স্মৃতির আগল খুলে

  • 06 January, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 769 view(s)
  • লিখেছেন : ​​​​​​​স্নিগ্ধা সেন
তখন সবার বাড়ি টেলিফোন ছিল না। উত্তরাদের ছিল, আমার ছিল না। গরমের ছুটি আর পূজোর ছুটিতে পোষ্ট অফিসের ওপরই ভরসা করতে হত। একদিনে চিঠি যেত। আর দুজনে যেতাম দুজনের বাড়ি। পরস্পরের বাড়িতে আমরা আপন হয়ে উঠলাম। দুজনেরই দেশ ঢাকা, বিক্রমপুর, সোনারং গ্রাম, উত্তরার দাদু তারই মধ্যে আবিষ্কার করলেন আমাদের বাড়ি আর তাঁদের বাড়ি একই পুকুরের এপার আর ওপার। সে এক অন্য অধ্যায়।

১৯৫৬ সাল, সেন্ট জনস্‌ ডায়োসেশন স্কুল। ক্লাস সেভেনের ক্লাস রুমে নতুন একটি মেয়ে এসে ঢুকল। রোগা ছিপছিপে, চোখে চশমা, স্কুল ইউনিফর্ম, দুই বিনুনী নীল ফিতে দিয়ে বো করা। নতুন এসেছে— ক্লাসে ফিসফিস্‌ শুরু হল। নাম উত্তরা সেন। আমি গিয়ে পাশে বসলাম। একটা দুটো কথায় আলাপ হল— দুদিনেই বন্ধুত্ব। আমি পুরনো ছাত্রী। আমি ভার নিলাম সারা স্কুল ওকে ঘুরে দেখানোর। পঞ্চাশের দশকের ডায়োসেশন এক নামী অভিজাত স্কুল। অজস্র বড় বড় গাছ, সযত্নে করা ফুলের বাগান, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ভলিবল খেলার মাঠ, বাস্কেট বলের কোর্ট। একদিকে কে জি ক্লাস হচ্ছে, তাদের ঘুমের জায়গা, টিফিন খাবার জায়গা। পিয়ানো ঘর। মিসেস বিশ্বাস পিয়ানো বাজিয়ে বাচ্চাদের rhymes শেখাচ্ছেন। পুরনো আমলের বড় বড় বিল্ডিং, বড় বড় ক্লাসঘর, কাঠের সিঁড়ি, অ্যাসেম্বেলী হল, হষ্টেল, লাইব্রেরী রুম— সর্ব্বোপরি পিছনের বড় মাঠ যেটাকে আমরা বলতাম back compound। ক্লাসের মাঝখানে ফাঁক একমাত্র টিফিন পিরিয়ড। আধঘণ্টা। সেই আধঘণ্টা ধরে নতুন বন্ধুকে নিয়ে স্কুল দেখানো চলতে থাকল আমার। বাড়ল ঘনিষ্ঠতা। সেই থেকে বন্ধুত্ব। এই বছর তা চৌষট্টি পূর্ণ করল যার কোনদিনও ছেদ হয়নি।

২৯শে নভেম্বর সকাল বেলায় যখন মর্মান্তিক খবরটি টেলিফোনে পেলাম তখন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না— আজও বিশ্বাস হচ্ছে না। আসলে আমার জীবনে উত্তরার উপস্থিতি এতই প্রবল ছিল যে ওর এই আকস্মিক স্থায়ী অনুপস্থিতিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আজ উত্তরার কথা লিখতে বসে আমাদের প্রথম দেখা হবার দিন থেকে শেষ দেখা পর্যন্ত সমস্ত স্মৃতিই উথালপাথাল করছে। ফিরে আসি সেই নতুন মেয়েটির কথায়। নাম উত্তরা সেন। প্রথম থেকেই সে ভালো ছাত্রী হিসেবে সব শিক্ষিকাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করল।

ডায়োসেশন স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা বলে কিছু ছিল না। ক্লাস পরীক্ষার ওপরই পাশ ফেল নির্ভর করত। প্রত্যেক মাসেই হতো ছাত্রীদের মান নির্ণয়। তার ভিত্তিতে মার্ক রিডিং পুরো স্কুলের। অর্থাৎ স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল চারুলতা দাশ প্রত্যেক ক্লাসের মেয়েদের স্থান অনুযায়ী নাম ডাকতেন। পর পর সবাইকে দাঁড়াতে হতো। উত্তরা প্রথম মাস থেকেই প্রথম হতে শুরু করল। ক্লাস ইলেভেনের টেষ্ট পরীক্ষা অবধি ক্লাসের প্রথম স্থানটি তার জন্যই বাঁধা ছিল।

আমায় যেটি মুগ্ধ করত সেটি হল তার একইসঙ্গে ইংরেজী ও বাংলা ভাষার ওপর দখল। প্রখর স্মৃতিশক্তি ছিল। তার যেকোন লেখাকে সে নানারকম উদ্ধৃতি দিয়ে সমৃদ্ধ করত। এ অভ্যেস তার পরবর্তীকালের রচনাতেও পাই। একদিন ইংরেজী ক্লাসে আমাদের ইংরেজী শিক্ষিকা একটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের ক্যালেন্ডার টাঙিয়ে বললেন, তোমরা যা পার তাই লেখ এই ছবিটার ওপর। আমরা আক্ষরিক অর্থেই যে যা পারি লিখলাম— কিন্তু উত্তরা লিখল সম্পূর্ণ অন্য লেখা। মনে হল দৃশ্যটি যেন তার লেখায় অন্য এক প্রাণ পেয়েছে। আমার তখনই মনে হয়েছিল যেন কোন এক কবির কবিতা শুনছি— একটুও বাড়িয়ে বলছি না, মিসেস বিশ্বাস লেখাটি ক্লাসে পড়ে শোনালেন। আমার গর্বের আর সীমা রইল না।

আমাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়েছিল গল্পের বই পড়াকে কেন্দ্র করে। সবরকম বই পড়ায় আমাদের আগ্রহ ছিল। তারমধ্যে যেমন ছিল ক্ল্যাসিকস্‌ তেমনি ছিল ভূতের গল্প থেকে হাসির গল্প, ডিটেকটিভ থেকে কল্পবিজ্ঞান, আরো কত কি।

তখনকার দিনে সবার বাড়ি টেলিফোন ছিল না। উত্তরাদের ছিল কিন্তু আমার ছিল না। গরমের ছুটি আর পূজোর ছুটিতে আমাদের সরকারি পোষ্ট অফিসের ওপরই ভরসা করতে হত। একদিনে চিঠি যেত। আর দুজনে যেতাম দুজনের বাড়ি। আমি থাকতাম পার্কসার্কাসের থিয়েটার রোডে আর ও থাকত টালিগঞ্জের চারু এভেনিউ-এ। সেকালের তুলনায় এবং আমাদের বয়স অনুযায়ী দূরত্বটা কিছু কম ছিল না। তবুও পরস্পরের বাড়িতে আমরা আপন হয়ে উঠলাম। দুজনেরই দেশ ঢাকা, বিক্রমপুর, সোনারং গ্রাম, উত্তরার দাদু তারই মধ্যে আবিষ্কার করলেন আমাদের বাড়ি আর তাঁদের বাড়ি একই পুকুরের এপার আর ওপার। সে এক অন্য অধ্যায়।

১৯৬০ সাল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়। ইলেভেন ক্লাসের শেষে ফাইনাল পরীক্ষা। এখনকার মতো টুয়েলভ্‌ ক্লাস নয়। এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় ক্লাস নাইন থেকেই স্ট্রিম ভাগ হয়ে যেত। আমরা ১৯৬১ এর দ্বিতীয় ব্যাচ। আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান, কমার্স আর হিউম্যানিটিজ চালু হল। আমি আর উত্তরা নিলাম হিউম্যানিটিজ, বিষয়— ইতিহাস, ভূগোল আর সংস্কৃত। কোন ঐচ্ছিক বিষয় ছিল না তখন। নম্বর পাওয়া ছিল দুরূহ। ইলেভেনের টেষ্ট পরীক্ষায় উত্তরা প্রথম হল। পড়াশুনো ছাড়াও প্রাইজ পেল ‘Best Student of the School’-এর । আমরা স্কুল ছেড়ে বেরোলাম। তিনমাস ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ছুটি।

নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় দ্বিতীয় বারের ফলাফল খুব খারাপ হল। সারা পশ্চিমবঙ্গে মাত্র পঁয়ত্রিশ জন প্রথম বিভাগে পাশ করেছিল। সেদিনের সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল এই পঁয়ত্রিশ জনের প্রথম বিভাগ পাবার কথা। উত্তরা প্রথম বিভাগে পাশ করেছিল।

পাশ করে উত্তরা প্রেসিডেন্সী কলেজ আর আমি লেডী ব্রেবোর্ণ কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজ আলাদা হল কিন্তু বিষয় একই রইল। দুজনেই ইতিহাসে অনার্স। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার একসাথে। তারপরে কর্মস্থল, সংসার, জীবনের নানা উত্থান পতন সব মিলিয়ে সময়ের এক দুরন্ত টানাটানি। এই টানাটানি সময়ের মধ্যেও আমাদের যোগ ছিল অবিচ্ছিন্ন। এর কৃতিত্ব পুরোটাই উত্তরার। দার্জিলিং-এ লোরেটো কলেজে পড়ানোর সময়েই হোক আর কলকাতার মৌলানা আজাদ, চন্দননগর, বেথুন, ব্রেবোর্ণে পড়ানোর সময়েই হোক উত্তরা চলে এসেছে আমাদের বাড়িতে কিংবা আমি ওর বাড়িতে।

এরই মধ্যে চলেছে ওর নানা বিষয়ে গবেষণামূলক লেখা। নানা বিষয়ে আগ্রহ এবং বিষয়টির গভীরে চলে যাওয়া ওর লেখার একটি বিশেষ দিক। সবচেয়ে বড় দিক হলো ওর কাব্যিক কলম এবং প্রবন্ধগুলোর নামকরণ সেই কাব্যিক মননেরই সাক্ষী। দু-একটা উদাহরণ দিই। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের দেড়শো বছর পূর্তিতে Asiatic Society থেকে যে আলোচনা চক্রের আয়োজন হয়েছিল তাতে উত্তরা যে প্রবন্ধটি পাঠ করেছিল সেটি প্রকাশিত হয়েছিল অধ্যাপক সুভাষ রঞ্জন চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘Uprisings of 1857 : Perspectives and Peripheries’ নামক এশিয়াটিক সোসাইটি কর্ত্তৃক প্রকাশিত বই-এ। উত্তরার প্রবন্ধটির নাম ছিল “Through a Glass Darkly” : Fearful English and the Ambivalent Bengali : Calcutta 1857-58 । পাদটিকায় ও নামটির ব্যাখ্যা দিয়েছে। ও জানিয়েছে বাইবেলের এই শব্দবন্ধটি পরবর্তীকালে অনেক সৃষ্টিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এ সব তথ্যই আমার কাছে তো নতুনই— আমার স্থির বিশ্বাস অনেকের কাছেই অজানা ছিল। এই শব্দবন্ধটি ও কেন ব্যবহার করেছে তাও সে জানিয়েছে। “The Phrase has been used here in this article to indicate the dark and complex fear that overwhelmed both Indians and the English in 1857”। একটি প্রবন্ধের নামের মধ্যেই কতটা অনুসন্ধান তা ভাবতে সত্যিই আশ্চর্য লাগে আর বলতে নেই আমার গর্ববোধ হয়।

উত্তরার গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলি নিয়ে ও চলে যাবার পর অনেক চর্চা হয়েছে। আগেই বলেছি বিভিন্ন বিষয়ে বিচিত্র পথে ওর ছিল পদচারণা। মধ্যযুগের ইতিহাস থেকে আরম্ভ করে বাঙালী মুসলমান নারী, বিপ্লবী মহিলা থেকে কলকাতার ইতিহাসে, আবার মাতামহ যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের একটি অসাধারণ জীবনীগ্রন্ধে ও তুলে ধরেছে ওর মাতামহের ইতিহাস ও সাহিত্যচর্চা। আমি জানি না কতজনের হাতে বইটি এসেছে কিন্তু বইটির পরতে পরতে যে মরমী কলমের স্পর্শ তা অনুভব না করে পারা যায় না। নারী সম্পর্কে উত্তরার যে মনোযোগ তা এই বইটির বেশ কিছু জায়গায় ধরা পড়েছে। “নারী চেতনার ইতিহাসে যোগেন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বঙ্গের মহিলা কবি গ্রন্থটি এই পর্বের উল্লেখযোগ্য এবং পরিণত সংযোজন।” নারীদের সম্পর্কে মাতামহ যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের ধ্যানধারণা মনে হয় উত্তরাকেও বাল্যকাল থেকেই প্রভাবিত করেছিল। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর মেয়েদের অর্থাৎ উত্তরার মা মাসীদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন এবং ইংরেজী মাধ্যমে পড়িয়েছিলেন। এই বইটি উত্তরার যে পরিশ্রমের পরিচয় দেয় তা অকল্পনীয়। যেমন বিপ্লবী বীনা দাশের ওপর “The Rattling Chain : Bina Das, A Woman in Revolution” পুস্তিকাটিও স্বল্পপরিসরে এক অসাধারণ পরিশ্রমের ফসল। বীনা দাশের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘শৃঙ্খল ঝংকার’কে উপজীব্য করে যে মূল্যবান দলিলটি সে পেশ করেছে তা অনেককেই ভাবনার খোরাক জোগাবে। সে নিজেই লিখছে, “For those searching for details of historical fact, her memoirs are disappointing. Its pages do not reveal the true identity of the young girl in action. One can only guess at the passion that was latent. The I B records, however, offer different viewings of a different Bina” উত্তরা যে কোন বিষয়েই এইরকমই স্পষ্ট মতামত পোষণ করত এবং তা প্রকাশ করতে কিছুমাত্র দ্বিধা বা কে কি ভাববে সে কথা চিন্তা করত না।

কেউ লেখা চাইলে বা যেকোন বিষয়ে চাইলে ও কোনদিন অপ্রস্তুত বোধ করে নি। আমি দেখেছি কি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে ও একেকটা লেখার পিছনে। প্রথম যখন ডাইলিসিস শুরু হয় হাসপাতালের বেডে শুয়েও ওকে proof দেখতে দেখেছি।

মীরাতুন নাহার সম্পাদিত নজরুল সম্পর্কে ‘দোলন চাঁপা’ সাময়িকীটিতে উত্তরার নজরুল সম্পর্কিত লেখাগুলি পাঠককে প্রচুর সমৃদ্ধ করবে। আমার বন্ধু, উত্তরা এই লেখাগুলিতে এক বড়মাপের সাহিত্যিক এবং ঐতিহাসিকও বটে। অবাক হয়েছি তার নিজের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কবিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা দেখে। দোলনচাঁপার সব সংখ্যা সে নিজের হাতে পৌঁছে দিয়েছে আমার হাতে এবং অনন্য আগ্রহে অপেক্ষা করেছে আমার মন্তব্যের, আমার অনুভূতির কথা জানবার জন্যে।

ঐতিহাসিক, গবেষক, প্রাবন্ধিক উত্তরা চক্রবর্তীর প্রয়াণের পর তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানিয়েছে তাঁর সকল ছাত্রছাত্রী ও বিদগ্ধজনেরা। কিন্তু আমার বোধহয় পুরো ছোটবেলাটাই হারিয়ে গেল এক নিমেষে। হারিয়ে গেল সেই রঙীন দিনগুলি যা আমরা দুজনে মিলে সযত্নে লালন করতাম নানা গল্পে, নানা কথায়। মনে হয় উত্তরাকে একটা খোলা চিঠি লিখি সেই পুরনো দুপয়সার সরকারি পোষ্টকার্ডে। চোখের জলে কলম ডুবিয়ে লিখি, কেমন আছিস উত্তরা ? ভালো আছিস তো? যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস উত্তরা। তুই নেই একথা ভাবিনা। বরং মনে হয় তুই আছিস, তুই থাকবি, খুব বেশী করেই থাকবি তোর সৃষ্টিতে, তোর লেখায়, তোর ভালোবাসার, তোর স্নেহের মানুষদের মধ্যে।

লেখক : অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক

 

0 Comments

Post Comment