- 03 May, 2024
- 0 Comment(s)
- 853 view(s)
- লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
প্রতিদিন সন্ধ্যে হয় প্রতিটা বাড়ির খিড়কি থেকে ভেসে আসা কিছু খুব চেনা সুরের আবাহনে।
স্টার জলসা, জী বাংলা অথবা রকমারি হিন্দি এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেলগুলোর কথাই বলছি।
আট থেকে আশি হাঁ করে ‘বোকা বাক্সে’র সামনে বসে পড়ে সব কাজ ফেলে, বা হাতের কাজ সেরে, বা তাড়াতাড়ি কাজ গুছিয়ে। যেন কী এক আফিমের নেশা!
একাধিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, স্ত্রী ও প্রেমিকার আকচা আকচি; নায়কের একাধিক বিয়ে, শাশুড়ির কূটচালের পাল্টা জবাব, আত্মীয়দের ষড়যন্ত্রের যোগ্য জবাব দিয়ে নিজের স্বামীকে নিজের আঁচলে বেঁধে কীভাবে শ্বশুরবাড়ির যোগ্য বৌ হয়ে উঠতে পারবে নায়িকা? -- এইসব নিয়ে মধ্যবিত্তের সান্ধ্য ডিবেট আজকাল বেশ জমে ওঠে একরাশ চ্যানেলের টিআরপি প্রতিযোগিতায়।
বৈঠকি বিকেলগুলো এখন আর বাচ্চাদের খিলখিলানিতে ভরে ওঠে না। বড়দের দাবার চাল বা মা-মাসিদের উলবোনার গপ্পে মুখরিত হয়ে ওঠে না। একটু বড় বাচ্চাদের পড়াশোনার ফাঁকে মায়েদের তর্জনগর্জন শোনা যায় না “কি রে, গলা শুনতে পাচ্ছি না কেন? চেঁচিয়ে বানান করে পড়া কর।”
এসব এখন অতীত। আগাপাশতলা পুরোটাই এখন বোকা বাক্সের দৌলতে অদ্ভুত সামাজিক দর্পণ— যেখানে বহুবিবাহ থেকে পারিবারিক হিংসা সবকিছুই ঝলমলে অলংকারে সজ্জিত হয়ে প্রদর্শিত হয়।
এখনকার মা-মাসিরা সিরিয়ালের নায়িকাদের পরনের শাড়ির কালেকশন দেখিয়ে পুজো বাজারে ভিড় করেন। তাঁদের দেখাদেখি বাচ্চারাও স্কুলের অলিন্দে এখন নির্দিধায় আড্ডা দেয়— “জানিস না, অর্চীর তো দুটো বিয়ে! বাহা তো কমলীকার বাবার অবৈধ সন্তান! কঙ্কাকে তো সেই লোকটা বিয়ে করেনি, রেপ করেছিল।”
—“জানিস তো ওদের একটা সম্পর্ক ছিল ... ওই যে বিছানার সিনটায় ... আরে সেই জন্য বাহা জন্মেছে।”
—“এরপরের সিনে কী হবে বল তো?”
স্কুলের টিফিনে এসব সিরিয়ালের চরিত্র নিয়ে যখন বাংলা মিডিয়ামের নিরীহ মধ্যমেধার কচি মনের বাচ্চারা বাজি ধরে, তখন আমরা শিক্ষিকারা ভারি বিস্মিত হই ঠিকই, কিন্তু শত শাসন বা বোঝানোতেও কিছুতেই ওদের আলোচনা থামাতে পারি না। কারণ, এগুলো ওদের প্রাত্যহিকির একটা অংশ হয়ে গেছে। টিউশান থেকে বাড়ি ফিরে প্রতিদিন এসবই শোনে, দেখে ও আত্মস্থ করে ওরা। দোষ তো ওদের না, বাড়ি সুদ্ধ সবাই সিরিয়াল জ্বরে আছন্ন। বড়দের থেকেই বাচ্চারা শেখে। কেউ ভাবেই না, বাচ্চাদের মাথায় এগুলো ভাইরাসের মত ছড়াচ্ছে। ‘মোরালিটি’ নামক বিষয় এখন প্লুটোয় প্রাণ পাওয়ার মত অবাস্তব।
সিরিয়াল কর্তারা এমন স্টোরি বানাচ্ছেন যার পাশে ‘A’ চিহ্ন থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বিনা প্রতিবাদে রমরমিয়ে চলছে নারীবিদ্বেষী ও অনৈতিক বার্তাবাহী কিছু চলমান গল্প। তাও আবার নারী অধিকারকে ঢাল করেই। মেয়েদের মুখ্য চরিত্র রেখেই মেয়েদেরই বিরুদ্ধে সাজানো হচ্ছে প্লট যা আদ্যিকালের মনুবাদী ধ্যানধারণাকে প্রশ্রয় দেয়। বাস্তবে যা অচল, কিন্তু মগজে সুচারু রূপে সচল লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, সিরিয়ালগুলোয় বাড়ির কর্তা পুরুষদের দেখানো হয় অকর্মণ্য ‘ক্লীব’ রূপে। যেন তাদের নিজস্ব কোনো মতামত নেই, মেরুদণ্ডহীন জড় পদার্থ এক একটা। বাস্তবের সাংসারিক চিত্র থেকে একদম ১৮০ ডিগ্রি উলটো ব্যাপার!
কেন?
খুব চালু উত্তর হল, সিরিয়াল তো মূলত মহিলারা দেখেন, তাই তাদের মনের খোরাক জুগিয়ে এই গল্পের প্লট সাজানো হয়েছে। যাতে বাস্তব সংসারে তারা যা যা করতে চান অথচ পারেন না, সেসব খোয়াবি পোলাওয়ে বেশি করে ঘি ঢেলে সেলুলয়েড-স্বাদ মেটাতে পারেন।
চমৎকার যুক্তি! আচ্ছা বাস্তবের কোন মহিলা চান এমন একটা জড় পদার্থ মার্কা স্বামী?
২৪ X ৭ হাড়জ্বালানো শ্বশুর-শাশুড়ি? দিনরাত হৈচৈ পার্টি করা বাড়ি? সাতমহলা বাড়ির নিত্যদিনের নাটক? গাদাগাদা ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক বাজাতে চান কোন গৃহিণী?
আসলে, খুব সূক্ষ্মভাবেই কিন্তু পুরুষদের আড়াল করা হয় এই সিরিয়ালগুলোতে। দেখানো হয় বাড়ির কর্তারা সব সাধুপুরুষ, ভাজা মাছটিও উলটে খেতে জানেন না। মহিলা মহলের ছিপে গাঁথা কাতলা মাছটি যেন!
তবে একটু তলিয়ে ভাবলেই আসল উদ্দেশ্য পাওয়া যায়। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার বীজ যদি মহিলাদের দ্বারাই প্রথিত করা যায় নতুন প্রজন্মের মগজে, তাহলে পুরুষদের আদপেই ফিল্ডে নামার দরকার পড়ে না। তাতে নারী নির্যাতনের লাভের গুড় পুরোটাই কিন্তু নারীবিদ্বেষী সমাজের জিভে মাখিয়ে দেওয়া যায়।
তথাকথিত সেলুলয়েড-কর্তা ‘শোষকের ভূমিকা’য় ম্যাচ খেললেন না। ওপেনিং থেকে মিডল অর্ডার অবধি লেলিয়ে দিলেন শাশুড়ি, জা, বৌদি, মামি, মাসি, বিধবা পিসি এদের। এরাই তো গোটা ম্যাচটা খেলে দিলেন পুং-টিমের হয়ে। দিনের শেষে ‘প্লেয়ার অফ দি ম্যাচ’-এর ট্রফি কিন্তু পেল পুংতন্ত্রই। পাশাপাশি ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’ এই আপ্ত বাক্যটিকে যথাযথভাবে প্রমোট করাও হল উপরি পাওনা হিসেবে।
রাজাবাদশার আমল থেকে, মোগল আর রাজপুতের গল্পের সময় থেকেই, ‘জহরব্রত’ বা ‘সতীপ্রথা’-র সময় থেকেই ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’-র চর্চা উপমহদেশের লৌকিকতায় গেঁথে গেছে। মেয়েদের দিয়েই মেয়েদেরকে পেটানো, পোড়ানো, পেষণের পরম্পরা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে কখনো লোককথায়, কখনও শিল্প সাহিত্যে, আবার কখনও বা সেলুলয়েডের পর্দায়। অর্থাৎ বিনোদনের সাথে সুচারুভাবে ঢোকানো হচ্ছে ঘৃণ্য পশ্চাদপদী নারীবিদ্বেষী ও পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণা।
এর পেছনে কে দায়ী?
উত্তরের পর উত্তর খুঁজতে গেলে একের পর এক নারীদের নানা ভূমিকায় তুলে ধরা হবে ‘মা- মাসি-দিদিমা-পিসিমা-ঠাকুমা-প্রমাতামহ’— সবশেষে দায় পড়বে ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় লোকাচারের আদ্যিকালের ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধানে।
তারওপরে যদি উত্তর চাও তো, দেখতে পাওয়া যাবে সব সংস্কার এবং সংসারের যাবতীয় 'জায়েজ' নিয়মগুলোর রূপকার এক বা একাধিক পুরুষ। যাদের জন্ম দিয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই। তারপর সুকৌশলে পরের প্রজন্মে ছড়ানোর সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হিসেবে মেয়েদেরকেই মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন নারী-অধিকার বিরোধী চিন্তাধারার ধারকবাহকগণ। এই মেয়েরাই পুংতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে মেয়েজীবনের পরমধর্ম, কন্যাজন্মের সার্থকতা এবং আরো নানা অলংকারে ভূষিত করছে যুগে যুগে এবং এখনও করে চলেছে।
আধুনিক সিরিয়ালগুলো সেইসব পুরোনো গ্যাঁজলা ওঠা মদকেই নতুন লেবেল সাঁটা চকচকে বোতলে পরিবেশন করে চলেছে মাত্র। চাবুকটা শুধু কর্তার হাত থেকে নিয়ে ধরানো হয়েছে কর্ত্রীর হাতে, যিনি নিজেও একইরকম নারীবিদ্বেষী লোকাচারের বশে আফিমগ্রস্ত। কারণ পিতৃতন্ত্র একটা আধার— সেটা যখন ঢোকে তখন পরিবার থেকে সমাজ থেকে দেশ সবকিছুকে নিজের লেলিহান গ্রাসে নিতেই ঢোকে।
বলা হয়, ডেলি সোপের গল্পগুলো সব নাকি বাস্তব থেকে ধার করা।
তাহলে, বাস্তব মহিলাদের ছবি ধরা পড়ে না কেন সিরিয়ালগুলোয়? আজকের শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মহিলারা বেশিরভাগই বহির্মুখী, সুচাকুরে, ঘরে-বাইরে সমান তালে ব্যালেন্স করে চলা পরিপূর্ণ মানুষ। কিন্তু সেলুলয়েডে যাদের আমরা বাঙালি ঘরের লক্ষী হিসেবে দেখি তারা সব গৃহবধূ। তারা বাবা-স্বামী-দাদা-প্রেমিকরূপী পুরুষের আঙিনায় ‘অর্ধেক আকাশ’ প্রাপ্তির আশায় ভিক্ষার ঝুলি হাতে দাঁড়িয়ে। শাখা-সিঁদুর ছাড়া যাদের অস্তিত্ব আর অসতীত্ব সমার্থক! চাকরির চেষ্টা করলে তাদের শুনতে হয় গঞ্জনা।
অথচ বাস্তব কিন্তু উলটো। আজকের দিনে স্ত্রীর মোটা টাকা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স থাকলে শ্বশুরবাড়ি তাদের হেলাছেদ্দা করে না এটিএমের পিন থেকে পেনশানের পিপিও-বুক অবধি মোটা অঙ্কের লোভেই।
অথচ সিরিয়ালে একটা মেয়ের জীবনযুদ্ধ মানে দেখানো হচ্ছে তার অবৈধ জন্ম। বেঁচে থাকার মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে ব্রাত্য মেয়ের পিতৃ পরিচয়ের খোঁজটুকুই। কিম্বা ‘অমুক পরিবারের যোগ্য বৌমা’ হয়ে ওঠাকে মূল লক্ষ্য বানিয়ে ত্রিকোণ প্রেমের টানাটানিতে স্ত্রী ও প্রেমিকার মধ্যে ন্যক্কারজনক চুলোচুলি দেখানো হচ্ছে অমূল্যরতন পুরুষকর্তাটির উপর অধিকার নিয়ে। তাকে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে শ্বশুরবাড়ির ঠাঁটবাট-আদব কায়দা শেখার মাধ্যমে, কিম্বা স্বামী-সন্তান-শ্বশুর-শাশুড়ির পাতে মুখরোচক খাবার পরিবেশন করে, অথবা সাংসারিক নানা ষড়যন্ত্রের পালটা আঘাত দিয়ে।
যেন মেয়েদের এসব ছাড়া আর কোনো কাজ নেই, শিক্ষায় বা সামাজিকীকরণের যোগ্যতা নেই, পরিচিতি প্রমাণের আর কোনো রাস্তা নেই। অত্যাচার মুখ বুজে সয়ে যাওয়া ছাড়া আদর্শ লক্ষীমন্ত বধূর অন্য কোনও ‘পরিচয়’ই নেই। সর্বোপরি এতশত গার্হ্যস্থ হিংসার শিকার হয়েও একটা যুতসই আইন-আদালতের দুয়ার নেই সেলুলয়েডের শিক্ষিত নারীর জন্য।
আধুনিক বাংলা সিনেমা যেখানে নানাবিধ বিষয় নিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে ছবি বানিয়ে সফল হচ্ছে, সেখানে টিভি সিরিয়ালগুলো— যাদের দ্বারা আগামী প্রজন্মের মেয়েরা সবচেয়ে দ্রুত ও সহজে বাড়ি বসেই নানা বার্তা পাচ্ছে, শিখছে— প্রমোট করছে মনুবাদী পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারা ধর্মীয় অনুশাসনকে ঢাল করে, যার মাধ্যমে মেয়েদের মস্তিষ্কের ব্যায়ামকে কার্যত বাধা দেওয়াই হয়।
আমরা জানি দৃশ্যমান শিক্ষার ফল সূদূরপ্রসারী। আর টিভি এমন এক মাধ্যম যা গ্রামগঞ্জে দুর্গম জায়গাতেও দৃশ্যমান, চলমান তথ্য সম্প্রচার করে। সেই সহজলভ্য গণমাধ্যমটিকে যদি নারীবিদ্বেষ ছড়ানোর প্রোমোটারি ব্যবসার কাজে লাগানো হয় এবং প্রতিদিনের সান্ধ্য মজলিশে সম্পর্কের জটিলতা ও সামাজিক কুশিক্ষা দ্বারা মা-ছা সবাইকে ধন্য করা হয়, তা হলে আগামী প্রজন্মের প্রতি পারিবারিক সুশিক্ষার পথ যে অত্যন্ত বন্ধুর হবে তা বলাই বাহুল্য। বিশ্বব্যাপী ছড়ানো পিতৃতান্ত্রিকতার দালালরা সচেতন সমাজে ছড়ানো মানবাধিকার আন্দোলনগুলোর কণ্ঠরোধ এভাবেই হয়ত আমাদের ঘরের মেয়ে দিয়েই করাচ্ছে। আমরা রঙিন চশমায় সেগুলো হাঁ করে গিলছি, তুরীয় আনন্দে মশগুল হচ্ছি— কিন্তু তলিয়ে ভেবে দেখছি না যে, আসলি পিকচার আভি বাকি হ্যায় ...
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment