ঘেরাটোপ (পর্ব-১৭)

  • 11 January, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 58 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সুস্মিতার নিজের প্রতি ঘৃণা জাগে। যেদিন পাকাপাকি ভাবে ওয়েস্টার্ন এজ ছেড়ে চলে আসবেন বলে সুরেশকে জানিয়েছিলেন, সুরেশ সহাস্যে বলেছিলেন, “এদেশে মিউচুয়াল ডিভোর্স পাকাপাকি হতে কত বছর লেগে যায় তুমি জানো না ডিয়র। আই উইল ড্র্যাগ ইউ থ্রু ইট! বরং এই এ্যাফেয়ারটাকে তুমি এ্যাকসেপ্ট করে নিতে পারতে।” “এ্যাকসেপ্ট!” রাগে গালাগালি বেরিয়ে গিয়েছিল সুস্মিতাশ্রী পনিরসেলভমের। আবারও হেসেছিলেন সুরেশ, ‘তুমি হেলায় তোমার যেটুকু ছিল সেটুকুতেও লাথি মেরে চলে যাচ্ছ।” (ধারাবাহিক রচনা, পর্ব ১৭)

[১৭]

নিশ্চুপে নিজের ডেস্কে বসেছিলেন সুস্মিতাশ্রী পনিরসেলভম। এমনিতেও তিনি বেশ সকাল সকালই অফিসে পৌঁছনোর চেষ্টা করেন। আজ কি কারণে যেন তিনি তার চেয়েও অনেক তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন। এমনকি যে সবচেয়ে আগে অফিসে চলে আসে, সেই রাজীবও কি না এখনও অবধি এসে উঠতে পারেনি। সুস্মিতাশ্রী নিজের মনে ভাবছিলেন। মাস বদলে যায়। তারিখও বদলে যায়। এত তাড়াতাড়ি যে পরের তারিখটা এসে পড়বে তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। দরজা ঠেলে ঢুকে এসেছে রাজীব।

 

 

 

-“ম্যাম আসব?” সুস্মিতাশ্রী মুখ তুলে তাকান।

 

 

 

ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলেন। “এত সকালে চলে এসেছেন?” রাজীব ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে, “কিছু হয়েছে? সব ঠিক আছে তো ম্যাডাম?” তার গলায় চাপা উদ্বেগ। সুস্মিতাশ্রী মৃদু হাসেন। “সব ঠিকই আছে রাজীব। বরং তুমি বলো আমায়। বোম্মাইয়ের কেসটার কি আপডেট? আর কি কিছু এগোলো?” রাজীব বোঝে সুস্মিতা প্রশ্ন এড়াচ্ছেন। তবু সে জোর করে না। “বোম্মাইয়ের কেসটা তো ঠিকই আছে ম্যাডাম,” রাজীব বলতে শুরু করে, “পূর্ণিমার লম্বা জামিন মঞ্জুর হয়ে গেছে। তাছাড়া আয়েঙ্গাররাও শুনলাম অভিযোগ তুলে নেবার কথা ভাবছে। যাতে জটিলতা না বাড়ে। কারণ, এই এক সপ্তাহেই আমরা কাস্ট-বেসড ভায়োলেন্স বা ডিসক্রিমিনেশন নিয়ে তিনটে আলাদা বড় স্টোরি পাবলিশ করেছি। তিনটেতেই খুব ভালো রিডার্স রেসপন্স। এবারে এর আগে থেকেই এই সিরিজের প্রথম স্টোরি হিসেবে আমরা পূর্ণিমার কেসটা নিয়ে এসেছি। সরাসরি আমরা আয়েঙ্গারদের, বা কোনও স্টোরির ক্ষেত্রেই লিগাল ইস্যুজ থাকলে এক্সপ্লয়টারদের নাম করছি না। তবু সকলেই তো খবর রাখে। আয়েঙ্গারদের পাবলিক ইমেজ এমনিতেই পড়ে গেছে। এখন ওরাও তাই এখান থেকে বেরতে চায়। আমরা আমাদের কাজটা ভালো ভাবে করতে পেরেছি ম্যাম!” রাজীব খানিক উৎসাহিত স্বরেই বলা শেষ করে। সুস্মিতাশ্রী জানালার দিকে তাকান।

 

 

 

হ্যাঁ, রাজীবকে এভাবেই গড়েপিটে নিতে চেয়েছিলেন সুস্মিতাশ্রী পনিরসেলভম। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তোমার মাথা থেকে প্রতিশোধ নেবার সেই ভূতটা নেমেছে তাহলে?” রাজীব মাথা নামিয়ে নেয়, “হ্যাঁ ম্যাডাম।” অস্ফূটে সে জবাব দেয়। এইবারে সুস্মিতাশ্রী তার দিকে তাকান, “আমারও আজ হিয়ারিংয়ের ডেট রয়েছে।” রাজীব চকিতে মাথা তুলে তাকায়।

 

 

 

সবটাই তার জানা ছিল অনেক আগে থেকেই। তাই কোথাও যেন পূজা আয়েঙ্গারের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত আক্রোশ জেগে উঠেছিল। নিজের কিউবিকলে বসিয়ে শেষমেশ রাজীবকে বুঝিয়েছিলেন সুস্মিতাশ্রী পনিরসেলভম। বুঝিয়েছিলেন সাংবাদিকতার জগতে ব্যক্তিগত আক্রোশের কোনও জায়গা নেই। সত্যিটুকু ছাড়া আর কোনওরকমেই কোনও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, ধারণা একজন সাংবাদিকের কাজকে প্রভাবিত করতে পারে না। একজন সাংবাদিককে কেবল নিরপেক্ষ হতে হয়। সমস্ত প্রসঙ্গেই। এসব কথা বলতে বলতে তিনি নিজের মনেই হেসেছিলেন। চারপাশে যা সব দেখা যায়। গোটা দেশজুড়েই সাংবাদিকতার নামে যে প্রহসন, ফাজলামি, চাটুকারিতার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা আজ। সুস্মিতার নিজেকে বড় হতাশ মনে হয়। তবু তিনি রাজীবদের মতো একেকজনকে গড়েপিটে নিতে চেষ্টা করেন। বড় আশা নিয়ে সেই চেষ্টা জারি রাখেন তিনি। রাজীব জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি তাহলে বেরিয়ে যাবেন এখন? এয়ারপোর্ট যেতেও তো সময় লাগবে। গাড়ি কি বলা আছে আপনার?” সুস্মিতাশ্রী ঘাড় নাড়েন। “তোমায় ব্যস্ত হতে হবে না। আমি যাচ্ছি না আজ।” তিনি জবাব দেন। এইবারে অবাক হয় রাজীব।

 

 

 

-“আপনি যাবেন না আজ?” সে জিজ্ঞেস করে। “আসলে কি জানো তো, মাঝে মাঝে বড় ক্লান্ত মনে হয়,” সুস্মিতাশ্রী জবাব দেন। “এতকিছুর মধ্যে আমারও খেয়াল ছিল না যে ডেট এসে পড়েছে। পরশুই দেখলাম এই ব্যাপার। তারপর কথা বললাম আমার ওখানে যিনি লইয়ার আছেন তাঁর সঙ্গে। উনি বললেন, আমার আসার দরকার নেই। প্রয়োজন হলে উনিই বরং ডেট চেয়ে নেবেন। এমনিও ব্যাপারটা নাকি অনেকটাই মিটে এসেছে। হয়তো আজকের হিয়ারিংয়েই ফাইনাল ভারডিক্টও হয়ে যেতে পারে। দেখা যাক।” শ্বাস পড়ে সুস্মিতার। তিনি বলেন, “একটু কফি বলবে রাজীব?” তাঁর গলা খসখস করে। রাজীব ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে যায়। কফি বানাতে বেশি সময় লাগবে না।

 

 

 

কতগুলো বছর। কতগুলো দিন। সুস্মিতাশ্রীর সব কেমন জানি স্বপ্নের মতো মনে হয়। নাকি দুঃস্বপ্ন বলা উচিত? সুবর্ণ ওয়েস্টার্ন এজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল যখন, সুস্মিতাশ্রী খুব করে চেয়েছিলেন সে যেন সুরেশ মানসুখানির বিরুদ্ধে থানায়, অথবা ওয়েস্টার্ন এজের এইচ-আর বা এ্যাডমিনের কাছেও অন্তত একটা অভিযোগ দায়ের করে যায়। আইনের দিক দিয়ে সেসময় সুবর্ণ সবদিক দিক দিয়েই যে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল কেবল তাই নয়, তার তরফে সেদিন সেই অভিযোগ দায়ের হলে পরে সুস্মিতাশ্রী নিজেও পারতেন অনেক সহজেই সুরেশ মানসুখানির সঙ্গে একতরফা বিচ্ছেদ পাকা করে ফেলতে। অনেকদিন ধরেই তিনি যে বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছিলেন। বন্ধন ছাড়া যে পরিচয়কে আর কিছুই ভাবা যাচ্ছিল না তখন।

 

 

 

সুরেশের বিষয় কানাঘুষোয় অনেক কথা শুনলেও, সুস্মিতাশ্রীর হাতে তেমন কোনও প্রমাণ ছিল না। অথচ সুবর্ণ চলে যাওয়ার পর কেবল তখনই সুস্মিতাশ্রী সুরেশের নতুন সম্পর্কের কথা জানতে পারেন। টাকার লোভ মানুষকে অনেকখানি নামিয়ে দেয়। আয়েঙ্গার পরিবারের সঙ্গে সুরেশ-সুস্মিতার আলাপ ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই। ওয়েস্টার্ন এজে প্রথমে সাধারণ বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবেই আয়েঙ্গারদের কোম্পানি যুক্ত হলেও, পরবর্তীতে তারা সরাসরি ওয়েস্টার্ন এজে প্রধান লগ্নিকারী হিসেবে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। আর সেই সূত্রেই সুরেশ মানসুখানির কাছাকাছি পৌঁছে যায় পূজা আয়েঙ্গার।

 

 

 

অবাক মনে হয় সুস্মিতার। নিজের প্রতি ঘৃণা জাগে। যেদিন পাকাপাকি ভাবে ওয়েস্টার্ন এজ ছেড়ে, এমনকি মুম্বাই ছেড়ে আসবেন বলে সুরেশকে জানিয়েছিলেন, সুরেশ সহাস্যে বলেছিলেন, “এদেশে মিউচুয়াল ডিভোর্স পাকাপাকি হতে কত বছর লেগে যায় তুমি জানো না ডিয়র। আই উইল ড্র্যাগ ইউ থ্রু ইট! বরং এই এ্যাফেয়ারটাকে তুমি এ্যাকসেপ্ট করে নিতে পারতে।” “এ্যাকসেপ্ট, মাই ফুট!” রাগে মুখ দিয়ে গালাগালি বেরিয়ে গিয়েছিল সুস্মিতাশ্রী পনিরসেলভমের। আবারও হেসেছিলেন সুরেশ, ‘ইউ আর নট গেটিং দ্য পয়েন্ট ডিয়র,” সামনে রাখা মদের গেলাসে চুমুক দিয়ে কাটা কাটা উচ্চারণে সুরেশ বলে গিয়েছিলেন, “এই মামলাটা  যতদিন যা চলার চলবে। বাট দেন, আফটার ইট গেটস ওভার, আই উইল ম্যারি পূজা আয়েঙ্গার ইন ড্যু কোর্স অব টাইম, এ্যাণ্ড শি উইল ইনহেরিট মাই রিচেস। তুমি হেলায় তোমার যেটুকু ছিল সেটুকুতেও লাথি মেরে চলে যাচ্ছ।” “ইউ আর সো ড্রাঙ্ক!” দাঁতে দাঁত চিপে কেবল এই কটি কথা বলে বেরিয়ে এসেছিলেন সুস্মিতা। পরে বুঝেছিলেন কথাগুলোয় ভুল ছিল না। সুরেশ মানসুখানির মতো লোকেরা নেশায় ভোলে না। তাঁদের মস্তিষ্ক এতটুকুও অসাড় হয় না কোনও সময়।

 

 

 

সেই থেকে এতগুলো বছর। সুরেশের সঙ্গে পূজার অভিসারে বাধা পড়েনি কোথাও। কেবল সুস্মিতার চেন্নাই থেকে মুম্বাই দৌড়ঝাঁপ চলেছে। মামলা গড়িয়েছে। ‘তারিখ পে তারিখ’ সংলাপের সম্পূর্ণ মর্মার্থ বোঝা হয়ে গিয়েছে তাঁর। অন্যদিকে তিলে তিলে গড়ে তোলা তাঁর নতুন সন্তান, ‘ভয়েসেস’ কাগজে প্রথম দিন থেকে জুড়ে থাকা রাজীব, আজকের সিনিয়র জার্নালিস্ট রাজীব মুরুগান, সেই রাজীবকে তিনি ওয়েস্টার্ন এজ থেকেই প্রথম এখানে নিয়ে এসেছিলেন। সবেমাত্র ওয়েস্টার্ন এজে সেসময় কাজে যোগ দেওয়া রাজীব কি কারণে যেন মুম্বাইয়ের নামী কাগজ ছেড়ে সুস্মিতাশ্রীর নতুন কাগজে আসতে এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। হয়তো নিজের রাজ্য, নিজের শহর, চেন্নাইতে ফিরে আসার কথা ভেবেই। অন্তত সুস্মিতাশ্রীও প্রথম সেইটিই ভেবেছিলেন। ক্রমশ নিজের ব্যবহার আর কাজের দক্ষতায় সুস্মিতাশ্রীর কাছের লোক হয়ে উঠেছিল রাজীব। পূজা আয়েঙ্গারকে সে এর আগেও দেখেছে।

 

 

 

ওয়েস্টার্ন এজের অফিসে সুরেশ মানসুখানির সঙ্গে একাধিকবার পূজাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিল রাজীব। কিন্তু জুনিয়র এ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে সেসময় মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি। এমনকি সুস্মিতাকেও নয়। তবু কোনও ভাবে কি সেই কারণেও তার ওয়েস্টার্ন এজ ছেড়ে এক কথায় ‘ভয়েসেস’এ চলে আসা? সুস্মিতাশ্রী কোনওদিন তাকে সরাসরি এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করেননি। কেবল বোম্মাইয়ের খবরটা যেদিন প্রথম জেনে এসে রাজীব ‘ভয়েসেস’এ পাবলিশ করতে চেয়েছিল, সুস্মিতাশ্রী স্পষ্ট দেখেছিলেন তার চোখে বিদ্বেষ জ্বলজ্বল করছে। কারণ বুঝতে পেরে তিনি প্রমাদ গুণেছিলেন। সৌভাগ্য, রাজীব কথা শুনেছিল তাঁর। রাজীবকে নিয়ে তাই আজ স্পষ্টতই সুস্মিতা গর্ববোধ করেন।

 

 

 

রাজীব কফি নিয়ে এসেছে। সুস্মিতাশ্রীর ফোন বেজে ওঠে হঠাৎ।

 

 

 

ফোনে কথা বলতে বলতে কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসে সুবর্ণ। কোনও ভাবেই মালতীর জামিন মঞ্জুর করানো যাচ্ছে না। এদিকে পুলিশের তরফেও অসহযোগিতা চরমে। শেষমেশ আজ কেবল এটুকু অনুমতি বের করা গেছে যে, প্রতিদিন বিকেলে নির্দিষ্ট কোনও এক সময় জেল সুপারের চেম্বার থেকে মালতী মেয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে পারবে। হাতে হাতে কোর্ট থেকে সেই অর্ডার নিয়ে এখন সুবর্ণকেই সেই হোমে ছুটতে হবে যেখানে আপাতত রানীকে ‘সেফ কাস্টডি’ হিসেবে রাখা হয়েছে। কেবল সুখেন যাবে তার সঙ্গে। সুবর্ণ আইনজীবী ভদ্রলোকের সঙ্গে কাজ মিটিয়ে নেয়। তারপর সোনালী সামন্তকে ফোন করে আপডেট দেয় সবকিছুর। সোনালীদিও যে এতটা কো-অপারেট করবে সে ভাবতে পারেনি। মালতীর হিয়ারিংয়ের দিনগুলোয় সুবর্ণের অন-ফিল্ড এ্যাসাইনমেন্ট ফ্রি রেখে দেওয়া হয়। যাতে নিজের মতো করে মালতীর কেসটাকে সে ফলো-আপ করতে পারে। সোনালী সামন্তের বক্তব্য, সবকিছুরই ডকুমেন্টেশন চলতে থাকুক। কেবল পাবলিকেশনের সময়টা, সুযোগ বুঝে ঠিক করে নিতে হবে। সকলেই মনে মনে যেন একটা কোনও ব্রেক-থ্রু’র অপেক্ষায়। মালতীর আইনজীবীর খরচ আপাতত সুবর্ণ নিজে কিছুটা দিচ্ছে, আর কিছুটা অংশ ডেইলি রিভিউয়ের তরফে দেওয়া হচ্ছে। কোর্ট থেকে বেরিয়ে সুবর্ণ একবার আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। মেঘের আড়ালে রূপোলী রঙ। সুদীপ সেনগুপ্তকে আজ আর কোর্ট চত্বরে দেখা যাচ্ছে না। হাত নেড়ে সুখেনকে কাছে ডাকে সুবর্ণ। “উবের এসেছে?” সে জিজ্ঞেস করে। না-বাচক ঘাড় নাড়ে সুখেন। দুজনে ফুটপাথে দাঁড়ায়। চন্দনকে ফোন করে সুবর্ণ। “বকুল ফিরেছে?” ওদিক থেকে কি উত্তর আসে শোনা যায় না। ঘাড় নাড়ে সুবর্ণ, “আচ্ছা। দেখো আর কিছুক্ষণ। হয়তো কোনও কারণে আজ ফিরতে একটু দেরি হচ্ছে। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা।” সুবর্ণের গলা স্বাভাবিক, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সন্ধ্যের মধ্যেই ফিরব,” সে চন্দনকে আশ্বস্ত করে। ফোন রেখে দেয়।

 

 

 

সুস্মিতাশ্রীর মুখটা ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য হয়ে এসেছে। মানুষ এতটাও সুযোগসন্ধানী, নিষ্ঠুর হয়! আবারও ফোন বাজছে। নামটা দেখে রাগে-বিরক্তিতে অন্ধ হয়ে প্রায় ফোন কেটে দিতে ইচ্ছে হয় সুস্মিতার। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি ফোন রিসিভ করেন। হাসছেন সুরেশ। ফোনের ওপাশে হাসি খলবলিয়ে উঠছে তাঁর।

 

 

 

-“এফআইআর’এর কপিটা পেয়েছ তো তাহলে? হ্যাঁ? কি হল – প্রাক্তন মিসেস মানসুখানি, নাকি বলব বর্তমানের মিস ফায়ারব্র্যাণ্ড পনিরসেলভম?” তাঁর গলায় স্পষ্ট ব্যঙ্গের সুর। মুম্বাইয়ের আদালতে সুরেশ-সুস্মিতার ডিভোর্স মামলা চলাকালীন হঠাৎই আজ নতুন করে সময় চেয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারপতির কাছে সুরেশের আইনজীবী বেশ কিছু বিশেষ নথি-কাগজ আদালত তথা বিচারপতির এজলাসে দায়েরের অনুমতি চান। এরপর আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে তিনি বেশ কিছু দরকারি নথি ও কিছুদিন আগে ওয়েস্টার্ন এজ পত্রিকারই তরফে রুজু করা নির্দিষ্ট পুলিশি এফআইআর’এর একখানি হুবহু প্রতিলিপি এজলাসে পেশ করেন। দেখা যায় তাতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক অডিটের পর ওয়েস্টার্ন এজের আর্থিক তহবিলে নাকি বিরাট পরিমাণ তছরুপের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। আর, অবাক হওয়ারও কোনও অবকাশ নেই – সেই তছরুপের পিছনে মূল কাণ্ডারী হিসেবে সুস্মিতাশ্রী পনিরসেলভমকেই নাকি সংস্থার তরফে সন্দেহ করা হচ্ছে। যেহেতু ওয়েস্টার্ন এজের প্রায় সমস্ত সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বরাবরই জড়িয়ে থেকেছেন, এবং এরপর এই তদন্ত বা তার ফলাফল, সেই সংক্রান্ত কোনও সুপারিশ যাতে সকলের সামনে আসার আগেই তিনি নিজের আখের গুছিয়ে কেটে পড়তে পারেন, সে কারণেই সুস্মিতাশ্রী নাকি সুরেশের কাছ থেকে তড়িঘড়ি ডিভোর্স আদায় করে নিতে উৎসাহী হয়ে পড়েন। স্বভাবতই এর ফলে ডিভোর্স মামলাটিও আগের চেয়ে অনেকাংশে বেশি জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

 

ফোনের ওপারে তখনও হেসে চলেছেন সুরেশ। ফোন কেটে দেন সুস্মিতাশ্রী পনিরসেলভম। এ যেন এক অদ্ভুৎ ঘেরাটোপের মধ্যকার জগৎ। দু-একবার জোরে জোরে শ্বাস নেন তিনি। হেরে গেলে চলবে না। সুস্মিতাশ্রী হেরে যাওয়ার কথা ভাবতে শেখেননি। তিনি বরং কফি শেষ করে সারাদিনে তাঁর কাজগুলোকে পরপর তালিকা ও গুরুত্ব অনুসারে ভাগ করে নিতে শুরু করেন।

 

 

 

(চলবে)

 

 

 

আগের পর্বের ঠিকানা – https://nariswattwo.com/welcome/singlepost/the-siege-serialised-novellete-series-sixteen

 

লেখক : বিজ্ঞানী, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment