আমি কেউ নই

  • 31 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 431 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
আড়তদার মনে হয় যাদু জানে। তর্কের নামে সাপ খেলার মতো খেলিয়ে বেড়াচ্ছে আমাকে। গণ্ডগ্রামের বউমানুষের মাথায় এসব কী ঢুকাচ্ছে? বলে কি না, দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধ চলছে। তোমার ঐ ছোট্ট ঘরে, ঐ ছোট্ট গ্রামে বসে থেকে করবে কী? গণ্ডমুর্খ পুরুষ মানুষটাকে নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিলে জীবনে আর দেখলে কী? দুনিয়াটাকে দেখতে হবে না?

আমার নেশা আর শফিকের ব্যবসা ভালোই চলছে। আড়তদারের মন ভাঁজিয়ে লাখ লাখ টাকা পুঁজি পাচ্ছে শফিক। সে ব্যবসা করছে চার হাতে। আর আমিও বসে নেই। ঢাকায় যাবার নেশা পেয়ে বসেছে। আড়তদারের ময়ূরপঙ্খি খাটে হেলান দিয়ে বিচিত্র বিষয় নিয়ে তর্ক করার নেশা আফিমের নেশার মতো আমারে ধরেছে।

শফিক লেখাপড়ায় ব-কলম, তবে বুদ্ধিতে একালের বিএ এমএ ওর কাছে নস্যি। ও ঠিকই ধরে ফেলেছে, আমার ঢাকায় যাবার নেশা ধরেছে। কিন্তু ওকে ধরেছে লাখে লাখে টাকার মাল কেনার নেশা। এত তুচ্ছ বিষয়ে ভাববার সময় নেই। রাতে বিছানা ভরে ফেলে টাকায়। নেশায় টগবগিয়ে ওঠে শরীরের সমস্ত রক্ত। টাকা আর আমি, ত্রিভুজের নিচের দুই কোণ, উপরের কোণ শফিক। টাকা, আমি আর বিছানা জড়িয়ে পেঁচিয়ে ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেল হলে ব-কলম শফিকের চিলের মতো থাবা তখন আরো ১০ ডিগ্রি কমিয়ে ৮০ ডিগ্রিতে জমিয়ে আনে। শকুনের মাংস ছিঁড়ে নেবার মতো যখন আমার পেটের নাড়ি-নক্ষত্র পর্যন্ত টানাছেঁড়া চলে তখন জলেভাসা পদ্মের মতো আমার চোখ দু-টি ভাসে টাকার উপরে। আমি তখন টাকার সমুদ্রে একবার ডুবি, একবার ভাসি। একবার জেগে উঠি, হাত-পা ছুঁড়ি, একবার নির্বিকার নিস্তেজ।

আমার শরীরজুড়ে এখন শুধু টাকার খসখস শব্দ। মাকে একদিন বললাম-তোমাকেও কিছু দিবো, মা।

মা বলে-ছি মা! ছি! তওবা কর। এ কথা বলিস  না। জামাইয়ের টাকায় হাত দিস না।

আমি তখন আনন্দে লাফাই। বজ্জাত টাকা আমাকে কিনতে পারলেও আমার মা-বাবাকে কিনতে পারেনি।

ঠিক তিন মাস তিন দিন পরের কথা। শেষ চৈত্রের দুপুরের একদিন মা মোবাইল করে, কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ তার, নাকি কাঁদছে কে জানে, ভারী নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। বলেতোর বাপের মাথা বিগড়ে গেছে!

চিরকাল মা-র মাথা বিগড়ে আছে। বাবা ঠাণ্ডা ছিল। এখন উল্টে গেল! আমি বললাম, কেন? কী হল?

মা-র কণ্ঠ থেকে ওঁ ওঁ শব্দ বের হল। পিঠে যেন কেউ চাবুক মারছে। চাবুকের আঘাত খেতে খেতেই বলছে-তোর বাপে তিন কাঠা বাড়ির জমি...। বলেই কেশে কণ্ঠের শ্লেষা পরিষ্কার করে নিল। পুরুষ কণ্ঠের থ্যাতলানো শব্দ শোনা গেল। বেঁধে মারা নেড়ি কুত্তার মতো কেঁউ কেঁউ আওয়াজ শোনা গেল। শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে বমি করার মতো করে আর একটি অসমাপ্ত বাক্য টেনে ছিঁড়ে বের করতে পারে মা-জানিস তো, ভাড়া বাড়িতে আর...।

আমি অট্টহাসিতে মোবাইলের পর্দা ফাটিয়ে ফেলতে চাইলাম-মা তুমি টাকা চাচ্ছো? এই তো? টাকা তুমি চাইবে-ই সে তো আমি জানি। তবে এ নাটুকেপনা কবে শিখলে? এখন কাঁদছো। কাল পরশু কঠিন অনুরোধ করবে। তোমার কাছে আমার দুধের ঋণ, আর আমার কাছে তুমি ঋণী হবে টাকার। এখন মেয়েকে সমীহ করবে। ধামকি-ধুমকি-শর্ত পুতুলের মতো তুমি শুনে যাবে। মেনে যাবে। অভাবের টাটানি শুরু হলে তুমি তো তুমি মা, দেশের সরকার পর্যন্ত হাত পাতে।

মাকে যে কথাগুলো এক নিশ্বাসে বললাম সবই আড়তদারের শেখানো বুলি। একটাও আমার কথা না। আড়তদার এত খবর রাখে বলে কি না আমাদের দেশের বাজেট নাকি আমাদের টাকায় হয় না। কারা কারা নাকি টাকা দেয়। আমি বললাম, সে টাকা শোধ দিতে হবে না?  সে তখন একগাল হাসি দিয়ে বলে, তুমি দেখছি আচ্ছা পাগল! কেউ কি এমনিতেই কিছু দেয় নাকি? এই পৃথিবীর মানুষ এতটা স্বার্থহীন ছিল নাকি কোন কালে? সুদে-আসলে শোধ করতে হয়।

আমি সেদিন বুঝতে পারিনি এবং এখনো যে পারছি তাও তো বলতে পারব না-আমাদের গ্রামের সুদখোর মহাজনদের তুলনায় ওদের পার্থক্য কোথায়? মানুষটার আরও একটি কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝে উঠতে পারলাম না। সে বলে, সরকার নাকি আমাদের মাথা দেখিয়ে বিদেশ থেকে টাকা আনে। আমরা প্রত্যেকেই নাকি ঋণী। আমি বললাম, আমিও? সে দমফাটা হাসি দিয়ে এমন করে বুঝিয়ে দিল, আমি তো আমি, জহুরা বেওয়া অর্থাৎ আমার শাশুড়িও নাকি এই ঋণের ঋণী।

আমি বললাম, কই, আমি তো সম্মতি দেইনি ঋণ নিতে?

আড়তদার আবারো একই স্কেলে হেসে ওঠে, তুমি কে?

আমার মেজাজ খাট্টা হয়ে গেল। আমি কেউ নই? আমি কেউ না!

আমার রক্ত মাথায় উঠে গেল। আমার নাম ভাঙিয়ে বিদেশ থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা ঋণ আনবে। সেই টাকা নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নেবে। দামি গাড়ি-বাড়ি কিনবে। বিদেশে ঘুরবে। দামি হোটেলে থাকবে আর দামি খাবার, মদ-নারী নিয়ে মৌজ করবে, আর আমাকে জানানো হবে না? আবার আমি কেউ না? রাগে-আক্রোশে আমার গা কাঁপছে। মানুষটা গুলতাপ্পি মারছে না তো?

আমি শিরদাঁড়া সোজা করে বলি, আমি কিছুতেই এই ঋণ মানি না। আমি এক পয়সাও দেবো না।

আমাকে পাঁচ সেকেন্ডও শিরদাঁড়া সোজা করে থাকতে দিল না লোকটা। পাল্টা আক্রমণ করে বসে। সেই একই হাসি তার সিগারেট পোড়া কালচিটে ঠোঁটজুড়ে। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে নাচিয়ে বলে-তুমি তো তুমি। এই মুহূর্তে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হল, নাড়ি ছেঁড়া হয়নি, ঠিক মতো চিৎকারটিও দেবার সময় পায়নি, সেও ঋণী। যে মানুষটি এই মুহূর্তে শেষ নিশ্বাস ফেলেছে, আর ফিরে আসবে না কোনদিন, সেও একগাদা ঋণ নিয়েই গেল।

আমার তখন চিল্লাতে ইচ্ছে করছিল। আপনি কী বলেন এসব? আজ সকালে জন্ম নেওয়া জরিনা খাতুনের শিশুটিও ঋণী? আমি ফিক করে হেসে দিলাম। দেশটাকে স্বাধীন করে শেষে এই পেলাম? একটা শিশুর জন্ম হয় ঋণের মুচলেকা দিয়ে। মরতে হবে ঋণের দায় নিয়ে। এই একটা বিষয়ে আমি আড়তদারের মুখে মুখে তর্ক করলাম। তারপরেই তর্কের নেশা পেয়ে বসে আমাকে।

আড়তদার মনে হয় যাদু জানে। তর্কের নামে সাপ খেলার মতো খেলিয়ে বেড়াচ্ছে আমাকে। গণ্ডগ্রামের বউমানুষের মাথায় এসব কী ঢুকাচ্ছে? বলে কি না, দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধ চলছে। তোমার ঐ ছোট্ট ঘরে, ঐ ছোট্ট গ্রামে বসে থেকে করবে কী? গণ্ডমুর্খ পুরুষ মানুষটাকে নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিলে জীবনে আর দেখলে কী? দুনিয়াটাকে দেখতে হবে না?

আমি বললাম, কে দেখাবে? আমার এত বড় চশমা নাই।

 লোকটি সোনালি ফ্রেমের চশমাটি চোখ থেকে নামিয়ে খালি চোখে আমাকে দেখে নিয়ে ফের চোখে নিল। পকেট থেকে সবুজ রঙের রুমাল বের করে মুখ মুছল। ইজি চেয়ারটিতে একবার দোল দিয়ে ঠিক আমার কোল বরাবর চোখ রেখে যা বলে তা বোঝার বিদ্যা-বুদ্ধি আমার নেই।

 তার মতে, আমরা নাকি যুদ্ধের মধ্যেই আছি! কী সাংঘাতিক কথা-আমাদের বাড়ির অশীতিপর বৃদ্ধা জহুরা বেওয়া অর্থাৎ আমার শাশুড়ি, সেও নাকি এই যুদ্ধে আছে। তা সে কিসের যুদ্ধ? যুদ্ধের জন্য ঢাল-তলোয়ার কই? অস্ত্র-গোলাবারুদ কামান কোথায়? সৈন্য-সামন্ত তো কিছুই চোখে দেখি না। যুদ্ধটা কিসের? কার বিরুদ্ধে? কে কার শত্রু?

আমাদের স্কুলের মিয়ারুদ্দি মাস্টারের মতো সবজান্তার হাসি দিয়ে মানুষটা বলে, হিটলার, মুসোলিনির নাম শুনেছো?

আমি ঘাড় বাঁকিয়ে অসম্মতি জানালাম, না, শুনিনি।

বুশ-সাদ্দামের নাম শুনেছো?

অ আ ক খ শিখাতে লাগলেন কেন?

উসামা বিন লাদেনের নাম শুনেছো?

ও ব্যাটা কি আমার বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষের কেউ হয়, নাকি স্বামীকুলের কেউ হয়, যে নাম আমার জানতেই হবে। প্যাঁচাল ছেড়ে সোজা লাইনে আসেন।

বুশ-সাদ্দাম যুদ্ধ করে, তেলের দাম বাড়ে এই দেশে, কথা ঠিক?

আমি কাঁধ ঝাঁকালাম, ঠিক।

টুইন টাওয়ার কোথায় আর কোথায় বা বাংলাদেশ-এই জন্যে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে লালবাতি জ্বলে। সর্বস্বান্ত মানুষরা বুকে থাপ্পড় মেরে গলায় ফাঁস নেয়। গার্মেন্টেসে শ্রমিক ছাটাই হয়। কেন?

আমি তখন সম্মতি জানিয়ে বলেছিলাম, এই কথাটি সত্য বলেছেন। সে বছর আমাদের গ্রামের বিশ-বাইশজন মেয়েমানুষ বাড়ি ফিরে সে কী কান্না! ওদের গার্মেন্টস নাকি বন্ধ করে দিয়েছে মালিক। কোথায় নাকি কোন মুসলমান বদমায়েশ বুশের দেশের বিল্ডিং ভেঙে ছাতু বানিয়ে ফেলেছে, হাজারে হাজারে মানুষ মারা পড়েছে, এই কারণে।

তাহলে এবার বলো, দুনিয়াটার একটা শেকড় আছে। সেখানে কোপ পড়লে গাছের মতো সারা দুনিয়া নড়ে ওঠে।

এরকম বিচিত্র তর্কের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি আড়তদারের কাছে থাকলে। আর যখন না থাকি, শফিকের কাছে থাকি, এক সাথে শুই, তখনও এই নেশার মধ্যেই থাকি। নেশা আমি ছাড়ি না, নেশাও আমাকে ছাড়ে না। এই নেশার ঘোরেই একদিন সাপের পেট থেকে বাচ্চা বেরোনোর মতো মুখ বাঁকাত্যাড়া হয়ে বেরিয়ে আসে মনের কথা-আমি আর তোমার এখানে থাকব না, শফিক। দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ চলছে এখানে থেকে করব কী?

শফিক কেমন বড় চোখ করে তাকাচ্ছিল আমার দিকে। মেয়েমানুষটা বলে কী!

কেন আছি তোমার কাছে? কেন থাকব? আর কেনই বা থাকতেই হবে? এই ধরনের আপেক্ষিক প্রশ্নগুলো মগজে ঢুকিয়ে কম লড়াই করিনি ভেতরে-বাইরে। নিজের সাথে নিজে। পাশের বাড়ির লাইলি বুবু, মনোয়ারা ভাবি, খাদিজা খালা সবাই তো দিব্যি আছে। তারা কি খোঁজ খবর নিতে গেছে নাকি নেওয়ার কোন দরকার আছে, কিসের যুদ্ধ চলছে। কেন চলছে যুদ্ধ? কে বা কারা পুঁজিরযুদ্ধ নাকি তেলের যুদ্ধ করে মরছে-তাতে তাদেরই বা কি? কিন্তু যেদিন থেকে আড়তদার বলেছে, তারাও যুদ্ধের মধ্যেই আছে, সেদিন থেকে কেন স্থির থাকতে পারছি না। তবে কি এইচএসসি পর্যন্ত পড়াটাই আমার জন্যে কাল হয়ে গেল? শফিককে মরা মাছের মতো হা করে তাকাচ্ছিল। মায়া হচ্ছিল ভীষণ। ওর চোখের উপরে নিজের চোখ দুটো স্থির করে বললাম-পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বুশের আগ্রাসন নীতি, তেলের যুদ্ধ, পানিরযুদ্ধ, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এসব বুঝো কি? বুঝো যে না সে তো আমি নিজেই জানি। সুতরাং বাছাধন তুমি মেনে  নাও, আমি ঢাকায় থাকব। মনে মনে বললাম, মানুষটা যে শক্তি দিয়ে টানছে, নিজেকে রক্ষা করার সেই শক্তি পাবো কোথায়? লোকে বলে, খুঁটির জোরে ভেড়া নাচে। আমার যা খুঁটি দেখছি, ভেড়া কেন ইঁদুর নাচলেই উপড়ে যাবে।

মেনে নিয়েছে শফিক। বড় চোখ ছোট হয়ে পাখির চোখের মতো হয়ে গেছে। মাথা নিচু করে বসে আছে। মাথার ভারে কুঁজো হয়ে আছে। মাথা নিচু হতে হতে ও কি উটপাখি হয়ে যাবে নাকি!

সমস্যা অন্যত্র। বউ থাকতো না রে! বউ চম্পট দিল রে! এই কোন কথা গো- বলেই আমার শাশুড়ি অর্থাৎ শফিকের মা জহুরা বেওয়া এমন জোরে চিল্লাতে শুরু করে দিল, আর হায় হায় করে কপাল চাপড়াতে শুরু করে যে, হয় ঘরে আগুন লেগেছে না হয় ছেলে মরেছে। গ্রাম ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে লোকেরা ছুটে আসে। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। শফিক তো উঠোনে কাপড় শুকানোর বাঁশে ঠেস দিয়ে বামপায়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে বাঘ-বন্দির ঘর আঁকছে উদাস মনে।  

ইতিমধ্যে জহুরা বেওয়া অক্ষম শরীর নিয়ে দৌড়ে ছেলের কাছে আসতে গিয়ে ছাগলের পেচ্ছাবে পা পিছলে উল্টি খেয়ে পড়ে দাঁত খিলাল লেগে যায় যায় অবস্থা। আমি তুলতে গেলাম না। সেও নাকি যুদ্ধের মধ্যে আছে। তাই তাকেই উঠতে হবে। কোন দয়া চলবে না। শফিক কী পাথর হয়ে গেল! মা বলতে সে দেওয়ানা। অথচ সেই মা হাত-পা ছেড়ে ইন্নালিল্লাহ পড়ার জো হচ্ছে তবু ধরতে এগোচ্ছে না। আমার কথা শুনে শফিক বোধহয় বুঝতে পেরেছে, তার মা যুদ্ধের মধ্যে আছে। যুদ্ধের সৈনিককে নিজের শক্তিতে লড়তে হয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়, প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে টিকে থাকতে হয়।

লোকের হুল্লোরের চোটে জহুরা বেওয়া খুব বেশিক্ষণ দাঁত খিলাল লাগিয়ে থাকতে পারল না। আঘাত খাওয়া সাপের মতো মাথা সামান্য চেতিয়ে লোকের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দ্বিতীয়বারের মতো বিলাপ জুড়ে-হের লাইগা কইছিলাম। হে রে বাপ আমার! লেহাপড়া জানা বউ ঘরে আনিস নারে। বউ তোরে ফালাই থুইয়া চম্পট দিবো। হেই তো দিলো। হায় হায় রে! ছেলের কী অইবো রে! বাপমরা এতিম ছেলে আমার।

জহুরা বেওয়ার এই বিলাপের হেতুটা কী! জলজ্যান্ত বউ ঘরে বসে আছে। বউ চম্পট দিলো কই? এ সব বলাবলি করছে আগতরা। পাশের বাড়ির ছোকড়া বয়সী ছেলে আজিজ তো এক ধাতানি দিয়ে গেল-ধ্যাত্! ফাউল বুড়ি। আর কুনোদিন এমন নাটক করলি তো তোর টুটি টিইপা ধরুম। জনমের মতো নাটক করা শিখাইয়া দিয়াম নে।

বুড়িটার নাটক শেষ হয় না। রাগে গা রি রি করে ওঠে। ঘরের জানালার ধারে বসে দেখছি আর ভাবছি, বুড়ি বড় নিখুঁত অভিনেত্রী। পুরুষেরা চলে গেল। কিন্তু মেয়েমানুষগুলো আঁটার মতো লেগে আছে। এদিকে শয়তান বুড়ির যেন মাথায় বিগাড় উঠেছে-বউ চম্পট দিলো রে! বউ চম্পট দিলো রে! বলে মরাকান্না আর থামছে না।

লাইলি বুবু বহু চেষ্টা-তদবির করে যাচ্ছে বুড়ির মুখে শুনতে, কেন সে এমন করে বিলাপ করছে? ছেলের বউ তো ঘরে। ঢাকা গেছিল, ফিরেছে সকালে। ঢাকা সে আজ নতুন যায় নাকি? সপ্তাহে সপ্তাহে না গেলে পেটের ভাত হজম হয় না। এ তো পুরানা কথা। তাতে এহেন বিলাপ কেন বুড়ির?

জহুরা বেওয়ার এই সব কাণ্ডকীর্তি দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। বিছানায় উপুড় হয়ে বুক উজাড় করে হাসলাম একচোট। তারপর উঠে গেলাম। কত শান্তভাবে বললাম, আমি ঢাকায় থাকব, আর কত ভয়ানক গর্জন হয়ে বেজে উঠল বুড়ির বুকে। তার ছেলের বুক তো কচু কাটার মতো কাটবে বলেছে আড়তদার। কেননা তার মধ্যে নাকি গরীবয়ানা ভাব আছে। কোটি টাকা দিতে রাজি সে, শফিক নাকি পাঁচ লাখ টাকা নিয়েই কুপোকাত। পুরুষ মানুষ টাকা নিতে ভয় পায়! কী করবে এত টাকা দিয়ে, কাজে তো লাগাতে পারবে না। ওকে দোষে কি লাভ। সরকারের ঘরে কত বিদেশি টাকা নাকি মুখথুবড়ে পড়ে থেকে শেষে ফেরত চলে যায়। খরচ করার নাকি হিম্মত নেই। আড়তদার বলেছে, তৃতীয় বিশ্বের গরীব কাঙালরাই এ সব ন্যাকামি করে। প্রেম-ভালোবাসা, শখের পীরিতি, বিয়ের মতো ফালতু বে-দামি চিন্তা নিয়ে পড়ে থাকে। বড় কোনো চিন্তা ওদের মাথায়  ঢোকে না। না হলে একজন বুড়ি চিৎকার দিল আর গ্রামের ছাওবুড়ো মিছিল করে চলে এলো! ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিনা লাভে খরচা করে গেল। সময়ের কি কোনো দাম নেই? বিদেশে যারা বড়লোক, যাদের অঢেল টাকা, তারাও নাকি সেকেন্ড মিনিট হিসেব করে খরচ করে, বিনিময়ে কত আয় হল সেই অঙ্ক কষে। 

চোখ ঘুরিয়ে সকলের অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করে কণ্ঠে কৃত্রিম রাগ টেনে এনে বললাম-আপনাদের কি কোন কাজ নাই? এখানে বসে রইলেন কেন? কী হইছে তার?

বউমা, তুমি এ কী কও! আমরা মাইয়া মানুষ, আমাদের কিয়ের কাম? কাম তো করে মিনসেরা। ক্ষেত-খামারে।

প্রয়োজনে ক্ষেত-খামারের কাজই করবেন। লাঙল-গরু-কাস্তে নিয়ে মাঠে যাবেন। জমিতে লাঙল দিবেন। ধান বুনবেন, ধান কাটবেন, বিল থেকে মাথায় করে ধান বাড়ি আনবেন। দুনিয়ার সবখানেই মেয়েমানুষরা ক্ষেত-খামারে কাজ করে। আপনারাই খালি পারেন না। বারো হাত শাড়ি পরে সারাজীবনের জন্য দাসি হয়ে যান। গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা দিয়ে দেশের জনসংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর কোন কাজটাই আপনারা করেন? পারেন শুধু এর-ওর দোষ খুঁজতে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের ৮ কোটি আপনারা। সেই দেশ চলে কী করে? বেশ কর্কশ কণ্ঠে চোখ পাকিয়ে কথাগুলো বললাম। 

তওবা! তওবা!! বউমা তুমি শহরের শিক্ষিত মাইয়া বইলা যা মুহে আইয়ে তাই কইবা! খেপে ওঠে পাশের বাড়ির মনোয়ারা ভাবি।

এবার শান্ত হবার চেষ্টা করি, বেশ মোলায়েম করে বলি, ভিয়েতনাম, জাপান, চীন, মার্কিনে গিয়ে দেখেন, আপনাদের মতো মেয়েমানুষরাই ক্ষেত-খামোরে কাজ করে। টিভিতে দেখেন না-কাগজের মতো ধবধবে ফর্সা, নাক-মুখ চ্যাপটা মেয়েমানুষ প্যান্ট-গেঞ্জি পরে চড়া রোদের মধ্যে পুরুষের সাথে মাঠে কাজ করে। সেই দেশের গম-চাল-টাকা দিয়েই তো এই দেশ চলে। 

তুমার শাশুড়ি এই গীত ধরছে কেরে হেই কথা আগে কও। পরে শুনুম নে ভিন্দেশি মাইয়ামানুষের কিচ্ছা।-লাইলি বুবু বরাবরই আমার দিকটা দেখে, কিন্তু কেন জানি আজকে আমার শাশুড়ির পক্ষ নিয়ে কথা বলছে।

আমি ঢাকা থাকব। তাই সে এমন নাটক করছে। আমি বেশ শান্তভাবে নিচু কণ্ঠে বললাম।

সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। বউ এসব কী বলে! ঢাকা থাকবে মানে? তবে তো বুড়ি ঠিক বিলাপ-ই পারছে। বউয়ের ছোঁ গো তো ভালা ঠেকছে না। লাইলি বুবু ভুরু কুঁচকে বলে, ঢাকা থাকবা কেরে?

যুদ্ধ দেখবো।

কীয়ের যুদ্ধ?

আপনেরা বুঝবেন না।

থাকবা কই? কার লগে থাকবা?

আড়তদারের বাসায় থাকব। তার কাছেই থাকব।

তওবা! তওবা!! আস্তাগফিরুল্লাহ!!! ওরা সকলে কোরাস কণ্ঠে বলে ওঠে। ঘরের বউ তুমি পরের ঘরে গিয়া থাকবা! এ কোন অনাসৃষ্টির কথা!

তার কাছে পুঁজি আছে। সে পুঁজিপতি। আড়তদারের শেখানো কথা মুখ ফসকে বের হয়ে গেল।

পুঁজ! পুঁজ!! ওয়াক ওয়াক করে উঠল পরিজার মা!

নাড়িভুঁড়ি বাইর হয়ে আসবে নাকি? আমার ভিতরে হাসি ইঁদুরের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু হাসছি না। দেখি এসব মানুষেরা কী ভেল্কি দেখায়? আড়তদার বলেছে, পুঁজি নাকি কৃষ্ণের বাঁশির মতো ওদের ডাকছে। এই ডাকে সাড়া না দিয়ে বাঁচা নাই। আমার জহুরা বেওয়া থেকে শুরু করে বারাক ওবামা পর্যন্ত এই পুঁজির দাস। নাকি ক্রীতদাস। দূর ছাই, মনে করতে পারছি না কী বলেছে। সে যাই হোক-কই, এরা তো শুনেনি পুঁজির কথা। তার বাপ, তার বাপের বাপ চৌদ্দ পুরুষের কেউ তো নামও জানে না। তারপরেও এরা পুঁজির দাস না ক্রীতদাস কীভাবে হবে? এসব আজগুবি চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে কি সর্বনাশটাই করল আমার!

এদের মধ্যে লাইলি বুবু বাংলা লিখতে-পড়তে পারে। মাথায় চিকন বুদ্ধির খেলও ভালোই পারে। চট করে ধরে নিল কথাটা। এ কোন জন্তু জানোয়ার পালে গো তোমার আড়তদার?

হি হি করে হেসে উঠল সবাই।

মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। আচ্ছা সেয়ানা তো মুর্খ মেয়েমানুষগুলো। আমার নীরবতাকে উপহাস করে কোরাস কণ্ঠে হেসে ওঠে সবাই-শফিকের বউ তুমি আমরার লগে সিনেমা করো, অ্যা! সিনেমা ?

এদের নেতা লাইলি বুবু খপ করে হাত ধরে বলে-বোন আমারে পুঁজ দেখাইতে নিয়া যাবি? চিড়াখানায় থাহে না? বাঘের মতো হিংস্র বুঝি? মানুষ খায়? দাঁত-নখ কেমন গো? কোদালের ফালার মতো? নাকি চাকুর মতো চকচক্কা? কথাগুলো বলেই রহস্যভরা  হাসি দিয়ে সকলের অভিব্যক্তি পরখ করে।

মুখ ফসকে এক কথা বলে এ কী ভয়ানক বেকায়দায় পড়েছি। সব বজ্জাত মেয়েমানুষ একজোটে হয়ে লেগেছে। আমার এতদিনের ধারণা ভুল ছিল।   জিলাপির প্যাঁচের মতো এদের মনে হাজারো প্যাঁচ, মাথাভর্তি কুবুদ্ধি।

আড়তদার যাইতে কইছে! কইলেই তুমি যাইবা? স্বামী-শাশুড়ির চোখের সামনে দিয়া, সমাজ-ধর্মের উপর দিয়া যাইবা? মানুষটা তোমারে যাদু-টোনা করছে বুঝি? টানা নিশ্বাসে কথাগুলো বলে অন্যদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসে মনোয়ারা ভাবি।

ঘুঘু ফাঁদ আর কি। আরও বড় ফাঁদে পড়েছি। কোন পাপে মুখ ফসকে বেরুতে গেল কথাটা! 

বৌমা, আড়তদার যদি...? পরীজার মা পান-খাওয়া ফোকলা দাঁত বের করে হাসতে গিয়ে কী মনে করে থেমে গেল। 

এরপর ক্রোধ প্রকাশ করা অর্থই আরো আক্রমণের শিকার হয়ে ঘায়েল হতে হতে মাটির সাথে মিশে যাওয়া। আর কিছু বলার নেই আমার। শুধু বললাম, আমি কে?

ও মা! সে কী কথা? তুমি আমাদের শফিকের বউ। লাইলি বুবু চমকে ওঠে। সকলেই চোখ চাওয়াচাওয়ি করে সবিস্ময়ে।

আমি কেউ না। নিজেকে ডিফেন্স করার আর কোনো ভাষা শেখায়নি আড়তদার।# 

লেখক : কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) 

ছবি : সংগৃহীত

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment