- 27 September, 2023
- 0 Comment(s)
- 1068 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
[কিছুদিন আগে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। পরিচিত বয়োজ্যেষ্ঠ একজন, জনপ্রিয় একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক লিখে পাঠালেন যে, অনেককে বিদ্যাসাগরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লেখার অনুরোধ জানালেও দু-তিনজন ছাড়া আর কারোর কাছ থেকেই তিনি নাকি লেখা পাননি। কেমন যেন একটা সার্বিক অবহেলার প্রতিচ্ছবি। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করছিলেন, এই কি তবে সামাজিক অবক্ষয় অথবা মনীষীদেরকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়ে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলার পূর্ব-সংকেত ? কিছুক্ষণ নিরুত্তর চেয়েছিলাম।]
আমার বয়স আঠাশ। কম-বেশি আড়াই-তিন দশক ধরে এই ধরাধামের বাসিন্দে। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়কে পিছনে ফেলে এসেছি অনেকদিন। কিন্তু সত্যিই কি তাই ? বাংলা রেনেসাঁর প্রাণপুরুষ যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – তাঁকে কি সত্যি সত্যিই এতখানি অবলীলাক্রমে ফেলে আসা চলে ? এতখানি অবহেলায়! আজ যেন আমাদের অধিকাংশের কাছেই বিদ্যাসাগর মানে, সেই বীরসিংহ গ্রাম – ক্যুইজ কনটেস্টের দরকারি জবাব, মাতৃভক্তির প্রতীক হিসেবে দামোদর পারের বৃত্তান্ত – অথবা বড়জোর সেই ইংরেজ সাহেবের মুখের উপরে শুঁড়তোলা তালতলার চটি তুলে দেওয়ার উপাখ্যান। এর বাইরে অবিশ্যি বর্ণপরিচয়ের আসাযাওয়া ছিল খানিক। কিন্তু ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’-এর গল্পগুলিকে আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। আমরা গ্লোবাল হয়েছি। বাঙালি হতে পারিনি বোধহয়। আত্মগর্ব আর মদগর্বকে গুলিয়ে ফেলে, আমরা না বাঙালি হয়েছি, না সঠিক অর্থে বিশ্বমানব হয়ে উঠতে পেরেছি। বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিত্বের কতটুকুই বা আমরা গ্রহণ করতে পেরেছি ? আমরা বোধহয় দুশো বছরেও তাঁর ব্যক্তিত্বের যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। কাজেই তাঁর অ্যানিভার্সারির বিষয়েও যে আমাদের প্রকট বা প্রচ্ছন্ন অনীহাটুকুই কেবল পরিলক্ষিত হবে, এতে আর আশ্চর্য কী!
বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়। যে-কোনো বাঙালি শিশুর প্রথম মুখেভাতের আনন্দ। প্রথম উচ্চারণের সুখ। বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে বইটির স্ট্রাকচার কেমন, বইটি পেডাগজি হিসেবে কতখানি সফল – সে আলোচনায় যাওয়াটা আমাদের পক্ষে ধৃষ্টতার সামিল। আমরা কেবল সেই প্রথম অন্নপ্রাশনের সুখটুকুকেই মনে করতে চাই। প্রথম হাতেখড়ির ইচ্ছেপূরণ। বাঙালিকে বাংলা শেখাতে যে একটি সঠিক বুনিয়াদি গ্রন্থের প্রয়োজন, তা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন রেনেসাঁস-যুগের এই আকারে খাটো, কিন্তু বিদ্যায় বুদ্ধিতে সাক্ষাৎ দৈত্যকুলপতি এই মানুষটি, যাঁর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর হাত ধরেই বাঙালির স্বর-ব্যঞ্জন পেরিয়ে যুক্তবর্ণের আঙিনাতে পদক্ষেপ। তাঁর দেখানো পথেই রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ, নোবেলজয়ীর কলমে বাংলা প্রাইমারের হদিস।
বিদ্যাসাগর যদি আর সব কটি বিষয়েই ব্যর্থতার সম্মুখীন হতেন, বিধবাবিবাহ থেকে বহুবিবাহের অন্ধকারকে দূরীভূত করতে অপারগ হতেন – যদি হতেন (হননি সে আমাদের বহুযুগের পুণ্যফল) কিন্তু যদি হতেন, তাহলেও – স্রেফ এই বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগদুটির জোরেই, অনায়াসে দুশো বছরের মাইলফলক পেরতেন বিদ্যাসাগর। এই একটিমাত্র বইয়ের জৌলুসেই। যে বই কেবল বিদ্যাসাগরের নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে – বাংলা ভাষার কাছে এক অমূল্য সম্পদ। বেদ-পুরাণ-গীতা-কোরাণ-বাইবেলের চেয়েও তা কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং হয়তো-বা বেশিই। বর্ণপরিচয় ব্যতীত কি ধর্মপরিচয়, জাতিপরিচয়, সংস্কৃতিপরিচয় সম্ভব ? মানুষের সবচেয়ে বড়ো আবিষ্কার হল ভাষা, মানুষের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হল বাক, আর বিদ্যাসাগর – সেই ভাষার দেবতা, বাকের অবতারপুরুষ। ২৬ সেপ্টেম্বর, বর্ণপরিচয়ের জন্মদিন।
ঈশ্বরচন্দ্র এও জানতেন যে, বিদ্যা কেবল বুনিয়াদী বই লিখলেই সম্পূর্ণ হয় না। সেই বিদ্যা জাতকদের কর্ণকুহরে (ও পরিশেষে অন্তরে) সঠিক সময়ে পৌঁছোনোটাও একান্ত ভাবে জরুরি। কাজেই পুরুষদের পাশাপাশি নারীশিক্ষা প্রসারের ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাটিও বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন। সে যুগে, এবং এ যুগেও, জন্মের পরে শিশুর প্রাথমিক বিদ্যাশিক্ষার দায়ভার অনেকটাই মায়েদের উপরে এসে পড়ে। সকল কাজের সমান বণ্টন যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনই বর্তমান সামাজিক স্থিতির কথা মাথায় রেখে একেকটি নীতিকে কীভাবে বৃহত্তর জনমানসে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হয় সেই বিষয়েও যথোচিত বিচক্ষণতার প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে যে, মেয়েদের কথা বলব যখন – তখন আপামর সমস্ত মেয়েদের কথাই বলব। কাজেই বিদ্যাশিক্ষার প্রসারে যখন প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতম নারীদের শিক্ষার প্রয়োজনে কথা বলব, তখন তারা চাকরি করতে যাবে কি যাবে না সেটিই প্রথম বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়াবে না – কারণ সেক্ষেত্রে অধিকাংশের কাছেই নারীশিক্ষার পরিবর্তে ব্যাপারটি অনেকাংশেই ‘শহুরে গিমিক’ হয়ে দাঁড়াতে পারে। নারীর শিক্ষা শুরু হবে তাঁর মাতৃত্বের প্রথম প্রয়োজনে। তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে। এগুলিই সিঁড়ির প্রথম ধাপ। তারপর নারীকে উঠতে দিতে হবে যতদূর সে চায়। নারী এবং পুরুষকে হয়ে উঠতে হবে একে-অপরের সার্থক রকমে পরিপূরক।
[একথাগুলি এখানে এসে পড়ল কেন সঠিক জানি না, তবে এটুকু বলতে পারি যে অরুন্ধতী রায়ের একটি সাম্প্রতিক বই পড়তে পড়তে এমনটাই মনে হয়েছিল আমার। সেখানে লেখিকা তাঁর কোনো একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে, আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিতা একজন (যাঁকে তিনি কোনও একসময় দেখেছেন, যাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন) – নারীর নিরাপত্তাহীনতার শহুরে সমস্যাগুলিকে নিয়ে যতখানি ভাবিত – জঙ্গলের দলিত আদিবাসী মহিলাদের উপরে নিরবিচ্ছিন্ন অত্যাচার নামিয়ে এনে পরিবেশ-ধ্বংসকারী সমস্ত অপ-উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির বিষয়ে ঠিক ততটাই উদাসীন। সকলে হয়তো এমনটা নন ... আবার, ‘হয়তো’-ই বা কেন – নিশ্চয়ই নন। কিন্তু সামগ্রিক চিত্রটির সম্পর্কে আমরা অনেকক্ষেত্রেই উদাসীন হয়ে পড়ি। কারণ যা সমগ্র, তা প্রকৃতার্থেই বিশাল। অথচ সেই বিশালকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে সঠিক পদক্ষেপটি নিতে গিয়েও ভুল হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।]
নারীশিক্ষার বিষয়ে, বিদ্যাসাগরের সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি ঠিক কোন্ কথাগুলি বলেছিলেন জানি না, কিন্তু এই কয়েকটি বিষয়ে (যথাক্রমে মাতৃত্ব, সুস্বাস্থ্য ও শিশুশিক্ষা), যে তাঁর প্রকট বা প্রচ্ছন্ন মনোযোগ ছিল সে তাঁর কাজের মাধ্যমেই প্রমাণিত। ১৮৫১-৫২তে বিদ্যাসাগর তৎকালীন বাংলায় বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সেসময়ে দেশে স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ দুর্দশা দেখে তিনি উপলব্ধি করেন যে, প্রকৃত শিক্ষা ব্যতীত নারীর উন্নতি অসম্ভব। ১৮৫২ থেকে ১৮৫৪ সালের মধ্যে তিনি তাই বাংলার বিভিন্ন অংশে অন্যূন ত্রিশটি নারী-বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিধবাবিবাহ বিষয়ে তাঁর আইনি স্বীকৃতি লাভ হয় ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই। মূলে শিক্ষা ও মনঃস্তাত্ত্বিক বিকাশ, পরে জোরদার সামাজিক আন্দোলন। নারীরা সেসময়ে বিধবাবিবাহের সপক্ষে পথে নেমে প্রতিবাদে শামিল হতে হয়তো না পারলেও, জোরালো একটি সামাজিক পরিবর্তনের পূর্বে সেই উন্নয়নের চালিকাশক্তিকে তার জন্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিক্ষালাভের পরেই কেবল ফললাভের প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন করা চলে। নচেৎ সে কেবল খাতায় কলমে অধিষ্ঠিত হয়ে থেকে যায়। ব্রোঞ্জের অথবা আরও কোনও ধাতব প্রাণহীন নিঃশ্চেষ্ট প্রতিমার মতোই।
এ লেখার উদ্দেশ্য এটাই যে, বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার কিন্তু নারীশিক্ষার বুনিয়াদ দিয়ে শুরু হয়েছিল সে কথাকে প্রমাণ করা, বা সেই কথাকে বলতে চেষ্টা করা। বিধবাবিবাহ অথবা বহুবিবাহের আইনি রায় কেবল কাগজের তরোয়াল হয়েই থেকে যেত যদি না কেউ সেই আইনের ফললাভকারী নারীজনসংখ্যাকে সেই রায়ের সার্থক অধিকারী করে তুলতে সচেষ্ট না হতেন। বিদ্যাসাগরের উপাধি তাই এক্ষেত্রে সর্বাংশে সার্থক হয়েছে। একমাত্র বিদ্যা এবং সার্বিক জ্ঞানের মাধ্যমেই যে কোনো সমাজকে আলোর দিশা দেখানো চলে। সবার প্রথমে একজনকে পড়তে শিখিয়ে দাও। তারপর সমাজের ভালোমন্দকে সে নিজেই সঠিক সময়ে উপলব্ধি করতে শিখবে।
২৬ সেপ্টেম্বর তাই আমরা পালন করছি, বর্ণপরিচয়ের জন্মদিন – শিক্ষামুক্তির জন্মদিন - নারীমুক্তির জন্মদিন।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০
ছবি সংগৃহীত
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment