয় পরিচয়ে বেঁচেছি। শিবরাত্রির উপোষ থেকে ভাইফোঁটা, রাখি সবই হয় পুরুষদের জন্য। মহিলা জন্ম উদযাপন করার কোনও বিশেষ রীতি চোখে পড়েনি আর সেই রক্ষাগুরু বাবা হন বা ভাই কিংবা স্বামী তারা কেবল শোষণ, অনুশাসন ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা ছাড়া কীই বা করেছেন? সামাজিক সম্মানের দায় পিতৃতন্ত্র মেয়েদের ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে তাই বাড়ির মেয়ে ও বউদের ঠিক কী কী করা উচিৎ নয় তা ঠিক করা আছে অন্দরমহলের সংবিধানে। বাড়ির  মেয়ের স্বাধীন চিন্তা থাকতে নেই, আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার নেই, সর্বোপরি নিজের বাড়িতে কোনও অধিকার নেই। তাই সার্বিক ভাবেই শিক্ষিত, অশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত সর্বস্তরে মেয়েদের পরিচয় তার বিবাহিত জীবন দিয়েই।

আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি কোনও পারিবারিক আলোচনাই আমার চাকরি, লেখাপড়া গবেষণা নিয়ে হয়না বরং আমার বিবাহ বিষয়ক আলোচনাটি বেশ উপাদেয় এবং এক্ষেত্রে মহিলাদের ভূমিকা বেশ অগ্রণী ও কিছুক্ষেত্রে কেবলমাত্রই। বিবাহ হল অন্যদিকে এক শোষণ যন্ত্র যা ধর্মের নামে কেবল শোষণই করে। শাঁখা, সিঁদুরের ব্যবহার মহিলাদের চিহ্নিত করে একটি পুরুষের সম্পদ হিসেবে কিন্ত বিবাহিত পুরুষের কোন চিহ্ন লাগেনা। ঠাকুমা দিদিমাদের মুখে শুনেছি “সোনার আংটি তাও আবার বাঁকা?”, তাই পুরুষের গলা বা মাথা সবটাই উচ্চ।  তারা পুরুষসিংহ । সেই তেজের আস্ফালনে প্রাপ্তবয়স্কা স্বাবলম্বী মেয়ের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বাবা কথা বললে তা হয় অধিকার , স্বামী গায়ে হাত তুললে তাও তার অধিকার হিসেবেই গণ্য। আমি কয়েকটি স্তরে পিতৃতন্ত্র কিভাবে আজও মহিলাদের অবদমন করে তা আলোচনা করব।

শিক্ষা ,ধর্ম ও অনুশাসনের চৌকাঠঃ

একজন মহিলা ঠিক কবে বড়ো হতে পারেন? সাংবিধানিক নিয়মে আঠার পার করলে, তখনি তার জীবন সম্পর্কে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার জন্মায়। কিন্তু আমাদের ধর্ম ও পরিবারতন্ত্র মহিলাদের কখনই সেই অধিকার দেয় না। বাবা, দাদা, ভাই, স্বামী, পুত্র এরাই তার জীবনের ধারা ঠিক করে আজীবন। শিক্ষা কি এই নিয়মের কোন বদল আনতে পারে? কিছুটা নিশ্চয়ই পারে কিন্তু সার্বিক কখনই নয়। তাই সমাজ ধর্ম ও অনুশাসনের চৌকাঠ পেরনো মহিলাদের পক্ষে অসম্ভব। সুবর্ণলতা, সত্যবতীর মত মায়েরা কোথায়? পরিবারে মহিলারা একটি পর্যায় পেরিয়ে পিতৃতন্ত্রের দারোয়ান। তাই বাড়ির মেয়েটিকে বা বৌটিকে মানুষ না ভেবে মা, শাশুড়িরা আজও পিতৃতন্ত্রের পুতুল ভাবেন এবং পেয়াদাগিরি করে চলেন। তাই সব খাঁচার পাখিরা তার সোনার খাঁচার গুণ গায় ও চায় এই সামাজিক শোষণ চালিয়ে নিয়ে যেতে। শিক্ষিত মহিলারা অর্থ উপার্জন করেন ঠিকই কিন্তু তার জীবনের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের পুরুষরা তাই খুব কম মহিলাই ভাবেন যে উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের একটি আশ্রয় তৈরি করতে। আর যারা ভাবেন সমাজ তাদের চোখ রাঙায়, অসম্মান করে, দমন করার প্রাণপণ চেষ্টা করে। মহিলাদের অসহায় রূপটি সমাজ ও ধর্মের বড়ো পছন্দের।

সংসার ও নারীত্ব যাপনঃ

“সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে”–প্রচলিত এই বাক্যটি আমরা সবাই শুনেছি কখনো  না কখনো। তাই সংসারে নারী থাকে সর্বশেষে এবং সর্বনীচে। ভালো, সেরা সম্মানীয় যা কিছু সবটাই পরিবারের পুরুষদের দিয়ে দেবার মধ্যেই নারী তার ধর্ম খুঁজে পায়। সন্তানের, স্বামীর বা ভাইয়ের মঙ্গলের জন্য তারা ব্রত করে, উপোষ করে কিন্তু এতে যাদের মঙ্গল হবার কথা তারা বিনিময়ে অসম্মান, অপমান ও শাসনই করে এবং একেই বেশ দস্তুর বলে সমাজ মেনে নিয়েছে। সংসারে নারী তার সর্বস্ব দেবে এবং বিনিময়ে তার জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ করবে তার চারপাশের পুরুষ ও সমাজ। এই শাসন মহিলারাও করেন তবে তার অন্তরে থাকে পিতৃতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য। কোন মা তার মেয়ে সন্তানকে আর ছেলে সন্তানকে সমতুল্য ভাবতে পারেন না। স্বাধীন মহিলাকে সমাজ ভয় পায়, সংসারে সে একা হয়, সমাজে তার নিন্দে হয়। তবে তাও বহু মহিলা এই আগল ভেঙে গুড়িয়ে এগিয়ে চলেছেন, লড়াই তাদের পাথেয় হয়েছে, সমাজ তাদের ত্যাগ করেছে। নারীত্বের যাপন সংসারে আপোষ করতে সেখায়, সহ্য করতে শেখায়, অসম্মান মানতে শেখায়। তাই অন্দরমহলের বিধাতাদের বিধানে মহিলারা আজও পরাধীন।   

নারী ও ব্যক্তি-স্বাধীনতাঃ

    ব্যক্তি স্বাধীনতা বিষয়টি আমাদের মত পরিবারতন্ত্রের ওপর নির্ভর সমাজের একটি ধূসর অধ্যায়। ঠিক কোন পর্যায়ে একটি মানুষের আরেকটি মানুষের জীবনে প্রবেশ করা অনধিকার চর্চা তা বুঝতে বা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়। সন্তানের জীবনে মা বাবার, স্ত্রীর জীবনে স্বামীর বা উল্টোটা কোনটাই ঠিক স্পষ্ট নয়। তাই একজন প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মা বাবা হস্তক্ষেপ করেন, তার মানসিক স্বাস্থ্যের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন সামাজিক নিয়মকে। আর সন্তান যখন মেয়ে তখন তার ব্যক্তিস্বাধীনতা বিষয়টি গর্হিত। অনেকেই এ বিষয়ে তর্জা করতে পারেন যে আজকের সমাজে এগুলি হয়না। আমি একমত পোষণ করিনা, বরং আরও বেশি হয় কারণ আজকাল সমাজমাধ্যমগুলিও এর প্রতিভূ। সম্প্রতি এক অভিনেতা তার এক সহকর্মীর পূর্বতন স্ত্রীকে বিবাহ করেন। এক্ষেত্রে সমাজ এবং সমাজের পরাকাষ্ঠাধারীরা ধরেই নিয়েছেন যে মহিলা চরিত্রহীনা তাই তাকে নিয়ে যা কিছু বলাই যায় এবং বিবাহ নামক মহান প্রতিষ্ঠানের ভিত  এতে বেশ নড়ে যায়। এখানে মহিলাদের ব্যক্তিগত জীবনকে সর্বদাই তার কাজের আগে রাখা হয়। তাই আজও মহিলাদের বন্ধুত্ব, চালচলন, বাড়ি ফেরার সময় থেকে বেড়াতে যাওয়া সবটাই পারিবারিক সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিষয়টি বেশ আবাঞ্ছিত বলেই বিশ্বাস করা হয়।

ধর্ম ও নারীঃ

ধর্ম কি? কিছু আচার অনুষ্ঠান নাকি জীবনের ধারা বা বিশ্বাস। আমার চোখে পিতৃতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যন্ত্রমাত্র। সব উৎসবে অনুষ্ঠানে মহিলাদের অসম্মান করার বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। বিভিন্ন শুভ অনুষ্ঠানে এয়ো অর্থাৎ বিবাহিত মহিলাদের লাগে, সেখানে অবিবাহিত বা বিধবারা ব্রাত্য। কিন্তু পুরুষদের জন্য তেমন কোন নিয়ম নেই। বিধবা মহিলাদের সমাজ এক করুনার পাত্রী করে রেখেছে দীর্ঘ সময় এবং এই বৈধব্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায়ও সেই আবার বিবাহ, কোন দয়াবান পুরুষ উদ্ধার করবেন জীবন যন্ত্রণায় জর্জরিত এক নারীকে। ঋতুমতী মহিলাদের সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্রাত্য করে রাখা হয় আবার সেই সমাজই বিবাহিত মহিলাদের সন্তানের জন্য উৎকীর্ণ হয়, আবার সন্তান না হলে তাকে বাঁজা তকমা দিয়ে দেয়। সমাজ ও ধর্ম মহিলাদের শোষণ করেই এগিয়ে চলে আর চরম দুঃখের ও হতাশার বিষয় হল এই প্রথাগুলিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে মহিলারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেন না। যদি সবাই এই এই দৃপ্ত প্রতিবাদ করতে পারতেন তাহলে ধর্মের নামে, সমাজের নামে, পরিবারের নামে মহিলাদের ওপর এই অন্যায় বন্ধ হত।

পরিশেষে বলা যায় ধর্ম নারীকে ও সমাজকে এক রকম ব্যবহার করেছে পিতৃতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এই সংসার ও সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যেদিন সমস্ত মহিলা এক সুরে অধিকারের লড়াইটা লড়বেন সেদিন এই সাম্যের লড়াই অনেক সহজ হবে। এর জন্য শিক্ষা, সচেতনতা ও জীবনবোধই আমাদের একমাত্র হাতিয়ার হতে পারে। তবে সমাজের সব পুরুষও সমান নন, যেমন সব মহিলাও এক নন। কেউ কেউ আবার এই লড়াইয়ে সামিল। তবে বিষয়টি ঠিক পুরুষ বা মহিলা হিসেবে না ভেবে মানসিক গঠনগত দিক দিয়ে ভাবলে পিতৃতন্ত্র, সমাজ, ধর্ম ও তাদের জটিল বহুস্তরীয় সম্পর্ক বুঝতে সুবিধে হয়।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment