শাপিতপুরুষ (একবিংশ কিস্তি)

  • 17 April, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 469 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পূর্বকথা-- কমলিকা ব্যানার্জি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কোনমতে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছি। এক বছর বন্ধ ছিল। ফের ভার্সিটিতে যাই। সুমন আসা অবধি নিত্য রাত শফিককে ভাবি। এই শাড়ি পরে এখানে বসে রাত কাটাই। প্রাণধর্মে সুমনরা একেক জন দেবতা। সমাজ-ধর্মের সম্ভ্রম রাখেনি বলে সমাজ-ধর্ম ওদেরকে এমনভাবে নিষ্ঠুর নৃশংস কামড় বসায় তখন ওরা হারতে বাধ্য হয়। মুখে বিদ্রূপের হাসি টেনে এনে উঠে যাবার সময় দুইবার করে বাতাসে থুতু ছিটিয়ে গেল কমলিকা ব্যানার্জি।

[৩০]

সেতু ভাঙছে, দেহ ভাঙছে : চৈতি

টানা দ্বিতীয়বার সুমনের হিংস্রতার শিকার হয়েছে চৈতি। শ্যামলের জন্যে এখন আর অবশিষ্ট কিছু নেই ওর কাছে। চৈতি দুম মেরে বিছানায় জড়িয়ে পেঁচিয়ে পড়ে রইল একদিন একরাত। নিজের খাবার, এমন কি ছেলের খাবারের কোন ব্যবস্থা করেনি। ছেলেটা ফ্রিজ হতে এটা ওটা বের করে খায়। বাবার কল আসলে সে বুঝতে পারে। শ্যামলের নম্বরে চৈতি ভিন্ন রিংটন সেট করে রেখেছে। সেই রিংটন বেজে উঠলেই ছেলে তখন বাবা বাবা বলে চেঁচিয়ে লাফিয়ে অস্থির। ছেলের স্মৃতিতে বাবা বলতে দেয়ালে টাঙানো ছবির মতন। বাবার কল আসলে ছবির দিকে তাকিয়ে কথা বলে। সুনসান নীরব ঘরে ঘরে ছোট ছোট পায়ে ছেলেটা হাঁটে একা একা। মুখ ভার। কখনো টিভি চালায়। টম এন্ড জেরির খেলা দেখে। কখনও সাপ-লুডু খেলে। কোন কাজেই স্থির নেই। আবার বাবার ছবির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে। মা কেন এভাবে পড়ে আছে? ওর ছোট বুদ্ধিতে কুল পায় না। কেন বাবার সাথে আর কথা বলে না?

ছেলের এ সব কাণ্ড চৈতি বালিশে মুখগুঁজেই দেখতে পায়। হাউমাউ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নখ দিয়ে খামছে ধরে বিছানা কুণ্ডলি পাকিয়ে তাতে গড়াগড়ি দিতে থাকে নিরন্তর। ছেলের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে লক খুলে কল ঢুকিয়েও কেটে দিল। ফের লক করে দিল। নিঃশব্দ ঘরে ছেলের পবিত্র পা ফেলার শব্দ ধুক ধুক করে বাজে চৈতির বুকের গহিনে। যে বিশেষ পবিত্র জায়গায় ছেলের জন্ম সেখানেই সুমনের বিষাক্ত বীজ জায়গা করে নিয়েছে। ছেলে কি ক্ষমা করবে? এ সত্য জানার পরও কি আর মা বলে ডাকবে বড় হয়ে? ছাইচাপা দিয়ে সত্য কতক্ষণ আড়াল করে রাখবে। খেলার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট চোখে চৈতির দিকে তাকায় ছেলে। চৈতি তখন হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। ঘৃণায় গুটিয়ে থাকে। প্রচণ্ড একটা ভয়ের তাণ্ডব ঢেউ খেলে চৈতির  মনে। স্বামী কি মানবে? আর মানলেই কী হবে? চৈতি কেন যাবে? সে কি শ্যামলের স্ত্রী এখন আর? বলিষ্ঠ বীজীপুরুষের দলিতমলিত উচ্ছ্বিষ্ট দেহটা কি এখন আর শ্যামলের আছে? তবে কি ফের বিয়ের মন্ত্র পড়ে নেবে?

নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে ওঠে চৈতি, হায় রে মন্ত্র!

সুমনের উপর আক্রোশ কিংবা ঘৃণা বিন্দুমাত্রও নেই চৈতির মনে। কী হবে মৃতবৎ মানুষকে ঘৃণা করে? যে সুমন চৈতির বুকের গহিনে, সে সুমন এই জীর্ণশীর্ণ কঙ্কালসার সুমন নয়। মায়ায় চৈতির ভিতরটা টনটন করে ওঠে মানুষটার জন্য। জীবনের কাছে কি অপার প্রত্যাশার কি ঘৃণ্য প্রাপ্তি তার! মানুষের ঘৃণা, ঈশ্বরের ঘৃণা, চারদিকে শুধু ঘৃণা আর ঘৃণা। ও সুমনদা, কেন এত বড় ভুল ফাঁদে পা দিলে? চৈতি কুঁকড়ে ওঠে। টলমলে একহারা উঁচালম্বা ঝকঝকে হাসি মুখের লোভনীয় সুমনকে দেখতে পায়। স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে মণিমানিক কুড়ানোর মতো সেই সন্ধ্যায় নিজের এলোমেলো চুমু আর সুমনের নখর আঁচড় খুঁজে পায়। সেই পুকুর পাড়ের বুক লেপটে ধরে সুমনকে চুমু খাওয়ার সুখ এত হিংস্রতাতেও ম্লান করতে পারছে না! জীবনের এক আত্মঘাতী সংকটের মুখে, ভাঙনের কূলে দাঁড়িয়ে চৈতি যেন আরও একবার সুমনকে মনেপ্রাণে কামনা করে। মোবাইলের লক খুলে সুমনকে কল ঢোকায়। সাপ-লুডুর ঘর ফেলে দৌড়ে আসে ছেলে। মার কোলে হুমড়ি খেয়ে আব্বু আব্বু বলে বলে বেদিশা হয়ে উঠেছে। কম্পমান চৈতি কল কেটে দেয়। তখনই বুক কাঁপিয়ে বেজে ওঠে ছেলের প্রতীক্ষিত রিংটন। আব্বু আব্বু বলে মায়ের আলগা হাত হতে মোবাইল কেড়ে লাফিয়ে নেমে দৌড়াল ছেলে।

নিথর চৈতি সম্বিতহারার মতো বসেই আছে। ছেলেকে ঠেকানোর চেষ্টা করেনি।

ছেলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রিসিভ বাটন টিপে ধরে, আব্বু...

ওপার হতে ভেসে আসে শ্যামলের শঙ্কিত কণ্ঠ, বাবা!

অভিমানে গাল ফুলিয়ে ছেলে বলে, আব্বু! তোমার কি হইছে? অসুখ!

না, আব্বু, আমার কিছু হয়নি।                                                                        

মাম্মীর না অসুখ। খালি কাঁদে। ছেলের কণ্ঠে আরও গভীর অভিমান।

কী বলো! তোমার মাম্মীকে দাও।

মোবাইল হাতে নিয়ে লাইন কেটে দিল চৈতি। ফের বন্ধ করে দিল। লাল টকটকে ছোট্ট গোল দুটি চোখে তীর্যকভাবে তাকায় ছেলে তার মায়ের দিকে। ছেলের তীব্র চাহনি বর্শার ফলার মতো বুকে বিঁধে চৈতির বুক যেন ছ্যাঁদা করে ফেলে। ছেলের চোখে ঘৃণা! আমি এখন পালাই কোথায়?

এই ছেলে চৈতিরই রক্তপিণ্ড। ওর পেটে চারা গাছের মতো দিনে দিনে বেড়ে ওঠে একদিন পেট ফেঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। এই ছেলেকেই এখন চৈতির বড় ভয়! আমি আমার স্বামীকে ত্যাগ করতে পারি, অস্বীকার করতে পারি, কিন্তু ছেলেকে অস্বীকার করি কী করে! ছেলে যে আমার-ই শরীর। আমার-ই রক্ত-মাংসে গড়া।

দরজায় টকটক শব্দ শুনে চৈতি বলে, কে?

আমি। পাশের ফ্লাটের।

শরীরে কাপড় জড়িয়ে পেঁচিয়ে দরজা ধরে দাঁড়ায় চৈতি। দরজা খুলতেই মহিলা শিউরে ওঠে, একি বৌদি! আপনার শরীর দেখছি যারপরণাই খারাপ। খবর দেননি কেন? দাদা থাকে না দেশে। আপন বলতে তো আমরা-ই। এক গাদা কথা দাড়ি কমা ছাড়াই ননস্টপ বলে ফেলে মহিলা। চৈতি চরম বিরক্ত। কিছু বলবেন বৌদি? 

দাদা আমার মোবাইলে ফোন করেছিলেন। আপনার মোবাইলে নাকি কল ঢুকছে না। বন্ধ বলছে। খুব করে অনুরোধ করলেন যেন এখনিই আপনি কল করেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রওয়ানা দিচ্ছেন।

আচ্ছা। চৈতি সপাট বন্ধ করে দরজা। ফের কল করতে পারে শ্যামল। বিষয়টা অড্ দেখাবে। রহস্য খুঁজবে শেষে। ঢাউস যুবতী বউ ফেলে স্বামী বিদেশে। বিষয়টা এমনিতেই একটা সন্দেহের। লক খুলতেই নিস্তব্ধ ঘর কাঁপিয়ে বেজে ওঠে মোবাইল। শ্যামলের কল। সুদূর কানাডা থেকে বাতাসে উড়ে আসা শ্যামলের কণ্ঠ শোনা যাবে এখনিই। স্ক্রিন কেঁপে কেঁপে অস্থির হয়ে ওঠানামা করছে শ্যামলের নাম। চৈতি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে। বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ের ঠাণ্ডা বাতাস শাঁ শাঁ করে বইছে চৈতির ভেতর রাজ্যে। বস্ত্রহীন নিঃস্ব শীতার্তের মতো থরথর করে কাঁপছে শরীর। ছেলে এলো না দৌড়ে। হরদম বেজে বেজে বন্ধ হতে হতে আর যখন রিং বাজছে না তখন চৈতি মোবাইল হাতে নিয়ে শিশুর খেলনার মতো নাড়েচাড়ে।

দরজায় খটখট শব্দে চৈতির টনক নড়ে। এবার নিস্তার নেই। কট করে দরজা খুলে ঠোঁট ফাঁক করে হাসির ভান করে বলে, সরি, এই যে কল করছি। মোবাইলে চার্জ ছিল না।

মোবাইল কানে উঠিয়ে দরজা বন্ধ করে চৈতি। রিং একবার বাজতেই শ্যামলের চেঁচানো কণ্ঠ, তোমার প্রবলেমটা কোথায়? অসুস্থ বলে মরে তো যাওনি, নাকি?

চৈতি আস্তে করে বলে, সরি!

[চলবে...]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) 

0 Comments

Post Comment