শাপিতপুরুষ (চতুর্দশ কিস্তি)

  • 27 February, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 595 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পায়ের আঙুল টিপে টিপে সুমন প্রবেশ করে বাবার ঘরে। বাবার শোবার জায়গাটাতে ছোট ছোট গাছ গজিয়েছে। সুমন হন্যে হয়ে বাবার কোন স্মৃতি খোঁজে। একটা কিছু পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছে। কিছুই চোখে না পড়ায় যারপরনাই হতাশ সুমন। ঘর হতে বেরুবার মুহূর্তে উপরে চোখ গেল। ছাদের জংধরা একটি রডে সুতোয় বাঁধা কিছু একটা ঝুলছে। রড থেকে নামিয়ে দেখে একটা ছবি। ছবিটি একটি পূর্ণ অবয়বের যুবতীর ছবি। কে এই ছবির যুবতী? চিনে উঠতে পারে না। যতদূর মনে পড়ে, মায়ের চেহারার সাথে ছিটেফোঁটা সাদৃশ্যও নেই ছবির যুবতীর।

[২৩]

সব বলে দিয়েছি : সুমন

সিঁড়ি মাড়িয়ে দো’তলায় উঠে সুমন দেখতে পেল দরজা বাহির হতে তালাবদ্ধ। প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসা সময়ে কোথায় যেতে পারে রিমা! তালা খুলে ঘরে ঢুকল সুমন। ছবিটা টেবিলে রাখতেই চোখে পড়ে একটা কলমের নিচে একটুকরো কাগজ। কাগজে রিমার হাতের লেখা, ঢাকা যাচ্ছি তিনটার ট্রেনে। কোথায় যাচ্ছি, কার কাছে যাচ্ছি, তুমি ভালোভাবেই জানো। থাকব না বেশিদিন।

আক্রোশে রাগে ঘড়ঘড় করতে করতে কাগজের টুকরোটাকে পায়ের তলায় ফেলে পিষে ভর্তা করে ফেলে সুমন। মোবাইলে কল ঢোকায়। ও প্রান্ত হতে কেটে দিচ্ছে রিমা। গোটা দশেক টানা কল ঢুকিয়েছে।

শেষে অয়নের নম্বরে ঢোকাল। রিং বাজে। রিসিভ হয় না। ক্রোধে সুমন হিস্ হিস্ করে ওঠে। চরকির মতো ঘোরে। হরদম মোবাইল টেপে আর কানে ধরে। একবার রিমার নাম্বারে, একবার অয়নের নাম্বারে। টানা চেষ্টার পরে অয়ন কল রিসিভ করে, হ্যালো, সুমন, এক্সট্রেমলি সরি দোস্ত। খুব পেরেসানির মধ্যে আছি। দু-দুটি সিরিয়াস অপারেশন ওটিতে এক সাথে চলছে। তোর সাথে কথা বলব পরে। সুমন চেঁচিয়ে ওঠে, না, এখনি কথা বলতে হবে তোকে। হারামি খুনি! এবারও আমার বাচ্চা মারবি?

ভয় পেয়ে বুক কেঁপে উঠে অয়নের। কী বলিস ননসেন্সের মতো?

ভণ্ডামি একদম আমার সহ্য হয় না। তা তুই জানিস। কেউ ভণ্ডামি করলে ওকে খুন করতে ইচ্ছে করে আমার। হাতের কাছে থাকলে খুন করতাম তোকে।

এভাবে কথা বলছিস কেন?

সুমনের উত্তেজনা বেড়ে দ্বিগুন। তুই কী ভাবিস নিজেকে? ধরাছোঁয়ার বাইরে তুই। কচুকাটার মতো ক্যাচ ক্যাচ করে কাটবো তোর ছেলেকে। তোর সামনেই। দিনে দুপুরে। নইলে তুই...।

দোস্ত, হেঁয়ালি রাখ, এখন সিরিয়াস অপারেশনে...। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে অয়ন।

তোর গ্রিনসিগন্যাল না পেয়েই মাতারি ঢাকা গেল! এত বড় সাহস! সুমন গাঙ্গুলিকে চেনে না-মাতারি! বুকের মইদ্যে হাত ঢোকাইয়া কলিজা বের করে খাসির কলিজার মতো কচকচ করে চিবিয়ে যদি না খাই আমার নাম সুমন গাঙ্গুলিই না! খানকির শরীরের হাড়-মাংস খাওয়াবো শিয়াল-কুকুর দিয়ে!

ঠাণ্ডা নিশ্বাস ফেলে হেসে ওঠে অয়ন, ওহ! এই কথা। ভাবি ঢাকায় নাকি?

স্তব্ধ ঘর কাঁপিয়ে ক্রুদ্ধ ষাঁড়ের মতো লাফাচ্ছে আর চিল্লাচ্ছে সুমন। মেনামুখো শয়তান! হাসতে হাসতে মানুষের বুকে পিঠে ছুরি চালাস! তোর ভিতরে এত লোভ! ঘরে পরীর মতো বউ থাকতে রিমার দিকে...। ছি! ছি! ছি!। এই দেখ থুতু দিলাম তোর মুখে। বলে সুমন ছিৎ করে থুতু ছোঁড়ে লুকিং গ্লাসে। থুতু ওর নিজের মুখে-ই ছড়িয়ে পড়ে।

এ ধরনের কদর্য শব্দ ব্যবহার করতে পারে সুমন! ওর মেন্টালডিজওর্ডার হয়নি তো? নাকি আরও জটিল কিছু? অপারেশনের রোগী টেবিলে। ভাববার সময় নেই। 

ফের চিল্লাচ্ছে সুমন, চুপসে গেলি কেন? ভাবছিস, তোদের ভেতরের পাঁক কি করে আমি জানি? মাতারি বলল কি না? না, না রে! আমার বউ নিয়ে চুটিয়ে মৌজ করবি আর আমি না দেখার ভান করব! সুমন গাঙ্গুলি এতো চুদনা না! আমি সব দেখি, সব জানি। তোরা ঢাকায় বসে কোথায় কী করছিস, ভাবছিস আমি দেখি না। আমি ঘরে বসেই সব দেখি। আমার গোয়েন্দা বাহিনী আছে। আমি সব খবরই পাই।

অয়ন খানিকটা বিরক্ত। লাইন কেটে দিলে সিনক্রিয়েট করতে পারে। কাঁধ দিয়ে মোবাইল কানে চেপে ধরে অপারেশনে মনোযোগ দেয়। সুমনের জড়িয়ে পেঁচিয়ে বলা সব কথা বোঝা যায় না। এ প্রবলেম ওর ইদানিংকালের। মনের আনন্দে খিস্তিখেউড় করে নিজেই রণেভঙ্গ দেয়। তাই লাইন কেটে গেল।

সুমনের জন্য অয়নের খুব মায়া হয়। একটা অবিশ্বাসের কাঠপোকা কেটে ছোবড়া করে ফেলছে ওর বিশ্বাসের তাজা গাছটি। অয়নের ন্যাংটাকালের বন্ধু সুমন। অয়নের বাড়ি রংপুর। বাবা নাটোরের সাব-রেজিস্ট্রার ছিল টানা দশ বছর। লালবাজারে সুমনদের বাসা লাগোয়া একটি বাসা অয়নের বাবা বাসা ভাড়া নিয়েছিল। ছিল টানা দশ বছর। একই স্কুলে একই ক্লাসে একই বেঞ্চে বসে পড়েছে দশ ক্লাস পর্যন্ত। বাবা বদলি হবার কারণে অয়ন কেবল উচ্চমাধ্যমিক পড়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। সুমন পড়েছে নাটোর কলেজে। তারপর ফের একই শহর রাজশাহীতে, সুমন ভার্সিটিতে, অয়ন মেডিক্যালে। সুমনকে বন্ধু হিসেবে বরাবরই সমীহ করে অয়ন। বিদ্যায়-বুদ্ধিতে-জেদে সব দিক থেকেই সুমন এডভান্স ছিল। ফার্স্টক্লাস পেয়ে সুমন বিভাগে-ই শিক্ষক হল। 

শৈশব-কৈশোর-যৌবনের ভাঁজে ভাঁজে সুমনের সাথে অয়নের সব স্মৃতি ঝেঁকে বসেছে ইদানিং। খুব অস্বস্তি ঠেকে অবসরে। ভাবলেই ভয় হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। কি হবে সুমনটার? মেন্টালডিজওর্ডার শেষে যদি শেষপর্যন্ত ...। উফ্! ভাবতে পারছি না। মাথা চাপড়ায় অয়ন। রিমাও কেমন যেন অবুঝ। কোনমতেই বাচ্চা নেবে না।

রিমার সাথে সুমনের রিলেশন তখন উত্তুঙ্গ মুহূর্ত। বিয়ে বিয়ে জপছে। তখন মৃদু আপত্তি করেছিল অয়ন। প্রেম অবাধ। কিন্তু বিয়ে মানেই সমাজ স্বীকৃতির ব্যাপার। সমাজের কতগুলো ছক আছে। এর বাইরে গিয়ে টিকতে পারে না কেউ। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওরা তখন রক্তখেকো বাঘের মতো ভয়ানক। সুমন বড্ড একরোখা জেদি ছেলে। ওকে বাধা দিলে হিংস্র হয়ে ওলট-পালট কিছু করে ফেলতে পারত। আড়ালে বার কয়েক অনুরোধ করেছিল রিমাকে। যেন সরে আসে। ওটুকু ক্যাম্পাসই পুরো পৃথিবী নয়। রিমা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, হিম্মত থাকলে আপনার বন্ধুকে সরে পড়তে বলেন।

অয়নকে সুমন প্রায়ই ‘পুরোহিত’ বলে ডাকত। পুরোহিতরা চিরদিনই প্রেমের পথের জঞ্জাল কি না। সুমন থোড়াই কেয়ার করত অয়নের অনুরোধ।

[চলবে...]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) 

0 Comments

Post Comment