- 04 April, 2022
- 0 Comment(s)
- 389 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
[২৮]
খুনি দরজায়, এখন পালাই কোথায় : সুমন
দরজায় বড় বড় অক্ষরে লেখা সুমন গাঙ্গুলি। দুই বছর আগে শেষবার আসার কথা ভাবে অয়ন। অয়নকে সাপের মতো জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরেছিল সুমন। দুই বন্ধুর হইহুল্লোড়-চেঁচামেচি-দাপাদাপি-আছড়াআছড়িতে ঘরের সব জিনিসপত্তর লণ্ডভণ্ড তখন। গেলো গেলো আমার সব শেষ হয়ে গেলো বলে চেঁচিয়ে মরে রিমা। দরজায় হাত রেখে সন্ত্রস্ত অয়ন ভাবে, আজ কী রিঅ্যাক্ট করে ঈশ্বরই জানেন! বুকে থুতু ছিটিয়ে মনে দ্বিধা নিয়ে টকটক করে পরপর দু’বার দরজায় টোকায়। ভেতর থেকে ভাঙা খসখসে কণ্ঠে সুমন বলে, এই কে? কাকে চাই?
দরজা খোলেই দেখ আমি কে?
দরজা খুলেই লাল মাড়ি বের করে বিকটদর্শন হাসি দিল সুমন।
অয়নের মাথার মগজ পর্যন্ত নড়ে ওঠে শাঁ শব্দ করে। এ কাকে দেখছি! মানুষ! মানুষ এমন হয় নাকি! যেন এই মাত্র শ্মশান থেকে উঠে এসেছে। দেহটা হাড়-কঙ্কালের সমষ্টি শুধুমাত্র। মাংস পুড়ে ছাই হয়ে লেগে আছে কালো কঙ্কালগুলোর সাথে। সুমন তীব্র চোখে তাকাতেই অয়ন দু’পা পেছনে সরে যায়।
বারো ভাতারিরে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস? জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় সুমন।
অয়নের মনের আবেগ অনুভূতি মুহূর্তেই ক্রোধে ঘৃণায় জ্বলে ওঠে। আসাটা-ই বৃথা। সুমন আর মানুষ নেই। নইলে নিজের স্ত্রী সম্পর্কে এমন মন্তব্য করে কেউ! অবশ্য নিজেকে প্রবোধ দেয়, রুগ্ন শরীর তাই এসব রুগ্ন চিন্তা। সৌজন্য প্রকাশ করে বসতেও বলবি না! এতটা বদলে গেলি কী করে! অয়নের চোখের কোণে টাই টাই করছে এক ফোঁটা করে দু’ফোঁটা জলকণা।
সুমন দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। ছয় মাস আগে এলেও এই সুমন-ই এঁড়ে বাছুরের মতো হৈ হুল্লোড় লাফালাফি ঝাপাঝাঁপি করে খামছে আঁচড়ে বিভোর উল্লাসে মেতে উঠত। অয়ন অনেক কষ্টে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখে সুমনের সামনে। হেঁচকা টান দিয়ে সুমনের গায়ের গেঞ্জি খুলে নেয়। চিমটি কাটলে ময়লা ওঠে! বালছাল কি সব গায়ে চড়িয়ে রেখেছিস। নোংরা জ্যালজেলে গেঞ্জি ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে হাসতে হাসতে ডান হাত বাড়ায় অয়ন, দেবো নাকি লুঙ্গি খুলে? আগের মতো জন্মদিনের পোশাকে করে ফেলব?
নিথর পাথরের মতো নিঃশ্চল দাঁড়িয়ে ভাবছে সুমন। শালা! তুমি আইছো পজিশন ঠিক করতে। খুন করে লাশ গুম করার জায়গা পাতি খুঁজতে। এ শহরের কোন পেশাদার কিলার সুমন গাঙ্গুলির বুকে গুলি চালাবে না। শেয়ানা মাল তো। সব জানে। রিমাকে দিয়েই কাজ সারবে। কইয়ের তেলে কই ভেজে মচমচ করে খাবে। শালা রিমার পা চাটা কুত্তা! কী আছে রিমা মাগির মধ্যে? থু! অবশ্য মনে মনে দেয় থুতু। দেখাবো নাকি আমার মালটা? ভয়ে নেড়ি কুকুরের মতো লেজগুটিয়ে কু কু করতে করতে দৌড়াবে এখনি। না থাক। ভালোয় ভালোয় হাত পা ধরে যদি বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারি। তারপরে দেখবি সুমন গাঙ্গুলির খেলা কারে কয়! সাপ-লুডুর খেলা! পাগলের মতো হি হি করে হেসে ওঠে সুমন!
এমন অকারণে পাগলের মতো হাসছিস কেন? তুই কি পাগল হয়ে গেলি? তোর অনুভূতি সব ভোতা হয়ে গেছে, টের পাস? তুই না দেশের নামকরা ভার্সিটির প্রফেসর। সব ভুলে গেলি!
সুমনের মাথার মগজ কিসে যেন চিবোচ্ছে। আরশোলা হতে পারে। ফের আরশোলাটা মগজে ঢুকলো কি করে, সুমন ভাবতে চেষ্টা করে। মাথার ভেতরে যতই নানা প্যাঁচ কষতে যাচ্ছে শালার আরশোলাটা যেন তখনই গিলে ফেলছে সম্পূর্ণ মগজ। ধ্যাত্ করে প্রচণ্ড জোরে মাথায় একটি চাপড় বসিয়ে দিতেই মাথা খুলে গেল। সোনার কাঠির ছোঁয়া পেয়ে সুমন যেন জেগে উঠেছে। ঠিকঠাক স্বাভাবিকের চাইতেও স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলে ওঠে, আমি কি দিবাস্বপ্নে আছি! রাজধানীর ব্যস্ত ডাক্তার আমার ঘরে!
লাফিয়ে সুমনকে জড়িয়ে ধরে অয়ন। দোস্ত তুই অবিকল আগের সুমনের মতো কথা বলছিস। একমিনিটও সুমনকে জড়িয়ে থাকতে পারল না। মুখে উৎকট গন্ধ। বমি ঠেলে আসছে।
সুমন তটস্থ হয়ে বলে, কী খাবি দোস্ত?
অয়ন গাল ফুলিয়ে বলে, না, কিছু খাবো না তোর এখানে।
মাথা নোয়ায়ে সুমন বলে, আমিও ঘরে কিচ্ছু খাই না।
অয়ন বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, কেন?
সুমন চুপ থাকে।
অয়ন বলে, আজ তোকে চাইনিজ খাওয়াব।
সুমন তেমন আপত্তি জানায় না।
সন্ধ্যার শহর। রাস্তায় উপচে পড়া রিক্সার ভিড়। কদাচিত কোন প্রাইভেট কার থাকলেও রিক্সাকেই সমীহ করে চলছে লো স্পিডে। একটা রিক্সা ভাড়ায় ঠিক করে দু’বন্ধু চড়ে বসেছে। সামান্য কিছুতেই সুমন হকচকিয়ে উঠছে। কী যে লজ্জা পাচ্ছে! অগেরকালে বিয়ের দিন নাকি ছেলেরা লজ্জায় ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকত। মাঠে দৌড়ে বেড়াত শরমে। সুমনকে দেখে অয়নের এই মুহূর্তে তেমনটাই মনে হচ্ছে। এত শরম পুরুষের! প্রথম গাড়িঘোড়ার শহরে আসা গ্রামের বালকের মতো গুটিসুটি মেরে অয়নের শরীর ঘেঁষে বসে আছে সুমন। রিক্সা একটি চাইনিজের সামনে এসে দাঁড়াল।
লালচে আলোয় সুমনের মুখটাকে শ্মশানের জংধরা কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছে। ভয় পায় অয়ন। মৃত্যুর পূর্বক্ষণের আলামত সুমনের মুখেচোখে স্পষ্ট। খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। বেশ খানিকটা সময়ও অতিক্রম হয়েছে। অধৈর্য হয়ে অয়ন নিজেই গেল। ঢাকা শহরের কোন চাইনিজে এমনটা হলে এত সময়ে হুলুস্থূল বেঁধে যেত। ওখানে মানুষের এত সময় কই যে এভাবে বসে ভেরেণ্ডা ভাজবে। স্যুপ, চিকেন ফ্রাই, রাইস এবং আরও কয়েকটা আইটেম সামনে রেখে গেল ওয়েটার।
টেবিলের প্রত্যেকটি খাবার-ই প্রথমে নাক বরাবর তোলে সুমন। তারপর গোয়েন্দার কুকুরের মতো সন্দেহ নিয়ে শুঁকে শুঁকে রেখে দেয়। চরম বিব্রত অয়ন। এদিক ওদিক তাকায়। কী শুঁকিস! দ্রুত খেয়ে নে। লোকেরা কী ভাববে? ফিসফিস করে বলে, তোর এত সন্দেহ কেন বল তো? ওরা কি তোর খাবারে বিষ মেশাবে? সুমন লালচে দাঁত বের এক ঝলক হেসেই চুপচাপ বসে রইল। ওরা মেশাবে কেন? মোটা টাকা দিয়ে ওদের কাউকে হাত করে ফেলতে পারিস তুই। বন্ধুর বউকে যে হাত করতে পারে, সে সব পারে। আর এদের তো কথা-ই নেই। নিশ্চয় রিমা আশেপাশেই আছে। বিষ মেশানো খাবার খেয়ে নাকেমুখে ফেনা তুলে লাফিয়ে মরার সময় আসবে বোধ হয়। মাগির পেটে পেটে বুদ্ধি ইঁদুরের মতো দৌড়ে বেড়ায়। আলো-আঁধারীর রহস্যময়তার মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে রিমা খোঁজার জন্যে সুমন একবার উঠে ঘুরে এসেছে।
সামান্য একটু স্যুপ ঠোঁটে স্পর্শ করে স্ট্যাচুর মতো বসে রইল সুমন। এত অনুরোধেও কাজ হয় না। নিজেকে সামলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ঘাড় নিচু করে স্যুপ মুখে দিতে দিতে নিচু কণ্ঠে বলে অয়ন, জানিস সুমন, পদ্মার স্মৃতি কখনো ভুলতে পারি না! দিন-রাতের খবর থাকে না এমন এক পেশায় আছি। স্বপ্নচারি মনটা খুব জ্বালায়। আঁকু-বাঁকু করে ফের সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে। পদ্মার পাড় ধরে প্রায়ই হাঁটতাম আমরা। আমাকে বেশি আলোড়িত করত বোশেখের পদ্মা। তখন দিগন্তব্যাপি পদ্মার ধূ ধূ বালুচর। উদোম বুক। আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম কতদূর! মনে আছে তোর?
একদিনের কথা মনে উঠলে আমি এখনো রোমাঞ্চিত হই, জানিস সুমন। উচ্ছ্বসিত অয়ন। আমরা তিনজনে পদ্মার টি-বাঁধ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তখন ছিল পদ্মার ভরাযৌবন। বাঁধ ছুঁই ছুঁই জল। আচমকা পেছন হতে এক যুবতী আমাকে পেঁচিয়ে ধরে পিঠে মুখ ঘষতে লাগল সৈকত সৈকত বলে। আমি ঘাড় ফেরাতেই ‘ও মাগো এ কে গো’ বলে উল্টো দিকে দৌড়াতে গিয়ে গুত্তা খেয়ে পড়ে গেল নদীতে। রুদ্ধশ্বাসে পালিয়ে প্রাণে বাঁচা! শাহ মখদুমের মাজার জিয়ারত করে দশ টাকা নজরানা দিয়ে তবেই না আমরা হাফ ছাড়ি।
অয়নের আবেগঘন স্মৃতিচারণে কাজ হয় না। ফাঁসির আসামীর মতো প্রতিক্রিয়াহীন সুমন।
বাসায় ফিরতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেল।
রাতে সুমনকে বেশ চনমনে হাসি খুশি দেখাচ্ছে। থেমে থেমে অন্য চিন্তায় মশগুল হয়ে পড়ছে। অয়ন আন্দাজ করতে পারে, সুমনের মাথায় এলোপাতাড়ি চিন্তা জটবেঁধে যায়, না হয় হিজিবিজি লেগে যায়।
অয়নের কানের কাছে মুখ নিয়ে অবোধ্য কিছু বলে নিজেই চুটিয়ে হাসছে সুমন।
অয়ন বিরক্তি প্রকাশ করে, কী বলছিস? কিছুই বোঝা যায় না তোর কথা।
আমার মাথায় মগজ নেই। খালি খোলস। ঠেকুর তুলে হাসে সুমন।
অয়নও হাসে। কী বলিস! তোর মাথার মগজ কোথায় গেল? বিক্রি করে দিয়েছিন নাকি? তোরা বুদ্ধিজীবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা বেশিরভাগই তো মগজ বিক্রি করে দিস। যে দলের কাছে মাথা বিক্রি করিস, কৃতজ্ঞ-প্রভুভক্ত প্রাণির মতো চিরকাল সেই দলের ফেউ হয়ে থাকিস। তখন আর কথা বলতে হয় না। মুখ হা করা মাত্রই একটা বালকও ধরে ফেলে কোন দলের ফেউ।
আরে হেঁয়ালি না, সত্যিই আমার মাথায় মগজ নেই। খেয়ে ফেলেছে আরশোলা। সুমনকে এবার কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে।
রাখ তো এসব ফাজলামি। অয়ন আমলে নেয় না।
জানিস, আরশোলারা পাকিস্তানিদের মতো বেজায় হারামি! আমার মাথায় বাসা করে আমারি মগজ খেয়ে ফেলছে।
আরশোলা গেল কী করে তোর মাথায়?
কী করে ঢুকল কে জানে! পায়খানার রাস্তা দিয়ে সাঁ করে ঢুকে যেতে পারে। খুব চিন্তিত সুমন।
ফালতু বকিস না।
ফালতু না, ঠিকই বলছি। শালা আরশোলা পেটমোটা রাক্ষস। হি হি করে লালচে দাঁত বের করে হেসে ওঠে সুমন। মগজবিহীন মাথার ভেতরে লাফিয়ে লাফিয়ে আমার চিন্তাগুলো হারিয়ে যায়। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ এবার। জানিস, আমার চিন্তাগুলো কেউ একজন প্রচার করে বেড়ায়। মানুষটা খুব চালাক। পত্রিকার লোকদের সাথে ওর খুব হাত। ভূতের মতো নাকে নাকে বলে, শুনেছি, আমার চিন্তাগুলো চুরি করে নিয়ে নাকি টিভি চ্যানেলে বিক্রি করে দেবে।
কে সে ? অয়ন বিস্মিত।
এক ডাইনি। ও সব সময় আড়ি পেতে আমার সব কথা শোনে।
কী করে?
ওর কাছে যন্ত্র আছে। এই দেখ আমার ডান সাইডে সেট করে রেখেছে। মাথা দেখাতে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল সুমন।
অয়ন ভয় পেয়ে ঢেকুর গিলে, সর্বনাশের আর শেষ নেই...
দেখ, এজন্য আমার মাথা এখন একেবারে চিন্তাশূন্য। ডাইনিটা রিমার গোয়েন্দা হতে পারে। হারামি মাগি হাড়ে হাড়ে বজ্জাত।
কে বলল তোকে?
ও নিজেই। ও নিজেকে মনে করে মহাবুদ্ধিমতী। হো হো করে হেসে ওঠে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে শিশুর মতন। হাঁটু দুমড়ে বসে ঝট করে অয়নের মাজা পেঁচিয়ে ধরে, তোর পায়ে পড়ি আমার বাবুটাকে মারিস না দোস্ত! মারিস না! এই দেখ, আমার বুকের ভেতরে বাবু হেঁটে বেড়ায়, একটুও ঘুমায় না, দিনরাত শুধু কাঁদে। বলে, আমাকে বাঁচাও আব্বু, আমাকে বাঁচাও। আরও চারটা বাবু আছে। ওরা রাতে আসে। এক সাথে বসে খাই। খেলা করি। ওরা আমাকে কী বলে জানিস? আমি নাকি ওদের খুনি বাবা। হি হি হি!
সুমনের পেঁচানো হাত ধীরে ধীরে আলগা হয়ে আসে।
রাতের কত প্রহর গেল ধরে উঠতে পারে না অয়ন। দেয়ালে ঘড়ির কাঁটাগুলো এক জায়গায় স্থবির। ব্যাটারি ফুরিয়েছে বোধ হয়। জীবনের ঘড়ি যার আর চলছে না। তার আবার ঘড়ির কাঁটা ঘুরলো কি ঘুরলো না তাতে কী আসে যায়। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে। স্ক্রিন অন্ধকার। কমলিকা ব্যানার্জির সাথে কথা বলার সময় লক করেছিল। লক-ই রয়ে গেছে।
রাত প্রায় দুপুর। অথচ ঘুমের বালাই নেই অয়নের চোখে। বউ বাচ্চার খবর নেবার তাগিদও বোধ করে না। এখন প্রধান বিষয় কোন প্রকারে রাতের বাকি প্রহরগুলো কাটিয়ে দেওয়া। কাল সকালেই এখানকার মেডিক্যালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান ডা. মামুন হুসাইনের কাছে নিয়ে যেতে হবে। যেভাবেই হোক নিতে হবে। কিন্তু যেতে চাইবে কি? বেঁকে বসলে তো কিছুই করার নেই। হঠাৎ মনে পড়ে অয়নের। কমলিকা ব্যানার্জির নাতনি বলেছিল, ওর বিরুদ্ধে নাকি কারা স্ক্যান্ডাল ছড়াচ্ছে ক্যাম্পসে। জিজ্ঞেস করে দেখি তো।
তোর বিরুদ্ধে নাকি ক্যাম্পাসে স্ক্যান্ডাল ছড়াচ্ছে কে বা কারা? তুই নাকি তোর ডিপার্টমেন্টের কোন ম্যাডামকে কু কথা বলেছিস? হাত দিতে গেছিস শরীরে?
ডিপার্টমেন্ট থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। নির্বিকার কণ্ঠে বলে সুমন।
কী দায়িত্ব?
ঐ ম্যাডামকে ইয়ে করতে। নইলে চাকরি থাকবে না। বিন্দুমাত্র উত্তেজনা নেই সুমনের কণ্ঠে।
অয়ন বিব্রত হয়। এর প্রেক্ষিতে কী বলবে? শুধু বলে, ঘুমা তো। অনেক রাত হল।
বড় বড় চোখ করে তাকায় সুমন। তুমি আমাকে এখনি জবাই করে লাশ বানাবা—শালা!। এত চুদু সুমন গাঙ্গুলি না। কী অস্ত্রপাতি আনছো? আমার টা দেখলে তো প্রস্রাব করে দিবা বিছানায়। হা হা হা!
অকারণেই এমন দম ছাড়া হাসি! মাথা টাল খেয়ে ওঠে অয়নের। সুমনের তাকানোর স্টাইলের মধ্যে কিছুটা হিংস্রতা, কিছুটা রহস্য। তড়িঘড়ি করে প্যান্ট শার্ট খুলে নিল অয়ন। বাথরুমে ঢুকতেই গা রি রি করে ওঠে। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো পায়খানা। নাক চেপে এক আজলা পানি মুখে ছিটিয়ে বেরোতেই লক্ষ করে, হন্যে হয়ে জরুরি কিছু একটা জিনিস খুঁজছে সুমন। অয়নের প্যান্টের পকেটে-ব্যাগে ত্রস্ত হয়ে হাত চালাচ্ছে। পায়ের শব্দে লাফিয়ে বিছানায় উঠে গেল। চার হাত পা কুঁকড়িয়ে ফুটবলের মতো গোল হয়ে সাথে সাথে নাক ডাকতে শুরু করল। অভিনয় না বাস্তবেই সুমন ঘুমিয়ে পড়েছে, অয়ন ঠাহর করতে পারে না। নাক ডাকার ঘড়ঘড় শব্দের মাত্রা বাড়তে থাকলে বুঝতে পারে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে।
শায়িত সুমনের শান্ত মুখটায় আধা-পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভরা। সুমনের এ কী রূপ! সুমন কি তাহলে বাঁচবে না! ওরা বেশ কিছুদিন বেঁচে যায়। ঢাকায় এক সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা হয়েছে। সুস্থ পরিবেশ, সার্বক্ষণিক সাহচার্য পেলে তবেই বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু সুমন কোথায় পাবে সুস্থ পরিবেশ? সব কিছুই চলছে ওর বিপরীত স্রোতে। কমলিকা ব্যানার্জির নাতনিটা বলছিল, এই শহরে সুমন ভীষণ একা। সুমনের কোন বন্ধু-হিতাকাঙ্ক্ষী নেই। কলকাতায় ওর আত্মীয় স্বজনদের খবর দিলে কেমন হয়। কিন্তু ওরা কি আমলে নেবে? ওদের জাত ধর্মে এমন করে থুতু ছিটিয়েছে সুমন। মূলত ছত্রিশ বছর ধরেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ওরা কালেভদ্রে যোগাযোগ করতে চাইলেও সুমন সাড়া দেয়নি। বরং উল্টো ঘৃণা লালন করে মনে। ওর ভেতরে খুব খেদ—যুদ্ধের সময় দেশ ছেড়ে পালাল কেন? দেশে থেকে যুদ্ধ করতে পারল না? আর যদি বা পালিয়ে গেল, যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরেনি কেন?
চাকরি, বউ বাচ্চা রেখে কী করে কিছুদিন সময় দেই, অয়ন ভাবে। ডাক্তার দেখাবো, ঢাকা যেতে বলবো, কী করে সম্ভব! জোর করে তো নেওয়া চলে না। লোকে ভাববে সত্যিই পাগল। জানাজানি হবে। পত্রিকায় উঠবে। তখন চাকরিটাও যাবে। এ কাজ করলে আরও উল্টো ভুল বুঝবে। হয়ত খুনটুন করার ষড়যন্ত্র। ঘুমোতে যাওয়ার কথা বলতেই কেমন সন্দেহের চাহনি। টানা হেঁচড়ার জীবন রিমার। তাছাড়া রিমা ওকে খুন করবে, এ বিশ্বাসও তো ক্রমেই প্রবল হচ্ছে। এক ঘরে থাকলে তো খুন একটা হবে-ই।
[চলবে...]
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ)
0 Comments
Post Comment