- 08 October, 2022
- 0 Comment(s)
- 665 view(s)
- লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
বছর খানেক আগে একটি ছায়াছবি মনে নাড়া দিয়েছিল। তার নাম মুখার্জীদার বউ। কাকতালীয় ব্যাপার হল এই যে আমি নিজেও মুখার্জীর বউ। আমার জীবনসঙ্গীর পদবি মুখার্জী। দুই পরিবারের চাপে নতিস্বীকার করে আমরা হিন্দুমতে বিয়ে করি। বিয়ের কয়েকদিন আগে হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে আমাদের রেজিস্ট্রি হয়। এমএ পাশ করে তখন আমি সবেমাত্র অধ্যাপনা শুরু করেছি। তবে আইন সম্বন্ধে তখন একদমই সচেতন ছিলাম না। রেজিস্ট্রির শংসাপত্রে আমি অপর্ণা মুখার্জী বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে যাই। কিন্তু আমার শিক্ষা এবং চাকরি সংক্রান্ত সমস্ত নথিতেই আমি বন্দ্যোপাধ্যায় রয়ে গেলাম। মানে, পরিবর্তন করার কোনও চেষ্টা করিনি। তবে শ্বশুরমশাই আমার নামে রেশন কার্ড করাতে গিয়ে বিবাহসূত্রে পাওয়া পদবিকেই আবেদনপত্রে লিখে এলেন। মনে পড়ে আমরা একটি নাম করা চলচ্চিত্র সংগঠনে দম্পতি হিসেবে (couple membership) সদস্যপদ গ্রহণ করতে গেছিলাম। ওই অফিসের একজন বাঁকা হাসি হেসে প্রশ্ন করেছিল, মুখার্জীর স্ত্রী কিভাবে বন্দ্যোপাধ্যায় হতে পারে?
বিয়ের পাঁচ বছর পর আমার মেয়ে এল আমার জীবনে। নার্সিং হোম আমার মেয়ের যে জন্মনথি দিল তাতে শিশুর মায়ের নাম অপর্ণা মুখার্জী। করপরেশনের জন্মনথিতেও তাই। স্কুলে যখন মেয়েকে ভর্তি করতে গেলাম তখন নাম লিখলাম অপর্ণা মুখার্জী বন্দ্যোপাধ্যায় । মেয়ে একটার পর একটা ক্লাস পেরিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠছে । আমি ওর খাতায় বা রিপোর্ট কার্ডে সই করতে গিয়ে কি পদবি লিখব বুঝতে পারি না। নিদারুণ এক পরিচয়-সংকট। প্রথমদিকে আমি লিখতাম মুখার্জী। কিন্তু পরে মুখার্জী বন্দ্যোপাধ্যায়। গোলমাল হল মেয়ের পাশপোর্ট বানাতে গিয়ে। আমার পাশপোর্টে আমি বন্দ্যোপাধ্যায়, অথচ মেয়ের জন্মনথিতে আমি মুখার্জী। পাশপোর্ট অফিসের এক কর্মী নোংরা সব ইঙ্গিত করে যাচ্ছেতাই অপমান করল।। রাগে মাথায় আগুন জ্বললেও বেশি প্রতিবাদ করতে পারিনি কারণ মেয়ের পাশপোর্টটা জরুরি ছিল। শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে দিল মেয়ের স্কুল। মেয়ের ক্লাস টেনের পরিক্ষার আডমিট কার্ড তৈরি করতে গিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ পদবি-সমস্যা দূর করার জন্য এফিডেভিট করে নেওয়ার পরামর্শ দিল। এফিডেভিটের পর অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় রুশতী মুখার্জীর মা হিসেবে অবশেষে আইনী স্বীকৃতি পেল। কিন্তু ভাবি, এই বন্দ্যোপাধ্যায় পদবিটাও আমার কি? ওটা তো আমার জন্মদাতার পদবি! যে জন্মদাতা মদ না খেয়েও পাগলা কুকুরের মতো এমন চিৎকার করত যে ভয়ে কাঁপতাম, একই সঙ্গে ঘেন্নায় বিষিয়ে উঠত মন। যে জন্মদাতা উইল করে আমায় তার সঞ্চয়-সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে গেছেন। সেই ‘পিতৃদেবের’ পরিচয় বহন করে চলেছি আজও। বিকল্প রাস্তা কিছু ছিল কি? না! আমি দেবী বা দাসী কোনটাই হতে চাই না। আমার নামের আগে আমার মায়ের নামও বসাতে চাই না। বা মায়ের পদবিও নয়। মায়ের পদবিও তো তার বাবার পদবি। আসলে পিতৃতন্ত্রের এই খাঁচা থেকে মুক্তি নেই কোনও। অথচ কাজের জগতে লক্ষটা অপর্ণা, তাই একটা পদবি জুড়ে দিতেই হয়! কিভাবে নিজের পরিচয়ে বাঁচা যায় ভেবে পাই না। নিজেকে আরেকটা নাম দেব? ধরা যাক, অপর্ণা ভূমিসুতা? বা অপর্ণা মেঘনা? হাস্যকর শোনাবে কি? দিনের শেষে নিজেকে বোঝাই, পদবিতে কি এসে যায়? সমাজ আমাকে যে নামেই চিনুক আমার ‘আমি’ হয়ে ওঠাটা আটকাবে না। পিতৃতন্ত্র যতই আমাদের স্বতন্ত্র পরিচিতি অস্বীকার করুক না কেন, আমাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই থামবে না।
0 Comments
Post Comment