- 11 February, 2023
- 0 Comment(s)
- 253 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
চারিদিকে এত আনন্দ জোনাকির মত সুখে ডানা মেলে উড়িয়া বেড়াবো এইরকম ভাবছিলাম! এদিকে ভ্যালেন্টাইন্স সপ্তাহ চলিতেছে, এইসময় আবার গরুকে জড়িয়ে ধরে নিজস্বী তুলিতে হবে বলে উপর মহল থেকে খবর আসছে, ওদিকে বলিউডের হিরো, হিরোইনের বিয়ে, বিয়ের পোশাক, গয়না সবকিছু মিলে ফিলিং উৎসব উৎসব। বয়েই গেছে কোথায় অনার কিলিং হচ্ছে, কোথায় ধর্ষণ হচ্ছে খবর রাখতে! একটাই তো জীবন, রসেবশে বেঁচে থাকি, বিশ্বাস করুন, অন্য কোনও দিকে তাকাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা ছিল না; এর, তার খিল্লি উড়িয়ে, নেগেটিভিটি ছড়িয়ে, দেদার পরনিন্দা করে বাঁচতে চেয়েছিলাম! তাই মনের সুখে ইন্সটাগ্রামে রিল দেখছিলাম, আর এইখানেই ঘটলো বিপত্তি। বলিউড হিরো, হিরোইনের মধ্যে টুক করে এসে গেলো টিবা আল আলি। অনলাইন নিউজ পোর্টালে টিবার খবর দেখে, পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছি। তবে রিল বাবাজি দেখলেন— বাইশ বছরের এক তরুণীকে তাঁর বাবা 'লজ্জার কারণ' বলে প্রথমে শ্বাসরোধ করে, তারপরে গুলি করে খুন করেছেন।
টিবার এরকম মৃত্যুর কথা শুনে বিশ্ববাসী থ বনে গিয়েছেন! টিবা তুরস্কে থাকতেন। তিনি একজন ইউটিউবার ছিলেন। সম্প্রতিই তুরস্ক থেকে ইরাকে নিজের বাড়িতে ফিরেছিলেন। পাঁচ বছর পর এসেছিলেন বাবা-মায়ের কাছে। টিবা, ইরাকে তাঁর বাড়িতে আসার পর থেকেই সমস্যা শুরু হয়। অশান্তি চরমে উঠলে, পুলিশকে ঝামেলা মেটাতে হয়। বাড়ি বয়ে এসে পুলিশ মধ্যস্থতা করেন। ইরাকের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী সাদ মানও একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন— “টিবা আল আলি এবং তাঁর আত্মীয়দের সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ।’’ কিন্তু সেই সমাধানসূত্র যে কোনও কাজেই দেয়নি তা স্পষ্ট হয়ে যায় গত ১ ফেব্রুয়ারি সকালে টিবার রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার হওয়ার পর। তবে খুন করার পর তা গোপন করেননি টিবার বাবা। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি নিজেই এসে পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, খুন তিনিই করেছেন। কেন খুন করেছেন, তার কারণও জানান। টিবার মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে আসতে থাকে নানা তথ্য। ইরাকের মানবাধিকার কর্মী হানা এদোয়ার একটি ভয়েস রেকর্ডিং দিয়ে জানান, টিবাকে শুধু ইউটিউবার হওয়ার জন্যই দেশ ছাড়তে হয়নি। নিজের বাড়িতেই ভাইয়ের যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন টিবা। টিবা ইউটিউব ভিডিয়োয় তাঁর নিত্যদিনের যাপনের যে সমস্ত ভিডিয়ো পোস্ট করতেন, তাতে রক্ষণশীলতা ছিল না, খোলামেলা পোশাক, প্রেমিকের সঙ্গে ইউটিউব ভিডিও, এসব তাঁর পরিবার মেনে নেয়নি। (তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার অনলাইন, ৬/২/২০২৩)
সম্মান রক্ষার্থে ইরাকে আগেও এরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। টিবার হত্যার পর পুরনো ঘটনার কথাগুলো পুনরায় উঠে আসছে। নারীদের সুরক্ষা দেবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ইরাকি দণ্ডবিধি এখনও ‘অনার কিলিং’ -এর মত জঘন্য অপরাধকে হালকাভাবে দেখে। ইরাকের মহিলারা এই বিষয়য়ে প্রশ্নও তুলেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ‘‘আমাদের সমাজে মহিলারা আসলে কিছু পুরুষের অহংকার এবং পিছিয়ে পড়া রীতির খাঁচায় বন্দি। মেয়েদের বাঁচানোর জন্য যেহেতু যথাযথ আইন এবং সরকারি উদ্যোগের অভাব রয়েছে, তাই এ ভাবেই নিজেদের বাড়িতেই অত্যাচারিত হতে হয় মেয়েদের।’’(তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার অনলাইন, ৬/২/২০২৩)
বাগদাদে পথে নেমেছিলেন ইরাকের মেয়েরা, টিবা হত্যার দাবিতে। বিশ্বজুড়ে উঠেছে টিবার সুবিচারের দাবি। তবে টিবার বাবা তাঁদের সেই দাবির উত্তর আগেই দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন— টিবার বাবা তাঁর স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন, তিনি পরিবারের সম্মানরক্ষায় তাঁর মেয়েকে হত্যা করেছেন। টিবার হত্যার অপরাধে যদিও বা তিনি কোনও শাস্তি পান, তবে সেই শাস্তিও লঘু হবে। কারণ ইরাকে সম্মানরক্ষায় কোনও অপরাধ করলে অপরাধীকে কম সাজা দেওয়া হয়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, টিবার বাবা যেহেতু মেয়েকে হত্যা করে মহান কাজ করেছেন, তাই তাকে পুরস্কৃত করা হবে।
এএফপির একজন সংবাদদাতা বলেছেন গত ৫ই ফেব্রুয়ারি ইরাকের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের রাস্তায় প্রায় কুড়ি জন সমাজ কর্মী বিক্ষোভ করছিলেন। সেইসময় সেখানকার নিরাপত্তা কর্মীরা তাঁদের ভবনের বাইরে বিক্ষোভ করতে বাধা দেন। তাঁদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘নারী হত্যা বন্ধ করুন’ এবং ‘টিবার হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’ সেখানে একজন প্রতিবাদকারী রোজ হামিদ, এএফপিকে বলেন, “আমরা নারীদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ করে গার্হস্থ্য সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনের দাবি জানাই। আমরা এখানে এসেছি টিবা হত্যা এবং এ ধরনের সব হত্যার বিরোধিতা করতে। পরবর্তী হতাহত কে হবে?’
লিনা আলি নামের আরেকজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘আমরা নারী হত্যা এবং গার্হস্থ্য সহিংসতার কারণে আন্দোলন চালিয়ে যাব।’ (তথ্যসূত্রঃ https://worldecho.net )
টিবার মৃত্যু সত্যি একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। এখনও বিশ্বের অনেকাংশে নারীর অধিকার এবং নিরাপত্তা হুমকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সত্যিকারের অর্থে পরিবর্তনের খুব প্রয়োজন। ক্ষমতার বিরুদ্ধে আমাদের বিরোধিতা জারি রাখতে হবে। যাঁরা সহিংসতার শিকার হয়েছেন তাঁদের ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের লড়তে হবে। আমাদের অবশ্যই অবশ্যই আওয়াজ তুলতে হবে। এমন একটি বিশ্বের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে; যেখানে নারীরা স্বাধীনভাবে এবং নিরাপদে বসবাস করতে পারেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
ছবি: সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment