- 12 June, 2022
- 0 Comment(s)
- 563 view(s)
- লিখেছেন : খালিদা খানুম
কিছু লোক তার দিকে তাকিয়ে বলল, কী নুরানি চেহেরা। কখুন মরেছে, কিন্তু মরার কুনো কষ্ট চোখেমুখে লেগে নাই। মুনে হচ্ছে যেনো ঘুমাচ্ছে, ডাক দিলেই উঠে পড়বে। যেমুন চোখ নাক রঙ তেমুন আছে। আহারে মেয়েটা কী কষ্ট পেয়েই না মরেছে। কী সুন্দর জীবনটা শুরু করল্যো, বিহা হবার বছরও ঘুরেনি মুনে হয়, এরি মধ্যে এই ঘটনা। চেহেরা ভালো হয়েছিল মাসখানেক। মোটাও হয়েছিল। রঙ ফুটেছিল, হাতে পায়ে গ্লেজ। লোকে বুলছে প্যাট হয়েছিল,হতেও পারে প্যাট। চোখমুখ ফোলা ফোলা লাগছিল ক'দিন। এরি মধ্যে শেষ করে দিলো। এরা কী মানুষ না জানোয়ার। খারাপ ভালো যায় হোক, বুঝিয়ে শুনিয়ে একটা ফাইসালা করা যেত, তা বলে মেরে ফেললি একেবারে! নিজে থেকেই যদি গলায় দড়ি দেবে তাহলে, জিভ বাহির হয়ে থাকতোক না? ঝুলে ছিল তখন আমি নিজে দেখেছি, আকগোছে দড়ি গলায় লাগানো, জিভ বাহির হয়নি, ঘাড় ভাঙেনি। ওয়া মেরে ফেলছে। বিহার ছয়মাসের থেকেই খুব ঝামেলা করছিল মাজারুল। বিহার কী টাকাপয়সা বাকি ছিলো, দেনাপাওনার সব টাকা নাকি শোধ দেয়নি সাহানাজের বাপ। সেদিন তেড়ে তেড়ে মারতে গিয়েছিল। আর ছুঁড়ি দৌড়ে ঘরে ঢুকে দোর লাগিয়ে দিল। না হলে সেদিনই একটা কেলেঙ্কারি হতো। তাও কী হলো না, সেই কেলেঙ্কারিই হলো। মাজারুলের মা বুলছে, বাড়িতে কেহু ছিলো না, সব ওদের কুন কুটুমের বাড়ি বিহা খেতে গেলছিল। ছুঁড়ি নাকি রাগ করে জিদে যায়নি। বুললে হবে, অরা প্ল্যান করেই রেখেছিল, রাতারাতি এসে মেরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে, ছুঁড়ি ওমন না যে গলায় দড়ি দিবে। নামাজ রোজা করতো। পুলিশে বুলবে কি বুলবে না কে জানে! পুলিশ আল্যেই বুঝবে ইয়া মার্ডার, কিন্তু কি হবে কিছু হবে না, লিয়ে যাবে কাটাঘরে, মাজারুলরা আগে হুনেই টাকাপয়সা দিয়ে সেটিং কর্যে রাখবে। কপাল খারাপ ছুড়িডার। আল্লা তো সবই দেখেছে, বিচার করবে।
কিছু লোক তার দিকে তাকিয়ে বলল, মরে গিয়ে কী শান্তি পেলি। মায়ের কোল খালি হলো কেবল। তার চেয়ে স্বামী যা বুলছিল সেটা করলেই ভালো হতো। কার সংসারে না অশান্তি হয়! সব সংসারেই টুকটাক ঝামেলা হয় দেনাপাওনা নিয়ে। বিয়ের সুমা মাজারুলরা পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছিল আর সোনাদানা। সোনাদানা দিয়েছিল বিয়ের সুমাতেই, কিন্তু টাকা দিতে পারেনি। পরে কিছু দিয়েছিল বোধহয়। তবে পুরো দেয়নি সাহানাজের বাপ। বিয়ের সুমাতেই কথা হয়েছিল নাকি একবছরের মধ্যে নগদ দেনাপাওনার টাকা না দিতে পারলে রাস্তার ধারের একখান জমি আছে, সেডা লিখে দিবে জামাইয়ের নামে। খারাপ কী বুলেছিল, জামাইয়ের নামে থাকা আর মেয়ের নামে থাকা তো এক কথা হলো। কিন্তু সাহানাজের এক জিদ, রাস্তার ধারের একমাত্র জমি আব্বা ভাই-এর ব্যবসার জন্য রাখিছে। তুমি নিয়ে নিলে ভাই-এর কী হবে! আর অন্য জামাইরাও দাবি করবে তখন। এই নিয়ে প্রায় সময়ে ঝামেলা লেগেই আছে। দিন রাত সগল সুমায়। ঘরের পাশে থাকি শুনবো না বললেও কানে আসে। সাহানাজের যে দোষ নাই তা বুললে হবে না। মেয়ের খুব জিদ আর রাগ। এক জিদে মনিরুলের ওষুধের দোকানে গাইনি বসে ওখানে কাজ নিলো। ডাক্তারের সাথে থাকতে হবে। তা, মেয়েছেলে তুই বাইরে এমন ঢ্যাং ঢ্যাং করে কাজ করতে যাবি, সংসারে আগুন লাগবে না! মাজারুলের ব্যাবসাপাতি তেমন ভালো চলছিল না, ওই জমিখান পেলে দোকান দিতো। তা না সাহানাজ বলে, টাকার অভাব থাকলে আমি ইনকাম করবো, কিন্তু বাপের জমি নিতে দিবো না। ব্যাটাছেলার বুকে লাগবে না এমুন কথা বলুল্যা। এখন কী হলো। জীবন শ্যাষ হলো। এখুন কাটাঘরে নিবে পুলিশে, পরপুরুষে ন্যাংটা করে বুক চিরবে। সব গেলো। আর পরকালে কী হবে কে জানে। নিজে থেকে গলায় দড়ি দিলে তো কুথাও জাগা পাবে না। আল্লা তো সবই দেখেছে, বিচার করবে!
২.
ত্রয়োদশীর জোৎস্না। পাকা গমের মতো হলুদ আলো লেপে আছে আকাশ বাতাস জমিনে। ভুঁই পাশ দিয়ে সরু আল। আল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সাহানাজ। একা নয়। কোলে আরেকজন। আলের উপর শুয়ে ছিল গহমা খরিশ। ফোঁস করে ফনা তুলেছিল। সাহানাজকে দেখে সড়সড় করে সরে গেল ফনা নামিয়ে। এ আল থেকে সে আল। আল ধরে হেঁটে চলেছে সাহানাজ।
কোলের জন দুলে উঠলো — মা আমরা কোথায় যাচ্ছি?
সাহানাজও হাওয়ার মতো দুলে উঠলো, বলল— জানি না। হয়তো নতুন কোন দূরের দেশ।
— সেই দেশে কী আছে মা?
— আমিও জানি না সোনা, তবে শুনেছি সে দেশে খুব সুখ। খুব আরাম। একেবারে রূপকথার দেশ।
— সে দেশ কেমন দেখতে মা?
— সে দেশে হীরা মানিক গাছে ফোটে। ঘাসে মুক্তো গড়াগড়ি খায়। সে দেশে কান্না নেই, কষ্ট নেই।
হঠাৎ থমকে উঠলো কোলেরজন। বলে— কান্না কী মা?
— কান্না অনেক না বলা কথার ঝর্ণা। যেগুলো আমরা বলতে পারি না, তা চোখ দিয়ে পানি হয়ে কান্না হয়ে ঝরে পড়ে।
— তাই বুঝি তুমি কাঁদতে ঘর বন্ধ করে। কাউকেই বলতে পারতে না তোমার কথা। কী এতো কথা ছিল মা তোমার?
ক্ষেতের পরে বাঁশবন। বাঁশবনে শেয়ালের পাল। শেয়ালের পাল বুনো জন্তুর অপেক্ষায়। অপেক্ষায় বাধা পড়ে। সাহানাজকে দেখে পিছু সরে তারা মুখ নীচু করে। জোৎস্নার সাথে মাখামাখি হয়ে সাহানাজ এগিয়ে চলে। কোলের সাথে লেগে থাকা মাংসপিন্ড, নরম, অবয়বহীন।
সাহানাজ শোনে তার কথা। সে বলে, মা তোমার বুকের উপর মাথা রেখে কাঁদছিল, আর বলছিল, আমার কী হবে নাজু। কোলপুঁছা মেয়ে তুই, নাড়িকাটা মানিক, আমাকে একলা রেখে চলে গেলি ক্যানে, সে কে মা।
— সে আমার মা।
— মা-দের কী কেবল কান্না জমা থাকে বুকে? তোমাকে যে মহিলা মারত সে কী মা নয়? সে কে মা?
— ও তোমার দাদিমা হয়।
— সে তোমাকে খেতে দিতো না কেন? তুমি না খেলে আমার যে কষ্ট হতো খুব। কেন বুঝতো না তুমি না খেলে আমার কষ্ট হয়! যে তোমাকে বারবার বলতো, বাপের বাড়ির থেকে ভাত নিয়ে আয়, বাপ তো তোর নায্য টাকা এখনো শোধ করল্য না। সে কী মা নয়? আর সেই লোকটা কে মা? যে তোমাকে ভয় দেখাতো, বলত, তালাক দিবো তোকে রান্ডি। দেমাগি মাগি। চাকরি করতে যাস না ঢলাঢলি করতে যাস? মনিরুল তোকে এমনি এমনি দুই হাজার টাকা দেয়? বানচোতের সাথে কিসের ঢলাঢলি তোর জানি না আমি। দ্যাশের সব মেয়ে থাকতে তোকে চাকরি দিলো! প্যাটেরটা কার সত্যি করে বল? তোর বাপ ফাঁকি দিয়ে মাল গছিয়ে দিলো, আর তুই মাগী অন্যের মাল আমার নামে চালাবি! সে কেন তোমার পেটে লাথি মারছিল। আমার কষ্ট হচ্ছিল, খুব কষ্ট। কেন তোমার মুখের উপর বালিশ চাপা দিচ্ছিল, আমার কষ্ট হচ্ছিল। আঁকুপাঁকু করছিল।
সাহানাজ জোৎস্নার সাথে মিশে যেতে থাকে। সাহানাজ হাওয়ার মতো ঘনত্বহীন হতে থাকে, আলোর ঢেউয়ের মতো এগিয়ে চলে। চলতে চলতে নদীর পাড়ে পৌঁছে যায়। কিচকিচে সাদা বালি। সাদা বালিতে জোৎস্নার আলো পড়ে রূপার মতো উজ্জ্বল।
কোলের অবয়বহীন মাংসপিন্ডটি সাহানাজের মতো জোৎস্না হতে থাকে। সে খুশি হয়, বলে এই কী নতুন দেশ মা? চকচক করছে এগুলো কি হীরা?
তার খুশিতে সাহানাজের আলো খুশি হয়ে নদীর ধার দিয়ে পাখির মতো দৌড়ায়। কোলের আলোটি হাততালি দেয়। দুজনে হাওয়া হাওয়াও উড়ে। উড়তে উড়তে আশমানের চাঁদের দিকে যায়।
কিছু জমাট বাঁধা রক্ত টুপটাপ করে ঝরে পড়ে, কান্নার মতো।
লেখক : পশুচিকিৎসক, ছোটগল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment