প্রয়াণ দিবসে স্মরণে সিমোন দ্য বোভোয়ার

  • 14 April, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 113 view(s)
  • লিখেছেন : শাম্মা বিশ্বাস
সিমন ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল প্যারিসে ৭৮ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর সময় নারী অধিকারের সংগ্রামের অগ্রভাগে থাকা ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল। কিন্তু শুধু নারীবাদী লেখক হিসেবে নয় সিমন পুরো পৃথিবীর মানুষের মনে বেঁচে আছেন একজন দার্শনিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী নারী হিসেবে।

সিমন দ্য বোভোয়ার( জন্ম - ৯ জানুয়ারি ১৯০৮, মৃত্যু - ১৪ এপ্রিল ১৯৮৬)

 

'কেউ নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠে।’

বিখ্যাত এই উক্তিটি সিমন দ্য বোভোয়ার এর, যিনি ছোটবেলা থেকে নারীদের প্রতি পুরুষ শাসিত সমাজের বৈষম্য, অসঙ্গতি লক্ষ্য করে খুব সহজেই এই সত্যটি উপলব্ধি করেন। সিমন দ্য বোভোয়ার ছিলেন বিশ্বের নারীবাদী আন্দোলনের পুরোধা। ৯ জানুয়ারি ১৯০৮ সালে প্যারিসের একটি বুর্জোয়া পরিবারে সিমন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জর্জেস বার্ট্রান্ড ডি বোভোয়ার ছিলেন একজন আইনজীবী এবং শখের অভিনেতা, মা ফ্রাঁসোয়া বোভোয়ার ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক। সিমনের হেলেন নামে এক বোন ছিল। সিমনের বাবার দুই কন্যা সন্তানের চেয়েও এক পুত্র সন্তানের শখ থাকলেও তিনি সিমনকে উৎসাহিত করতেন এবং তাঁকে নিয়ে গর্ব করে বলতেন,"সিমন পুরুষের মতই চিন্তা করে।" প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর পরিবার অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে,তখন সিমনের মা তাঁদের দুই বোনকে ধর্মবাদী বিদ্যালয়ে পাঠাতে চাইলেও বুর্জোয়া মর্যাদা বজায় রাখতে দুই মেয়েকে কনভেন্ট স্কুলে পাঠানো হয়। সিমন ছোটবেলায় খুব ধর্মবাদী ছিলেন, কিন্তু ১৪ বছর বয়সে তিনি ধর্মের উপর বিশ্বাস হারান এবং সারা জীবন নাস্তিক ছিলেন। সিমন ছোট থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠেন, চোখের সামনে দেখেন মায়ের দুর্দশার চিত্র। সেই ছোটবেলাতেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করবেন না, এবং সন্তানের জন্ম দেবেন না। কোর্স ডিজাইর থেকে উচ্চ বিদ্যালয় শেষ করে তিনি ভর্তি হিন ফ্রান্সের সোরবোর্নে। সেখানে পরিচয় হয় বিখ্যাত লেখক দার্শনিক জঁ-পল সার্ত্র এর সঙ্গে। ১৯২৯ সালে সিমন দর্শনে এগ্রিগ্রেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পেয়ে পাশ করেন। সার্ত্রের সঙ্গে শুধু বন্ধুত্ব নয়, তাঁর দার্শনিক চিন্তা বিচার বিশ্লেষণের তীব্র সমালোচক হয়ে ওঠেন সিমন।

 

প্রাক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি ও প্রেমের জটিল সম্পর্ককে নিয়ে ১৯৪৩ সালে সিমন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘শি কেম  টু স্টে' লেখেন। এরপর ‘ লা সেং ডেস অট্রিস’, ‘দ্য ব্লাড অফ আদারস', ‘দ্য  ম্যান্ডারিনস', 'দি এথিক্স অব এমবিগিউটি', 'এ ফেয়ারওয়েল টু সার্ত্র' ইত্যাদি বই লেখেন। ১৯৪৯ সালে দুই খণ্ডে লেখা সিমনের সবচেয়ে জনপ্রিয় নারীবাদী গ্রন্থ 'দি সেকেন্ড সেক্স'। এই বইটির মধ্যে দিয়ে তিনি পুরো পৃথিবীতে নারীবাদী তত্ত্বের এক নতুন প্রতিবাদী রূপ তৈরি করেন। এই বইটিতে তিনি লিঙ্গ বৈষম্যের ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্বিক ভিত্তিগুলো ব্যাখ্যা করেন। ষাটের দশকের শুরুর দিকে জরায়ুর স্বাধীনতা,গর্ভপাত এবং নারীর ওপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন সিমন। ১৯৭৯ সালে তাঁর প্রথম জীবনে দেখা কিছু প্রগতিশীল নারীদের গল্প নিয়ে লেখেন ছোটগল্প 'দা থিংক্স অব দি স্পিরিট কাম ফার্স্ট'। নারীর অধিকার নিয়ে লেখা ছোটগল্পের সিরিজ 'দি ওমেন ডেস্ট্রয়েড' বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

সিমন মনে করতেন সমাজে দুই শ্রেণির প্রাণী আছে। প্রথম সারিতে থাকেন পুরুষ এবং দ্বিতীয় সারিতে থাকেন অন্যান্য গোত্রভুক্ত প্রাণী। পুরুষ শাসিত সমাজ নারীদের সবসময় 'অন্যান্য' গোত্রের মধ্যে বসবাসরত এক কাল্পনিক জীব হিসেবে ভাবতেই বেশি আনন্দ পায়। এর অন্যতম কারণ হিসেবে পুরুষরা যে সাফাইটি দেন তা হল নারীকে বোঝা কঠিন এরা সবসময় রহস্যাবৃত। লোক দেখানো সামাজিকতায় সিমনের কোন বিশ্বাস ছিল না। নিজের পছন্দমতো জীবনযাপন করতে তিনি ভালোবাসতেন। তিনি আরো মনে করতেন নারীরা পুরুষের মতই নিজের পছন্দের বিষয় ও পথ বেছে নিতে পারে, নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম নারীরা।

 

সিমন ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল প্যারিসে ৭৮ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর সময় নারী অধিকারের সংগ্রামের অগ্রভাগে থাকা ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল। কিন্তু শুধু নারীবাদী লেখক হিসেবে নয় সিমন পুরো পৃথিবীর মানুষের মনে বেঁচে আছেন একজন দার্শনিক, সাহিত্যিক,বুদ্ধিজীবী নারী হিসেবে।

লেখক : সাংবাদিক, বাচিক শিল্পী 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment