- 03 November, 2024
- 0 Comment(s)
- 49 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
বোধন
গতকাল অর্থাৎ দুর্গাষষ্ঠীতে আমার স্ত্রীর একান্ত অনুরোধে তাকে নিয়ে দক্ষিণ কলকাতায় ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা নামকরা পুজো মণ্ডপে ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখতে গিয়ে বছর একুশের একটি মেয়েকে চোখে পড়লো। তাকে দেখামাত্রই আমি চমকে উঠলাম। সেই একই রকম কাঁচা সোনার মত গায়ের রঙ, একই রকম ঘন কালো চোখ, একই রকম পাতলা ঠোঁট, কোঁকড়া চুল, মেদহীন সুঠাম শরীর – ঠিক সাত মাস আগে যেমনটি দেখেছিলাম হুবহু যেন তাই। মেয়েটা তাজা রক্তের মত লাল রঙের একটা শাড়ি পরেছে। আমি মেয়েটার সামনে আসার চেষ্টা করলাম কিন্তু দেখলাম মেয়েটা আমাকে চিনতে না পেরে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। তারপর হঠাৎ মনে পড়লো এই মেয়েটা সে নয়, কারণ তার থুতনিতে এর মত তিল ছিল না। মনে হল আমার জীবনের একটা জঘন্য অতীত অতল অন্ধকার থেকে উঠে এসে একবার দেখা দিয়েই আবার বিলীন হয়ে গেল।
নব-পত্রিকা
আজ সপ্তমী। গতকাল মেয়েটাকে দেখতে পাওয়ার পর থেকেই আমি একটা অবিচ্ছিন্ন ভাবনার মধ্যে ডুবে রয়েছি। আমার শরীর খারাপ করেছে ভেবে আমার ভ্রমণপিপাসু গিন্নি আজকে বিকেলে ঘুরতে বেড়ানোর পরিকল্পনাটা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন নিঝুম বিকেলের একফালি শেষ রোদ জানলার কাঁচ বেয়ে চুঁইয়ে টেবিলের উপর আমার লেখার খাতার খোলা পৃষ্ঠার ওপর এসে পড়েছে। আমি ভাবছি আজ সকালের কথা। সকালবেলা গিন্নি প্রাতঃভ্রমণ থেকে ফিরে এসে আমাকে ডেকে দেখালেন যে তিনি রাস্তার ধারের একটা গাছ থেকে কতগুলি ছাতিম ফুল ছিঁড়ে এনেছেন। আমি দেখলাম গিন্নি ফুলের সঙ্গে কয়েকটি সবুজ পাতাও ছিঁড়েছেন। আমি বলতে গেলাম, ‘একটু সাবধানে ফুল তুললে তো আর কচি পাতাগুলো ছিঁড়তো না।’ কথাগুলো বলতে গিয়েও দিলে ফেললাম কারণ আমার মনে পড়লো সাত মাস আগে শুধুমাত্র আমার কারণে এমনই একটা কচি পাতা অকালে ঝরে গিয়েছিল। তাই এখনকার এই পাতার জন্য শোক করাটা যেন আমাকে থেকে থেকে খোঁচা মেরে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। এরপর আমি নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মনে হল সাত মাস আগের একটা গল্পের উপসংহার রচনা এখনও বাকি রয়ে গেছে। গল্পটার সূত্রপাত ঘটেছিল বর্তমানে আমি যে কলেজের প্রোফেসর সেই কলেজে একটি মেয়ে অনার্সের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর থেকে। মেয়েটার আসল নাম গোপন করছি, ধরুন তার নাম সানন্দা। আমার প্রাইভেটে পড়ানোর কথা জানতে পেরে সে আমার কাছে টিউশন ক্লাস করতে আসতো প্রতি সপ্তাহে একদিন করে শনিবার বিকেলে। সানন্দাকে দেখার পর থেকে আমি ওর শরীরের ওপর একটা তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম। সেটাকে এড়ানোর জন্য আমি ওকে বিশেষ গ্রাহ্য না করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সানন্দা আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব আর বেশি নম্বর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বারংবার আমার কাছে এগিয়ে আসার চেষ্টা করতো। একদিন আমি নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। সেদিন সন্ধ্যেবেলা টিউশন ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাকি ছাত্র ছাত্রীরা চলে যাওয়ার পরে কোনো একটা বোঝানো পড়া আবার বুঝবে বলে সানন্দা একা আমার কাছে থেকে গিয়েছিল। সুযোগ বুঝে আমি ওর ওপর নেকড়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সানন্দার নরম শরীরটা হিংস্র জন্তুর থাবা থেকে নিজেকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে অসহায় হরিণীর মত ছটফট করছিল। শিকার হয়ে যাওয়ার পর আমি মানসিক ও শারীরিক ভাবে বিপর্যস্ত মেয়েটিকে তার কেরিয়ার নষ্ট করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে একেবারে চুপ করিয়ে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম সাধারণ গরীব পরিবার থেকে উঠে আসা একটা মেয়ের আর্তনাদকে চাপা দেওয়ার জন্য এর থেকে ভালো ওষুধ আর নেই। কেউ কিচ্ছুটি টেরও পেল না অথচ আস্ত একটা মেয়ে ধীরে ধীরে অনন্ত যাতনার সমুদ্রে তলিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সানন্দা কলেজ ও টিউশন ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমি আর জানতে পারিনি তার কী হয়েছে। আমার বিশ্বাস সে সম্পূর্ণ রূপে গুড়িয়ে যাওয়ার পরেও আবার অল্পে অল্পে নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে তুলবে। কারণ মেয়েরা ধারণার বাইরে গিয়ে অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু আমি আর সে বিষয়ে কোনো খোঁজখবর নিতে চাইনি। হয়তো মনের মধ্যে ধরা পড়ে যাওয়ার একটা ভয় জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু একটা সাধারণ মেয়েকে আমার আবার কিসের ভয়?
সন্ধিপুজো
এবছর আমার অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যাওয়া হল না। আসলে আমি একটু একা থাকতে চাইছিলাম তাই আমার ঘোর কৃষ্ণবর্ণা স্থূলকায়া হুজুগে গিন্নিকে একাই তার অফিসের বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যেতে হল। আমি মিথ্যা কৈফিয়ত স্বরূপ তাকে বলেছিলাম, ‘আমার শরীর ভালো নেই। মাথাটা একটু যন্ত্রণা করছে। অবশ্য তেমন কিছু বাড়াবাড়ি নয় ঘরে থেকে একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’ গিন্নি হয়তো মনে মনে বললেন, ‘যত বয়স হচ্ছে তত অলস হয়ে যাচ্ছ তুমি। পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে থাকার একটা সুযোগ একবার পেলেই হয়।’ ফাঁকা ঘরে বিছানায় শুয়ে আমার মনে পড়ছিল সেই ছেলেবেলার পাড়াগাঁর দুর্গাপুজোর কথা। বাঁড়ুজ্যেদের পুজোর সেই ঢাকের আওয়াজ যেন এখনো আমার কানে বাজে আর সেই বাজনার কথা মনে পড়ে আজও আমার মন নেচে ওঠে। ক্রমে আমার চোখের ওপর অন্ধকার ছেয়ে গেল।
ঘুম ভাঙলো একেবারে নবমীর সকালে, প্রখর রৌদ্র তাপে চোখ ঝলসে যাওয়ার পর। মনে হল আমার সমস্ত জীবনের রুক্ষতার মাঝে কৈশোরের সেই মুহূর্তগুলো ছাড়া কোথাও কোন শীতল ছায়ার স্নিগ্ধতা নেই। অনেক ডাকাডাকির পরেও আমাকে মড়ার মত ঘুমাতে দেখে গিন্নি রেগে গিয়ে বিছানার পাশের জানলা থেকে সমস্ত পর্দা সরিয়ে দিয়ে গেছেন। এবার তিনি আমাকে বিছানায় উঠে বসতে দেখে ছুটে এসে তার ভাঙ্গা রেকর্ডার তুল্য কন্ঠে বিরক্তি জাগানো অনর্গল ভাষণ আরম্ভ করলেন। তার বক্তব্যের মধ্যে যেটুকু সারবস্তু ছিল তা হল, আমি কাল রাতে দাঁতে কিছু না কেটে ঘুমিয়ে পড়েছি এবং এত বেলা পর্যন্ত অকর্মণ্যের মত ঘুমাচ্ছি। আমি গিন্নিকে থামিয়ে হালকা ভাবে বললাম, ‘জানো আজকে ভোরের দিকে একটা স্বপ্ন দেখেছি।’ গিন্নি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার ফালতু স্বপ্নের গল্প শোনার মত সময় আমার নেই।’ এইভাবে তিনি আমার আশ্রয় সন্ধানী কোমল হৃদয়কে পিষে দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলেন। আমি সানন্দাকে নিয়ে সত্যি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। অনেকদিন পর সানন্দা আবার আমার স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ফিরে এসেছিল। তাকে দেখে মনে হয়েছিল ভোরের আকাশের শুকতারার মতো নির্মল ও উজ্জ্বল। তার মুখটা এক দূরাগত ভাসমান আবছায়ার মত ঘন কুয়াশার মাঝে ফুটে উঠেছিল। সে যেন একগুচ্ছ ক্ষোভ নিয়ে আমাকে অনেক কথা বলতে এসেছিল। তার ঠোঁট দুটোকে কেঁপে উঠতে দেখলেও আমি তার কোনো কথা শুনতে পাইনি। সানন্দা যেন আমাকে নয়, আমার মধ্যে থাকা অন্য কাউকে সেই কথাগুলো বলেছে যে তার ভাষা বোঝে। সে যেন সানন্দার সমস্ত অভিযোগ মেনে নিয়েছে।
বলি
সানন্দা সাত মাস আগে আমার বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ নিতে পারতো স্বপ্নের মধ্যে ফিরে এসে সে আমার তার চেয়েও অনেক ভয়ংকর ক্ষতি করে দিয়ে প্রতিশোধ নিয়ে গেছে। তখন বেলা বারোটা। সকাল থেকে যে রোদটা ব্যালকনিতে আসে তা সরে গিয়ে ছায়া পড়ে গেছে। আমি সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারের ওপরে বসে একটা পুরনো খবরের কাগজের পাতা উল্টাচ্ছি তখন একটা পৃষ্ঠায় আর জি কর কাণ্ডকে নিয়ে লেখা একটা নারীবাদী প্রবন্ধ চোখে পড়লো। সেই প্রবন্ধের কয়েকটা লাইনে চোখ বুলানোর পর হঠাৎ হাতের পেয়ালা থেকে গরম চা ছলকে আমার সাদা পাজামার ওপর পড়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। তারপর ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি চায়ের পেয়ালাটা রেখে এলাম। গিন্নি আমার আর্তনাদ শুনে ভয় পেয়ে ছুটে এসে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল?’ আমি আঙুল তুলে পেপারটা দেখিয়ে বললাম, ‘রক্ত লেগে আছে।’ গিন্নি কাগজটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করে বললেন, ‘কোথায় রক্ত?’ আমি প্রবন্ধের পৃষ্ঠাটা খুলে দেখালাম। গিন্নি দেখে বললেন, ‘এটা?’ তারপর উচ্চৈস্বরে হেসে উঠলেন, ‘আরে, এটাতো জল লেগে পিছনের পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপনের ছাপ ফুটে উঠেছে। উফ! এমন ভয় পাইয়ে দাও না তুমি। তোমার আর কোনো কাজ নেই নাকি?’ আমি অপ্রস্তুত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
বিজয়া
পাড়ার পুজো মণ্ডপে বিসর্জনের সুরে ঢাক কেঁদে উঠেছে। আকাশের মুখও ভার। সরকারকে চাকরিতে ইস্তফা জানিয়ে আমার চিঠি লেখাও এইমাত্র শেষ হল। এখন আমি মুক্ত বিহঙ্গ। এখন আমার কোনো শাস্তি, কোনো ঘৃণা, কোনো অপমান, কোনো লজ্জা বা কিছু হারিয়ে ফেলার আর কোনো ভয় নেই। আজ বিকেলে পাড়ার পুজো মণ্ডপে সিঁদুর খেলা চলছিল। গিন্নি আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি করলেন। কিন্তু তাকে আমার জেদের কাছে নতি স্বীকার করতেই হল। অবশেষে গিন্নি ঠোঁট উল্টে একাই চলে গেলেন। তার বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার চোখে পড়লো সাদা টালির মেঝেতে চাপ চাপ রক্তের দাগ। ইদানিং আমি সর্বত্রই রক্ত দেখতে পাচ্ছি- ভাতের থালায়, জামা কাপড়ে, বিছানায়, বাথরুমে সর্বত্র। তবে প্রথমবারের মতো এবারে আর চমকে উঠলাম না। পরীক্ষা করে দেখলাম যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, গিন্নির পা থেকে গড়িয়ে পড়া আলতার দাগ। এখন আমি নিজের ছায়াকেও ভয় পাই। কোথা থেকে জানিনা একটা ভূত এসে অনবরত আমার মাথার চারপাশে পাক খেয়ে যাচ্ছে আর আমি ক্ষণে ক্ষণে আতঙ্কে শিউরে উঠছি। আমার অন্ধকার অতীত আমাকে পীড়িত করতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করছে না। আজ আমি পৃথিবীতে বড্ড একা। আমার মনের কথা শোনার মতো বা বোঝার মত কেউ নেই, যার কাছে আমি নিজের পাপ স্বীকার করে হালকা হতে পারি। আমি আজ নিজেই নিজের কাছে অবাঞ্ছিত। আমার জন্য রয়েছে কেবল আত্মগ্লানির তুষানল আর হতাশার নিরেট আঁধার। তাই এই পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ বেদনা, হাসি কান্নার জগৎ থেকে নিজেকে নির্বাসন দিতে চাই। আমার মধ্যে আসা এই আচমকা পরিবর্তন, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে চলেছে আমার নানা রকম অস্বাভাবিক আচরণের মধ্যে দিয়ে তা দেখে গিন্নি হয়তো ভাবছেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ভাবুক, আমাকে সবাই যত খুশি পাগল ভাবুক। আমি এটাই চাই, এতেই আমার তৃপ্তি। বাইরে থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে একটা হট্টগোলের শব্দ কানে ভেসে আসছে। খেয়াল করার পর বুঝতে পারলাম গিন্নি ফিরে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছেন আর দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন। আমি দরজা না খোলায় তিনি ক্রমাগত আমার ফোনে কল করে চলেছেন আর এদিকে আমি নিজের অচেতনে দুহাত দিয়ে কষে নিজেরই গলা টিপে ধরে বসে আছি। সচেতন হওয়া মাত্র আমি সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিয়েই গলায় ও ঘাড়ে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলাম। বুঝলাম সত্যি এবার আমাকে ভূতে পেয়েছে। কিন্তু আমি যমেরও অরুচি।
লেখক : শিক্ষার্থী, গল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment