- 15 April, 2025
- 0 Comment(s)
- 118 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
[২২]
স র গ ম প ধ ন স
স ন ধ প জ্ঞ গ র স
ইমন কল্যাণ। সাঁঝবেলাকার রাগ। মূল কল্যাণের সঙ্গে এর সূক্ষ একটি পার্থক্য রয়েছে। কল্যাণে তীব্র মধ্যম ভিন্ন অন্য মধ্যমের ব্যবহার নেই। বিপরীতে ইমনে এই দুই মধ্যমেরই ব্যবহার সিদ্ধ। এই রাগে আরোহের সময় শুদ্ধ, ও অবরোহে তীব্র মধ্যমের ব্যবহার। একমনে সুর সাধতে সাধতে ছেলেটির এসবই মনে পড়ছিল। সেই কোন কিশোরবেলায় ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া জমির একপাশে, মলমলে ঘাসের উপর তাকে বসিয়ে রেখে বৃদ্ধ উস্তাদ তানপুরায় গলা ভাঁজতেন। পাহাড়ি, সাঝগিরি, মালগুঞ্জি। সেসব রাগের কতরকম যে নাম। ছেলেটি তন্ময় হয়ে শুনত, আর আজ এই একফালি ঘরের ভিতর – দুর্গন্ধময় চারপাশ। দেওয়ালের হুক থেকে ময়লা কাপড় ঝুলছে। টেবলের উপর ডাঁই হয়ে পড়ে থাকা টুকিটাকি জিনিস। ওপাশের খাটে অন্য আরেকটি লোক। যে কোনও দিকে তাকালেই বিতৃষ্ণা জাগে কেমন। ছেলেটি জানে ওই ওপাশের লোকটির নামে অন্তত সাতটা খুনের চার্জ রয়েছে। একাধিক রাজ্যের পুলিশের খাতায় তার নাম রয়েছে। এসব ওই লোকটিই তাকে বলেছে। তবু ছেলেটি জানালার পাশে বসে ইমনের সুর তোলে। পাশাপাশি অনেক দিন থাকতে থাকতে দুজনেই দুজনের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তার মনে পড়ে দিল্লির সেই ‘প্রতিযোগিতা’র মাঠ। হোয়াটস্যাপ গ্রুপের মেসেজগুলোর সঙ্গে, এই পুরো বিষয়টার সঙ্গে ক্রমশ ছেলেটি নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। দিনের শেষে রোজগারের অর্থ জুটছে তার।
সত্যিই তো দেশের জনসংখ্যা যদি ওই, ওদের কারণেই, এতখানি না বাড়ত – মনে মনে ছেলেটা প্রায় বিশ্বাস করে ফেলে, আর তারপরেই যেন কানে আবারও সেই তীব্র মধ্যমের স্বর। ছেলেটার সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকে। আগামীকাল প্রথম এ্যাকশনের দিন। শাসিয়ে-ধমকিয়ে-চমকিয়ে, একেবারে হিসেবে রাখতে হবে ‘ওদের’। তাছাড়াও, ছেলেটার মনে কিসের যেন অস্বস্তি হয়। তীব্র মধ্যমের স্বর। আজ যেন ঠিক মতো লাগছে না কোথাও। বারেবারেই ভুল হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা গান থামিয়ে দেয়। লোকটা উঠে এসে তার পাশে বসেছে।
জানালার বাইরে তাকিয়ে ছেলেটি দেখল শহরজোড়া যেন এক কনে-দেখা-আলোর বাহার। আশ্চর্য মায়াবী সেই হলুদ রঙ। আকাশ থেকে যেন অজস্র ফুল ঝরে পড়ছে শহরের উপর। ছেলেটার পিঠে একটা হাত পড়ে। সেই লোকটার হাত। হাতে এতটুকুও রক্তের গন্ধ নেই।
“আমি যদি ঠিকমতো খেতে পেতাম জানিস, ঠিকমতো পড়ালেখা করতে পারতাম, তাহলে,” লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছেলেটার মনে হয় ভারতের বেশীরভাগ মানুষের জীবন – বেশীরভাগ ‘অপরাধী’রই জীবন, হয়তো এইরকম। লোকটা নিজের ছেলেকে স্কুলে পড়াতে চেয়েছিল। বুকে আগলে তাকে বড় করতে চেয়েছিল। কিন্তু কিসব যেন গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ে লোকটার চাকরি চলে যায়। তারপর, কোনও রাজনৈতিক দলের আশায়, নেতার আশ্বাসে লোকটা একসময় তাদের হয়ে খুনোখুনি-মারামারিতে জড়িয়ে পড়তে থাকে। ‘দলের হয়ে কাজ’। যেমন বলে মানুষজন। লোকটা বিক্রি হয়ে যায়। ঠিক এইভাবেই। আস্ত মানুষ একেকজন, এভাবেই এদেশে বিক্রি হয়ে যায়। কেউ টের পায় না। শেষমেশ প্রথম যে নেতাটি ওকে ব্যবহার করেছিল লোকটা তার উপর প্রতিশোধ নেয় ঠিকই, কিন্তু ততদিনে খুন করা ছাড়া আর সব কাজ সে করতে ভুলে গেছে। সে কেবল খুন করতে পারে এখন। তবু সে কান পেতে ছেলেটার গান শোনে। বাইরে হলুদ ফুল এখনও অবিরাম ঝরে পড়ছে। “গান থামাসনি ভাই,” ফিসফিস করে লোকটা বলে ওঠে। বাইরে থেকে কড়া নাড়ছে কেউ। তীব্র মধ্যমের স্বর ফিকে হয়ে আসে। ফুল পড়া বন্ধ হয়ে যায়। দুজনে উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্য আরেকজন ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে। তার এক হাতে খোলা পিস্তল। অন্য হাতে থলির ভিতর আরও কিছু নিষিদ্ধ বস্তু দেখা যায়।
খাড়াই পথ বেয়ে বাহার স্কুটিতে চেপে উঠে আসছে। উৎসব এদেশের মানুষের কাছে এখন আশঙ্কার সময়। যখনই দেশে বেরোজগারি, দুর্নীতি, শাসকের অন্যায় কীর্তিকলাপ, এসব নিয়ে আলোচনা প্রবল হয়ে ওঠে – তখনই জায়গায় জায়গায় রাজনীতির কারবারিরা পালটা ‘ধর্ম’-পালনের উৎসবে ব্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে। রাখী, বাহার, সুবর্ণ, এরা সবাই এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল। কাল তেমনই এক উৎসবের দিন। বিকেলে বাহার ভালোমন্দ কিছু খাবার নিয়ে আসে। হলদোয়ানি ট্রিবিউনের অফিস। প্রতিদিনের চা-পকোড়ার সঙ্গে আজ কিঞ্চিৎ প্যাটিস-পেস্ট্রির আয়োজন। রাখীর অবশ্য কফি ছাড়া আর কিছুই চলেনা। কফিতে চুমুক দিতে দিতে সে বলে ওঠে, “কাল কিন্তু এ্যালার্ট থাকতে হবে আমাদের। বেশ কয়েকটা মিছিল, পালটা মিছিলের সম্ভাবনা আছে। কোথাও কোনও আনরেস্টের খবর পেলেই,” বাহার ওর পিঠে হাত রাখে। “ভাই রেহনে দো না আজ। মারপিট-খুনখারাপির কথা নাহয় কাল দেখা যাবে আবার। সিচুয়েশন ভালো নয় জানি। তবু আজ আমরা একটু খুশহাল মানাই?” রাখী হাসে। সে জানে কাল কোন বিশেষ সম্প্রদায়েরই উপাসনাস্থলের সামনেটায়, ক্রমশ উন্মাদ হয়ে নারকীয় উল্লাস ফেটে পড়বে বারংবার। পালটা কোনও উত্তেজনার দায় কার হাতে গিয়ে পড়বে? সেও নতুন করে কিছু ভাবতে চায় না। অজান্তেই সে বাহারের হাত নিজের হাতের ভিতরে নেয়। এই সামান্য ভালোবাসাটাকে দুঃসাহসী, অথবা ব্যতিক্রম বলে ভাবতেও সে অস্বীকার করে।
বাহার অবাক হয়ে যায়। আওয়াজটা শোনার পর একবার মাত্র সে নিজের ধবধবে সাদা জামাটার দিকে তাকায়। ক্রমশ বড় হয়ে উঠতে থাকা একটা লাল ছোপ। ছেলেটা ভাবতে পারে না, কখন সে তার নিজের হাতের অস্ত্রকেই এভাবে ব্যবহার করে ফেলেছে। নির্দ্বিধায়। আকাশ থেকে অঝোরে নেমে আসছে রক্তস্রোত। অথচ সেই রক্তে কারোরই শরীর ভিজছে না। দেবতার আশীর্বাদ। টাঙ্গির আরেকটা কোপ। পিছন থেকে আরেকবার।
পুলিশের কিছুই করার ছিল না। পুলিশের কখনই কিছু করার থাকে না। হলদোয়ানির সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনেটায় থিকথিকে মানুষের ভিড়। সুহানিকে নিয়ে রাখী যখন সেখানে পৌঁছল ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিজি, উত্তরাখণ্ড এসে পৌঁছবেন। পুলিশ ভিড় সামলাতে ব্যস্ত। প্রেস-মিডিয়ার ভিড়। এলাকার সাংসদ-বিধায়ক সকলেই এসে গেছেন। তাঁরা ভিতরে রয়েছেন। রাখীকে দেখে স্থানীয় থানার আইসি জায়গা করে দেন। “ম্যাডাম, আপনি এইদিকটায় আসুন প্লিজ।” লোহার ব্যারিকেড পেরিয়ে হাসপাতাল চত্বরে পা রাখতেই ক্রমশ যেন এক অদ্ভুৎ নিস্তব্ধতা। রাখীর চোখে পড়ে চত্বরের একপাশে দাঁড়িয়ে, দুপাশে দুই ধর্মের দুজন উপাসককে খাড়া কাঠপুতুলের ন্যায় দাঁড় করিয়ে রেখে স্থানীয় বিধায়ক ক্যামেরার সামনে শান্তির সপক্ষে লম্বাচওড়া বক্তব্য রেখে চলেছেন। ফটোফ্রেমে সাজানোর মতো মুহূর্ত। রাখী কিছু বলতে পারে না। তার সমস্ত শরীর প্রতিরোধে চিৎকার করে উঠতে চায়। তার শরীরে আর এতটুকুও শক্তি নেই।
রাখীর বড় ঠাণ্ডা লাগছে। এর আগে সে কখনও মর্গের ভিতরে ঢোকেনি। এই তার প্রথমবার।
মর্গ থেকে বেরতেই রাখী মনোহরলালের মুখোমুখি পড়ে যায়। মুখে তাঁর স্পষ্ট ধূর্তামির ছাপ।
-“কী থেকে যে কী হয়ে গেল রাখীজি, হাঁ!” মনোহরলাল কাঁপা গলায় বলেন, “আমার মুখে আজ আর সান্ত্বনার ভাষা নেই!” রাখী ঘাড় নাড়ে। সে পালটা তর্ক করতে চায় না। তার চারপাশটা ক্রমশ কঠিন শীতলতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। সে মনোহরলালের দিকে তাকিয়ে মাথা নোয়ায় একটিবার। সুহানি তাকে পাশ থেকে ধরে আছে। থানার আইসি আরও একবার এগিয়ে আসেন, “ম্যাডাম আপনি কী তাহলে?” আবারও ঘাড় নাড়ে রাখী। মৃদু স্বরে বলে, “হ্যাঁ। ঠিকই আছে। আমিই আইডেন্টিফিকেশন পেপারে সই করব। ওর বাবা-মাকে আমরা জানিয়ে দিয়েছি। দে উইল বি হিয়র বাই লেট টুনাইট।”
হঠাৎ রাখীর চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসে। আর কিছু মনে পড়ে না তার।
অনেক রাত। হাসপাতালের বাইরেটায় ভিড় কমে এসেছে। রাখীর পরিবার, বাহারের মা-বাবা, ওর ছোট বোন, সকলেই এসে পৌঁছেছেন। একটু সুস্থ হয়ে রাখী সুহানিকে কাছে ডেকে নেয়। “কালকের এডিটোরিয়লটা,” এটুকু বলতেই সুহানি রাখীকে থামিয়ে দেয়, “তুমি এখনও -” “চুপ, যা বলছি শোন,” রাখী বলে চলে, “কালকের কাগজে এডিটোরিয়ল ছাড়া আর কিছুই বেরবে না। আমি মোবাইলে লিখতে শুরু করছি। আই উইল ফরোয়ার্ড ইট টু ইউ। এখন একটু বাড়ি যা। ঘুমিয়ে নে,” সুহানি মাথা নাড়ে, “তুমি কি পাগল? তোমাকে এই অবস্থায় রেখে আমি বাড়ি চলে যাব? আর ইউ ইনসেন!” রাখী ঠোঁটে আঙুল রেখে সুহানিকে চুপ করতে বলে, “নো আয়্যাম নট। আমি ভেবেচিন্তেই তোকে বাড়ি যেতে বলছি। কারণ বডি কখন ছাড়া পাবে জানা নেই। কাল সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাবে হয়তো। আই উইল নিড ইউ এ্যাট দ্যাট টাইম। তুই বাড়ি যা। রাতটা ঘুমো। সকালে উঠে এডিটোরিয়লটা প্রুফরিড করে, আপলোড করে ইউ কাম টু দ্য হসপিটাল। এ্যাজ আর্লি এ্যাজ পসিবল, যা!” রাখী সুহানির পিঠ চাপড়ে দেয়। তার চোখের জল শুকিয়ে এসেছে অনেকক্ষণ। এক দীর্ঘ, দগ্ধ রাত নিঃশব্দে এগিয়ে যায়।
ছেলেটা বরফের উপর শুয়ে আছে। টাঙ্গির কোপে মাথাটা প্রায় আধখানা হয়ে গেলেও তাকে চিনতে ভুল হয় না। বাহারকে গুলি করার পর পিছন থেকে কেউ এসে তার মাথায় টাঙ্গি বসিয়ে দেয়। হয়তো যে লোকটা তার সঙ্গে একই ঘরে থাকত, এ সেই লোকটারই কাজ। ছেলেটা বুঝতে পারে না। সকালে যখন তার হাতে পিস্তল ধরিয়ে দিয়ে যে লোকটাকে মারতে হবে তার ছবি দেখানো হয়েছিল, ছেলেটা চমকে উঠেছিল খুব। এই লোকটাকে তো সে আগে দেখেছে। লোকটা তার গান শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু।
“চোপ শালা, কোনও মেয়েলিপনার জায়গা এটা নয়। ভিড়ের মধ্যে গা ঢেকে তুই অপেক্ষা করবি। আমরা জানি হুজ্জতি হলেই এই শালা জার্নালিস্ট, সঙ্গে আরও কেউ থাকতে পারে, তারা স্পটে আসবে। নিশানা যেন ভুল না হয়।” ছেলেটার কলার চেপে ধরে ওদের ঘরে আসা গুণ্ডাটা হুমকি দিয়ে গিয়েছিল। সকালেই তাদের পেটে মদ পড়েছিল। ঠাসঠাস করে ছেলেটার দুগালে চড় মেরে ওর ঘরে থাকা অন্য লোকটা ওকে চাগিয়ে দিয়েছিল। কেবল বেরনোর সময় গুণ্ডাটা ফিসফিস করে অন্য লোকটাকেও কী যেন বলেছিল তখন। নেশার ঘোরে ছেলেটার হুঁশ ছিল না।
বাইরে লাউডস্পিকারে চড়া গলায় গান শুরু হয়ে গিয়েছিল। কান, মাথা দপদপ করে ওঠার মতো গান। ছেলেটা জানে না সে কখন গুলি চালিয়ে দিয়েছিল। লোকটা তাকে চিনতে পেরেছিল কিনা, তাও সে বুঝতে পারেনি। মাথাটা দো-ফালা হয়ে যেতেই …
বরফের উপর ছেলেটা শুয়ে আছে। সবকিছু সে দেখতে পাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে তার বৃদ্ধ বাপ এসে বসে আছে হাসপাতালের বাইরেটায়। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সুহানি এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ঠায় বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখে। ঠিক পুলিশ-ব্যারিকেডের সামনেটায়। ভিতরে যাওয়ার হুকুম মেলেনি। রাখী কি বাহারের পাশে শুইয়ে রাখা সেই ছেলেটির দেহকেও নজর করেছিল? সে খবর জানা যায় না। রাখী একমনে মোবাইলে টাইপ করতে থাকে।
সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখে সুহানির কী মনে হয় তাঁর সঙ্গে কথা বলার। তাঁর কথা বলার মতো অবস্থা নেই। ভাঙা ভাঙা বাক্যে কেবল কয়েকটি কথা শোনা যায়। সুহানি কি পরে এডিটোরিয়লে ঢোকাবে সেসব? সাতপাঁচ ভেবে সে কথাগুলো টাইপ করে রাখীকে পাঠিয়ে দেয়। ভদ্রলোকের কথাগুলো পড়ে অবশ্য রাখী আলাদা করে ছেলেটাকে চিনে উঠতে পারে না। তার কেবল মনে পড়ে যায় দিল্লীতে থাকাকালীন নোবেলজয়ী বাঙালী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি বক্তৃতা-অনুষ্ঠান। যেখানে তার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। যেখানে অধ্যাপক সেন স্পষ্ট উচ্চারণে বলেছিলেন, “দাঙ্গায় সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষেরাই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
রাত ভোর হয়ে এসেছে। আকাশ ক্রমশ পাতলা, পরিষ্কার হয়ে আসে। মোবাইলে লিখতে লিখতে রাখীরও চোখ লেগে এসেছে। সে লেখাটা সুহানিকে পাঠিয়ে দেয়। বাহারের সেই স্বচ্ছ, সুন্দর মুখটাই বারবার করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। একটা গানের সুর তার কানে ভেসে আসে। অথচ সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পায় আর কারও কানে সে গানের সুর পৌঁছয়নি। তিন-চারজন পুলিশ কাছাকাছিই পাহারায় রয়েছে। তাদের চলাফেরা, কথাবার্তায় কোনও তফাত ধরা পড়ে না। অথচ গান গাইছে কেউ।
বরফের উপর ছেলেটা শুয়ে রয়েছে। তার মাথাটা দো-ফালা হয়ে রয়েছে। বাহার বরফের উপর উঠে বসে হঠাৎ। রাখী কি দরজায় কড়া নাড়ছে? বাহারের শার্টে রক্তের দাগ কখন শুকিয়ে গিয়েছে। বাহার রাগটাকে চিনতে চেষ্টা করে। ছেলেটা তার ঠিক পাশটাতেই ঠাণ্ডা বরফের উপর শুয়ে থাকে। আকাশের তারাগুলো এক-এক করে নিভে আসতে চায়।
খুব দ্রুত ভোর হয়ে আসছে। আকাশ থেকে আবারও ফুল ঝরছে। সেই ফুলের রঙ আর হলুদ নয়। সেই ফুলের রঙ সাদা। রাখীর হাত বাহার নিজের হাতের ভিতরে নেয়। মর্গের ছাদ বেয়ে, ভোরের আকাশ বেয়ে সাদা ফুল ঝরে পড়ছে। “এই রাগে ঋষভ আর ধৈবত কোমল, তুমি চিনতে পারছ?” ফিসফিস করে বাহার রাখীকে জিজ্ঞেস করে। উন্মুক্ত চত্বরে পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে রাখীও স্বগতোক্তিতে জবাব দেয়, “পারছি বাহার। আমি পারছি ঠিক।”
সাদা ফুল আর ভৈরোঁর আলাপ। হলদোয়ানির আকাশে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আলো ফুটতে শুরু করেছে।
(আগামী পর্বে সমাপ্ত)
আগের পর্বের ঠিকানা – https://nariswattwo.com/welcome/singlepost/%C2%A0the-siege-serialised-novelette-series-twenty-one-
0 Comments
Post Comment