- 21 November, 2022
- 0 Comment(s)
- 206 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
ডাকিনী
গল্পটা শুনেছিলাম আমাদের বাড়ির অনেকদিনের পুরনো বিশ্বস্ত কাজের লোক রামদুলালের কাছে।
বছর তিনেক আগের ঘটনা। রামদুলালের বাড়ি রাইবল্লভপুর গ্রামে। সেখানকার আদি বাসিন্দা মল্লিকদের ছোট নাতনি ললিতা দিল্লিতে ছেলে-বউমার সঙ্গে ঝগড়া করে অনেক বছর পর
গ্রামে ফিরে পূর্বপুরুষদের পরিত্যক্ত এই ভাঙ্গাচোরা ভিটেতে এসে ওঠে। এক কালে মল্লিকদের অবস্থা খুবই ভাল ছিল। ললিতার দাদুর বাবা ছিলেন এই গ্রামের জমিদার। তবে সুযোগ্য বংশধরের অভাবে এদের অবস্থা ধীরেধীরে পড়তে থাকে। তারপর জমিদারি সামলাতে না পেরে গ্রামের জমিজমা সম্পত্তি সবই প্রায় বেচেবুচে দিয়ে বিক্রির টাকা সব ভাগাভাগি করে সকলেই আলাদা হয়ে গিয়ে শহরে কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। গ্রামে মল্লিকদের স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেবল তাদের বিশাল দোতলা পোড়ো বাড়িটি। বহুদিনের অযত্ন ও কালের কবলে পড়ার কারণে বাড়ির একদিকের কিছুটা অংশ ধসে পড়ে ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে। বাড়ির চারধারে নোনা ধরা পাঁচিলগুলিতে চিড় ধরিয়ে বড় বড় বটগাছ শিকড় বিছিয়ে দিয়েছে। ইঁটের পাঁজর বের করা দেওয়ালের মাঝে কপাটহীন, শিক ভাঙ্গা
জানালাগুলো অন্ধকার কোটরের মত হাঁ করে অতীতের সুখস্মৃতির দিকে চেয়ে থাকে। গ্রামের
মানুষের মনে অগাধ বিশ্বাস জমেছে যে ঐ বাড়িতে ভূত থাকে। গ্রামের মোড়ল অলকেশ মিত্তিরের
মুখে অনেকেই এই গল্প শুনেছে যে দোতলার পশ্চিম কোণের ভাঙা জানালায় রোজ রাতে
মল্লিকদের স্বর্গীয় পূর্বপুরুষ ও এই বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা অন্নদাচরণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা
যায়। সুতরাং এই সব গল্প শোনার পর দিন হোক কি রাত মল্লিকদের হানাবাড়ির চৌহদ্দিতে
ঘুণাক্ষরেও কেউ পা মাড়াতে চাইত না। সেই মল্লিকদের বংশের শেষ প্রদীপ ললিতা দেবীর বয়সও এখন প্রায় পঁয়ষট্টির কাছাকাছি। ললিতা পিতৃপুরুষের প্রাণাধিক প্রিয় ভিটের এই দুরাবস্থা
সহ্য করতে না পেরে কলকাতা থেকে ভাল মিস্ত্রিপত্র, মালমশলা আনিয়ে বাড়ি সংস্কারে
কাজে হাত দেন। গ্রামের অনেকেই বিশেষত অলকেশ মিত্তির এই কাজের ঘোরতর বিরোধিতা
করে বলেছিলেন, ‘ভূতের বাড়ি সংস্কার করে কী লাভ বলুন তো? তার চেয়ে বরং যেখান থেকে
এসেছিলেন সেখানেই ফিরে যান, তাতেই আপনার আর গ্রামের সকলের মঙ্গল। আর একান্তই যদি
গ্রামে থাকতে চান তবে আমার বাড়িতে আপনার জন্য কিছুদিন থাকার ব্যবস্থা করতে পারি।
কিন্তু ও বাড়ির কাজে হাত লাগাবেন না। তেনারা অসন্তুষ্ট হবেন।’ললিতা দেবীরও এক উত্তর, ‘আমার বাপ-পিতেমোর ভিটে, আমি ভাঙবো কি গড়বো, থাকব কি যাব সেটা আমার ব্যাপার। আপনারা তাতে নাকগলানোর কে?’
এই ঝাঁঝালো উত্তর শোনার পর অবশ্য গ্রামের কোন মাতব্বরই আর কিছু বলার সাহস পায়নি।
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খেটে মিস্ত্রিরা জোরকদমে হানা বাড়ি সারাইয়ের কাজে লেগে পড়ে। কাজের অবসরে ললিতা একাকীত্ব দূর করার জন্য গ্রামের চার পাঁচজন মেয়ে-বউদের নিয়ে নিচের তলার একটি ঘরে অবৈতনিক সেলাইয়ের স্কুল খোলেন। গ্রামের পুরুষেরা কাজে বেরিয়ে গেলে দুপুরবেলা তাড়াতাড়ি ঘরের কাজকর্ম সেরে নিয়ে তারা চলে আসত ললিতার কাছে। সেলাইয়ের কাজ শেখা ও শেখানোর পাশাপাশি ললিতা তাদের শোনাতেন দেশ-বিদেশের নানা রোমাঞ্চকর গল্প। মিস্ত্রিরা নিচের তলার কাজ শেষ করে দোতলার কাজে হাত দেওয়ার পর পরই পশ্চিম কোণের ছোট ঘরটিতে মেঝের ওপর সারি দিয়ে রাখা পাঁচটি টাকা ভর্তি কালো সুটকেস খুঁজে পায়। ললিতা পুলিশে খবর দেওয়া মাত্র গোটা গ্রামে খবরটি রটে যায়। ললিতার থাকা-খাওয়া সবই একতলায় তাই সুটকেস গুলো প্রথমে কারোরই চোখে পড়েনি। পুলিশ এসে তদন্ত করার নামে বাড়ির দোতলাটা সিল করে কাজ বন্ধ করে দিয়ে চলে যায়। এতে ললিতা দেবী প্রাথমিকভাবে মুষড়ে পড়লেও হাল ছাড়বার পাত্রী তিনি নন। একতলার ঘর গুলিকেই তিনি গ্রামের মেয়েদের সাহায্যে সাজিয়ে-গুছিয়ে সেখানেই ঘরকন্না পেতে বসলেন। গ্রামের সেই পাঁচজন মহিলা ছাড়া বাকি আর কারোর সঙ্গেই ললিতার তেমন সংযোগ ছিল না। একটা কাজের লোক ছিল বটে। সে বাজার সওদা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না,ঝাঁট দেওয়া, ঘর মোছা, কাপড় কাচা সব কাজই দিনেরবেলার মধ্যে করে দিয়ে চলে যেত। রাতে ভূতের ভয়ে থাকতে চাইত না মোটেও।
এভাবে প্রায় দেড়মাস কেটে গেল। হানাবাড়িতে বান্ডিল বান্ডিল টাকা উদ্ধারের ব্যাপারটা যখন প্রায় ছাইচাপা পড়ে গেছে তখন এক শনিবারের সকালে অলকেশ মিত্তিরের বাড়িতে ভিন গাঁয়ের এক তান্ত্রিক এসে উঠলেন। গোটা গ্রাম এসে মোড়লের বাড়িতে ভেঙ্গে পড়ল নামকরা সেই সিদ্ধপুরুষের দর্শন লাভের আশায়। তান্ত্রিক ভৈরব চাটুজ্জে সকলকে বললেন, ‘তোদের ঘরের মেয়ে-বউদের
মল্লিকদের হানা বাড়িতে পাঠাস কেন, জানিস না ওখানে অশুভ শক্তির বাস?’ মোড়ল বললেন, ‘কিন্তু বাবা, ওদের নাতনি যে ঐ পোড়োবাড়ি কে বসত ভিটে বানিয়েছে।’ ভৈরব চাটুজ্জে চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘ঘোর অমঙ্গল! ও বাড়িতে কোন মানুষ বাস করতে পারেনা। আমার দৈব শক্তি কখনও ভুল কথা বলে না। ঐ বাড়িতে যে থাকে সে এক মূর্তিমতী অপদেবী ছাড়া আর কেউ নয়। তোরা এত দিন ওকে এই গ্রামে ঠাঁই দিয়েছিস আর বুঝতে পারিসনি যে সে মানুষ নয়?’ পঞ্চায়েতের প্রবীণতম ব্যক্তি মুখুজ্জে কম্পিত কন্ঠে বললেন, ‘আমরা তুচ্ছ সাধারণ মানুষ, আমরা অত কিছু বুঝব কী করে
ঠাকুরমশাই? ললিতা দেবী যদি ডাইনি হয় তবে, আপনি আমাদের যেভাবে হোক বাঁচান ঠাকুরমশাই।’ তান্ত্রিক অভয় দান করে বললেন, ‘ওরে, তোদের ডাইনির হাত থেকে রক্ষা করতেই তো আমার এখানে আসা। স্বয়ং মা ভবানী আমাকে তেমনই নির্দেশ দিয়েছেন।’ এই বলে তান্ত্রিক দুই হাত জোড় করে মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। তার সঙ্গে গ্রামের বাকি সকলেও ওপরের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকাল। প্রণাম সেরে তান্ত্রিক বাবার সঙ্গে মোড়লের একবার চোখাচোখি হতেই মুহূর্তে দুজনে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন। ভৈরব চাটুজ্জে এবার সোজা হয়ে বসে গ্রাম্য জনতার
উদ্দেশ্যে বললেন, ‘যা বলছি তা মন দিয়ে শোন। এই মাসের শেষ অমাবস্যায় ডাইনি বুড়ির বাড়ির
ঠিক সামনে একটা যজ্ঞ করতে হবে। আমিই সমস্ত কিছু জোগাড়যন্ত্র যা করার করব। তোরা
শুধু একটা দিকে খেয়াল রাখবি, ঐ ডাইনি যেন কোন ভাবে এই যজ্ঞের কথা না জানতে পারে।’
এরপর থেকে গ্রামের কেউই আর ললিতার কাছে যাওয়ার সাহস পেত না। এমনকি কাজের লোকটিও
কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে ললিতাকে যথেষ্ট অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। মাসের ঠিক শেষ
অমাবস্যায় তান্ত্রিক আবার গ্রামে এলেন। তবে এবারে আর খালি হাতে নয় সঙ্গে করে নিজের
চারজন শিষ্য ও যজ্ঞের সমস্ত রকম উপাচার নিয়ে এলেন। শুভক্ষণ নির্ণয় করে সূর্যাস্তের
পর পরই ডাইনির বাড়ির সামনে উত্তর দিকে মুখ করে যজ্ঞে বসে পড়লেন। যজ্ঞবেদীর আগুনের
লাল রঙ যেন ক্ষণিকের জন্যে পশ্চিমের সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে অন্ধকারের
সঙ্গে মিশে গেল। তান্ত্রিক শুদ্ধাচারে বসে বেল পাতা, জবা ফু্ল, শ্মশানভষ্ম, নরকঙ্কাল আরও
অনেক উপকরণ সহযোগে বিড় বিড় করে মন্ত্রচ্চারণের মধ্যে দিয়ে আহুতি দিতে
থাকলেন। রাত যত বাড়তে থাকল তান্ত্রিকের একঘেয়ে মন্ত্রপাঠের ফলে আশেপাশের পরিবেশ
ততই রহস্যময় হয়ে উঠল। ভূত তাড়ানি এই মহাযজ্ঞে দর্শকের কোন অভাব হল না।
মল্লিকদের হানাবাড়িকে প্রচণ্ড কৌতূহলে সমস্ত গ্রাম আজ ছেঁকে ধরেছে। রাত্রি ন’টার পর হয়ত বাড়ির বাইরে এত শোরগোল শুনেই ললিতা দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। তাকে দেখে সকলে ভয়ে চিৎকার, চেঁচামেচি জুড়ে দিল। নারীকন্ঠের তীব্র আর্তনাদে সে পরিবেশ হয়ে উঠল আরও ভয়াবহ। মোড়ল সবার আগে নিজেকে সামলে নিয়ে শূন্যে হাত তুলে সকলকে শান্ত করে বললেন, ‘আমাদের ওঝা বাবার মন্ত্রের জোর দেখ সকলে। ডাইনি নিজে থেকেই ঘর ছেড়ে কেমন বেরিয়ে এসেছে।’ তান্ত্রিকও নিজেকে সামলে নিয়ে ডান হাতে একটা ঝাঁটা আর বাম হাতে একমুঠো লঙ্কা গুঁড়ো
নিয়ে এগিয়ে গেল ডাইনির দিকে। এক দফা ঝাড়ফুঁক না করতে পারলে গ্রামের লোকদের
বিশ্বাস করাবেন কী করে যে ডাইনি কে তাড়ানো গেছে? ললিতা প্রথমে এইসব কাণ্ড দেখে থতমত
খেয়ে গেলেও পরে সব কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। তার মুখ দেখে মনে হল হয়ত কিছুটা আন্দাজ তিনি করতে পারছেন। ছোটবেলার অনেকটা সময় যার এই গ্রামে কেটেছে তার পক্ষে তান্ত্রিকের ভোজবাজির এই কাণ্ডকারখানা বুঝে উঠতে বেশি সময় লাগারও কথা নয়। ওঝা যেই না ললিতার গায়ে ঝাঁটার বাড়ি মারতে গেলেন অমনি ললিতা নিজের শ্বাস আটকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মরার ভান করলেন। দমরুদ্ধ করা থমথমে পরিবেশ, কারো মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোল না। মোড়ল ভিড়ের মধ্যে থেকে গ্রামের এক হাতুড়ে ডাক্তার কে ডেকে এনে ডাইনিকে পরীক্ষা করালেন। ডাক্তার তার হাতের নাড়ি টিপে, নাকের সামনে হাত রেখে বেশ কিছুক্ষণ ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে উঠে
কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘শ্বাস পড়ছে না, নাড়ির স্পন্দনও অতি ক্ষীণ। হার্ট অ্যাটাক করেছে
বোধহয়।’ মোড়ল ডাক্তারের কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘বুড়ির শেষকৃত্য করতে পারব কি না এইটুকু শুধু বল। অনেক টাকা খরচ করে এই ওঝাকে আনা হয়েছে শুধুমাত্র বুড়িকে মেরে ধরে এই বাড়ি থেকে বিদেয় করার জন্য। আমার কালো টাকা গুলো সব পুলিশে…’ কোনক্রমে মোড়ল ভেতর থেকে উঠে আসা প্রবল হাহাকারটা চাপলেন। ডাক্তার ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘শুনেছিলাম আপনার নাকি কীসব বেআইনি মদের কারবার আছে। ঐ টাকাগুলো তবে আপনি ওখানে রেখে ছিলেন? তাহলে তো ললিতা দেবী কে সরাতে না পারলে আপনার সব সত্যিটা সবার সামনে চলে আসবে।’
মোড়ল ঠোঁটে একটা আঙুল চেপে ধরে বললেন, ‘তুমি জেনেছ ঠিক আছে, তবে সাবধান কথাটা যেন পাঁচ কান না হয়। তোমাকে যা করতে বলছি তাই কর, যেভাবে হোক হাসপাতালে টাকা খাইয়ে একটা মিথ্যে ডেথ সার্টিফিকেট বের করে আনো ললিতা দেবীর নামে, ওতেই কাজ হবে। তারপর বুড়ি জ্যান্ত থাক কি মরুক তাতে কিছু যায় আসে না। একবার দেহটা পুড়িয়ে দিতে পারলেই ব্যাস কাজ
শেষ।’
ওদের কথার মাঝেই ভৈরব চাটুজ্জে এদিক ওদিক তাকিয়ে সন্ত্রস্ত ভাবে বললেন, ‘আমার কাজ
হয়ে গেছে। এবার দক্ষিণাটা যদি একটু তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেন, মানে আমি আর এসব ঝামেলায়
নিজেকে জড়াতে চাই না। শেষে পুলিশ জানতে পারলে একটা কেলেঙ্কারি হবে।’ মোড়ল ঠোঁটের কোণে আত্মবিশ্বাসের হাসি লাগিয়ে বললেন, ‘তা আমার বিরুদ্ধে পুলিশে খবরটা দেবে কে শুনি?’
--‘আমি দেব।’
রাতের কালো আকাশে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। প্রকৃতি যেন অনেকক্ষণ শ্বাসবায়ু চেপে রাখার
পর ঘন ঘন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইছে। মাটিতে পড়ে থাকা ধুলো, শুকনো পাতা সব কিছুকে উড়িয়ে দিয়ে হঠাৎ প্রকাণ্ড এক ঝড় উঠলো আর তার সঙ্গে অলোকেশ মিত্তিরের বুকের ভিতরটাও হু হু করে কেঁপে উঠল। এ গলা যে সকলেরই খুব চেনা! পিছন ফিরে ডাইনির মরদেহের দিকে চোখ পড়তেই সকলে দেখল ডাইনি সটান সোজা হয়ে উঠে বসেছে। ঝড়ের দাপটে পাশের জনের কথাও কারোর কান পর্যন্ত এসে পৌঁছানো দায়। ওঝা ও ডাক্তার সহ গ্রামের সকলে প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়ে যে যার ঘরে ঢুকে দরজা-জানালায় কপাট দিল। অলোকেশ মিত্তির ঝড়ের মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট দেখলেন ললিতা মাটিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কোঁকড়া চুলের গোছা এলোমেলো ভাবে মুখের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে তাকে আরও ভৌতিক রূপ দান করেছে। এরপর অবশ্য মোড়ল চোখের সামনে দুর্ভেদ্য অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননি। পরদিন সকালে ললিতার বাড়ির সামনে থেকে অলোকেশ মিত্তিরকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এত কিছু
ঘটার কিছু দিন পর থেকে অবশ্য গ্রামের মেয়ে-বউরা আবার আগের মতই ললিতার বাড়িতে
প্রতিদিন যাতায়াত শুরু করে।
পুরো গল্পটা শুনে আমি রামদুলাল কে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘এত কিছুর পরও নিজের স্ত্রীকে তার কাছে একা যেতে দাও, তোমার ভয় করে না?’ রামদুলাল জিভ কেটে একগাল হেসে বলেছিল, ‘ছিঃ
ছিঃ, ভয় করবে কেন? গরীবের কাছে উনি সাক্ষাৎ ভগবান। আপদে বিপদে আমরা এখনও
ওনার কাছেই তো যায়। বিশ্বাস করুন ও বাড়ি থেকে কাউকে কোনদিন খালি হাতে ফিরতে
দেখিনি। এইতো করোনার সময় কত মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেল, কিন্তু ললিতা
মায়ের কৃপায় আমাদের গ্রামে তেমন কিছুই হয়নি। তবে কি জানেন গ্রামের মানুষের মনে একবার
সন্দেহের বীজ পুঁতে দিলে তা সহজে ছাড়ে না। তাই লোকের মনে আবার নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয় নি। প্রচুর টাকা বিলিয়ে, বুদ্ধি খাটিয়ে তবে গ্রামের মানুষের মন জয় করতে পেরেছেন। যে মানুষটা একদিন টাকার জন্যে ডাইনি হয়ে গেলেন সেই মানুষটাই আজ কেবল টাকার জোরেই দেবী হয়ে গেছেন।’ এই বলে রামদুলাল মাথার ওপর হাত জোড় করে ভক্তিভরে প্রণাম করল।
0 Comments
Post Comment