সরযূ নদীর তীরে

  • 06 December, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 610 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
রাত করে বাড়ি ফিরলেও আজ মরদরা টিটকিরি দেবে না, ভয় নেই। জোয়ান ছেলেরাও সব জানে আজ আমরা এখানে এসেছি। দেখছিস না পাড়ার সবকজন জিন্দা মেয়েমানুষ আজ বলতে গেলে এখানেই রয়েছে। সরযূ মেয়েকে আশ্বস্ত করে। এই বাজারে এছাড়া আর উপায়ই বা কি ছিল বল। যা দাম বেড়েছে সবকিছুর ...

সরযূ নদীর তীরে দেব-দীপাবলির মহোৎসব। লক্ষ প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে অযোধ্যা নগরী। একসুরে বেজে উঠেছে কাড়া-নাকাড়া-তূরী-ভেরী-দামামা-কাঁসি-বাশি প্রভৃতি সকল বাদ্যযন্ত্র। রাক্ষসরাজ রাবণের বিরুদ্ধে বর্ষব্যাপী সংগ্রামের অন্তে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাঁর অর্ধাঙ্গিনী সীতাকে নিয়ে আজ স্বরাজ্যে, স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করতে চলেছেন। নগরের পথে পথে আজ আনন্দ কলরোল কেবল। এ এক অদ্ভুৎ সময়।

সরযূ বিরক্ত ভঙ্গিতে বাসনকটাকে ।মেজে নিচ্ছিল। হাতের কাজ আর শেষই হয় না তার। ওদিকে মেয়ের কথা ভাবতে গিয়েও তার সারা শরীরটা রাগে রি রি করে উঠল। বেড়ালটারও আর বাচ্চা দেবার সময় জুটল না। ধিঙ্গি মেয়েটাও হয়েছে তেমন। এদিকে এত বড়টা হয়েছে, কোথায় বাড়ির দুচারটে কাজ দেখবে, হাতে হাতে জিনিস এগিয়ে দেবে, রান্না শিখবে তা নয়, তিনি নাকি বড় স্কুলে পড়বেন। অঙ্ক শিখবেন, এমনকি পাড়ার বিচ্ছিরি বদ ছেলেগুলোর মুখের সামনে দিয়ে গটগটিয়ে হেঁটে যাবেন। এখন যেমন গিয়েছেন বাড়ির পিছনে গোয়ালঘরে ঝুড়ির তলায় চাপা দিয়ে রেখে আসা বেড়ালবাচ্চাগুলোর পরিচর্যা করতে। মানুষের পেটে ভাত জুটছে না, তায় এখন বেড়ালকে নিয়ে চিন্তা। সরযূ কর্কশ গলায় চিৎকার করে ওঠে, “আরে ও লড়কি! কঁহা গেলি রে!” এদিকে বাড়ির মরদটার খাওয়া হয়ে গেছে, ব্যাটাছেলেটারও খাওয়া প্রায় শেষ। কোথায় একটু এসে হাত ধোয়ার জলটাকে এগিয়ে দেবে, অথবা থালাকটাকে তুলে নিয়ে এসে মার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে ঝটপট মেজে ফেলবে, কোথায় কি! সরযূর মুখে বিচ্ছিরি একটা গালাগালি চলে আসে। ওদের সমাজে যেমনটা দস্তুর আর কি।

“আরে ও ছোকরি, আজ দুপুরে ভালো করে ঘুমিয়ে নিতে হবে বুঝলি। অনেক রাত অবধি জেগে থাকতে হবে তো! দেব-দীপাবলির উৎসব আছে না আজ!” সরযূর মেয়ে অবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকায়। তাদের দেশে বাস করে তো এমন কথা সে আজ অবধিও কোনওকালে শোনেনি। মা নিজে তার মেয়েকে বলছে অনেক রাত অবধি বাইরে থাকতে হবে ? এও কি সম্ভব ? যদিও দীপাবলির মেলাতে যেতে দারুণ ভালো লাগে তার। কিন্তু গতবছর তো মেলাও সেরকমটা হয়নি। এবারেও আর কতটুকুই বা হবে কে জানে। কিন্তু গত বেশ কিছু বছর ধরে প্রতিবার এই দেব-দীপাবলির সময়ে এই শহর আর এই মোচ্ছবকে ঘিরে দারুণ সমস্ত ব্যাপারস্যাপার ঘটে যাচ্ছে। দেশবিদেশ, হিল্লিদিল্লি থেকে কত লোকজন আসছে, কত মিডিয়া, কত ক্যামেরা, কত হূলস্থূল কাণ্ড! সরযূর মেয়ে অবাক হয়ে শুধু দেখে যেতে থাকে। দিল্লি থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁরা নাকি জনগণের নেতা – অথচ তেমনিই তাঁদের নিরাপত্তার বহর। দিনের পর দিন তো শহরের কত এলাকাই নো-এন্ট্রি করে দেওয়া হয়। আধার কার্ড সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হয় সরযূদের। ফস করে যদি কেউ দেখতে চেয়ে বসে হঠাৎ ?

দুপুরে বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিল না মেয়ের। সরযূ পাশে শুয়ে শুয়ে গজগজ করছিল। “তা নিদ আসবে কেন ? এই তো সবে গরমি কমেছে, এখন দুপুরগুলোয় পাড়ায়-বেপাড়ায় ছুটোছুটি করে অমরুদ-চুরি না করলে, মরদ-জোয়ানদের সামনে বেশরমি ঘুরে না বেড়ালে চলবে কেমন করে,” মেয়ে তবুও কিছু বুঝে উঠতে পারে না। মনে মনে ভাবে দিল্লি থেকে পেরাইম মিনিস্টার আসবে বলে বুঝি ওদের সবাইকে যেতে বলেছে ? সে তো আগেরবারও উনি এসেছিলেন। তার আগেরবারও এসেছিলেন। কই কোনওবার তো মা এমন করে রাত জাগতে হবে বলে নিয়ে যায়নি। বাপ তো যাবে না নিশ্চয়ই। সন্ধ্যে হলেই তাস নিয়ে বসবে চৌপাট্টি পেতে। ব্যস ওতেই সব কাবার। সরযূর মেয়ে এপাশ ওপাশ করছিল। জানালার ওপাশে রোদ ঝলমল করছে। ওদের ঘরের থেকে কিছুদূরেই একটা সোনাঝুরি গাছ আছে। ও নাকি বঙ্গাল মুলুকের গাছ। সরযূর বাপ-দাদারা নাকি বঙ্গাল থেকে এসেছিল। ওই গাছটাকে সরযূর মেয়ের ভারী ভালো লাগে। এই কার্তিক মাসে হঠাৎ হঠাৎ করে একটা দমকা হাওয়া ওঠে, আর উঠোন জুড়ে ধুলোরা নাচানাচি শুরু করে দেয়। সোনাঝুরি গাছটা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হেসে ওঠে। সরযূ চিল্লিয়ে বলে ওঠে, “কপাট বন্ধ কর হতচ্ছাড়ি! ধুলো ঢুকে গেল তো!” এই আমাদের অয্যোধ্যা। ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান।

হনুমানগড়ির যে মন্দির, সেই মন্দিরের জন্য জমি দান করেছিলেন স্বয়ং ঔরঙ্গজেব-পুত্র সুজাউদ্দৌল্লা। এই ঘটনা ১৭৬৫ সালের। ১৮৫৫তে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার এক পরিস্থিতি তৈরি হলে পরে অয্যোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ নিজে সেই সমস্যার মীমাংসা করেছিলেন। সরযূর মেয়ে এই গল্প শুনেছে। ওপাড়ার কিসমত-চাচার মেয়ের সঙ্গেও ওর খুব ভাব। ওরা দুজনে একসঙ্গে স্কুলে যায়। সরযূ যদিও সেটাকে পছন্দ করে না। কে জানে, হয়তো কিসমত চাচাও করে না। ’৯২এর পর থেকে অযোধ্যার হাওয়া-বাতাস সবই কেমনটা জানি গুমোট হয়ে পড়েছে। এই গুমোট যে কতদিনে কাটবে সে খবর ঈশ্বরই জানেন। মনে মনে একবার সিয়ারামের নাম উচ্চারণ করে সরযূ। সিয়ারামের কিরপাতেই তো মেয়ে হল তার। একটা মেয়ের যে সাধ ছিল ভীষণ। সে কথা মেয়ের বাপকে বললে হয়তো সরযূকে দু-আধখানা করে কেটেই রেখে দিত। কপাল ভালো যে প্রথম সন্তানেই ছেলের মুখ দেখিয়ে দিয়েছিল মরদকে। সরযূর খাতির বেড়ে গেছল তখন।

বেলা পড়ে আসছে। “চা চা,” করে মরদটা চিল্লাছে বাইরে থেকে। সরযূ কোনওমতে উঠে বসতে না বসতেই পাল্টা খেঁকিয়ে উঠল একবার, “যাচ্ছি তো, এত তাড়া কিসের ?” সরযূর বয়স হচ্ছে। ধৈর্য্য কমে আসছে। মরদটারও গায়ের জোর কমেছে। ছেলে এখন বাপের দোকানে গিয়ে বসে। সরযূ ঘটাং ঘটাং শব্দ করে চা বসিয়ে দিল। উজ্জ্বলার গ্যাস আসার পর থেকে চায়ের খাঁই বেড়ে গিয়েছে লোকটার। এদিকে শুধু উজ্জ্বলার সিলিন্ডার দিয়েই বা কি হবে ? গ্যাসের দাম যা বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মহাজনের সুদ। দেনার দায়ে গোটা সমাজটাই যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। সরযূ এসব বোঝে না। উলটো পার্টির লোকেরা এসে ভোটের আগে ওদেরকে এসব বুঝায়। কে শুনবে ওদের কথা। সব তো একই রকম। ভোটের বেলায় ভাউজি, মাজি, বেহেনজি আর কাজ ফুরলে পরেই হাঁ জি, কেয়া জি! টুজি, থিরি জি, ফাইভ জি! সব চেনা হয়ে গেছে সরযূর। সব। ওই এখনকার পেরাইম মিনিস্টারই ঠিক। যা করার নিজেকেই করে নিতে হবে। তাই তো আজ গোটা মহল্লা রাত জাগবে বলে তৈরি হচ্ছে। সরযূর মেয়ে অবাক হয়ে তাকায়।

শোঁ শোঁ করে আকাশে অনেক কটা ফানুস উড়ে গেল। লাউডস্পিকারে গমগমে গলায় বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীত। ভারতবর্ষের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় এসে গেছেন। সরযূ নদীর তীরে আজ লক্ষ-কোটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেব-দীপাবলি উদযাপন করা হবে। বাতাসেও যেন কিসের এক সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। চারপাশে যেদিকেই কারো নজর পড়ছে, ফুলের নকশাতে, প্রদীপের আলোতে অথবা আলপনার রঙবাহারিতে তার চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। চতুর্দিকে আজ আলোর উপস্থিতি কেবল। এক এক করে সেই অজস্র অজস্র প্রদীপেরা একে একে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। সরযূর জল আজ সেই আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। তিরতিরে হাওয়ায় শিখাগুলি কাঁপছে, জলের উপরে তাদের প্রতিবিম্বগুলিরও অন্যথা হচ্ছে না। পাড়ের প্রান্তে পুলিশি ব্যারিকেডের ওধারে সরযূ আর তার মেয়ে হাজার মানুষের ভিড়ের মধ্যেখানে চেপেচুপে, চুপিসাড়ে কোনওরকমে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সরযূর মেয়ের একবার মনে হল, মাকে জিজ্ঞেস করে যে কখন তারা বাড়ি ফিরবে। তার মায়ের শরীরটাও কদিন ধরে খুব ভাল যাচ্ছে না। সামনের সপ্তাহ থেকে আবার স্কুলে পরীক্ষা নেবে বলে জানিয়েছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। নদীর জোলো হাওয়াতে সেই ঠাণ্ডা ভাবটা আরও বেড়ে উঠেছে। সরযূর মেয়ে তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।

... রাত করে বাড়ি ফিরলেও আজ মরদরা টিটকিরি দেবে না, ভয় নেই। জোয়ান ছেলেরাও সব জানে আজ আমরা এখানে এসেছি। দেখছিস না পাড়ার সবকজন জিন্দা মেয়েমানুষ আজ বলতে গেলে এখানেই রয়েছে। সরযূ মেয়েকে আশ্বস্ত করে। এই বাজারে এছাড়া আর উপায়ই বা কি ছিল বল। যা দাম বেড়েছে সবকিছুর ...

কনকনে ঠাণ্ডা জল। রাত বোধহয় দশটার কাছাকাছি। দিল্লির লোকজনেরা সব চলে গেছেন। পুলিশ, সিআরপিএফ, বড় বড় মিডিয়াভ্যানেরা সবাই আস্তে আস্তে পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে। ব্যারিকেডেরও আর প্রয়োজন নেই। সরযূ আর তার মেয়ে এখন নদীর বুকে এক কোমর সমান জলে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তারা একা নয়। সরযূ নদীর পাড় বেয়ে যতদূর অবধি দেখা যেতে পারে, সমস্ত জায়গাতেই পাড় থেকে প্রায় নদীর মাঝবরাবর অবধি এখন মানুষের ভিড়। মেয়েদের ভিড়। দেব-দীপাবলির প্রদীপগুলোকে হাতড়ে নেবার ভিড়। হাওয়াতে বা জলের ছিটেতে অনেক প্রদীপই পুরোপুরি জ্বলেনি, পুরোটা পোড়বার আগেই নিভে গিয়েছে। সরযূদের লক্ষ্য এখন সেই না শেষ হওয়া প্রদীপের খোলগুলি। সেই মাটির খোলসে রয়েছে তেল, মূল্যবান তেল - যা কি না এখনও, যেটুকুও বা সংগ্রহ করা যায় – সেইটুকুই অনেক। কনকনে ঠাণ্ডা নদীতে কোমর অবধি নিজেকে ডুবিয়ে সরযূ আর সরযূর মেয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে প্রদীপ খুঁজছিল। এইভাবে ভেজা গায়ে গ্রামে ফিরতে দেখলে মরদরা ওদেরকে আওয়াজ দেবে না ? সরযূর মেয়ের সে কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না। একটু আগেই সে দেখেছে, ঘাটের উপরে সেই কানওয়ার ছোকরাটা লোলুপ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়েছিল। সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অস্বস্তিকর ভাবটা কমেনি।

হাতড়াতে হাতড়াতে আরেকটা মানুষের হাতের সঙ্গে সরযূর মেয়ের হাত ঠেকে গেল। কিসমত-চাচার মেয়ে না ? তেলের দাম এখন ওদের সবাইকে কেমন মিলিয়ে দিয়েছে। বাড়ুক, আরও তেলের দাম বাড়ুক। ওদের নাক দিয়ে জল ঝরছে। শীত বাড়ছে।

রঙচঙে সাজগোজ করা, মেক আপ একটু ধেবড়ে যাওয়া একটা শহুরে মেয়েকে হঠাৎই সরযূ দেখল ওদের মাঝখানে নেমে আসতে। পিছনে পিছনে ক্যামেরা কাঁধে আরেকজন। মেয়েটা, সরযূর মেয়ের দিকেই হাতে ধরা বুমটা বাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, “কেয়া নাম হ্যায় বেহেনজি ?” সরযূর মেয়ে একবার মায়ের দিকে তাকাল, একবার নতুন মেয়েটার দিকে তাকাল। তারপর জবাব দিল, “সীতা, ম্যায় তো সীতা হুঁ। সীতা পরসাদ।” সাংবাদিক মেয়েটা তার স্টোরির হেডলাইন ঠিক করে ফেলেছে। ... সরযূর বুকের উপরে তখন কার্তিকের কুয়াশা নেমে আসছিল। রাত আরও বাড়তে থাকছিল। সরযূর বুকে তখন অন্ধকার নেমে আসছিল।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার

অলঙ্করণ : সৃজীতা গুপ্ত

0 Comments

Post Comment