- 25 November, 2020
- 0 Comment(s)
- 989 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
যুবতী মেয়েদের পছন্দের স্বাধীনতা সবসময়ই ভীষণ নিয়ন্ত্রিত ছিল। তাঁদের কুমারীত্ব--কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র বাদে যেখানে তা ধর্মীয় পবিত্রতার পোশাকে ঢাকা--তাঁদের পরজীবী এবং সমাজ-বিচ্যুত বলে গিলে খায়। বিবাহই তাঁদের কাছে রুটিরুজির উৎস এবং তাঁদের অস্বিত্বের একমাত্র সামাজিক সমর্থন। নারীদের উপর এই বিবাহ দুটি বিষয় চাপিয়ে দেয় : সমাজ-সম্প্রদায়কে তিনি সন্তান উপহার দেবেন, কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রে--স্পার্টা বা নাৎসি শাসনের কিছু অংশের মতো--রাষ্ট্রই সরাসরি অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নেয় এবং মহিলাদের কাছ থেকে কেবল মাতৃত্বই দাবি করে। এমনকি যে-সমস্ত সভ্যতা পিতার উৎপাদকের ভূমিকাকে উপেক্ষা করে এসেছে, তারাও চায় একজন মহিলা তাঁর স্বামীর অধীনেই সুরক্ষিত থাকুক। সেই মহিলার কাজ হল স্বামীর যৌন আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করা এবং একইসঙ্গে গৃহস্থালীর যত্ন নেওয়া। সমাজ নারীর উপর যে-দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়, তা স্বামীর প্রতি এক ধরনের সেবা বলেই মনে করে। বিপরীতে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে উপহার দেবেন, অথবা যৌতুক দেবেন এবং দেখভালের ব্যাপারে নিয়োজিত থাকবেন। স্বামীর মাধ্যমেই সমাজ-সম্প্রদায় মহিলাদের উপর এইসব দায়িত্ব ন্যস্ত করে যার জন্য মহিলারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।
এইভাবে নিজেদের কাজ বা সেবার দ্বারা যে-অধিকার মহিলারা অর্জন করেন, তা পুরুষের কাছেও কিছু বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি করে। পুরুষও কিন্তু নিজের ইচ্ছামতো দ্বৈত জীবনের এই বন্ধন ভাঙতে পারেন না। একমাত্র সরকারি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই প্রত্যাখ্যান বা বিবাহ-বিচ্ছেদ লাভ করা সম্ভব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বামী বাধ্য থাকেন আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে। এই ধরনটিও বেশ আপত্তিজনক হয়ে উঠেছে বোকশোরির ইজিপ্টে এবং আজকের দিনের আমেরিকায় ‘খোরপোষ’-এর রূপ ধরে। বহুগামিতাকে চিরকালই কম-বেশি খোলাখুলিভাবে সহ্য করা হয়েছে : পুরুষ তাঁর শয্যাসঙ্গী হিসাবে পেতে পারেন একজন ক্রীতদাসকে, উপপত্নীকে, প্রণয়িনীকে বা পতিতাকে। যদিও আইনসিদ্ধ স্ত্রীকে কিছু অধিকার বা সুবিধা দিতে তিনি বাধ্য থাকেন। স্ত্রী যদি বোঝেন যে তাঁর প্রতি খারাপ ব্যবহার করা হচ্ছে বা তিনি আহত হচ্ছেন, তাহলে তার প্রতিকারও তাঁর হাতে আছে--কম-বেশি জোরালো নিশ্চিন্ততার সঙ্গেই আছে--নিজের পরিবারে তিনি ফিরে যেতে পারেন এবং তাঁর দিক থেকে বিবাহ-বিচ্ছেদ লাভ করতে পারেন।
এইভাবে স্বামী-স্ত্রী দুজনের কাছেই বিবাহ হল একইসঙ্গে দায়িত্ব ও আশীর্বাদ। কিন্তু স্বামী ও স্ত্রীর অবস্থানের মধ্যে এক্ষেত্রে কোনো সামঞ্জস্য নেই। যুবতী নারীদের ক্ষেত্রে বিবাহ হল সমাজের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একমাত্র মাধ্যম। তা যদি তাঁরা না পারেন, তাহলে তাঁদের গণ্য করা হয় সামাজিক বর্জ্য হিসাবে। মায়েরা এইজন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন মেয়েদের বিয়ে দিতে। গত শতকে বুর্জোয়া সমাজে মেয়েদের মতামত প্রায় নেওয়াই হত না। আগে থেকে কথাবার্তা বলে স্থির-করা সম্ভাব্য পাণিপ্রার্থীর হাতেই তাঁকে তুলে দেওয়া হত। সামাজিক এই রীতি বা প্রথাকেই এমিল জোলা বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘পত্-বুইই’ রচনায় :
“হারিয়ে ফেললাম, হারিয়ে ফেললাম”, এই কথা বলতে বলতে শ্রীমতী জোসেরঁ চেয়ারের ওপর নিজেকে ফেলে দিলেন।
--“ওহ্” এইটুকুই বললেন শ্রীমতী জোসেরঁ। তীক্ষ্ণ গলায় আবার বললেন, “কিন্তু তুমি বুঝতে না, আমি তোমায় বলছি যে বিয়ের আরও একটা সুযোগ জলে গেল। এই নিয়ে চতুর্থবার!”
মেয়ের দিকে হেঁটে গিয়ে শ্রীমতী জোসেরঁ আবার বললেন, “তুই শুনতে পাচ্ছিস? আবার কী করে তুই এই বিয়েরও সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিলি?”
ব্যর্ত্ বুঝতে পারলো যে এবার তার বলার পালা।
বিড়বিড় করে বললো, “আমি জানি না, মা”।
“অফিসের ছোটোকর্তা”, মা বলে চললেন, “বয়স এখনও তিরিশ হয়নি, সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। প্রত্যেক মাসেই বাড়িতে টাকা-পয়সা আসবে; হাতে এক্কেবারে আকাশের চাঁদ। এই বাইরে আর কীই-বা চাওয়ার থাকতে পারে... নিশ্চয়ই তুই আবার কিছু বোকামি করেছিস, যেমন করেছিলি অন্য ছেলেদের সঙ্গে?”
--মা, আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি যে, কোনো বোকামিই আমি করিনি।
--নাচতে নাচতে তুই কি ওই ছোট্ট শোওয়ার ঘরে ঢুকে পড়েছিলি?
বিব্রত ব্যর্ত্ বললো : “হ্যাঁ মা ... যখন আমরা একা ছিলাম, তখন উনি আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করতে চেয়েছিলেন। উনি আমাকে চুমু খান আর জড়িয়ে ধরেন। ভয়ে আমি ওঁনাকে আসবাবের দিকে ঠেলে দিই”।
আবার রেগে গিয়ে মাঝপথেই মা বললেন : “আসবাবের দিকে ঠেলে দিয়েছিস? হায় কপাল! কী দুর্ভাগ্য! আসবাবের দিকে ঠেলে দিয়েছিস?”
--কিন্তু মা, উনি যে আমাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন।
--তারপর? তিনি তোকে ধরেছিলেন ... এটা তো চমৎকার ব্যাপার! এ আবার এমন কী খারাপ কাজ? ... দরজার পেছনে একটা চুমু খেয়েছেন! সত্যি বলতে, বাবা-মায়ের সামনে তোর কি এই কথা বলা উচিত? আর তুই লোকজনকে আসবাবের দিকে ঠেলে দিচ্ছিস, আর নিজের বিয়ের বারোটা বাজাচ্ছিস!
বেশ জ্ঞানগম্ভীর গলায় জোসেরঁ বলে চললেন :
“এটা শেষ, আমি আশা ছেড়েই দিলাম। ওরে, তুই একটা বেকুব ... তোর যেহেতু ভাগ্য বলে কিচ্ছু নেই, বুঝলি তো, তোকে তাই অন্যভাবে ছেলেদের পাকড়াও করতে হবে। তোকে বেশ সদয়, বন্ধুত্বপূর্ণ হতে হবে। চোখ হতে হবে স্নিগ্ধ। ছেলেরা গায়ে হাত দিলে কিছু বলবি না, তাদের কিছু বাচ্চাপনাকে না-বোঝার ভাণ করে প্রশ্রয় দিবি; এইভাবে শেষমেষ তোকে একটা বরকে ছিপে তুলতে হবে ... আর যেটা আমাকে সবচেয়ে জ্বালিয়ে মারে সেটা হল তুই নিজে যখন চাস তখন কিন্তু এই কাজগুলো খুব একটা খারাপ করিস না। দ্যাখ, চোখের জল মোছ। আমার দিকে এমন ভাবে তাকা যেন আমি একটা ছেলে আর তোর সঙ্গে কোর্টশিপ করছি। তুই তোর হাতপাখাকে এমনভাবে ফেলে দে যাতে ছেলেটি সেটা কুড়িয়ে তোকে দেওয়ার সময় তোর হাতের আঙুলে আলতো ছোঁয়া লাগে ... আর এই সময় কিন্তু মোটেই কাঠের মতো থাকবি না, বরং কোমরটা যেন নমনীয় থাকে। ছেলেরা কাঠের মতো মেয়েদেরকে পছন্দ করে না। তারা একটু বাড়াবাড়ি করলেও বোকার মতো কিছু করে বসিস না। যে-ছেলে বেশি বাড়াবাড়ি করবে, বুঝবি সেই ধরা পড়েছে”।
বৈঠকখানার ঘরের পেণ্ডুলামে দুটোর ঘণ্টা বাজলো। আর এই শীতযাপনের উদ্দীপনার মধ্যে, মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছায়, মায়ের বিচারবুদ্ধি লোপ পেল। তিনি তখন তাঁর মেয়েকে কাঠের পুতুলের মতো এদিক-ওদিক ঘোরাতে লাগলেন। নরম মনের মেয়েটি তখন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মায়ের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু তার হৃদয় তখন ভারী। ভয় আর লজ্জা তার কণ্ঠরোধ করেছে।
এইভাবেই একজন যুবতী মহিলাকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়রূপে উপস্থাপিত করা হয়। তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয়, বাবা-মা তাঁকে বিবাহ দেন। পুরুষেরা বিবাহ করেন, বিয়ে করে তাঁরা মেয়েদের গ্রহণ করেন। বিবাহের মধ্য দিয়েই পুরুষেরা নিজেদের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা বা প্রসারতার সন্ধান করেন। পুরুষেরা কিন্তু নিজেদের অস্তিত্বের অধিকারের খোঁজ করেন না। এই দায়িত্ব তাঁরা স্বাধীনভাবেই গ্রহণ করেন। তাই মধ্যযুগের এবং গ্রিক স্যাটায়ারিস্টদের মতো পুরুষেরা এর সুবিধা ও অসুবিধার দিকগুলি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। এটা তাঁদের জীবনের একটি পথ মাত্র, কোনো নিয়তি নয়। নির্দ্বিধায় ছেলেরা তাঁদের কৌমার্যের নির্জনতাকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন, অনেকে আবার দেরি করে বিয়ে করেন, অথবা কেউ করেন-ই না।
লেখক : অধ্যাপক
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট
0 Comments
Post Comment