ঘরের বাইরে ঘর

  • 03 May, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 366 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সবাই জানে বিনতাই কিছুটা নিতাইয়ের বিপক্ষে গিয়ে সাহস দেখানোর মতো ঔদ্ধত্য রাখে। আঁটোসাঁটো চেহারাতে কিসের এত আগুন ওর, লোকেরা ভেবে পায় না। কিন্তু মনে মনে ভাবে একদিন ঝড় এলেই গাছটা পড়ে যাবে। গেলে বেশ হয়। মেয়েদের দাপট পুরুষ-অধ্যুষিত সমাজ ভালো চোখে নিতে পারে না কোনওদিন। ওর নামে খুব মৃদুস্বরে হলেও কুৎসার চেষ্টা হয়েছে। ধোপে টেকেনি। নিতাই জানে এসব করে লাভ হবে না। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সে। সুযোগ সে পেয়েছে। তারপর ?

বিনতা রুটি সেঁকছিল। ওর চারপাশে অনেকেই ভিড় করে দাঁড়িয়ে। যত না রুটির গন্ধে, তার চেয়ে অনেক বেশি করে বোধহয় বিনতাকেই মেপে নেওয়ার আশায়। কয়লার উনুন থেকে গনগনে আঁচ উঠছিল। বিনতার মুখের উপরে আলো এসে পড়ছিল। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। কালো কোঁদা পাথরের মতো দেহে সামান্য সস্তা দরের একটা ছাপা শাড়ি জড়ানো। স্বাস্থ্য দেখলে অনেকেরই চোখ পড়তে বাধ্য। বিনতার হোটেলে দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষই খেতে আসে। মানুষগুলো দুঃখী, পরিশ্রমী, সৎ অথবা জোচ্চোরও হতে পারে। কিন্তু বিনতা সকলকেই হাতের মুঠোর মধ্যে করে রেখেছে। আশ্চর্য এক সম্মোহনী শক্তি রয়েছে তার।

 

এই সময়ই পরম কোথা থেকে যেন ঘেমে নেয়ে এসে কাঠের বেঞ্চিটার একপাশে ধপ করে বসে পড়ল। পরম সম্পর্কে বিনতার দেওর, ওর স্বামী নরেনের খুড়তুতো ভাই। সংসারের বাজারে এখনও ঠিক মতো গুছিয়ে বসতে পারেনি। টুকিটাকি কাজ করে বেড়ায় এদিক সেদিক। মন বসে না। পালিয়ে আবারও জ্যাঠার কাছে এসে ঘ্যানঘ্যান করে। পরমের বাবা গত হয়েছেন। মা কোনওমতে একপাশে পড়ে আছেন। পোদ্দারনগরের এই বাজার অঞ্চলটা যেখানে শেষ হয়েছে, তার কাছেই একটা ছোট দুকামরার ঘরে বিনতারা ভাড়া থাকে। বিনতারা বলতে, ও আর ওর স্বামী নরেন, মেয়ে সোনালী। সোনালী গেল বারে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। এখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার। পরমদের ঘর আরও একটু ভিতরে। এককামরার একচিলতে ঘুপচিতে ও আর ওর মা থাকে। বিনতাদের ঘর থেকে হেঁটে মিনিট তিনেকও লাগে না। পরম হাতের কাছে পড়ে থাকা জলের জগটা তুলে নিয়ে ঢকঢক করে জল খায়। ঘাম মোছে। বিনতার দিকে তাকায়।

 

রুটিগুলো তাওয়াতে সেঁকে নিয়ে যার যে’কটা লাগবে কাগজের ঠোঙাতে মুড়ে হাতে হাতে দিয়ে দিতেই মিষ্টির দোকানে মাছি তাড়ানোর মতো ভিড়টাও হালকা হয়ে গেল। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে, কপালে চকচকে ঘাম নিয়ে বিনতা পরমের পাশে এসে বসে। হাতপাখাটা তুলে নিয়ে নিজেকে হাওয়া করতে শুরু করে। ওপাশের টেবিলে দুজন বসে খাচ্ছে। বিনতার হোটেলে তরকা, ডিমের ডালনা, আলুভাজি, এসবও পাওয়া যায়। একগাল হেসে পরম বলে ওঠে, “নিতাইদা জ্যাঠার কথা শুনেছে গো। সস্তায় রফা করে দিয়েছে।” বিনতা অবাক হয় না। স্থানীয় পার্টির নেতা নিতাই ঘোষের সঙ্গে তার স্বামীর যে একটা ঘনিষ্ঠতা আছে এ খবর এখানে কারও অজানা নয়। নিতাই কেবল পার্টির নেতাই নয়, সে বাজার-সমিতিরও একজন হোমরাচোমরা সদস্য। তার কথাতেই এখানে অনেক কিছু ঘটে থাকে। ওর সাঙ্গপাঙ্গরা বাজারে বেশ একটা রেলা নিয়ে চলে। কেউ তাদেরকে ঘাঁটাতে সাহস করে না। বিনতা এদেরকে তেমন রেয়াত না করলেও, দূরত্ব বজায় রেখে চলতে ভালোবাসে। স্বামীর সঙ্গে নিতাইয়ের ঘনিষ্ঠতার কারণেই হয়তো বা এতটুকু সাহস দেখাতে পারে সে। “একেবারে মোড়ের মাথায় আমাকে দোকান বসাতে দেবে গো! বাজার কমিটিতে বলে দিয়েছে নিতাইদা। কমিটি পঁয়ত্রিশ চেয়েছিল এজন্য। নিতাইদা পঁচিশে রফা করে দিয়েছে। জ্যাঠা না থাকলে,” পরম দাঁত বের করে বিনতার দিকে তাকায়। বিনতা মনে মনে ভাবে এবার না সে ধার চেয়ে বসে। অবশ্য পরম আজকে দারুণ মুডে রয়েছে। ধার চাইবার কথা তার মাথাতেও আসে না।

 

জমানো টাকা থেকেই সে নাকি প্রায় পুরোটাই ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে। হিসেব করে দেখেছে সে। আপন মনে পরম বকবক করে যেতে থাকে। মোড়ের উপরে, ওই যে চিঙ্কি মেয়েগুলোর মোমো-চাউমিনের ঠেলাগাড়ির দোকান। ওরই আশেপাশে জায়গা হবে তার। পরমের কথা শুনে নড়েচড়ে বসে বিনতা। চিঙ্কি বলতে, মেঘালয়, মণিপুর বা অরুণাচলের মেয়ে ওরা। সঠিক করে জানে না কেউ। সোনিয়া-ঝিলিক আর ওদের মা শিরিন। শিরিন যে কতকাল ধরে এই পোদ্দারনগরে পড়ে রয়েছে তাও কেউ জানে না। ওর স্বামীকেও কেউ দেখেনি কোনওদিন। একদম শুরুতে নাকি স্বামীর সঙ্গেই এই পোদ্দারনগরের ভাড়া বাড়িতে এসে উঠেছিল এই শিরিন। সোনিয়া তখন কোলে, ঝিলিক পেটের ভিতরে বড় হচ্ছে। তারপর সেই যে স্বামী মানুষটি গেল নিরুদ্দেশ হয়ে কোথায়, শিরিন একা হাতে দুই মেয়েকে দাঁড় করালো। ওই মোমো আর চাউমিন বেচেই। ঝিলিক বা সোনিয়াও এখন মায়েরই কাজে হাত লাগায়। সকালে যায় কলেজে ক্লাস করতে। এলাকার ছেলেরা খুব নজর দেয়। পাহাড়িয়া গড়ন, জামাকাপড়ও পরে ছোট ছোট। হায়া-লজ্জা নেই যেন। এসব বিনতার কথা নয়। ওদের কাপড় নিয়ে বিনতার কোনও অসুবিধে হয় না। কেবল মাঝবয়সী পুরুষগুলোরই বাড়াবাড়ি সমস্যা যত। একদিন তো নরেনের সঙ্গেও বিনতার লেগে গিয়েছিল। স্পষ্ট বলে দিয়েছিল বিনতা, ওরা যে কাপড়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করে তাই তো পরে ওরা – তোমাদেরই বা এত ঘুরে ঘুরে তাকানোর বাই কিসের! নরেন খুব চটে গিয়েছিল সেদিন। পরম হঠাৎ চুপ করে গেছে। বিনতা মুখ তুলে দেখল সোনিয়া আর শিরিন আসছে। পরম যেন চট করে উঠে পড়ল, “আমি বাড়ি যাই গো বৌদি, মা বসে থাকবে।” বিনতা ওকে কিছু বলার আগেই শিরিনরা তার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। পরম চলে গেল।

 

-“রোটি হবে নাকি গো দিদি ?” একগাল হেসে শিরিন জিজ্ঞেস করে। এতবছর এখানে থেকেও বাংলায় তার পাহাড়িয়া টান কাটেনি। তুলনায় মেয়েদুটোই বরং পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে। বিনতাও হেসে তাকায়।

-“নিশ্চয়ই হবে গো দিদি। কটা লাগবে বলো তোমার!” বেঞ্চি থেকে উঠতে উঠতে বিনতা বলে ওঠে।

-“দশটা দাও আপাতত,” শিরিন বলে, “আর বোলো না। ছোট মেয়েটার শরীর ভালো নেই। যা সব লোকজন হয়েছে আজকাল তুমাদের পাড়ায়।” শিরিনের গলায় চাপা বিরক্তি ঝরে পড়ে। বিনতা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়।

-“কি হয়েছে গো ?” সে জিজ্ঞেস করে।

-“আরে ওই তুমাদের পিন্টু আছে না। নিতাইবাবুর বড় চেলা এখন। রোজই আমার মেয়েদুটোকে দেখে। আওয়াজ দেয়। সঙ্গে আরও দু-চারজন ওই মাস্তান ছোকরাগুলো থাকে। ভোলা, নরেশ। মেয়েগুলো কিছু বলতেও পারে না। আজ একেবারে সন্ধ্যেয় ফেরার সময় ঝিলিকবেটির হাত ধরে টানাটানি করেছে। জড়িয়ে ধরতেও নাকি গিয়েছিল। ঝিলিক হাত ছাড়িয়ে কোনওমতে পালিয়ে এসেছে। এসে থেকে ঘরে শুয়ে আছে। মনমেজাজ ভালো নেই। এভাবে চলে বলো ?” শিরিন বিনতার দিকে তাকায়।

 

অন্ধকারে কয়লার আগুন গনগনে হয়ে চকচকে হয়ে ওঠে। বিনতার মুখে কথা সরে না। রুটি সেঁকবার সময় চারপাশেকার এমন অনেক দৃষ্টিকেই তো তাকেও প্রতিনিয়ত সহ্য করতে হয়। কেবল ভরসা বলতে মাঝে থাকে কয়লার আগুন। হাত বাড়ালেই পুড়বে হাত। ও সোনিয়ার দিকে তাকায়। যৌবন ভরে এসেছে। পরনে একটা হাফ-শর্ট আর হাতাওলা টপ উপরে। সুন্দর, এবং তারই মধ্যে এক অপার স্নিগ্ধতা। এসব কি সত্যিই অমন করে চেটে নেওয়ার জিনিস ? পাড়ার লোকগুলোর চোখের দিকে তাকালেই কেমন যেন গা ঘিন ঘিন করে ওঠে বিনতার। বিতৃষ্ণা জমে ওঠে মনের ভিতর। ও শিরিনের হাতের উপরে হাত রাখে। রুটি সেঁকতে থাকে আবার।

 

রাত্তিরে নরেনের পাশে শুয়ে বিনতা পাড়ল কথাটা। “পিন্টুরা কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি শুরু করেছে আজকাল। শিরিন আজ বলছিল।” “কি বলছিল ?” নরেনের গলায় অল্প বিরক্তি। “ওর মেয়েদুটোর সাথে কনটিনিউ বাজে ব্যবহার করে যাচ্ছে। আজ নাকি গায়ে হাতফাত দিয়েছিল।” “তো ?” জড়ানো গলায় বলে নরেন, “ওরা ওরম জানলা-দরজা ফোটানো জামা পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে, আর বাড়ন্ত ছেলেরা সব সতীলক্ষ্মী হয়ে হাতে নোয়া পরে বসে থাকবে নাকি, শালা!” আজ মনে হয়ে পেটে জল পড়েছে তার। বিনতা চুপ করে যায়। ওর গা আবারও ঘিন ঘিন করে ওঠে। কাদের সঙ্গে বেঁচে থাকতে হয়। সোনালীও তো জিনস আর টপ পরে কলেজে যায়। তাহলে কি একদিন! মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে ওর, আর ভাবতে পারে না। পাশ ফিরে সে শুয়ে পড়ে। কথা বাড়ায় না।

 

হঠাৎ করে ওর জীবনের গল্পটাও স্পিড বাড়িয়ে নেয়। বিনতার মতো মেয়েরা যারা মুখ বুজে খেটে গিয়েছে, রেয়াত করেনি কারোকে, তারাও একেকটা সময়ে এসে নুয়ে পড়ে হঠাৎ। নুয়ে পড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু তার আগেও তারা ঠিকই বুঝিয়ে দিয়ে যায় তাদের ক্ষমতাকে, তাদের নারীত্বকে। সাহসের সঙ্গে। যদিও সমাজের ক্রমাগত জমতে থাকা অন্ধকারের তলায় চাপা পড়ে যায় সেইসব ইতিহাস। গল্পেরা খেই হারায়।

 

পরের দিন সকাল থেকেই কাজের চাপ চলছিল। পরমও সকালে এসে একবার কোনওমতে মুখ দেখিয়ে নিয়েই ছুটেছে নিতাইদার অফিসে, দোকানের জায়গাটার ব্যাপারে ফাইনাল কথা বলে নিতে। আপাতত চা-সিগারেটের একটা ছোটমতো দোকানের ব্যবস্থা হয়েছে। অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠেই অবশ্য বিনতার মেজাজটা খিঁচড়ে গিয়েছিল। বেরুতে যাওয়ার সময়েই নরেন চা খেতে খেতে মুখ তুলে একবার শাসিয়ে বলে দিয়েছে, “পিন্টু-মিন্টুদের নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতে যেও না কিন্তু। ভুলো না, পরমেরও একটা ভবিষ্যৎ আছে।” ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। সবটাই  জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। এতদিন অবধি শিরিন বা ওর মেয়েদের সঙ্গে যখনই বাড়াবাড়ি কিছু হয়েছে বা হওয়ার মতো ইঙ্গিত দেখা দিয়েছে, বিনতা প্রকাশ্যে বা নরেনকে দিয়েও নিতাইকে বলিয়েছে। সবাই জানে বিনতাই কিছুটা নিতাইয়ের বিপক্ষে গিয়ে সাহস দেখানোর মতো ঔদ্ধত্য রাখে। আঁটোসাঁটো চেহারাতে কিসের এত আগুন ওর, লোকেরা ভেবে পায় না। কিন্তু মনে মনে ভাবে একদিন ঝড় এলেই গাছটা পড়ে যাবে। গেলে বেশ হয়। মেয়েদের দাপট পুরুষ-অধ্যুষিত সমাজ ভালো চোখে নিতে পারে না কোনওদিন। ওর নামে খুব মৃদুস্বরে হলেও কুৎসার চেষ্টা হয়েছে। ধোপে টেকেনি। নিতাই জানে এসব করে লাভ হবে না। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সে। সুযোগ সে পেয়েছে।

 

তখন বিকেল। কি একটা জিনিস আনতে বিনতা মোড়ের মাথার দিকটাতে গিয়েছিল। তখনই দেখল ঝিলিককে। কলেজ থেকে ফিরছে বোধহয়। জিনস আর টপ পরেছে। অটো থেকে নেমে গলিতে ঢুকতে যাবে, পিন্টুর বাইকটা ওর পথ আটকিয়ে দাঁড়ালো। বাইকের উপরে পিন্টু আর ওর এক সাগরেদ। “কিরে চিঙ্কি বেড়াতে যাবি ?” ঝিলিকের গায়ে হাত দিল সে। পিন্টু দাঁত বের করে আসছে। ঝাঁকুনি দিয়ে সরে এসে ঝিলিক আবার হাঁটতে চেষ্টা করল। বাইকটা আবারও চুক্কি মেরে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। লোকে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। “চিঙ্কি! চিঙ্কি!” আবারও ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে পিন্টু, অশ্লীল ইঙ্গিত করে। বিনতা আর দেরী করল না।

 

চড়টা যে আসবে এবং অতটাও জোরে আসবে ভাবতে পারেনি পিন্টু। বাইক থেকে সে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। সানগ্লাসটা উড়ে গিয়ে নর্দমার উপরে পড়েছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি-সমেত গালটা লাল হয়ে গেছে। কোনওমতে বাইক সামলিয়ে এবারে সে নেমে আসে। বিনতা ভয় পায় না। কিন্তু চড়টা যে পালটা ফিরে আসবে এটা তার অঙ্কে ছিল না। মাথা ঘুরে রাস্তাতেই সে বসে পড়ে। আঙুল উঁচিয়ে হুমকি দিচ্ছে পিন্টু, অশ্লীল শব্দগুলো কানে শোনা যাচ্ছে না। ঝিলিক ওর পাশে বসে পড়ে ওকে তুলতে চেষ্টা করে। পরমও যেন কোথা থেকে ছুটে এসেছে। ঝিলিকের উদ্দেশ্যে একটা অশ্রাব্য গালি ছুঁড়ে দিয়ে সে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, “ এখান থেকে চলো বৌদি,” সে বিনতাকে ধরে তুলতে চেষ্টা করে। এবারে বিনতাই ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে সে উঠে দাঁড়ায়। ঝিলিকের হাত ধরে। কিছু বলে না। ওর সময় ফুরিয়েছে। কিন্তু বিনতারা ঠিকই অন্যভাবে ফিরে আসবে। সে পায়ে পায়ে এগোয়। ঝিলিক কেঁদে ফেলেছে।

 

মাস ছয়েক কেটে গেছে। নীচুশ্রেণির ভাড়া বাড়িতে অন্তত আগে থাকলেও একেবারে একরাত্তিরের নোটিশে বস্তিতে উঠে আসতে গিয়ে, মানিয়ে নিতে প্রথম প্রথম বেশ একটু সমস্যা হয়েছিল বিনতার। এখন তারও অভ্যাস হয়ে গেছে। সকালে জল তোলার জন্য লাইন দিতে হয়। একদিন বিনতা একদিন শিরিন যায় পালা করে। সোনিয়া-ঝিলিকদের কলেজটা এখান থেকে একটু দূর হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম দুএকদিন নরেন এসে চেঁচামেচি করেছিল। লোকদেখানি ঝামেলার চেষ্টা করেছিল। বিনতা গা করেনি। চুপচাপ সয়ে গেছে সেসব। মনে মনে ও বেশ জানে, পাশের বাড়ির চাঁপার দিকেও বেশ কিছুদিন ধরেই বাঁকা চোখে দেখছিল নরেন। এখন আর লুকোছাপার প্রয়োজন রইল না। আসলে মনুষ্যত্ব, স্বাধিকার, সম্মতি, সম্মান কেতাবি শব্দ সব। দাঁতনখ সকলেরই আছে। কেউ কেউ বা প্রকাশ্যে বের করে রাখে। কেউ বা আড়ালে ছুরি চালায়। সততার ভান করে কেবল। সেদিন সকালে কটকটে রোদ উঠেছে। দরজায় খটখট শব্দ হতেই চোখ তুলে তাকালো বিনতা। এগারোটা প্রায় বাজে। শিরিনের ঘাড়ে আজ বাজারের দায়িত্ব। সোনিয়া-ঝিলিক কলেজে। শিরিন আর বিনতা মিলে এখানেও একটা ছোট ঠেলাগাড়িতে করে নানারকম চটজলদি ফাস্টফুড ঘুরে ঘুরে বিক্রির চেষ্টা শুরু করেছে। একজায়গাতে না দাঁড়িয়ে, বিভিন্ন পাড়ায়, এলাকাতে। খাট থেকে উঠতে গিয়ে আলিস্যি লাগছিল বিনতার। তবুও উঠতে হয়। দরজা খুলতেই ওর চোখদুটো কেমন স্থির হয়ে আসে।

 

“চলে এলাম মা। ওখানে টিকতে পারলাম না। পরমও ...” দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা হঠাৎ বিনতাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। বিনতা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে কেবল। বাপ-ন্যাওটা মেয়েটাকেও যে এভাবে শাস্তি পেতে হবে, সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। কেবল সে কোনওমতে থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীরটার উপরে হাত বোলায়। “ভিতরে চল, চোখেমুখে জল দিয়ে একটু ঠাণ্ডা হ দিকিনি,” বিনতার সেই হোটেলমালিকসুলভ মেজাজটা ফিরে এসেছে। বিনতাদের যে হেরে যাওয়ার মতো কোনও বিকল্প নেই। ওরা ঠিকই তলে তলে সংগঠিত হয়। ওরা ঠিক জানে – একদিন ওদের হাতেও আকাশের কর্তৃত্ব আসবে। অনেক রাত্তিরে সোনিয়া-ঝিলিক-সোনালীতে মিলে নরম ময়দার মোড়কে, মোমোর সুস্বাদু পুর ঠেসে ভরতে থাকে। পরস্পরের দিকে হাসিমুখে বারংবার তাকায়। নতুন একটা দিনের স্বাদ ওদের মনের জানালাতে উঁকি মেরে বেড়ায় ...

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment