চিঠি

  • 24 December, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 550 view(s)
  • লিখেছেন : মীরা কাজী
দেবায়নের হাত থেকে খামটা নিয়ে সেটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তৃণা। চিঠি! এখন তো চিঠির পাঠ নেই! যা কিছু সব মোবাইলে। কে লিখেছে? প্রেরকের নামের জায়গাটা ফাঁকা। প্রাপকের জায়গায় তারই নাম লেখা। “তৃণা সেন”। দ্রুত হাতে খামটা ছিঁড়ে ভিতরের কাগজটার ভাঁজ খুলে চিঠির শেষ অংশটিতে চোখ রাখে সে। বিস্ময়ে,বেদনায়একাকার হয়ে যায় তৃণা। চিঠিটা হাতে ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।

  (পর্ব-১)

দেবায়নের হাত থেকে খামটা নিয়ে সেটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তৃণা। চিঠি! এখন তো চিঠির পাঠ নেই! যা কিছু সব মোবাইলে। কে লিখেছে?প্রেরকের নামের জায়গাটা ফাঁকা। প্রাপকের জায়গায় তারই নাম লেখা। “তৃণা সেন”। দ্রুত হাতে খামটা ছিঁড়ে ভিতরের কাগজটার ভাঁজ খুলে চিঠির শেষ অংশটিতে চোখ রাখে সে। মধু! মধু চিঠি লিখেছে তাকে? বিস্ময়ে,বেদনায়একাকার হয়ে যায় তৃণা। চিঠিটা হাতে ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তারপর চোখের কোলটা আঁচলের খুঁট দিয়ে মুছে পড়তে শুরু করে।

“দিদি, আমার প্রণাম নিবি। দেবায়নদাকে আমার প্রণাম দিবি। আমরা ভাল আছি।মিশুকও ভাল আছে। তার মুখে সারাক্ষণ “সোনামা” আর “সোনামা”। জানিস!ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সে তার সোনামাকে ডাকে”।

 আবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তৃণার। এত দুর্বল চিত্তের মেয়ে তো সে নয়? তাহলে চিঠির কয়েকটি শব্দ পড়ে এমন হচ্ছে কেন? বুকের ভিতরটা উথাল পাথাল করে উঠছে।  বেশ করে রগড়ে চোখ পরিষ্কার করে আবার চিঠিটা পড়তে শুরু করে তৃণা।

“আমি জানি তুই আজো আমাকে আগের মতই ভালোবাসিস। কিন্তু আমি তোকে কোনোদিন দিদির মর্যাদা দিতে পারিনি। কেন পারলাম না তা আমি নিজেও কি জানি? শুধু এই টুকু মর্মে মর্মে জানি,ছোটোবেলা থেকে তোকে হারাতে চেয়ে নিজেই গো হারান হয়েছি। যে নিজেই হারতে চায়, তাকে হারানোয় মজা কোথায়? তাইতুই হেরে গিয়েও জিতে যেতিস। আর তোকে হারিয়েও জেতার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজেকেই আমার হেরো মনে হত। তখন সব রাগ গিয়ে পড়ত তোর উপর। এই চিঠিটা আমার ‘কনফেশন’ বলে ধরে নিতে পারিস। কিছু কথা আমার বুকে পাথরের মত চেপে বসেছে। সেটা তোকে বলে হাল্কা হতে চাই। যার বেশির ভাগই তুই জানিস। যেটুকু জানিস না, সেটুকু এখান থেকে জানতে পারবি।

  আমি চিরকাল তোর উল্টো। তুই আমাকে যত ভালবাসতিস আমি তোকে ততই ঈর্ষা করতাম। অথচ আমার তোকে ঈর্ষা করার কথা নয়। বরং তুই আমাকে ঈর্ষা করলে তবু একটা কথা ছিল। আমি ফর্সা। তুই কালো। আমার স্বাস্থ্য নিটোল। তুই রোগা। আমি সহজে সবার সাথে মিশতে পারি। তুই মুখচোরা। আমি ছোটো বলে মা,বাবাও আমকে বেশি প্রশ্রয় দেয়। ফলে যা কিছু দায়িত্ব সব তোর ঘাড়ে চাপে।

আমি মধুরিমা। তুই তৃণা। আমি বলতাম, “তুই হলি ঘাস।তোকে ছাগলে খাবে”। “ওটা তো নাম? নাম আবার ছাগলে খায় নাকি? বোকা কোথাকার? ”বলে নিজেই বোকার মত খানিক হেসে নিতিস তুই। আমাকে বোকা বলায় আমি রেগে গিয়ে মায়ের কাছে নালিশ জানাতাম, “মা! দিদি আমাকে বোকা ,হাঁদা বলল”! মা তোকে বকা দিত। খাবার সময় মাছের বড় পিসটা নিজের পাতে তুলে নিলে, তুই আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতিস, এ ছিল তোর প্রশ্রয়ের হাসি। তখন কি বুঝতাম? আজ বুঝি। আমি খাওয়া ফেলে কাঁদতে কাঁদতে বলতাম, “মা! দিদি আমাকে মুখ ভেঙালো! "মা রেগে বলত, “ছোটো বোনটার খাওয়া পণ্ড না করলেই চলছিলনা? বুড়ো ধাড়ি মেয়ে!” তোর চোখের কোল ভিজে উঠতো। আমি  খুশি খুশি আবার খেতে বসতাম।

   তুই আমার থেকে দু বছরের বড় হলে কি হবে, তোর রোগা চেহারার জন্য আমদের জামার সাইজ ছিল এক। পুজোর সময় প্রত্যেকবার আমি আগে নিজের পছন্দেরটি তুলে নিতাম। শীতকালে লেপের বেশির ভাগটা নিজের দিকে টেনে নিতাম। লেপের কোনাটা কোনোমতে গায়ে দিয়ে বুকে হাঁটু লাগিয়ে  ঘুমিয়ে পড়তিস তুই। তুই যদি আমার সাথে ঝগড়া করতিস, মায়ের কাছে নালিশ করে আমাকে বকুনি খাওয়াতিস। তাহলে তোর প্রতি আমার অকারণ  ঈর্ষাভাবটা হয়তো জন্মাতো না। তোর এই নির্বিচারে সব কিছু সয়ে নেওয়া আমার সহ্য হতনা। কেবলই মনে হত, তুই বাবা-মায়ের কাছে ভালো সেজে আমাকে খারাপ প্রতিপন্ন করতে চাস।

পড়াশোনায় তুই বরাবরই ভালো। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবি। এটা তোর স্বপ্ন। আমার আবার পড়াশোনা মোটেই ভালো লাগেনা। আর সেই তুই পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ হয়ে রয়ে গেলি। আর আমি কোনো রকমে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলাম। হঠাৎ করে মায়ের ব্রেন টিউমার ধরা পড়ল। হঠাৎ হঠাৎজ্ঞান হারাচ্ছে। মাকে একা রাখা যাবেনা। বাবার যা অবস্থা তাতে করে একজন আয়া রাখা সম্ভব নয়। এমনিতেই মায়ের চিকিৎসার জন্য বিরাট অংকের টাকা খরচ হচ্ছে। তাই তোকে পড়া ছাড়তে হল। তুই একবার মিন মিন করে বললি, “তুই তো বলিস পড়তে তোর ভাল লাগেনা! পড়া ছাড়তে পারলে বেঁচে যাস!তাহলে এখন তুই বাড়ীতে থাক!” “আমি অতসব পারব নাকি? তুই থাকতে আমি কেন করতে যাব?” আমি সাফ বলে দিলাম। কলেজে ভর্তি হওয়া তোর হলনা।  উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।     

এক সময় মা সুস্থ হল। ততদিনে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। তুই আবার কলেজে ভর্তি হতে চাইলে এবার মা বাধা দিলেন। তোকে পাত্রস্থ করার জন্য বাবা তখন উঠে পড়ে লেগেছে।

 পাত্রপক্ষ তোকে দেখতে আসে। কেউ তোকে পছন্দ করেনা। সকলেই বলে, “বড়টি নয়, আপনার ছোটো মেয়েটির সঙ্গে দিন”। এরপর পাত্রপক্ষ তোকে দেখতে এলে তাদের সামনে আমার যাওয়া বারণ হয়ে গেল। তবুও কি করে তারা জানতে পেরে যাচ্ছিল যে কালো মেয়েটির একটি সুন্দরী বোন আছে। বাবা মা বিস্মিত হচ্ছিলেন, “মধুকে এরা দেখল কীভাবে? তাহলে কি আগে থেকে খবর নিয়ে এসেছে”? একটা কথা কেউ জানলনা। আমি ফাঁক বুঝে, পাত্রপক্ষকে আমার সুন্দর মুখটি দেখিয়ে আসতাম। অন্য কিছুই নয়, তোকে বার বার অপমানিত হতে দেখে আমি এক ধরনের সুখ অনুভব করতাম। বাবা-মা বুঝে নিলেন আমার বিয়ে না হলে তোর বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তারা এবার আমাকে নিয়ে পড়লেন।

এক কথাতেই সায়নের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। সায়নরা দুই ভাই। সায়ন চ্যাটার্ড এ্যাকাউন্টেন্সি পাশ করে ভাল কোম্পানিতে চাকরি করে। সায়নের দাদা দেবায়ন বিয়ে করেনি। ছবি এঁকে, বই পড়ে দিন তার কাটে। হাত খরচের জন্য জনাকতক ছেলে মেয়েকে পড়ায়। শ্বশুর নেই। শাশুড়ী দিনের বেশিরভাগ সময় পুজোর ঘরে কাটান।

শ্বশুর বাড়িতে আমার দিনগুলো ভালোই কাটছিল। একদিন সায়নই কথাটা তুলল, “তোমার দিদির গায়ের রংটা চাপা। তবে ভারি চমৎকার স্বভাব। কি সুন্দর রান্নার হাত? দাদার সঙ্গে বেশ মানাতো।”

আমি ঝাঁঝিয়ে বললাম, “দিদিকে কদিন দেখেছো যে তার এত গুণগান করছ?”

“ কাউকে কাউকে এক পলক দেখলেই বোঝা যায়?”

“আমাকে দেখে কি বুঝেছিলে শুনি?”

“বাবা,মা আর দিদির আদরে বাঁদুরে একটি মেয়ে! ”সায়ন ফিচেল হাসি হেসে বলে।

“তাই অমনি এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলে?”

“বাঁদরিটার গলায় মুক্তোর মালা পরাবার সাধ জাগল কি না?”

“আহারে! আমি বাঁদরি আর উনি মুক্তোর মালা না? দেখাচ্ছি মজা!” কৃত্রিম রাগ দেখাই আমি।

“এখন ছাড় ওসব। আমার প্রস্তাবটা কেমন বল? ”সায়ন খুনসুটি ছেড়ে স্বাভাবিক হয়।

“ বাবা-মার সাথে কথা বল? তাছাড়া দাদা তো বিয়ে করবেনা ঠিক করেছে”।

“একবার তোমার দিদির সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে দেখি না কি হয়?” সায়ন আরো সিরিয়াস।

সায়নের প্রস্তাবটা আমার মনে ধরল। তোকে যতই খারাপ বাসিনা কেন? তুই আইবুড়ো হয়ে থাকবি এটা আমি চাইনি। তবে আমি আমার স্বভাব মত কিছু বিষয় সেই সঙ্গে চিন্তা করে নিয়ে ছিলাম। দেবায়নদার রোজ়গার কম তাই বড়জা হয়েও আমার করুনার পাত্রী হয়েই থাকতে হবে তোকে। আবার, তোর উপর সংসারের ভার দিয়ে দায়মুক্ত হতে পারব। তোর জায়গায় অন্য কেউ এলে সেটা হবেনা।

দেবায়নদা তোকে দেখে বলল, “আপনি নিশ্চয় আপনার বোনের মুখে আমার সমন্ধে সব শুনেছেন। এখন আপনি ভেবে দেখুন,আমি আপনার যোগ্য কি না?” তুই চুপ করেছিলি। আমি নিশ্চিত জানি, তুই ভিতরে ভিতরে কাঁদছিলি। এই প্রথম কেউ একজন তোকে  মানুষের মর্যাদা  দিল।

পর্ব-(২)

তুই আমাদের সংসারে এলি। সংসারের হাল ধরলি। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। দেবায়নদার আচরনে বিরাট পরিবর্তন এল। যে মানুষটা বইএ মুখ গুঁজে থাকত, সে এখন তোকে চোখে হারায়। তুই রান্নাঘরে থাকলে সে কাজের বৌ সুমিতাকে দিয়ে তোকে ডেকে পাঠায়। তুই সাথে সাথে  না গেলে নিজেই সেখানে এসে হাজির হয় চা এর বাহানায়। সায়ন সেই সকালে অফিস বেরিয়ে যায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে উতরে যায়। এসে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কথাবার্তা যা হয় সবই কেজো। আর তোরা দুটিতে সারাদিন বকম বকম করিস। আমি ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যেতে লাগলাম।

একদিন রান্নাঘরে, সুমিতা তোর হাতে একটা চিরকুট দিয়ে ফিক করে হেসে বলল, “ধর! বড়দাবাবু দিলেন”। তুই নেবার আগেই আমি একরকম ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে নিলাম। চিরকুটে লেখা ছিল, “আমার কৃষ্ণকলিগো! তোমার শ্রীবদনটি না দেখে আর যে পারিনা! এক পেয়ালা চায়ের অছিলায় বারেক দেখা দিয়ে এই অধমকে ধন্য কর!” দিদি,জামাইবাবুর প্রেমালাপ নিয়ে মজা করাই যেত! এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আমি পারলামনা। হিসহিসিয়ে উঠলাম, “আদিখ্যেতা! লোকজন মানামানি নাই? বউ যেন কারো নাই? তোর আর রান্নাঘরে থেকে কাজ নেই। বরের সামনে বসে থাকগে যা! এদিকটা আমিই সামলে নেব। দরকার হলে আর একজন লোক রাখব”। তুই লজ্জায় মুখ নত করে বেরিয়ে গেলি।

দিনকয়েক পরে সায়নের মুখে শুনলাম, দেবায়নদা তোকে কলেজে ভর্তি করে দিচ্ছে। শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। যথাসাধ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “ আর সংসারের কাজ়?” সায়ন আমার মনের ঝঁঝ ধরতে পারলনা। সে বলল, “বউদি বলেছে, সে দু দিক সামলে নেবে। রূপে লক্ষী না হোক বউদি তো গুণে স্বরস্বতী”। সায়নের এই বউদি প্রীতি আমার রাগ আরো বাড়িয়ে দিল। তোকে দেখলেই আমার গায়ে জ্বালা ধরে। কি করে তোকে অপদস্ত করব ছুতো খুঁজে বেড়াই। শেষে মাকে ফোন করে তোর নামে উল্টোপাল্টা বললাম। মা ফোনে তোকে কি বলেছিল জানিনা। তুই জানিয়ে দিলি, তুই কলেজে ভর্তি হতে চাস না।কেন চাইছিস না, সেটা কারো কাছে ভাঙলি না। আমি ছাড়া সবাই বুঝল,সংসারের অসুবিধার জন্য তোর এই সিধান্ত বদল। একদিন শাশুড়িমা তোকে ডেকে বললেন, “দেবুটা চাকরি বাকরি করলনা। তুমি পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারতে? অসুবিধে কোথায়?” আমি আড়াল থেকে শুনে ভয় পাচ্ছি- সত্যিটা বলে দিবিনাতো? তুই বললি, “এই বয়সে পড়াশোনা করে চাকরি তো আর পাবনা? তাই আর--”। শাশুড়িমা এই নিয়ে  আর কথা বাড়ালেন না। তিনি তোর হাতে তার নিজের কয়েকটা শাড়ি, দু একটা গয়না দিয়ে বললেন, “ধর! এগুলো তুলে রেখোনা,পরবে”।

তুই ভুলেও সাজগোজ করতিসনা। আমি বরাবর সাজতে ভালবাসি। এখন আগের মত পরিপাটি করে সাজা হয়না। তুই যখন শাড়ি গয়নায় সাজতে শুরু করলি সেটা আমার চোখে বিঁধতে লাগল। আমি বেশ কয়েকখানা দামি দামি শাড়ি কিনে, প্রতিদিন ভাঁজ ভেঙে ভেঙে পরতে লাগলাম। একদিন তোকে বললাম, “সেকেলেশাড়ি-গয়না পরতে ভাল লাগে তোর? সাজার শখ হয়েছে যদি তাহলে নতুন কিছু কেন?” দেবায়নদার আর্থিক অবস্থা আমার অজানা নয়। তোকে আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত করার চেষ্টা করলাম। তুই সে ধার দিয়েও গেলি না। বললি, “কেন? এগুলো তো বেশ ভালো? পরেও আরাম?”

একদিনের কথা, দেখি দেবায়নদা মগ্ন দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। আমি পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেলেও তার ধ্যান ভঙ্গ হলনা। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম খানিকটা তফাতে তুই দাঁড়িয়ে। তোর পরনে আকাশি রঙের জরিপাড় শাড়ি, খোলা চুল। আমি আবার হারলাম। সায়ন কি কোনোদিন এভাবে আমাকে দেখেছে? মনে পড়েনা তো? আমি শাড়ি-গয়না খুলে ফেলে বিছানায় উপুড় হলাম।

  এরপর আমার জীবনের এক করুণ অধ্যায় শুরু হল। কোন কিছুতেই কোন উৎসাহ পাইনা। সব উৎসাহ কেবল চুপচাপ শুয়ে থাকায়। কিন্তু ঘুম আসে কই? এরকম অবস্থায় জানতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি। এত বড় ঘটনাও আমাকে উৎসাহিত করতে পারলনা। বাড়ির সকলে ভাবল এটা গর্ভকালীন সমস্যা। আমিও তাই ভাবলাম। কিন্তু তোর প্রতি আমার বিরাগ উত্তোরোত্তর বেড়ে যেতে লাগল। তোকে দেখলেই খেপে যাই। চিৎকার চেঁচামেচি করি। আমাকে একজন সাইক্রিয়াটিস্টকে দেখানো হল। তিনি বললেন,কোনো রকম উত্তেজনা মা বাচ্চার ক্ষতির কারণ হতে পারে। তুই আমার সামনে আসিস না। লুকিয়ে লুকিয়ে থাকিস। মা আমাকে দেখতে এসে সমস্যার সমাধান করল। তোকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল।

আমি দুর্বল শরীরে মিশুকের জন্ম দিলাম। বাচ্চার যত্ন করার ক্ষমতা আমার নাই। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকি। বাচ্চার জন্য আয়া রাখার কথা উঠলে, শাশুড়িমা সেটা নাকচ করে তোকে আনিয়ে নিলেন। আমি তখন সমস্ত উত্তাপ নিরুত্তাপের বাইরে। বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, মিশুক তোর কোলে বড় হচ্ছে। হামা দিচ্ছে, হাঁটছে,কলকল করছে, তোকে “সোনামা” ডাকছে। জীবনের বড় হারটা এবার আমার হল। আমি জন্ম দিয়েও নামেই মা হয়ে থাকলাম। আর তুই পেটে না ধরেও ওর প্রিয় “সোনামা” হয়ে উঠলি।

 সায়ন প্রমোশন পেয়ে দিল্লিতে বদলি হল। আমার শরীরের কথা ভেবে দোনামনা করেও শেষ পর্যন্ত আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই সাবস্ত করল সে। ভাবল পরিবেশ পাল্টালে হয়তো আমার সুস্থ হয়ে ওঠাটা সহজ হবে। মিশুককে নিয়ে চিন্তা ছিল। সে তার সোনামাকে ছেড়ে থাকতে পারবে তো?

নতুন পরিবেশ আর চিরশত্রু তোকে ছেড়ে এসে আমি এখন অনেকটাই সুস্থ। এখানে সায়নের কাজের চাপ কম। সে বাড়িতে অনেকটা সময় দিতে পারছে।আমি আর কলকাতা ফিরতে চাই না। আমি আগের মধু হতেও চাই না। আমার দীনতা নীচতা নিয়ে তোর থেকে অনেক দূরে থাকতে চাই। সায়নের মুখে শুনলাম, তুই আবার পড়াশোনা শুরু করেছিস। তোর এতদিনের স্বপ্নটা এবার পূর্ণ হবে। ক্ষমা চেয়ে তোকে ছোটো করব না। ভাল থাকিস।

                 মধু”।

“কার চিঠি?”

“মধুর!”

“কি লিখেছে? সব ঠিক আছে তো?”

“হ্যাঁ।

“চিঠি কেন? ফোনে কথা বললেই তো হয়?”

দেবায়নের এই প্রশ্নের উত্তর দেয়না তৃণা। খোলা চিঠিটা যত্নসহকারে খাম বন্দী করতে থাকে সে।

বুকের খামে বন্দী চিঠিটার যে পাতাকটি খুলে দিয়েছে মধু, সেটা খামবন্দী করতে এখন কিছুটা নিভৃত অবকাশ লাগবে তৃণার।

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২০ জানুয়ারি ২০২২  

                             

লেখক : ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment