- 26 April, 2021
- 0 Comment(s)
- 639 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
বালজাক এরপর উন্মোচন করলেন বিবাহের বিজ্ঞানটি। তবে আমরা দ্রুত উপলব্ধি করতে পারি যে, স্বামীর কাছে বিবাহ বলতে ভালোবাসা পাওয়া বোঝায় না, বোঝায় প্রতারিত না-হওয়া। কোনোরকম ইতস্তত না করেই নারীর ওপর তিনি আরোপ করবেন নীতিহীন শাসনব্যবস্থা। সমস্তরকম সংস্কৃতি থেকে নারীকে বাদ দিয়ে স্বামীর সম্মানরক্ষার একমাত্র লক্ষ্যে তাঁকে বোকা বানিয়ে রাখবেন। এর পরেও কি একে প্রেম বলা চলে? কেউ যদি এই সব অস্পষ্ট এবং অসংলগ্ন ধারণা থেকে কোনো অর্থ খুঁজতে চান, তাহলে মনে হবে পুরুষের অধিকার আছে এমন এক নারীকে নির্বাচন করা যাঁর মাধ্যমে সাধারণভাবে পুরুষ তাঁর চাহিদা পূরণ করতে পারবেন। এই ‘সাধারণভাব’ আসলে তাঁর বিশ্বস্ততার নিশ্চয়তা। এরপর পুরুষের দায়িত্ব হল নির্দিষ্ট কিছু কৌশল প্রয়োগ করে স্ত্রীর ভালোবাসা জাগ্রত করা। কিন্তু কোনো পুরুষ যদি সম্পত্তি বা বংশধরের জন্য বিয়ে করে তাহলে কি সেই পুরুষটি যথার্থই প্রেমে পড়েছেন বলা যায়? আর তা যদি না হয়, তাহলে কীভাবে তাঁর প্রবল আবেগ এতটাই দুর্দমনীয় হয়ে উঠতে পারে যা পারস্পরিক আবেগের জন্ম দিতে পারে? আর বালজাক কি সত্যিই এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছিলেন যে, যে-ভালোবাসার মধ্যে পারস্পরিকতা নেই, অনিবার্য মোহাবেশ থেকে অনেক দূরে যার অবস্থান, তা উলটোদিকে ঘৃণা এবং বিরক্তি তৈরি করে? এই খারাপ বিশ্বাস স্পষ্ট লক্ষ করা যায় তাঁর বার্তাবহ পত্রোপন্যাস ‘Mémoires de deux jeunes mariées’ বইতে। লুইস দ্য শালিও বিশ্বাস করতেন যে, ভালোবাসার ওপরই বিবাহের প্রতিষ্ঠা। আবেগের আতিশয্যে তিনি তাঁর প্রথম স্বামীকে হত্যা করেন, নিজে তিনি এরপর মারা যান দ্বিতীয় স্বামীর প্রতি ঈর্ষার অতিরেকে। র্যনে দ্য লেসতোরাদ নিজের যুক্তির জন্য আবেগকে ত্যাগ করেছিলেন। যদিও মাতৃত্বের আনন্দ তাঁর এই ক্ষতে যথেষ্ট প্রলেপ দিয়েছিল এবং তিনি একটি সুস্থিত সুখও তৈরি করে নিয়েছিলেন। আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই যে প্রাথমিকভাবে কোন্ অভিশাপে, নাহলে লেখকের নিজের ফরমানেই, প্রেমিকা লুইসকে তাঁর ঈপ্সিত মাতৃত্ব থেকে আটকানো হয়েছিল। প্রেম কখনোই গর্ভধারণকে বাধা দেয় না এবং আমরা এও ভাবতে পারি যে, স্বামীর আলিঙ্গনকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে র্যনে এই ‘ভণ্ডামি’-কে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যা ‘সৎ মহিলাদের’ মধ্যে দেখতে স্টেনডাল ঘৃণাবোধ করতেন। বিবাহ রাতের বর্ণনা বালজাক দিয়েছেন এইভাবে :
মেয়ে-বন্ধুকে র্যনে লিখেছিলেন, “ তোর কথা অনুযায়ী যে-জন্তুকে আমরা স্বামী বলে ডাকি, তিনি আজ অদৃশ্য হয়ে গেছেন। আমি জানি না কোন্ কোমল সন্ধ্যায় তাঁর মধ্যে আমি আবিষ্কার করেছি এক প্রেমিককে যাঁর কথা আমার হৃদয় স্পর্শ করে যেত এবং যাঁর বাহুতে আমি এক অনির্বচনীয় আনন্দে ধরা দিয়েছিলাম ... আমার মনের মধ্যে তখন কৌতূহলের মাত্রা বেড়ে যায় ... তবে তুই তো জানিস যে, সবচেয়ে সূক্ষ্মতম ভালোবাসা যা চায় অথবা এই অভাবিতপূর্ব ঘটনা যাকে সেই মুহূর্তের সম্মানই বলা যায়, তার কোনো কিছুরই অভাব ছিল না ...”
এই সুন্দর অলৌকিক ঘটনাটির ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি উচিত নয়। কারণ কয়েকটি চিঠি পরেই আমরা আবার খুঁজে পাই অশ্রুসিক্ত র্যনেকে : “আগে আমি মানুষ ছিলাম। এখন একটি বস্তু”; এবং ‘বৈবাহিক ভালোবাসা’-র রাতগুলিতে তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিতেন বোনাল্ড পড়ে। তবুও একজন জানতে চাইবেন কী রেসিপি ব্যবহার করে মেয়েলি প্রবর্তনার সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে স্বামীকে মন্ত্রমুগ্ধ করা হয়েছিল। ‘Physiology of Marriage’ বইতে এই ব্যাপারে সংক্ষিপ্তসারে জানিয়েছেন : “ধর্ষণ দিয়ে কখনোই বিবাহ শুরু করবেন না” অথবা অস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন : “আনন্দের সূক্ষ্ম তারতম্যকে দক্ষতার সঙ্গে গ্রহণ করা, তার উন্নতি করা, সেগুলিকে একটি নতুন শৈলী প্রদান করা, নিজস্ব এক প্রকাশভঙ্গিই স্বামীর প্রতিভা গঠন করে”। পাশাপাশি তৎক্ষণাৎ তিনি যুক্ত করেছেন : “একে-অপরকে ভালোবাসে না এমন দুজন মানুষের মধ্যে এই প্রতিভা হল লির্বাটিনিজম”। এখন নির্দিষ্টভাবে বললে, লুইসকে ভালোবাসে না র্যনে। লুইসকে আমাদের সামনে যেভাবে আঁকা হয়েছে, সেক্ষেত্রে কোথা থেকে এই ‘প্রতিভা’-র আগমন হল? সত্যি বলতে, এই সমস্যাটি খুব চটজলদিভাবে বালজাক এড়িয়ে গেছেন। তিনি এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছিলেন যে, নিরপেক্ষ অনুভূতি বলে আদৌ কিছু হয় না এবং বিরক্তি, অধৈর্য ও শত্রুতার চেয়ে ভালোবাসার অভাব, ভয় বা একঘেয়েমি অনেক সহজেই কোমল বন্ধুত্বের জন্ম দেয়। ‘Lys dans la vallée’ গ্রন্থে তিনি অনেক বেশি আন্তরিক এবং সেখানে নিরানন্দচিত্ত মাদাম মর্ত্সোফের নিয়তি অনেক কম উৎসাহব্যঞ্জক হিসাবে প্রতিভাত হয়।
বিবাহ এবং প্রেমের মধ্যে সংগতিসাধন এমন এক কাজ যার সফলতার জন্য স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ অবশ্য প্রয়োজনীয়। জটিল মোচড় অতিক্রমের সময় এই সমাধানই গ্রহণ করেছিলেন কিয়ের্কেগার্ড। বিবাহের কূটাভাসকে তিনি নিন্দা করতে চেয়েছিলেন :
কী অদ্ভুত আবিষ্কার এই বিবাহ। উপরন্তু যা এই বিবাহকে আরও অপরিচিত, আরও অদ্ভুত করে তোলে তা হল, মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যদিও কোনো পদক্ষেপই তেমন নিষ্পত্তিমূলক বা সিদ্ধান্তমূলক নয়, ... তাই এই জাতীয় সিদ্ধান্তগ্রহণকারী-কাজটি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করা উচিত।
কিন্তু সমস্যা এইখানে : প্রেম এবং প্রেমে-পড়া দুটোই সম্পূর্ণভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার। কিন্তু বিবাহ হল একটি সিদ্ধান্ত। যদিও বিবাহ বা বিবাহেচ্ছুক সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রেমে-পড়া বিষয়টি জেগে ওঠা উচিত। এর অর্থ হল, যা সবচেয়ে বেশি স্বতঃস্ফূর্ত তাকে একইসঙ্গে হতে হবে সবচেয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত এবং এই স্বতঃস্ফূর্ততার জন্য যা সবচেয়ে বেশি ব্যাখার অতীত এবং যার জন্য তার ওপর স্বর্গীয় গুণাবলী আরোপ করা হয়, তাকে অবশ্যই সংঘটিত হতে হবে চিন্তার সততার দ্বারা। এই চিন্তাকে এতটাই শক্তিশালী হতে হবে যাতে সেখান থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যায়। এতদ্ব্যতীত, এই জিনিসগুলির কিন্তু একে-অপরকে অনুসরণ করা উচিত নয়। পিছন থেকে চুপি চুপি অলক্ষ্যে সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়। একইসঙ্গে এই দুটি বিষয়ের সংঘটিত হওয়া উচিত। শেষ মুহূর্তে অবশ্যই এই দুটি জিনিসের ঐক্যসাধন হওয়া উচিত।
এর অর্থ হল, ভালোবাসা মানেই বিবাহ করা নয় এবং এটা বোঝা বেশ শক্ত যে, ভালোবাসা কীভাবে দায়িত্বে পরিণত হয়। এই কূটাভাস দেখে কিয়ের্কেগার্ড কিন্তু ভীত হননি। বিবাহের ওপর তাঁর সমস্ত প্রবন্ধই রচিত হয়েছে এই রহস্যকেই বিশদে ব্যাখ্যা করার জন্য। এটা সত্যি, তিনি সহমত হয়েছিলেন যে :
“চিন্তাভাবনা হল স্বতঃস্ফূর্ততার মৃত্যুদূত ... এটা যদি সত্যি হয় যে প্রেমে-পড়ার চেয়ে চিন্তাভাবনাকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে, তাহলে আর কখনোই বিবাহ সংঘটিত হবে না।” কিন্তু, “সিদ্ধান্ত হল নির্ভেজাল আদর্শের দ্বারা অভিজ্ঞতালব্ধ, চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রাপ্ত এক নতুন স্বতঃস্ফূর্ততা যা অবিকল প্রেমে-পড়ার অনুরূপ। সিদ্ধান্ত হল নৈতিকতার ভিত্তিতে নির্মিত জীবনের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেইজন্য অবশ্যই বলতে হয় যে তা প্রেমে-পড়ার পথকে প্রশস্ত করে দেয় এবং তাকে ভিতরের ও বাইরের সকল রকম বিপদের হাত থেকে নিরাপদ করে।” এবং এই কারণেই “একজন স্বামী, একজন প্রকৃত স্বামী, নিজের কাছেই নিজে এক বিস্ময়! ... অস্তিত্বের সময় প্রেমের সুখানুভবকে ধরে রাখার সক্ষমতা স্বামী এবং তাঁর প্রিয়ার ওপর গুরুত্বের সমস্ত শক্তিকে একত্র করে”।
মহিলার ক্ষেত্রে এই যুক্তি তাঁর ভাগ্য নয়, তাঁর ‘চিন্তা’ করার ক্ষমতা নেই; একইসঙ্গে ‘প্রেমের নীতি থেকে তিনি পৌঁছে যান ধর্মের নীতিতে’। সরল ভাষায় অনুবাদ করলে বলা যায়, এই মতবাদের অর্থ হল, প্রেমে-পড়া পুরুষ বিবাহের সিদ্ধান্ত নেন ভগবানের প্রতি বিশ্বাস থেকে যিনি বিপরীতে পুরুষকে নিশ্চয়তা দেন অনুভূতি এবং কর্তব্যের মধ্যে সংগতির। আর মহিলারা বিবাহ করতে চান তখনই, যখন তাঁরা প্রেমে পড়েন। আমি একজন প্রবীণ ক্যাথলিক ভদ্রমহিলাকে জানতাম যিনি আরও সরলভাবে ‘প্রথম দর্শনে ধর্মনিষ্ঠ ভালবাসায়’ বিশ্বাস করেছিলেন। দৃঢ়ভাবে তিনি বলেছিলেন, যে-মুহূর্তে স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই বেদিতলে চূড়ান্তভাবে উচ্চারণ করেন ‘আমি রাজি’, তখনই তাঁরা অনুভব করেন যে তাঁদের হৃদয় প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। যদিও কিয়েরকেগার্ড স্বীকার করেছেন যে আগে থেকে অবশ্যই ‘ঝোঁক’ থাকতে হবে, তবে চিরকাল একসঙ্গে চলার এই শপথও কম অলৌকিক ঘটনা নয়।
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক।
0 Comments
Post Comment