শামসুন নাহার মাহমুদ

  • 10 April, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 333 view(s)
  • লিখেছেন : শাম্মা বিশ্বাস
১০ এপ্রিল ১৯৬৪ শামসুন নাহার মাহমুদের প্রয়াণ দিবস। তিনি ছিলেন নারী আন্দোলনের নেত্রী, শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদ। চট্টগ্রামের ডাক্তার খাস্তগীর গার্লস হাই স্কুল থেকে লেখাপড়া করেন। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা এল। কারণ তখনকার মেয়েদের একটু বড় হলেই পর্দা প্রথার জন্য বাইরে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। তাই অবরোধের আড়ালে বসেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন। বিয়ের পর আবার পড়াশোনার সুযোগ পান। অধ্যাপনা করেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে।

  শামসুন নাহার মাহমুদ ছিলেন নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং  রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর বর্তমান বাংলাদেশের ফেনী জেলায় গুতুমা গ্রামে, মুন্সীবাড়িতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৌলভী মুহাম্মদ নুরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন মুন্সেফ এবং মা আছিয়া খাতুন চৌধুরী ছিলেন গৃহবধূ। শামসুন নাহারের যখন ৬ মাস বয়স তখন তাঁর বাবা মারা গেলে মা তাঁকে ও তাঁর ৩ বছরের দাদা হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীকে নিয়ে পিতার বাড়ি  চট্টগ্রামে চলে আসেন। শামসুন নাহারের মা আছিয়া খাতুন ছিলেন যথার্থ শিক্ষিত। তিনি বাংলা লেখাপড়া জানতেন এবং এর সঙ্গে সঙ্গে আরবি উর্দু ইংরেজিও জানতেন। ছেলেমেয়ের  চরিত্র গঠনে লেখাপড়া আদব কায়দা ধর্ম শিক্ষার প্রতি তাঁর বিশেষ খেয়াল ছিল। 

শামসুন নাহার চট্টগ্রামের ডাক্তার খাস্তগীর গার্লস হাই স্কুল থেকে লেখা পড়া করেন। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর স্কুলে পড়ার ক্ষেত্রে বাধা এল। কারণ তখনকার মেয়েদের একটু বড় হলেই পর্দা প্রথার জন্য বাইরে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। তাই উচ্চশিক্ষিত অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও শামসুন নাহার স্কুলের পড়া সম্পূর্ন করতে পারলেন না। সমাজের ভয়ে তাঁকে স্কুল ছাড়তে হয়। তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা জানতে চাইলেন,"তুমি স্কুল ছাড়ছ কেন? তুমি তো পড়াশুনায় খুব ভালো।" শামসুন নাহার জবাব দিলেন,"বড় হয়ে গেছি যে।" শিক্ষিকা মুসলমান ছিলেন না। তাঁর সমাজে এই বাধা এত ছিল না। তাই তিনি এই ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলেন না অতটুকু মেয়ে বড় হয়ে গেছে শুনে। কিন্তু তাঁর আগ্রহে এবং পরিবারের সহযোগিতায় তিনি ম্যাট্রিককুলেশন পরীক্ষা দিলেন। ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল তিনি চারটি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে আশি শতাংশের কাছাকাছি নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন। অবরোধের আড়ালে বসে শামসুন নাহার যে কষ্ট ও পরিশ্রম করেছিলেন তা সার্থক হল। ১৯২৬ সালে ডাক্তার ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে বিয়ের পর শামসুন নাহার কলকাতায় যান। ডাক্তার মাহমুদ ছিলেন মুক্তমনা ও উদার।  তিনি পূর্ব পাকিস্তানের শল্য চিকিৎসক। স্বামীর অনুপ্রেরণায় শামসুন নাহার পরীক্ষার প্রায় ৪/৫ মাস পর কলকাতার ডায়োসিসান কলেজে ভর্তি হন। ১৯২৮ সালে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে আইএ পরীক্ষা পাস করেন। ১৯৩২ সালে ডিস্টিংশন নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হন। এরপর দীর্ঘ ১০ বছর পর ১৯৪২ সালে তিনি এম.এ পাশ করেন। ডায়োসিসান কলেজে পড়ার সময় থেকে ১৯৩২ সালে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের  মৃত্যু পর্যন্ত শামসুন নাহার রোকেয়ার ঘনিষ্ট ছিলেন এমনকি তাঁর সহকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান তিনি। শামসুন নাহারের বিএ পাশ উপলক্ষে ১৯৩২ সালে রোকেয়া এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সেখানে শামসুন নাহার বলেন, "আমি আশা করি সেদিন দূরে নয় যেদিন আমাদের সমাজের মেয়েরা শুধু বিএ পাশ করে সংবর্ধনা পাবেন না, সংবর্ধনা পেতে হলে তাঁদের আরো বড় কাজ করতে হবে"। 

পরবর্তীকালে শামসুন নাহার রোকেয়ার নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। রোকেয়া ' আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম ' বা ' নিখিল বঙ্গ  মুসলিম মহিলা সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেখানে সমিতির সম্পাদিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন শামসুন নাহার। ১৯৩৯ সালে বাংলার মুসলিম নারী সমাজের দাবিতে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠান করেন সরকারি  কলেজ লেডি ব্রেবোর্ন। এই কলেজে অধ্যাপনা (বাংলা বিভাগে) করেন তিনি। এ সময় ‘নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলন’ এর কলকাতা শাখায় তিনি যোগ দেন। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন সংস্কার আইন পাশ করেন। তখন পর্যন্ত ভারতীয় নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। এই সময় শামসুন নাহার নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনের কলকাতা শাখার তরফ থেকে এদেশের মেয়েদের ভোটাধিকার নিয়ে ব্যাপকভাবে আন্দোলন চালাতে থাকেন। ফলে ভারতীয় নারীদের ভোটাধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আইন পাশ হয়। যার ফলে এদেশের মেয়েরা ভোট দেওয়ার অধিকার পেলেন। এছাড়াও আন্দোলনের কারনে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার কয়েকটি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। ১৯৩৬ সালে কলকাতায় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে বাংলার মুসলমান নারী সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ফলে তিনি স্বামীপুত্রসহ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং রাজধানী ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি বাংলা একাডেমীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন’-এর সুবর্ণ জয়ন্তী সম্মেলনে ছয় সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তানি নারী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। পরে তিনি সমগ্র এশিয়ার জন্য এই আন্তর্জাতিক মৈত্রী সংঘের আঞ্চলিক পরিচালক হয়েছিলেন। দেশভাগের কয়েক বছর পর ঢাকায় নারীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘বেগম ক্লাব’ এর সভানেত্রী ছিলেন তিনি। শামসুন নাহারের চেষ্টায় ১৯৬১ সালে ‘পঙ্গু শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র’ স্থাপিত হয়। তিনি ১৯৬৩ সালে সমগ্র পাকিস্তান শিশু কল্যাণ পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে লন্ডনে জাতিসংঘের উদ্যোগে ‘পারিবারিক আইনে নারীর মর্যাদা’ সম্পর্কে একটি সভা হয়। এতে পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে শামসুন নাহার যোগদান করেন।

অল্প বয়স থেকেই শামসুন নাহার লেখাপড়ায় যেমন আকৃষ্ট ছিলেন সেরকম সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল ছোট থেকেই। তিনি কবি নজরুল ইসলামের স্নেহধন্য ছিলেন। কবির কাছ থেকে তিনি অনেক অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা পান।  তাঁর ছোটবেলায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হত মাসিক পত্রিকা  'আঙুর'। এই পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। আই. এ. পড়ার সময় তিনি  'নওরোজ ' এবং ' আত্মশক্তি ' পত্রিকার মহিলা বিভাগ সম্পাদনা করতেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ গুলি হল - 'পূণ্যময়ী' , 'ফুল বাগিচা', 'বেগম মহল',  'রোকেয়া জীবনী', 'নজরুলকে যেমন দেখেছি' ইত্যাদি। তিনি স্কুল পাঠ্য পুস্তকও রচনা করেন, 'সবুজ পাঠ' ,'কিশোর সাথী','তাজমহল পাঠ'  ইত্যাদি। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে শিক্ষাক্ষেত্র ও সমাজকর্মের জন্য বিশেষ উপাধিতে  সম্মানিত করে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার শামসুন নাহারকে মরোনত্তর ' বেগম রোকেয়া পদক, ১৯৯৫ ' প্রদান করেন। ১৯৬৪ সালের ১০ এপ্রিল মাত্র ৫৬ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।

এদেশের নারীদের জন্য বিশেষ করে মুসলিম নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে,নারী জাগরণের প্রচার ও প্রসারে শামসুন নাহার মাহমুদ অনন্য কীর্তি ও অবদান রেখে গেছেন।

ছবি : সংগৃহীত

লেখক : বাচিক শিল্পী 

0 Comments

Post Comment