ঘেরাটোপ (পর্ব-১৮)

  • 30 January, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 65 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
পুঁটি ততক্ষণে ওপারের জমিতে নরম ঘাসের উপর লাফিয়ে নেমেছে। সে হাত তুলে মুখভঙ্গি করে কুড়ুনিকে নেমে আসতে উৎসাহ দেয়। কষ্ট সহ্য করতে বলে। কুড়ুনি কি নামতে পারবে? প্রচণ্ড জ্বালা করছে। পিঠের জামাটা যেন ভেজা ভেজা লাগে। রক্ত? কুড়ুনির গা হিম হয়ে আসে। রক্তে বড় ভয় তার। দাঁতে দাঁত চিপে এক ঝটকাতে সে তার শরীরের প্রায় সবটুকুই এবারে জানালার বাইরে বের করে আনে। লাফ দিতে আর দেরি করা চলে না। যন্ত্রণায় যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে তার। ধুপ করে একটা শব্দ হয়। (ধারাবাহিক রচনা, পর্ব ১৮)

[১৮]

 

মাঝরাত্তিরে কুড়ুনির ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। কুড়ুনি মুখে কথা বলতে পারে না, কিন্তু ভয় পেলে বা খুব অবাক হলে ওর মুখ দিয়ে একটা গোঙানির মতো গোঁ গোঁ শব্দ হয়। পুঁটি সেটা জানত। তাই কুড়ুনি চোখ খোলা মাত্র তার মুখের উপর একটা হাত এসে পড়ে। কুড়ুনি কোনও শব্দ করতে পারে না। কেবল বিস্ফারিত চোখে সে পুঁটির দিকে তাকায়। পুঁটি নতুন এসেছে এই আস্তানায়। সবে এক সপ্তাহ কি বড়জোর দশদিন হয়েছে তার। কুড়ুনি এখানে এসে রয়েছে একমাসের উপর। খাওয়াদাওয়া জুটছে একরকম। আরও প্রায় বারো-তেরো জন ওদেরই মতো মেয়ে রয়েছে এই বাড়িতে। সত্যিটা বুঝতে কুড়ুনির দেরি হয়নি। নদীর ধারের মুদির দোকানদার সত্যেন যে এমনই এক জঘন্য কাজের সঙ্গে জড়িত এখানে আসার পরেপরেই কুড়ুনি তা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তখন এই ঘাঁটি থেকে তার পালানোরও আর কোনও উপায় ছিল না।

 

কুড়ুনির সেই নদীর দেশটাকে মনে পড়ে। বাদাবন আর লোনামাটি। হাঁটতে হাঁটতে কাদায় পা ডুবে যেত একেকদিন। মালতী, রানী আর খানিক অচেনা যেন, সেই অন্য লোকটাকেও কুড়ুনির মনে পড়ে। কুড়ুনি তাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারেনি কোনওদিন। যেমনটা কোনওদিন কুড়ুনি মালতীকেও ‘মা’ বলে ডাকতে পারেনি। কিন্তু মালতীর চেয়েও অনেক বেশি করে তার সেই লোকটাকে মনে পড়ে। লোকটা কেমন দেখতে ছিল, চওড়া কাঁধ ছিল তার। পেটানো দেহ ছিল। একেকদিন কুড়ুনিকে সে ঘাড়ের উপরে চাপিয়ে বাঁধ থেকে বাড়ি নিয়ে আসত। সেই ঘাড়ের উপর থেকে কতকিছু যেন দেখত কুড়ুনি। নিজের মনে-মনেই। সত্যেনের দোকানে থাকার সময় মালতীর চেয়ে অন্য লোকটাকেই কুড়ুনির বেশি করে মনে পড়ত। কিন্তু তাই বলে এতখানিও নয়। খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ঘুম পাড়িয়ে কুড়ুনিকে যেদিন কলকাতায় নিয়ে আসা হল, তারপর থেকেই যেন আরও বেশি করে সেই লোকটাকে মনে পড়ছে তার। কলকাতায় কোন এক বিরাট বাড়ির পিছনে অন্ধকার গোডাউনে তাকে কিছুদিন আলাদা করে আটকে রাখা হয়েছিল। কেন, কুড়ুনি তার কারণ জানে না।

 

কথা বলতে পারে না! কুড়ুনির বিবরণ শুনে খেপে উঠেছিল সুতনু। এইসব কাজে বলিয়ে-কইয়ে মেয়েদের প্রয়োজন। মুখে যাদের খই ফুটবে। বাচালতা যাদের চরিত্রে স্বাভাবিক। তেমন মেয়েদেরই এই কাজে দর বেশি। সেখানে কথা বলতে পারে না, হাবা কিনা জানা নেই – সত্যেনের কাছ থেকে কুড়ুনিকে কিনে নিয়ে আসা দালাল লোকটাকে সুতনু যা নয় তাই বলে গালাগাল দিয়েছিল। কেবল নিজের বাড়ি বলে গায়ে হাত তোলেনি। দালাল লোকটা কেবল শান্ত স্বরে সুতনুকে বলেছিল, “আপনি মেয়েটাকে দেখুন একবার।” কি অদ্ভুৎ আত্মবিশ্বাস!

 

এজন্যই কুড়ুনিকে প্রথম কয়েকদিন সেই অন্ধকার গোডাউনে আটকে রাখা হয়েছিল। সব মেয়েকেই প্রথম ওই গোডাউনে নিয়ে এসে তোলা হয়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার ভিতরেই তাদের অন্যত্র, আলাদা আস্তানায় সরিয়ে ফেলা হয়। এই সেই আলাদা জায়গা। পাচারের কাজে প্রধান কারিগর সুতনু মিত্র সরেজমিনে কুড়ুনিকে দেখে নিতে চেয়েছিল বলেই তাকে সরাতে ক’দিন  দেরি  হয়েছিল। দেখাশোনার এই সময়েই সুতনুর ঘরে একদিন কুড়ুনিকে দেখে ফেলে মালতী। কুড়ুনি অবশ্য মালতীকে লক্ষ্য করেনি। সে তখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কেবল সুতনুর দিকেই ঠায় তাকিয়েছিল। সুতনুও সেই হিলহিলে সাপের মতো তার দুটো চোখ দিয়ে কুড়ুনিকে মাপছিল। দু-একবারে বলেছিল, “ঘুরে দাঁড়াও। হেঁটে ওদিকে যাও। পাশে ওই চেয়ারের উপর এক পা তুলে দাঁড়াও। এইবারে এইদিকে তাকাও”, ইত্যাদি। গায়ে হাত দিয়েছিল? কুড়ুনির মনে পড়ছে না। একবার বোধহয় - নোংরা, ঠাণ্ডা একটা হাত – কিন্তু তাও কেবল সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের জন্য। সুতনু মিত্রেরা ঝানু ব্যবসাদার। তারা পা পিছলে কখনও ভুল করে বসে না।

 

পুঁটিকে ওরা কিভাবে তুলে নিয়ে এসেছিল কুড়ুনির জানা নেই। কেবল সে লক্ষ্য করেছিল মেয়েটা শুধু দুরন্তই নয়, রীতিমতো লড়ুয়েও বটে। প্রথমদিকে সে গোঁজ হয়ে থাকত সবসময়। খাবার দিলে খেত না। দু-একবারে পাহারা দেওয়ার লোকগুলোর সঙ্গে আঁচড়ে-কামড়ে রীতিমতো ঝগড়া-মারামারিও বাঁধিয়েছিল। তারপর দু-তিনদিনেই ক্রমশ সে শান্ত হয়ে আসে। সেই প্রথম কয়েকদিনে কুড়ুনিই কেন জানি যত্ন করে পুঁটির জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকত। হাত-পা নেড়ে সেধে খাওয়াতে চেষ্টা করত। পুঁটি রেগেমেগে তার হাত ঠেলে সরিয়ে দিত। তারপর পুঁটি বুঝল এই আস্তানা থেকে আপাতত পালানোর কোনও উপায় নেই। কিন্তু তার চোখেমুখে বুদ্ধি যেন কথা বলত। কুড়ুনি লক্ষ্য করত মেয়েটা শান্ত হয়ে গেলেও সবসময়েই সে যেন কিছু দেখেশুনে, মেপে চলেছে। আর আজ রাত্তিরে হঠাৎ তার এই কাণ্ড।

 

কুড়ুনি মুখে শব্দ করে না। তার চোখের ভাষা পড়ে পুঁটিও সে কথা বুঝতে পারে। সে কুড়ুনির মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়।

 

“পাহারার লোকগুলো সবাই ঘুমোচ্ছে। আমাদের রাতের খাবারে ওরা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। আজ তুমি রাতের খাবার খাওনি। আমিও ফেলে দিয়েছি। এমনিতেও আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। শুধু ভাবছিলাম কিভাবে তোমাকে একদিন বলব রাতের খাবারটা না খেতে। দেখলাম আজ তুমি নিজেই খেলে না। আমার সুবিধে হয়ে গেল। আমিও পিছনের জানলা দিয়ে সব খাবারটা ফেলে দিলাম।” ফিসফিস করে এক নাগাড়ে পুঁটি কথাগুলো বলে যায়। অবাক হয়ে কুড়ুনি শোনে। সবটা বুঝে উঠতে পারে না। আজ তার শরীর ভালো ছিল না একেবারেই। তাই রাতের খাবারটুকু সে খায়নি। চোখে হাত চাপা দিয়ে শুয়েছিল। কিন্তু এই পুঁটি মেয়েটা কি মতলব করেছে! সে কিছুতেই ঠাহর করে উঠতে পারে না।

 

ঘরের লাগোয়া একটা বাথরুম। সেটায় যাওয়ার জন্য দরজাটা আবার ঘরের ভিতরেই। যাতে বাথরুম যাওয়ার জন্য কোনও মেয়ে বারবার পাহারার লোকেদের বিরক্ত না করে।

 

“উপরের ঘুলঘুলিটা অনেক চওড়া। শার্সিটাও ভাঙা। ঠেলেঠুলে বেরতে গেলে একটু গা-হাত পা কাটবে হয়তো, কিন্তু এই জানোয়ারদের হাত থেকে আমরা পালিয়ে যেতে পারব। বাড়িটা একতলা। পিছনে খোলা মাঠ। আমি একদিন উঠে দেখেছি।”

 

উফফ! মেয়েটা কি পাগল! কুড়ুনির মাথা খারাপ হয়ে আসে। ওই আধভাঙা কমোডের উপর উঠে! ভাঙা ঘুলঘুলি দিয়ে! সে আর কিছু ভাবতে পারে না। পুঁটি আবারও তার হাত ধরে টান মারে, “কি ভাবছ কি? হাতে বেশি সময় নেই। চলো এদের হাত থেকে পালাই!”

 

“আহ!” অস্ফূটে কাতর একটা শব্দ।

 

ফাটা ধারালো কাচের বড় অংশগুলো অধিকাংশই সন্তর্পণে তুলে নীচে মেঝেয় নামিয়ে দিলেও, দু’একটা সূচালো ফলার মতো অংশ তবু ঘুলঘুলির ফ্রেমে আটকে রয়ে গিয়েছিল। পুঁটির ছোট্টখাট্টো চেহারায় সেই ঘুলঘুলি বেয়ে বেরতে অসুবিধে না হলেও, উঁচিয়ে থাকা সেই ফলাগুলোর একটাতেই কুড়ুনির পিঠ ঘষড়ে গিয়েছে। চামড়ায় ধারালো স্পর্শ। চামড়া ছিঁড়ে যাচ্ছে। কুড়ুনি দাঁত চিপে থাকে। থমকে আটকে যায়। পুঁটি ততক্ষণে ওপারের জমিতে নরম ঘাসের উপর লাফিয়ে নেমেছে। সে হাত তুলে মুখভঙ্গি করে কুড়ুনিকে নেমে আসতে উৎসাহ দেয়। কষ্ট সহ্য করতে বলে। কুড়ুনি কি নামতে পারবে? প্রচণ্ড জ্বালা করছে। পিঠের জামাটা যেন ভেজা ভেজা লাগে। রক্ত? কুড়ুনির গা হিম হয়ে আসে। রক্তে বড় ভয় তার। দাঁতে দাঁত চিপে এক ঝটকাতে সে তার শরীরের প্রায় সবটুকুই এবারে জানালার বাইরে বের করে আনে। লাফ দিতে আর দেরি করা চলে না। যন্ত্রণায় যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে তার। ধুপ করে একটা শব্দ হয়।

 

ছুট-ছুট-ছুট। কুড়ুনিরা ছুটছে। ঘুরে পিছনে তাকানোরও সময় নেই। কেউ ছুটে আসছে কিনা দেখারও সময় নেই। অন্ধকার মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে দুজনেই পরপর পড়ে যায় কয়েকবার। মাঠ যেন আর শেষ হয় না। কুড়ুনি তার পিঠের যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছে। এভাবে অনেকক্ষণ ছোটার পর তারা পিচঢালা রাস্তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ধুপ করে বসে পড়ে গাছতলায়। রাত অনেক। এভাবে ছুটে আসতে গিয়ে ওরা যে এই অচেনা এলাকায় শেয়াল-কুকুর বা অন্য কোনও রাতচরা জন্তুর সামনে পড়ে যায়নি – ভাগ্যিস! ওরা নিজেরাই হাঁপাতে হাঁপাতে একে-অন্যের দিকে তাকায়। দুজনেরই মুখে ঘাম। বুকদুটো হাপরের মতো উঠছে আর নামছে। এতক্ষণে তার পিঠের জ্বালাটা টের পায় কুড়ুনি। “আহ!” সে কাতরে ওঠে আবার। “দেখি, দেখি একবার!” হাঁপাতে হাঁপাতেই পুঁটি আবারও উঠে দাঁড়িয়ে সটান কুড়ুনির পিঠের দিকে চলে যায়, “ইসস! একি! এ যে রক্তে একেবারে ভেসে যাচ্ছে!” এটুকু বলার অপেক্ষা কেবল। কুড়ুনিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের পরনে থাকা ফুলহাতা ফ্রকের দুটো হাতাকেই একটানে ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলে পুঁটি। “একটু জল,” বলে সে কান পেতে কিছু যেন শুনতে চেষ্টা করে। “রাস্তার ওপারে জল আছে,” পুঁটি একছুটে রাস্তা পেরিয়ে যায়। খানিক পরে ভেজা কাপড়ের টুকরো দুটোকে হাতে নিয়ে সে এপারে ফিরে আসে। কুড়ুনির মাথা ঝিমঝিম করছে।

 

জলের শব্দ সেও যে কানে পায়নি তা নয়। কিন্তু সেই অনুভূতি যে এতটাই ক্ষীণ, এতটাই আত্মকেন্দ্রিক, যে সজাগ হয়ে তাকে লক্ষ্য করা, এমন এক অবস্থায় মনস্থির রেখে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কুড়ুনির মাথা এতটাও পরিষ্কার নয়। সে বিস্ময়ের চোখে ছোট্ট পুঁটির দিকে তাকায়। একটা কাপড় দিয়ে কুড়ুনির পিঠে রক্তের জায়গাটা পুঁটি ভালো করে চেপে মুছিয়ে দেয়। তারপর অন্য হাতাটা পিঠ থেকে বগলের তলা দিয়ে কুড়ুনির বুকের সামনে অবধি নিয়ে এসে আবারও ঘুরিয়ে সে মোটামুটি শক্ত ধাঁচের একটা ব্যাণ্ডেজ করে দেয়। “একটু ভালো লাগছে কি এবার?” কুড়ুনি ফ্যালফ্যাল করে মেয়েটার দিকে চেয়ে থাকে। তার চোখে জল?

 

সেই জল যেন ঠিক যন্ত্রণার নয়। ভয়ানক শারীরিক ও মানসিক চাপের পর মেঘ ভেঙে যখন হুড়মুড়িয়ে মাথার উপর বৃষ্টি নামে, হঠাৎ করেই মাটির অভ্যন্তর থেকে জেগে ওঠে নতুন শিকড়, সেই জল যেন ঠিক একইরকম কোনও আগমনী বরষার গান। কুড়ুনি আর পুঁটি, দুজনে একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। কান্নায় দুজনেরই শরীর হু হু করে কেঁপে ওঠে কয়েকবার।

 

(চলবে)

 

আগের পর্বের ঠিকানা – https://nariswattwo.com/welcome/singlepost/the-siege-serialised-novelette-series-seventeen-

লেখক : বিজ্ঞানী, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক 

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment